

আমার হেসেল তথা রসুইঘর তথা রান্নাঘর বা কিচেনে ঢুকলে প্রায়ই আমার কলাবাগান ভাইয়ার কথা মনে পড়ে। এই পোস্টটা লেখার সময়ও তার কথা মনে পড়েছে এবং এই কিচেনের ছবি তোলার সময় ও সাজানোর সময়ও আমার তার কথাই মনে পড়েছে এবং কেনো বার বার মনে পড়ে তা ভাইয়াসহ বেশ কয়েকজনই জানে।

শুধু একটা গল্প বলি। তখন লকডাউন আর আমাদের বন্দি জীবনের শুরু। যদিও অনলাইন ক্লাসের চক্করে পড়ে হাবুডুবু খাচ্ছি আমি তবুও তারপরেও আমাদের সকলেরই মন উচাটন। কোথাও যাবার নেই কিচ্ছু করার নেই। আমার অবশ্য তখনও অনেক কিছু করার ছিলো মানে থাকেই তবুও কেমন কেমন অন্যরকম আবহাওয়া তখন ঘরে বাইরে। এমন সময় মানুষের বন্দীজীবনে শুরু হলো অর্থাৎ গৃহী জীবন। এত উৎকন্ঠা, এত অনিশ্চয়তা, ভয় ভীতির মাঝে মানুষের দৈনন্দিন জীবনের কিছু হারিয়ে যাওয়া কাজকর্মের পুণঃ সূচনা হলো। তার প্রভাব দেখা গেলো ফেসবুকে। কেউ গান করছে, কেউ বাগান আর কেউ কেউ মনের আনন্দে জিলাপী রসগোল্লা। আমিও আজীবন সাজুগুজু মানুষ রোজ রোজ টেবিলে খানা পিনা সাজাই আর ছবি তুলি। পেয়ে গেলাম এক ঘরবাড়ি সাজানোর গ্রুপ।

সেখানে ছবি দিতে দিতে আবার তাদের এক কনটেস্টে এক্কেবারে ফার্স্ট হয়ে গেলাম। ব্যাস তারা কল করলো আমার বাসা ফিচার করা হবে। এই রে তখন তো গেছি আর কি। টেবিলে খানা সাজানো এক জিনিস আর সারাবাড়ি ছড়িয়ে ছিটিয়ে পুতুল সাজিয়ে বেড়ানো আরেক জিনিস আর একদম ফিচার করে সারা দেশে ছড়িয়ে দেবে। তখনও জানতাম না কি যে ঝামেলায় পড়লাম। যাই হোক আমতা আমতা করে রাজী হলাম আর তারপর লাইট ক্যামেরা একশন।

যাইহোক তারপর সেসব ছবি নিয়ে পোস্ট দিয়েছিলাম এই ব্লগেই আর কলাবাগান ভাইয়া এসে আমার কিচেন দেখে এক্কেবারে বোল্ড আউট করে দিলো আমার আনন্দের।

এরপর নেটে সার্চ দিলাম একটা অতি সৌন্দয্য কিচেনের আতিপাতি হা হা মানে বৈশিষ্ঠ্যগুলি। আমিও গুগল, ইউটিউব, গৃহসজ্জা তথা কিচেন সজ্জার বই টই পড়ে মনে মনে ভাবি দাঁড়া দেখাচ্ছি মজা। তখন জানলাম একটি কিচেনের বৈশিষ্ঠ আর মাথায় হাত দিয়ে বসলাম।
একটা কিচেন বা রান্নাঘরের ৫টি অবশ্য বৈশিষ্ঠ্য থাকা উচিৎ। যেমন-
Pantry area: আমাদের নানু দাদুর বাড়িতে দেখেছিলাম ভাড়ারঘর। চাল ডাল সব মজুদ থাকতো সেখানে। মায়ের বাড়িতে এসে তা হলো স্টোর রুম আর আমার বাড়িতে এসে প্যান্ট্রী। সেই প্যান্ট্রী এরিয়ার জন্য আমার কিচেনের ভেতরেই রয়েছে তো চাল ডাল হাড়ি কড়াই রাখবার ব্যবস্থা।

Storage area: হাড়ি কড়াই কিমা মেশিন, ওয়াফেল মেকার স্যান্ডুইচ মেকার প্রেশার কুকার স্টোরেজের জন্য কিচেন কেবিনেটের উপরের অংশ।দেখো আমি কি সুন্দর করে একই রকম কালার মিলিয়ে সাজিয়েছি।

Sink area: cleaning area - এই যে আমার সিংক এরিয়া। থালাবাসন ধুয়ে মুছে রাখা আছে।

Preparation area:

