somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

বকর স্যার ও ফেল্টুস ছোট্ট টুত

৩১ শে মে, ২০১৬ সকাল ৯:১৯
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

বকর স্যার ও ফেল্টুস ছোট্ট টুত

সামিও শীশ

(স্বপ্ন, সৃজন, রূপকথাকে মাঝে মাঝে গল্প বলে বলে বসিয়ে রাখতে হয়.. অবশ্য ঠিক গল্প বলা হয়না। বাচ্চারা গল্পের শেষে কী হল তা নিয়ে মোটেও চিন্তিত নয়, গল্পের কোনো একটা কথা মজা পেলেই বারবার বলে “আবার বল, আবার বল..”, সেইটা যে কোন কথা- গল্পের গুরুত্বপূর্ণ কিনা সেগুলো কোনো বিবেচ্য ভাবনাই তাদের নয়।
বাচ্চা-কাচ্চাগুলোকে ঠা-া রাখার জন্য হুমায়ূন আহমেদের লেখা একটি বলার চেষ্টা করছিলাম। বলার সময় যা হয়, একটু যোগ-বিয়োগ হয়। ধীরে ধীরে মূল গল্পের প্রায় পুরোটাই বিয়োগ হয়, আর যোগ হয় নতুন গল্প। এখনও জানি না মুখে বলা গল্প লিখতে গিয়ে যোগ-বিয়োগের হিসেবটা কী হবে? ‘বকর স্যার ও ছোট্ট টুত’ তেমনি একটি কিছু. . . . )

