শিক্ষকতা পেশাহিসাবে সম্মানের, মহত্বের ও মর্যাদার । বিশ্বের অন্যান্য দেশের জন্য এই কথাগুলো সত্য হলেও বাংলাদেশের জন্য নয়। বাংলাদেশে এই কথাগুলো শুধুই লোক মুখে প্রচলিত। বাস্তবে শিক্ষকরা সর্বক্ষেত্রে অবহেলিত, বঞ্চিত ও সর্বংসহা।
মানুষের জীবনে টাকা অনেক গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। তাই প্রথমে আসা যাক সেই টাকা বা বেতনের ক্ষেত্রে। বাংলাদেশে সবচেয়ে কম বেতন শিক্ষকতা পেশায়। গার্মেন্টস শ্রমিকের সর্ব নিম্ন বেতন পাঁচ হাজার টাকা। আর দেশের কিন্ডারগার্ডেন গুলোতে এখনো অনেক শিক্ষকের বেতন মাসে পাঁচশত টাকা। বেসরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের মাসিক বাড়ি ভাড়া একশত টাকা, যা বর্তমানে বৃদ্ধি করে হয়েছে পাঁচশত টাকা। এই টাকায় দেশের কোথাও বাড়ি ভাড়া পাওয়া যায় বলে আমার জানানেই। শিক্ষকদের বেতনের একটি তুলনা মূলক বাস্তব চিত্র তুলে ধরতে চাই। আমার আপন ছোট ভাই পঞ্চম ও অষ্টম শ্রেণিতে টেলেন্টপুল বৃত্তি পেয়েছে। অষ্টম শ্রেণি বৃত্তি পরীক্ষায় নারায়ণগঞ্জ জেলায় প্রথম হয়েছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পদার্থ বিজ্ঞান বিষয়ে প্রথম শ্রেণিতে সম্মান ও প্রথম শ্রেণিতে মাস্টার্স শেষ করেছে। বর্তমানে দেশের অন্যতম শ্রেষ্ঠ বিদ্যাপিঠ মতিঝিল আইডিয়াল স্কুল এন্ড কলেজের ইংলিশ ভার্সনে এডহক ভিত্তিতে শিক্ষকতা করে মাসে ছয় হাজার টাকা বেতন পায়। আর আমার এক বোন মোহাম্মদ পুরে যে বিল্ডিংয়ে থাকে সেই বিল্ডিংয়ের দারোয়ানের বেতন মাসে আট হাজার টাকা।
প্রাথমিক ও মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষকতা এমন পেশা যেখানে কোন পদোন্নতির ব্যবস্থা নেই। যেই পদে চাকরিতে ঢুকবেন সেই পদে থেকে অবসরে যাবেন বা মৃত্যু বরণ করবেন। সরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালযগুলোতে সামান্য সুযোগ থাকলেও বছরের পর বছর পদ খালি থাকে কিন্তু পদোন্নতি দিয়ে শূণ্য পদ পূরণ করা হয়না। আমি ও আমার বন্ধু তোফাজ্জল ঢাকা বিশ্ব বিদ্যালয় থেকে পাস করে চাকরিতে যোগ দেই। তোফাজ্জল ৩৪০০/ টাকা বেতন স্কেলে সোনালী ব্যাংকে যোগদান করে। বর্তমানে প্রমোশন পেয়ে সিনিয়র প্রিন্সিপাল অফিসার হয়েছেন। বর্তমানে সে ৪৩,০০০/ টাকা স্কেলে বেতন পায়। আর আমি একই সময়ে শিক্ষকতাকে আদর্শ পেশা হিসাবে নিয়ে ৩৪০০/ টাকা স্কেলে সরকারি মাধ্যমিক স্কুলে যোগদান করি। এখন আমি ২৬,৭৬০/ টাকা স্কেলে বেতন পাই। এই ১৫ বছরে আমাদের শুধু স্কেলের ব্যবধান হয়েছে দেড়গুণ। সে তার ব্যাংক থেকে মাত্র ৬% সুদে পঞ্চাশ লাখ টাকা ঋণ পেয়েছে। যা তার বেতন থেকে কেটে নেওয়া হয়। অথচ ছাত্র জীবনের কোন পর্যায়েই আমার চেয়ে তার লেখাপড়ার ফলাফল ভাল নয়।