সেসব তো আছেই। নীচে সব ছবি দিয়ে দিয়েছি। কফি কর্নার টি কর্নার জ্যুস কর্নার কাটাকাটি বাটাবাটি সহ বেকিং মেকিং সেকিং কর্নার সবই ছবি আছে।
Cooking area: আর চুলা ছাড়া কি চলবে তাই চুলা কর্নারে চুল আছে এবং আশে পাশেই আছে মশলাপাতিও।

আমার রান্নাঘরটিকে আমি ইউ শেপ স্টাইলে ইউজ করছি। পুরো রান্নাঘরের কিচেন কেবিনেট সেগুন কাঁঠের হওয়ায় মেঝে বা ফ্লোরটিও কাঁঠের ডিজাইনে করা। আমাদের কাউন্টারটপে ব্লাক কালারের ঝিলিমিলি মার্বেল বসানো আছে। যেন ময়লা ঝয়লা কম কম বুঝা যায়।
যত এক্সপেরিমেন্ট এর উপর দিয়ে চলে!!
আমার রান্নাঘরের আরও ডিটেইলস সাজুগুজুর গল্প-
এটা আমার জ্যুস কর্নার

সুন্দর করে সাজিয়েছি না? ফলমুল রাখাই আছে কেটে কুটে জ্যুস মেকারে বানিয়ে নাও বা হাত দিয়েই চেপে চুপে বানাও।
এটা আমার চা কফি কর্নার

চা বানিয়ে নাও। গরম পানিটার স্যুইচ দিলেই হয়ে যাবে।

মশলা চা, টি ব্যাগ সবই আছে।

নিজে নিজে বানাও..... কারো হেল্প দরকারই নেই একদম।

লেমন টি এর জন্য লেমন রাখা আছে। মধু ঢালবার জন্য ঐ যে জাগের মত ছোট্ট পটটা।

এটা আমার সব্জী কাঁটাকাটি এরিয়া

এখানে অবশ্য বেকিং মেকিং পিজ্জা, রুটি লুচিও বানাই আমি। চপিং বোর্ড সরিয়ে হয়ে যায় টপিং বোর্ড।
রান্নার চুলা কর্নার

মশলাপাতিও আছে কিন্তু আশে পাশেই

আরও একটু বড় ছবি

সিংক এরিয়া

শুধু রাঁধাবাড়া করলেই হবে? খেলেই হবে? ধুতে হবে না!!!
আরে ৫ বৈশিষ্ঠের সকল বৈশিষ্ঠ্য তো আমার কিচেনে বিদ্যমান তবুও কলাবাগান ভাইয়া কেনো বললো, আমার কিচেন নাকি বোরিং?
তখন আবার মনে মনে ভাবতে বসলাম। ওহ ভাইয়া বলেছিলো একটা কিচেন আইল্যান্ড করতে। কিন্তু কেনো? কেনো আমাকে কিচেন আইল্যান্ড করতে হবে? লেগে গেলাম জানতে কেনো মানুষ কিচেন আইল্যান্ড করে। জানলাম-
কিচেন আইল্যান্ড রান্নাঘরে প্রয়োজনীয় সবকিছু একত্রিত করার একটি দুর্দান্ত উপায়। যেহেতু এটি সাধারণত একটি বৃহত্তর ইউনিট, এটি স্টোরেজ এবং প্রিপার স্পেস, পাশাপাশি একটি সমন্বিত ডাইনিং এরিয়া উভয়ই অফার করতে পারে। টেবিলটপের নীচে তাক দিয়ে, সঞ্চয়স্থানের বেশিরভাগ অংশ লুকিয়ে রাখা যায়। যেমন প্লেট এবং কাটলারি থেকে পাত্র এবং প্যান পর্যন্ত। কিচেন আইল্যান্ড বাড়ির লোকজনের মিটিং পয়েন্ট এবং একসাথে রান্না করার নিখুঁত উপায়। এই আইল্যান্ডের পাশে চেয়ার জুড়ে দিয়ে খানাপিনার ব্যবস্থাও করা যায়। কিন্তু আমার তো সেসব দরকার নেই। তবে কেনো করবো? কাজেই আমার কিচেনই সঠিক এবং সেরা আমার জন্য।

ভাইয়া বলেছিলো কিচেন নুক বসিয়ে নিতে। সেই নুক নো ওয়ে।কোনোই দক্কাল নেই আমার। তবে হ্যাঁ সার্চিং করিতে গিয়া দেখিলাম কিচেন আইল্যান্ডের পরিবর্তে ট্রলীও ইউজ করা যেতে পারে। এই যে করেছি!