বকর স্যার বাংলার শিক্ষক। মানুষ হিসেবে নেহায়েত নিরীহ গোছের। খুবই সাত-পাঁচ ছাড়া মানুষ। সকালে নাস্তা সেরে হেঁটে স্কুলে আসেন হাতে একটা ছাতা আর একটি দু’টি গল্পের বই। ক্লাসে নিয়মিত পাঠ্যবইয়ের বাইরে নানা বিষয়ের বই নিয়ে কথা বলেন। স্কুল শেষে বাড়ি ফেরা আর ভাত-ঘুম। তারপর আবারও ছাতা হাতে পাঠাগারে। বিকেল সন্ধ্যা সেখানে কাটিয়ে আবার বাড়ি ফেরা।
এমন গোবেচারা মানুষকে স্কুলের দুষ্টু ছেলের দল কেন আড়ালে ‘বক্কর-ঝক্কর’ নাম দিল, তার কারণ বুঝা যায় না। অবশ্য এই দুষ্টু ছেলের দলের কার্যকারণের কোনো মাথা মু-ুও নেই। আজকে ক্লাসে বকর স্যার বলেছেন, “ভূত-টুত বলে কিছু নাই । এই সবই মানুষের কল্পনা। তোমরা যত ভাববে, পড়বে, মনকে মুক্ত করবে তত ভূত-দৈত্য আর মনের সব অন্ধকার দূর হয়ে যাবে। তখন দেখবে সন্ধ্যার পরেও খোলা মাঠ দিয়ে, গাছের ফাঁক, বন-জঙ্গল দিয়ে হাঁটতে ভয় লাগবে না।” বকর স্যার অবশ্য শুধু মুখেই বলেন না, এক হাতে ছাতা, অন্য হাতে টর্চ আর ঝোলা ব্যাগে লাইব্রেরি থেকে তোলা বই নিয়ে প্রতি সন্ধ্যায় খোলা মাঠ পেরিয়ে গাছের মাঝ দিয়ে হেঁটে বাড়ি ফেরেন।
স্কুলের দুষ্টু ছেলের দলের দুইজনের শুধু আড়ালে ‘বক্কর-ঝক্কর’ ডেকেই মন ভরছে না তারা আরও দুষ্টুমির ফন্দি এটেছে।
রোজকার মতো আজও বকর স্যার ফিরছেন। হঠাৎ আওয়াজ শোনেন নাকি গলায় কে ডাকছে, “হাঁউ-মাঁউ-খাঁউ. . . চিঁ, চিঁ, চিঁ.” তবুও বকর স্যার নির্বিকারে হেঁটে যাচ্ছেন, হঠাৎ শোনেন “বক্কর- ঝক্কর করে করে খক্কর খক্কর...” এই কথা শুনবার সময় বকর স্যার অনুভব করলেন কে যেন ছাতা ধরে টান দিচ্ছে..বকর স্যার ছাতা দিয়ে মারলেন টান। হঠাৎ শুনলেন “আঁউচ”।
সেই রাতে বকর স্যার আাঁধো ঘুম চোখ, কানের কাছে শুনেন কে ফিশ ফিশ করছে, ‘‘কুঁ কুঁ .. ছুঁছুৃঁ . . .। বকর স্যার কানের কাছে জোরে হাত ঝারা দিলেন। আবার শুনলেন, “আঁউচ।”
পরদিন বকর স্যার ক্লাসে। আজ মুখটা অন্যদিনের চেয়ে একটু বেশি খুশি খুশি। তিনি ক্লাসে বলছেন, “জানিস তো . . . কথা বলার সৌন্দর্য বাড়ায় দেয় নানা রকম বিচিত্র আওয়াজ...। এখন আমরা এমন আওয়াজের প্রতিযোগিতা খেলব।” বলেই স্যার কয়েকজনকে ছাত্রকে ডাকলেন। প্রথমে বললেন, “ “হাঁউ-মাঁউ-খাঁউ. . . চিঁ, চিঁ, চিঁ.” আওয়াজটা করত। ক্লাসে হাসির রোল। তারপর বললেন, “এবার করতো... বক্কর- ঝক্কর করে করে খক্কর খক্কর...”। এই দুই পর্ব শেষে প্রথম দুইজনকে নির্বাচন করলেন। সবাই খুশি . . . শুধু প্রথম হওয়া প্রতিযোগী দুইজন একটু ঘাবড়ে গেল, ভাবতে লাগল, “স্যার কী করে বুঝলেন যে গতকাল আমরা দুইজন গাছের আড়ালে লুকিয়ে ডাকছিলাম।” আরও বেশি অবাক হল এই ভেবে যে এত বড় অপরাধ করেও বকর স্যার না বকলেন, না কান ধরে দাঁড় করিয়ে রাখলেন না কোনো অপদস্ত করলেন। বরং বিষয়টিকে নিয়ে মজা করলেন, পুরস্কার দিলেন।
এই বার বকর স্যার বললেন, “এখন সর্বশেষ আওয়াজ আঁউচ।” এইবার সবই আরো বেশি উৎসাহ, উদ্দাম নিয়ে আওয়াজ করল। কিন্তু কারো আওয়াজই গতরাতের মতো হল না। এই পর্বে কেউ পুরস্কার পেল না।
সেই রাতে বকর স্যার ঘুমাতে যাচ্ছেন, এমন সময় শোনেন...“উঁ, উঁ . . .” মৃদু কান্নার শব্দ। বকর স্যার একটি গলা খেঁকিয়ে উঠলেন, “কে রে?
আমি ভুলু।
ভুুলু কে?
আমি ছোট টুত।
কী?
টুত।
আমাকে এমন গল্প বলিস না। ভূত-টুত বলে কিছু নাই।
