রাত ৮.২০, ক্লাস চলবে আরো ঘন্টা দুইয়েক। পিএইচডি করা মানুষ একটু পাগালাটে গোছের হয় এটা এখানে না আসলে বুঝতাম না। সবারই কিছুনা কিছু পাগলামী আছে। ছবির ব্যক্তির নাম ড. সিয়া সেন। জাভার টিচার। এই মাইনাস তাপমাত্রার ভেতর রাতে ক্লাস দিয়ে রেখেছেন। উনাকে ক্লাস বাদে সব সময় দৌড়াতে দেখা যায়। ঝন্টু বাবুর মত তালে তালে দৌড়াতে দৌড়াতে উনি ক্লাসে আসেন। উনি জুতার ফিতা জোড়া খুলে বাসায় রেখে আসেন কারণ জুতা খুলতে এবং পড়তে তার সময় নষ্ট হয়। বাচ্চাদের ফিডারের মত ফ্লাক্স ইউজ করেন। পকেটে মাঝে মাঝে টয়লেট টিস্যুর পুরো রোল পাওয়া যায়। ইন্টারেস্টিং ব্যাপার হচ্ছে উনি প্রায় ৪০টা কোর্সে একই পরিমাণ পারদর্শী।
ভার্সিটিতে এসে প্রথম দিকে একজন গণিত টিচারের দেখা পাই উনার নাম ড. ড্যাং ।গণিতে উনার মর তুখোর মেধার মানুষ আমি দেখি নাই। যথেষ্ট স্মার্ট এবং উপস্থিত বুদ্ধির অধিকারী তিনি । উনি গ্রীষ্মকালে মাঝে মাঝে হাফ প্যান্ট আর টিশার্ট পরে ক্লাসে চলে আসতেন । কখনো মন বেশি থাকলে ভার্সিটিতে থাকাকালীন সময়ে কতগুলো প্রেম করেছেন আর কিভাবে বিয়ে করেছেন সেগুলোও তার আলোচনায় উঠে আসত।
সোশ্যাল সাইন্স পড়াতেন একজন ম্যাম । আমরা চেরী লাওশী বলেই ডাকতাম। চীনা ভাষায় লাওশি অর্থ হচ্ছে শিক্ষক। পড়াশুনা নিয়ে যথেষ্ট কড়া একজন শিক্ষিকা। তিনি কথায় কথায় একবার বলেছিলেন , কারণ দর্শান ব্যাতীত ক্লাসে ৩০ মিনিট দেরি করে উপস্থিত হবার জন্য বিশ্ববিদ্যালয় তাকে একবার বাংলাদেশী টাকায় ৪০ হাজার টাকা জরিমানা করেছিলো। আমার বাংলাদেশে হয়ত এমন ঘটনা অহরহ। যাই হোক, উনাকে একবার তার পোষা কুকুর কামড় দিয়েছিলো । প্রায় বেশ কয়েকটি ক্লাস নিতে পারেন নাই। সুস্থ হয়ে ক্লাসে এসে বললেন, " অপরাধ বোধহয় আমারই ছিলো, আমি ওকে কোন কারণে রাগিয়ে দিয়েছিলাম। তাই কামড়ে দিয়েছে। " বাংলাদেশ হলে হয়ত সেইদিনই এই কুকুরকে আমরা ঘর থেকে তাড়িয়ে দিতাম । কিছুদিন পরে উনার কুকুরটি হারিয়ে যায় । পরের দিন ভারাক্রান্ত মনে ক্লাস করিয়েছিলেন আর কুকুরের জন্য আফসোস করেছিলেন। এখনো তিনি মাঝে মাঝে রাস্তায় তার হারানো কুকুর খুজে বেড়ান। চীনা সোশ্যাল মিডিয়ায় পোস্ট করে জানান দেন।
এতোগুলো কথা বলার কারণ হচ্ছে, আমার দেশে অর্থাৎ বাংলাদেশে শিক্ষার্থী- শিক্ষকদের যে দূরত্ব এখানে তার ছিটে ফোটাও নেই। প্রিয় শিক্ষার্থীদের মাঝে মাঝে উনারা বাসায় দাওয়াত করেন কিংবা পিকনিকে নিয়ে যান। চীনা শিক্ষার্থীরাও কম যায়না। সম্মান প্রদর্শনে বিন্দু মাত্র ছাড় নেই তাদের।
ইন্টারন্যাশনাল শিক্ষার্থীদের অধিকাংশই স্কলারশিপ নিয়ে এখানে এসেছে । আমিও তাদের মতই একজন। যার যার দেশের মাধাবী শিক্ষার্থী সবাই।