অন্তর্মুখী মানুষদের নিয়ে প্রচলিত কিছু ধারণা রয়েছে যার কারণে সিংহভাগ মানুষ মনে করে থাকে অন্তর্মুখী হওয়া একটি নেতিবাচক ব্যাপার। বেশিরভাগ মানুষ ভেবে থাকে অন্তর্মুখীরা মানুষেরা খাপ খাওয়াতে পারেনা ,তার কারণ হলো অন্তর্মুখী মানুষদেরকে বহির্মুখী ( Extrovert ) মানুষদের সাথে তুলনা করার প্রবণতা। কিন্ত আদতে অন্তর্মুখী এবং বহির্মুখী মানুষের মস্তিষ্কের গঠন সম্পূর্ন আলাদা, এমনকি তাদের ডোপামিন (Dopamine) নিঃসরন প্রক্রিয়াও ভিন্নভাবে হয়ে থাকে।অর্থাৎ আপনি অন্তর্মুখী নাকি বহির্মুখী তা জন্ম থেকেই নির্ধারিত।
আমার ব্যাক্তিগত জীবনে আমি দেখেছি অন্তর্মুখী মানুষেরা খুবই দৃঢ় ব্যাক্তিত্বের হয়ে থাকে এবং কাছের মানুষদের প্রতি বহির্মুখী মানুষদের তুলনায় বেশি যত্নবান। অন্তর্মুখী মানুষদের নিয়ে প্রচলিত কিছু ধারনা বা ভুল ধারণা গুলো হলোঃ
১- অন্তর্মুখী মানুষেরা কথা বলতে পছন্দ করে না।
এটি সত্য নয় , অন্তর্মুখী মানুষেরা কথা বলেনা যতক্ষন পর্যন্ত না তাদের বলার কিছু আছে। শুধু বলার জন্য বলা কথাবার্তা তাদের আগ্রহের সঞ্চার যোগাতে পারে না। একজন অন্তর্মুখী মানুষের সাথে তার পছন্দের বিষয়ে কথা বলেই দেখুন, এরপর তাকে থামাতে আপনার বেশ বেগ পেতে হবে।
২- অন্তর্মুখীরা লাজুক ।
আদতে লাজুকতার সাথে অন্তর্মুখীতার কোন সম্পর্ক ই নেই। অন্তর্মুখী মানেই এটা জরুরী নয় যে তারা মানুষের সাথে মিশতে ভয় পায়। তাদের মেশার জন্য দরকার শুধু একটা কারণ। তাদের মধ্যে কুশলাদি বিনিময়ের এত বালাই নেই, আপনার কোন অন্তর্মুখী মানুষের সাথে কথা বলতে ইচ্ছা হয় , শুরু করে দিন, এত বেশি আদব কেতা নিয়ে চিন্তা করার কোণ প্রয়োজন ই নেই।
৩- অন্তর্মুখী মানুষেরা অভদ্র।
অন্তর্মুখীরা প্রায়ই কোন কারণ খুজে পায়না নিয়ম রক্ষার্তে লোক দেখানো সামাজিকতায় । তারা চায় সবাই আসল এবং সৎ থাকবে, কোন মেকি থাকবে না। দুর্ভাগ্যবশত বেশিরভাগ সমাজে এমনটা অগ্রহনযোগ্য , যার কারণে অন্তর্মুখীরা সর্বদা চাপ অনুভব করে যা তাদের জন্য ক্লান্তিকর ও বটে।
৪- অন্তর্মুখীরা মানুষজন পছন্দ করে না।
মজার ব্যাপার হলো, অন্তর্মুখী মানুষেরা তাদের কাছের মানুষ অল্প হলেও , সেই সম্পর্কগুলোর গভীর কদর এবং শ্রদ্ধা করে থাকে। তাদের কাছের মানুষদের সংখ্যা তারা এক হাতে গুনে শেষ করতে পারবে। যদি আপনি যথেষ্ট সৌভাগ্যবান হয়ে থাকেন এবং একজন অন্তর্মুখী মানুষ আপনাকে বন্ধু ভাবে, তবে সম্ভাবনা হলো আপনার সারাজীবনের জন্য একটি অনুগত সহচর রয়েছে। একবার আপনি তাদের কাছে একজন মানুষ হিসেবে শ্রদ্ধার জায়গা আদায় করে নিতে পারলেই আপনি আপনার সবকিছুতে তাকে পাশে পাচ্ছেন।
৫- অন্তর্মুখীরা জনবহুল জায়গায় যেতে চায়না।