আপনি কেমন বাংলা শিক্ষক। এই নিজেই বললেন ভ’ত আর টুত..আবার বলেন বলে কিছু নাই। বলে কিছু না থাকলে ভ’ত- টুত বললেন কী করে?
বকর স্যার একটু চমৎকৃত হলেন। এত বছর ধরে শিক্ষকতা করছেন কোনো ছাত্র-ছাত্রী কখনও এই কথা বলে নি। এমনকি মুখে মুখে তর্কও কেউ করে না। তিনি আবার বললেন, তার মানে তুই বলতে চাস তুই একটা ভূতের বাচ্চা।
জ্বি না স্যার। আমি ভূত না, আমি টুত। আমার বাবা-মা টুত।
ওই একই কথা। আমরা মুখে বলি মানুষ-টানুষ, ভূত-টুত।
এমন কথা আপনারা বলেন, আপনার মুখে এক কথা বলেন মানে আরেকটা করেন। আমরা টুতরা তা করি না।
তাহলে তোরা টুতরা করিস টা কী?
বড় টুতরা কী কাজ করে এখনও জানি না। আমি ছোট টুত, এখন শিখি আর পরীক্ষা দেই।
পরীক্ষা? তোদের আবার কী পরীক্ষা।
আমাকে পরীক্ষার পাশের জন্য কাজ দিয়েছে আপনাকে ভয় দেখানো। আমি পারি না। আমার অবশ্য ভয় দেখাতেও ভাল লাগে না। একজন ভয় পেয়ে চিৎকার করে, কষ্ট পায় - এই কাজ করতে আমারও কষ্ট হয়।
কষ্ট হলে তা করিস কেন?
কী করব স্যার করতে হয়। পাশের জন্য, সার্টিফিকেটের জন্য। এই পঁচা জিনিসটা টুতরা শিখেছে আপনাদের কাছ থেকে।
আমরা পঁচা কাজ করি? বাজে বকিস না।
কেন স্যার, আপনাদের ছাত্রদের ভাল লাগে না, তাও এক গাঁদা প্রশ্ন মুখস্থ করে পরীক্ষা দিতে হয়। তবুও আমাদের পরীক্ষা ভাল, মুখস্থ করার নেই।
তাহলে তোদের পরীক্ষা কেমন?
কাজ। যেমন আমার কাজ ছিল আপনাকে ভয় দেখানো। আপনার ছাতা ধরে টান দিয়েছি, আপনার কানের কাছে ‘কুঁ কুঁ .. ছুঁছুৃঁ . . . করেছি, কিন্তু আপনি তো মহা সাহসী আমাকে এমন হেঁচকা মেরেছিলেন আঁউচ। আমি ফেল। তাই আমাকে সার্টিফিকেট দিয়েছে ফেল্টুস।
আচ্ছা, তাহলে তুই সেই আঁউচ আওয়াজ করে ছিলি। তোর ভুল হয়েছিল আমাকে বেছে নিয়ে। কোনো ভীতু মানুষকে ভয় দেখাতি তাহলে তো পাশ করতি, একেবারে জিপিএ ৫।
কী বলেন স্যার? ভীতু লোক তো এমনি ভয়ে আধামরা। তাকে ভয় দেখানোতে কোনো কোনো কৃতিত্ব নেই।
আচ্ছা শোন্, কান তুই একই কাজ করিস, আমি ভয় পাবার ভান করব। আর তুই পাশ করে সার্টিফিকেট পাবি।
আজব কথা। ঠিক মত কাজ না শিখেই সার্টিফিকেট পাব? এই সার্টিফিকেট আমরা টুতরা নিতে পারি না। আপনিই তো স্যার ক্লাসে বলেন, রবীন্দ্রনাথ, নজরুলের সার্টিফিকেট ছিল না কিন্তু বিদ্যা ছিল। সার্টিফিকেট ছাড়া বিদ্বান কত ভাল মানুষ আছেন, তারা কত বড় বড় কাজ করেছেন। কিন্তু বিদ্যা ছাড়া সার্টিফিকেট? একজনের নাম বলেন, বিদ্যা ছাড়া সার্টিফিকেট নিয়ে বড় কাজ করেছেন। যারা বিদ্যা ছাড়া সার্টিফিকেটকে বেশি দাম দেয় তারা অসভ্য, বর্বর। আমি ফেল্টুস টুত, তাতে আমার আম্মু- আব্বু আমাকে ঠিকই আদর করবেনম নতুন করে চেষ্টা করতে উৎসাহ দেবেন। কিন্তু আপনার কথা শুনলে . . . . না স্যার, আপনার মতো একজন সাহসী শিক্ষকের কাছ থেকে এমন কথা আশা করি নি। আসি স্যার।
বকর স্যার বিছানা ছেড়ে উঠলেন। জানালা দিয়ে বাইরে আকাশ দেখছেন, আকাশ একটু একটু ফর্সা হচ্ছে। তিনি ভাবছেন, একটু পর কত কত ছেলে-মেয়েরা হৈচৈ করে স্কুলে যাবে, আমরা পড়াব, তারা পরীক্ষা দেবে, অনেক অনেক জিপিএ পাবে। হঠাৎ নিজেকে জিজ্ঞাসা করলেন,
আচ্ছা, আমরা কী শিক্ষার্থীর সততা, নিজের মনের কথা বলার সাহস আর নিজের চেষ্টায় পাশ করার উদ্যমকে স্বাগত জানানোর জন্যে কখনও কোনো প্রশ্ন করি?
সর্বশেষ এডিট : ৩১ শে মে, ২০১৬ সকাল ৯:২১
০টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