হরেক জাতি হরেক সংস্কৃতি। মাঝে মাঝে টুকটাক সমস্যা হয় বৈকী কিন্তু দিন শেষে সবাই একই মেলবন্ধনে আবন্ধ থাকে । পড়াশুনো নিয়ে কারো কোন ছাড় নেই । চীনাদের সাথে তাল মিলিয়ে পড়ার চেষ্টা করে সবাই। চীনাদের সাথে পেরে ওঠা খুবই মুশকিল । চীনা শিক্ষার্থীরা সময়ের কড়া অনুশাসন মেনে চলে। ভোর ৫টার আগে ঘুম থেকে উঠে , অন্য দিকে ঠিক রাত ১২টার মধ্যে ঘুমিয়ে পরে। নিতান্তই কাজ কিংরা এড়ে স্বভাবের না হলে রাত ১২টার পর কোন চীনা হোস্টেলের কোন রুমে লাইট জ্বালানো থাকেনা। সকাল ৮টা থেকে শুরু করে বিকেল ৫টা পর্যন্ত ক্লাস করে। মাঝে মাঝে রাত ১০টা পর্যন্ত থাকে। মাঝে যদিও বিরতি থাকে । তবুও পৃথিবীর কোন দেশ এতো রাত্তিরে ক্লাস করায় আমার জানা নেই। ইভিনিং কোর্সের হিসেব আলাদা। যদি ক্লাস না থাকে পুরোটা সময় তাদের পাওয়া যায় লাইব্রেরী কিংবা খেলার মাঠে।
লাইব্রেরীর কথা বলতে বলতে মনে হলো এখানে রাত ৯.৩০ পর্যন্ত লাইব্রেরী খোলা থাকে । এবং বিকেল থেকে এই সময় পর্যন্ত খুব কম সময়ই দেখেছি যে কোন বসার জায়গা ফাঁকা আছে । আরো বলে রাখা ভালো এখানকার এক একটি লাইব্রেরী এক একটি লাইব্রেরী থেকে বড় এবং বেশি সুন্দর। কি নেই একটি আধুনিক লাইব্রেরীর ভেতরে! লক্ষ লক্ষ বই, ডিজিটাল বুক সার্চিং সিস্টেম, কম্পিউটার ল্যাব, মুভি থিয়েটার, কনফারেন্স রুম, ছোট পরিসরের অডিটোরিয়াম । আর আলোকসজ্জ্যা তো আছেই । রাত্রে বেলা কোন অবস্থাতেই পাঁচ তারা হোটেল কিংবা হাই ফাই অফিসের থেকে কম মনে হয়না।
চীনা শিক্ষক শিক্ষার্থীদের একমাত্র লক্ষ হচ্ছে উন্নত জাতি গঠন করা। এক্ষ্যে তারা মাত্রাতিরিক্ত পরিশ্রম করে এবং করায়। অধ্যবসায়ই যেন একমাত্র চাবি কাঠি। একমাত্র শিক্ষাখাতে উন্নতি করতে পারলেই দেশের উন্নতি সম্ভব। চীন সেটাই করে দেখিয়েছে। প্রথম সারির দেশগুলোর ভেতর চীন অন্যতম।
বাংলাদেশের কথা চিন্তা করতে মাঝে মাঝে আমার খুব কষ্ট হয় । কেন আমরা এতো আপন করে নিতে পারিনা? কেনই বা আমরা ভয়ে থাকি কিংবা ভয়ে রাখা হয়। অনেকেই বলেন এডুকেশন সিস্টেম খারাপ কিংবা অহেতুক পড়াশুনার ব্যাপক চাপ । চীন দেশে পড়াশুনার চাপ বাংলাদেশ থেকে তিনগুন না হলেও দ্বিগুনের কম হবেনা এমন না যে চীনারা শুধু পড়াশুনাই করে । চীনারা নাচ , গান , খেলাধুলা সব বিষয়ে সমান পারদর্শী। বিশ্ববিদ্যালে ভর্তির পর এক মাস তাদের মিলিটারি ট্রেনিং হয় যেন দেশের যে কোন কাজে তারা সহায়তা করতে পারে। এতো কিছুর পরেও চীনারা এতে অভস্ত হয়ে পড়েছে এবং খুব সাধারণভাবেই জীবন যাপন করছে । শুধু মাত্র একটিই কারণ পড়াশুনার পরিবেশ তাদের অনূকুলে রাখা হয়েছে ।
অনেকেই হয়ত বলবেন আমি বাংলাদেশকে ছোট করে দেখাচ্ছি কিংবা তুলনা করে কথা বলছি । তাদের জন্য বলব সমালোচনা সহ্য করে নিজেকে শুধরে নিতে না পারলে কেউ কখনো বড় হতে পারে না। আমি কোন ভাবেই দেশকে ছোট করছিনা। পারতপক্ষে নেতিবাচক ইংরেজী কোন খবর সোশ্যাল মিডিয়ায় প্রকাশ করি না কারণ আমি চাইনা আমার দেশকে আমার বিদেশি বন্ধুদের কাছে ছোট করে দেখাতে। একবার দেশের বাইরে এসে দেখুন, তখন মাতৃকার মর্ম সেদিন বুঝতে পারবেন । তেঁতো হলেও যেমন সত্য মিথ্যে হয়ে যাবেনা একই ভাবে এর প্রতিষকও কিন্তু রয়েছে। আজ আর নয় হয়ত অন্য কোন দিন ফিরে আসবো প্রবাস জীবনের অন্য কোন ঘটনা কিংবা মতামত নিয়ে।
শিহাব আল মামুন
সফটওয়ার ইঞ্জিনিয়ারিং
হুয়াইন ইন্সটিটিউট অফ টেকনোলজি
জিয়াংসু, চীন। ২১.১১.২০১৮
সর্বশেষ এডিট : ২১ শে নভেম্বর, ২০১৮ রাত ৩:১০