ভাইয়া একটা ছবি দিয়েছিলো আর লিখেছিলো-
কলাবাগান১ বলেছেন: আপনার কাছে রান্নাঘরের সেই পুরানো আমলের কনসেপ্টেই পড়ে আছেন মনে হচ্ছে....। যেখানে মসলা বাটা হয়, মাছ মাংশ কাটাকুটি করে আশ রক্তে মাখামাখি অবস্হা, ধুয়া/রান্না মসলার গন্ধ, মাছের কাটা/হাড্ডি, তরকারির গার্বেজ যে ভরপুর রান্নাঘর এর কনসেপ্ট...
আর আমি যে কিচেনের কথা বলছি, সে কিচেনে গ্রানাইট পাথরের কাউন্টার টপ, কোন মাছ মাংশ কাটাকাটি নাই (সবই প্যাকেট করা), রান্নার ধুয়া রুমে ঢুকারই চান্স পায় না, তার আগেই চুলার উপর থেকেই বাহিরে বের করে দেয়, ওয়াশিং মেশিন সব থালা বাসন ধুয়ে দিচ্ছে...

ওহ এমন কিচেন তো আমার বাসার আশেপাশের মানুষেরই আছে। আমার সেটা ভালো লাগে না। কিচেন থাকবি কিচেনের মত এত ড্রইংরুমের মধ্যে নাক গলিয়ে ঢুকে পড়া কেনো? যাইহোক এমন কিচেন দেখলেও সেটা নিয়ে নাক গলাইনি আমি মানে মানুষ কেনো সেটা করে কি কারণ এত কিছু ভাবিনি আমি। কিন্তু এরপরই বুঝলাম। এই কিচেন কিচেন নয় আরও কিচেন আছে। এই কিচেনরে নিয়া গেলো সেই কিচেনের কাছে। মানে আমাদের শ্বাশত কিচেনই কিচেন। তবে সৌন্দর্য্য ধরে রাখতে ঐ কিচেনকে লুকিয়ে মানুষ ড্রইংরুম কিচেন বানিয়েছে। মানে ঐ কিচেন হলো ওয়েট কিচেন আর এই কিচেন হলো ড্রাই কিচেন।

ওয়েট কিচেন- এমন নামকরণ করা হয়েছে, কারণ এখানেই বেশিরভাগ রান্না এবং 'অগোছালো' প্রস্তুতিমূলক কাজ হবে।মাংস এবং মাছের মতো আমিষ জাতীয় আইটেমগুলি কাটাকুটা এবং পরিষ্কার করা, সেইসাথে গভীরভাবে ভাজা বা রান্না করা আইটেমগুলির তীব্র গন্ধ সাধারণত ভেজা রান্নাঘরে হবে।সিঙ্ক এবং ডিশ ওয়াশার, সেইসাথে রান্নার যন্ত্রপাতি যেমন চুলা এবং ওভেন, এই এলাকায় স্থাপন করা হবে।এই ওয়েট কিচেন পরিষ্কার এবং রক্ষণাবেক্ষণের জন্য ড্রাই কিচেনের চেয়ে বেশি পরিশ্রমের প্রয়োজন হয়।

ড্রাই কিচেন- হালকা খাবারের প্রস্তুতির জন্য ব্যবহৃত হয়।এখানে 'শুষ্ক' এবং সহজ কাজগুলির জন্য ব্যবহার করা হয়, যেমন টোস্ট তৈরি করা, শাকসবজি এবং ফল কাটা, বা মাইক্রোওয়েভ করা ইত্যাদি।এখানেই সাধারণত ফ্রিজ, কফি মেকার এবং মাইক্রোওয়েভের মতো যন্ত্রপাতি রাখা হয়।
এখন কথা হলো নাইবা থাকুক আমার ড্রাই কিচেন আর ওয়েট কিচেন আলাদা আলাদা। আমার এটা অল রাউন্ডার কিচেন। আই মিন অল রাউন্ডার আমার কিচেন ।
আমার কিচেন ভিডিও

ড্রয়ারের ভেতরে চামচ..




এই ছবিগুলো কলাবাগান ভাইয়ার জন্য। এই পোস্টটাও কলাবাগান ভাইয়ার জন্য। ভাইয়া অনেক জানা হলো এবং জানাতে পারলাম তোমারই কল্যানে আই মিন তোমার সেই পোস্টের সকল কমেন্টের কল্যানে যে দেশে দেশে এবং বিদেশ ও বাংলাদেশে কিচেনের নানা রঙ নানা ঢঙ। আমাদের এই বাংলায় আজীবন হেসেলে বা রান্নাঘরে কাটিয়ে দেওয়া অনেক গৃহবধুরাই জানে না যে হেসেলে তাদের জীবন কেটে যায় সেই হেসেলের ইতিকথা...... জানবার সময়ও নেই হয়ত.... আসল কথা বাংলার মেয়েরা যে যার মত ভালোবেসে তাদের হেসেলটাকে আগলে রাখে সেটাই সেরা.......
অনেক অনেক শুভকামনা আর ভালোবাসা যারা যারা এতক্ষন এই লেখা পড়লো আর আমার কিচেনঘরের ছবি দেখলো তাদেরকে ....
সর্বশেষ এডিট : ১৭ ই এপ্রিল, ২০২৩ সন্ধ্যা ৭:৪৪

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।