অর্থহীন কথা। তারা জনবহুল জায়গায় যেতে চায়না এমনটা একেবারেই সঠিক নয়, বলা যেতে পারে তারা দীর্ঘক্ষন থাকতে চায়না। তারা পাব্লিক এক্টিভিটি তে জড়িত জটিল বিষয়গুলোও এড়িয়ে যেতে চায়। তারা তথ্য খুবই দ্রুত ধারন করতে পারে এবং তা থেকে অভিজ্ঞতার সঞ্চার করতে পারে, যার ফলে তাদের কোন কিছু বুঝতে দীর্ঘসময়ের প্রয়োজন হয় না। অল্প সময়েই তারা বাসায় যাওয়ার জন্যে প্রস্তুত এবং সমস্ত তথ্য বিশ্লেষন করার জন্য নিজেকে রিচার্জ করে নিতে তৈরি থাকে। রিচার্জ করার ব্যাপারটা খুবই গুরুত্বপূর্ন অন্তর্মুখী মানুষদের জন্য।
৬- অন্তর্মুখীরা সবসময় একা থাকতে চায়।
অন্তর্মুখীরা নিজেদের চিন্তা ভাবনা নিয়ে সম্পূর্ন স্বাচ্ছন্দে থাকতে পারে। তারা প্রচুর চিন্তা করে, তারা স্বপ্ন দেখে। তাদের সমস্যার সমাধা্ন নিয়ে কাজ করতে ভালো লাগে এবং ধাধার উত্তর মেলানোতে তাদের আনন্দ। কিন্ত সত্যিকার অর্থেই তারা একা হয়ে পড়ে যখন তাদের কেউ থাকে না নিজের অনুধাবন বা আবিস্কার নিয়ে কথা বলার মতো। তারা সত্যিকারের সচেতন সংগ পাওয়ার জন্য আকুতি করে, একটি সময়ে শুধু একটি মানুষের কাছ হতে।
৭- অন্তর্মুখীরা অদ্ভূত।
অন্তর্মুখীরা প্রায়ই ব্যাক্তিত্ববাদী হয়ে থাকে। তারা গড্ডালিকা প্রবাহে গা ভাসায় না। এর চেয়ে তারা নিজেদের আদর্শ নিয়ে থাকার জন্য মূল্যায়িত হওয়া পছন্দ করে। তারা নিজেদের জন্য এবং নিজেদের নিয়ে ভাবে এবং নিজে নিজে ভাবতে পারে। যুক্তি এবং বিশ্লেষন ক্ষমতা তাদের তুলনামূলক বেশি হওয়াতে তারা বেশিরভাগ সময়ই প্রচলিত আদর্শ গুলোকে চ্যালেঞ্জ করে থাকে এবং মেনে নিতে পারেনা। তাদের জীবনের বেশিরভাগ সিদ্ধান্তের ক্ষেত্রে তারা লোকে কি ভাবে বা বলে কিংবা করে তা বিবেচনা করে না।
৮- অন্তর্মুখীরা নির্লিপ্ত
অন্তর্মুখী মানুষেরা প্রধানত তাদের নিজেদের চিন্তা, মূল্যবোধ এবং আদর্শে প্রতি প্রচুর মনোযোগী হয়ে থাকে। বিষয়টি এমন নয় যে তাদের চারপাশে কি হচ্ছে তাতে তাদের মনোযোগ দেয়ার সামর্থ্য নেই। আসলে তাদের নিজেদের চিন্তার জগৎ তাদের কাছে আরও বেশি উত্তেজনাপূর্ন এবং ফলপ্রসূ ।
৯- অন্তর্মুখী মানুষেরা জানেনা কিভাবে আনন্দ বা মজা করতে হয়।
অন্তর্মুখী মানুষেরা সাধারণত বাসায় কিংবা প্রকৃতির মাঝে নিজেদের শান্তি খুজে নেয়, ব্যাস্ত জনবহুল জায়গা তাদের স্বাচ্ছন্দ্যের জায়গা নয়। তারা সাধারণত হৈ হুল্লোড় করে বেড়ানো প্রজাতি নয়, যদি আশেপাশে প্রচুর হৈ চৈ থাকে, তারা নিস্তেজ অনুভব করতে থাকে। তাদের মস্তিস্কের ডোপামিন নিউরোট্রান্সমিটার খুবই স্পর্শকাতর। অন্তর্মুখী এবং বহির্মুখী মানুষের মস্তিস্কের প্রভাবশালী স্নায়বিক পথ একেবারেই ভিন্ন।
১০- অন্তর্মুখীরা নিজেদের ঠিক করতে পারে এবং বহির্মুখী হয়ে যেতে পারে চাইলে।
অন্তর্মুখী নিজেদের ঠিক করতে পারেনা, আসলে ঠিক করার কিছু নেইও। তাদের স্বাভাবিক মেজাজ এবং মানব জাতির জন্য রাখা অবদান এর জন্য সম্মানটা তাদের প্রাপ্য। এমনকি, একটি গবেষনায় দেখা গিয়েছে ( Silverman, 1986 ) অন্তর্মুখী মানুষের শতকরা হার আই কিউ এর সাথে সাথে বৃদ্ধি পায়।
সর্বশেষ এডিট : ০১ লা নভেম্বর, ২০১৯ ভোর ৬:৪৩