ছি , অবৈধ দখলদার॥ আজকের প্রতিটি অন‍্যায়ের বিচার হবে একদিন।

লিখেছেন ক্লোন রাফা, ০৪ ঠা ডিসেম্বর, ২০২৫ দুপুর ১২:১০



ধিক ‼️বর্তমান অবৈধভাবে দখলদার বর্তমান নরাধমদের। মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীন বাংলাদেশে । বীর মুক্তিযোদ্ধাদের ক্ষমা চাইতে হলো ! রাজাকার তাজুলের অবৈধ আদালতে। এর চাইতে অবমাননা আর কিছুই হোতে পারেনা।... ...বাকিটুকু পড়ুন

আম্লিগকে স্থায়ীভাবে নিষিদ্ধে আর কোন বাধা নেই

লিখেছেন সৈয়দ মশিউর রহমান, ০৪ ঠা ডিসেম্বর, ২০২৫ দুপুর ১২:২২


মঈন উদ্দিন ফখর উদ্দিনের ওয়ান-ইলেভেনে সরকারের ২০০৮ সালের ডিসেম্বরে ভারতের সহায়তায় পাতানো নির্বাচনে হাসিনা ক্ষমতায় বসে। এরপরই পরিকল্পিত উপায়ে মাত্র দুই মাসের মধ্যে দেশপ্রেমিক সেনা অফিসারদের পর্যায়ক্রমে বিডিআরে পদায়ন... ...বাকিটুকু পড়ুন

মিশন: কাঁসার থালা–বাটি

লিখেছেন কলিমুদ্দি দফাদার, ০৪ ঠা ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ৯:২৭

বড় ভাই–ভাবীর ম্যারেজ ডে। কিছু একটা উপহার দেওয়া দরকার। কিন্তু সমস্যা হলো—ভাই আমার পোশাক–আশাক বা লাইফস্টাইল নিয়ে খুবই উদাসীন। এসব কিনে দেওয়া মানে পুরো টাকা জ্বলে ঠালা! আগের দেওয়া অনেক... ...বাকিটুকু পড়ুন

আওয়ামী লীগের পাশাপাশি জামায়াতে ইসলামীকেও নিষিদ্ধ করা যেতে পারে ।

লিখেছেন সৈয়দ কুতুব, ০৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ১২:৪৫


বাংলাদেশে আসলে দুইটা পক্ষের লোকজনই মূলত রাজনীতিটা নিয়ন্ত্রণ করে। একটা হলো স্বাধীনতার পক্ষের শক্তি এবং অন্যটি হলো স্বাধীনতার বিপক্ষ শক্তি। এর মাঝে আধা পক্ষ-বিপক্ষ শক্তি হিসেবে একটা রাজনৈতিক দল... ...বাকিটুকু পড়ুন

J K and Our liberation war১৯৭১

লিখেছেন ক্লোন রাফা, ০৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ৯:০৯



জ্যাঁ ক্যুয়ে ছিলেন একজন ফরাসি মানবতাবাদী যিনি ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তান ইন্টারন্যাশনাল এয়ারলাইন্সের একটি বিমান হাইজ্যাক করেছিলেন। তিনি ৩ ডিসেম্বর, ১৯৭১ তারিখে প্যারিসের অরলি... ...বাকিটুকু পড়ুন

×