শিক্ষকদের চেয়ে ডাক্তারদের বেতন বেশি। সরকারি হাসপাতালের ডাক্তারগন সরকারি চাকরির বাইরে একেকজন কয়েকটি বেসরকারি হাসপাতাল বা ক্লিনিকের সাথে জড়িত থাকেন। বিভিন্ন চেম্বারে রোগী দেখে। কিন্তু তাতে কোন বিধি নিষেধ নাই। তাদের বিরুদ্ধে মিডিয়ায় সংবাদ প্রচার হয়না। কিন্তু একজন শিক্ষক শিক্ষকতার বাইরে অবসর সময়ে প্রইভেট পড়ালে বা টিউশনি করলে তার বিরুদ্ধে মিডিয়ায় প্রতিবেদন হয়। সরকার আইন করে শিক্ষকদের জন্য প্রাইভেট ও টিউশনি বন্ধ করে দিয়েছে। ইসলাম ধর্মে চুরির জন্য হাত কেটে দেওয়ার বিধান আছে। কিন্তু শর্ত হলো যে এই আইনে তখনই হাত কাটা যাবে যখন রাষ্ট্রে এমন অবস্থা থাকবে যে কেউ পেটের দায়ে চুরি করবেনা। পেটের দায়ে চুরি করলে হাত কাটা নিষিদ্ধ। আমাদের দেশের সরকার শিক্ষকদের বেতন বৃদ্ধি না করে পেটের দায়ে টিউশনি করা শিক্ষকদের টিউশনি বন্ধ করে দিয়েছে। বর্তমান সরকারের নির্বাচনী ইসতেহারে শিক্ষকদের জন্য স্বতন্ত্র্য বেতন স্কেলের কথা বলা হয়েছিল। কিন্তু বাস্তবায়ন হয়নি। সরকারের নির্বাচনী ইসতেহারে না থাকলেও বেতন বেড়েছে পুলিশের, পিএসসি সদস্যদের। বেড়েছে মন্ত্রী-এমপিদের বিদেশ ভ্রমন ভাতা।১৯৫৪ সালের যুক্তফ্রন্টের ২১ দফায় শিক্ষকদের জন্য স্বতন্ত্র বেতন স্কেলের কথা ছিল। সেই থেকে প্রত্যেক রাজনৈতিক দল নির্বাচনের পূর্বে ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য নির্বাচনী ইসতেহারে শিক্ষকদের জন্য স্বতন্ত্র্য বেতন স্কেলের কথা বলে। কিন্তু ক্ষমতায় গেলে কেউ কথা রাখেনা। সব কিছু নিরবে সয়ে চলছে শিক্ষক সমাজ। কারণ জাতির মেরুদন্ড গড়তে গড়তে নিজেদের মেরুদন্ড যে ক্ষয় করে ফেলেছে তারা।
কোন চাকুরীজীবিকেই অফিস শেষে বাসায় গিয়ে অফিসের কাজ করতে হয়না। কিন্তু শিক্ষকদের বাসায় গিয়েও স্কুলের কাজ করতে হয়। বাসায় গিয়ে পরীক্ষার খাতা দেখতে হয়, পরীক্ষার ফলাফল তৈরী করতে হয়, প্রশ্নপত্র তৈরী করতে হয়। একটি সৃজনশীল রচনা মূলক প্রশ্ন ও একটি সৃজনশীল নৈর্ব্যক্তিক প্রশ্ন তৈরী করতে প্রতিদিন রাত আটটায় বসে বারটায় শেষ করলে তিনদিন লাগবে।
গার্মেন্টস কর্মীসহ অন্য যে কোন চাকুরীজীবি ছুটির দিনে অফিস করলে ওভার টাইম ভাতা পায়। কিন্তু শিক্ষকতা পেশায় এ জন্য কোন ওভার টাইম ভাতার ব্যবস্থা নেই। ২১ ফেব্রুয়ারি,২৬মার্চ, ইত্যাদি বছরে প্রায় ১০টি জাতীয় ছুটির দিনে শিক্ষকদের বিদ্যালয়ে উপস্থিত হতে হয়। অথচ এর জন্য কোন ভাতা নেই।
বাংলাদেশের শিক্ষক সমাজের মাঝে সৈয়দ মুজতবা আলীর পাদটীকা গল্পের নায়ক পন্ডিত মশাইয়ের প্রতিচ্ছবি দেখা যায়। গল্পের পন্ডিত মশাইয়ের মাসিক বেতন ছিল ২৫ (পঁচিশ) টাকা। তার সংসারের সদস্য নয় জন। পন্ডিত মশাইয়ের বিদ্যালয় পরিদর্শনে আগত ইংরেজ লাট সাহেবের সাথে এনছিলেন একটি তিন ঠ্যাংগা কুকুর। যার পিছনে মাসে ব্যয় হয় ৭৫ (পঁচাত্তুর) টাকা। পন্ডিত মশাই তার প্রিয় ছাত্র সৈয়দ মুজতবা আলীকে প্রশ্ন করে বলেছিলেন- “ তবে বল তো দেখি গণিতে তোর কত বিদ্যা ? আমার পরিবার লাট সাহেবের তিন ঠ্যাংগা কুকুরের কয় ঠ্যাংগের সমান?”
সর্বশেষ এডিট : ২২ শে মার্চ, ২০১৬ দুপুর ১:৩৬