ভোরের আজান হচ্ছে—
দ্রুতই ব্যাগ গুছিয়ে নিচ্ছি হাতে কফি নিয়েই , একটু পরেই বেরিয়ে পড়তে হবে । যেতে হবে অনেকটা পথ একাই । ফোনটা বেজে উঠল প্রায় অপ্রত্যাশিত ভাবে – শুধু জানতে চাইল আমি কোথায় এবং কখন এসে পৌঁছুবো । জানালাম বিকেল নাগাদ পৌঁছে যাবার কথা । কেন এবং কি জন্য ফোন সে কথা উত্তরে তেমন কিছুই জানাল না ।
বাসে উঠে বসলাম.....
বছর দেড়েক আগের কথা -আমার বাসা থেকে একটু দূরে পুর্ব পরিচিত এক বড় ভাইয়ের সাথে দেখা (সম্পর্ক তেমন জোরাল না) । তার বাসায় বসলাম ও অন্যান্য কথার পরে তার অসুস্থ্য শিশুটির কথা শুনলাম - দেখলাম । সেই থেকে শুরু এরপর অনেক দিনের ব্যবধানে হলেও - কখনও মাস দু'য়েক পর পর, কখনও বা আরো বেশি দিনের ব্যবধানে শিশুটিকে দেখতে যেতাম । এভাবেই চলছিল - মাঝখানে আবার কিছু দিন খোঁজও নেয়া হয়নি । পরে জেনেছিলাম বিদেশেও চিকিৎসা করিয়েছে ,কিন্তু তেমন সুবিধে হয়নি । একবার বেশি অসুস্থ্য হওয়ায় হাসপাতালে ও নিয়েছিল ,আমি দেখেও এসেছিলাম । অসুখের নূতন উপসর্গ যোগ হয়েছে গায়ের জামা কাপড় খুলে ফেলা বা ছিড়ে ফেলা। সেও এক গুরুতর সমস্যা। চিরটাকাল তো সে নেহাৎ শিশু রবে না। তার বয়সের সাথে তার বাবা'র কপালের ভাঁজ বাড়তেই থাকবে... (আমাদের সমাজ অনেক ক্ষেত্রে মানসিক অসুখ মেনে নিলেও, অসুখের উপসর্গ'গুলোকে মেনে নিতে পারে না। রোগ'টার কথা শুনলে আহা-উহু করে, অথচ রোগী'টাকে দেখলে তখন ভিন্ন চোখে তাকায়) তো যাই হোক, অবাক ব্যাপার হল এগার বার বছরের প্রতিবন্ধী শিশুটি আমি গেলে মোটামুটি স্বাভাবিক দেখতাম যদিও কথা বলতে পারত খুব কম । আমার কাছে খেলনা নিয়ে আসত -একটুখানি খেলত আমার সাথে , অবশ্য আমার সময় অনেক কম ,তাই সময় দিতেও পারিনি। নাগরিক মানুষকে সময় ক্ষমা করে না , ওই অবুঝ শিশু'টা ক্ষমা করত কি ? জানি না। কখনও জানতে চাওয়াও হয়নি তা !
দুপুর নাগাদ আবারও ফোনে জানতে চাইল কখন এসে পৌঁছাব, একটু অবাক হলাম দ্বিতীয় বার ফোন করার জন্য , তবে কিছু বুঝতে না দিয়ে একই কথা বললাম।ওর বাবা একবার আমাকে বলেছিল শিশুটি আমাকে অনেক পছন্দ করে ,যদিও আমি তেমন করে আসলে সময় দিতে পারিনি বা দেইনি ।বিকেল নাগাদ বাড়ীতে পৌঁছে ফোন দিলাম দু'বার , কেউ ধরল না ফোন , একটু অবাক হয়ে তাদের বাসার দিকে রওয়ানা দিলাম । মাস খানেক আগে শেষবার এই প্রতিবন্ধী মেয়ে শিশুটিকে দেখতে গিয়েছিলাম । একটু বেশি সময় ছিলাম – সারাক্ষণ কাছাকাছিই ছিল ; যদিও কেমন যেন আমার কাছে কিছুটা অসুস্থও মনে হচ্ছিল তারপরও খেলনা নিয়ে আমার কাছে বসে খেলছিল। ওর বাবার কাছ থেকে চিকিৎসার সমস্ত কাগজপত্র নিলাম আমার পরিচিত ডাক্তারকে দেখাব বলে । যদিও দেখাতে পারিনি তখন ঐ ডাক্তার দেশের বাইরে ছিল বলে । তবে এবারে সব কাগজ পত্র ডাক্তারের কাছে রেখে এসেছি । আর ওই শেষ বারে অদ্ভুত একটি ঘটনা ঘটেছিল। আমি চলে আসার সময় আমার হাত ধরে রেখেছিল - কিছুতেই ছাড়তে চাইছিল না। ওর বাবা বুঝিয়ে রাজী করিয়ে হাত ছাড়িয়ে নিয়েছিল।
মন খারাপ'টাও যদি ওভাবে বুঝিয়ে ছাড়িয়ে নেয়া যেত...
ওদের বাসায় পৌছে খবর শুনে দৌড়ে গেলাম। আমার বিশ্বাস হচ্ছিল না, কিছুতেই বিশ্বাস হচ্ছিল না ! সেই শেষদিনের মত ছোট দু'টা হাতের তালু যেন আমার আঙুল টেনে ধরে আমাকে উড়িয়ে নিয়ে যাচ্ছিল কোনদিকে...
তখন সব শেষ করে সবাই গোরস্থান থেকে বের হচ্ছে । ওর বাবার অঝোর কান্নার মধ্যে আমাকে যা বলল তা হল একেবারে শেষ মুহুর্ত পর্যন্ত আমাকেই খুঁজছিল কন্যাটি।
থতমত আমি বিদ্যুৎস্পৃষ্টের মত দাঁড়িয়ে রইলাম।
হৃৎপিণ্ডটা ছিঁড়ে বেড়িয়ে আসতে চাইছিল–বন্ধ হয়ে গেলে এর থেকে কম কষ্ট হত।
অকঃ কৃতজ্ঞতা একজনের কাছে লেখাটির জন্য।
সর্বশেষ এডিট : ০১ লা অক্টোবর, ২০১২ রাত ৮:৩৫