somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

পলাশী পরবর্তী সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বাঙালি মুসলমান, কাজী নজরুল ইসলাম

২৬ শে মে, ২০২০ দুপুর ২:৪২
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :



বাংলা ভাষা এবং সাহিত্যের জন্ম হয় ১২ 'শ শতাব্দীতে মুসলিম সালতানাতের হাত ধরে। সেটা ছিল আরবি-ফারসি শব্দ বহুল বাংলা। ড. দীনেশচন্দ্র সেন,

"ইতরের ভাষা বলিয়া বঙ্গভাষাকে ব্রাহ্মণ পণ্ডিতমণ্ডলী ‘দূর দূর’ করিয়া তাড়াইয়া দিতেন, হাড়ি-ডোমের স্পর্শ হইতে ব্রাহ্মণেরা যেরূপ দূরে থাকেন বঙ্গভাষা তেমনই সুধী সমাজের অপাংক্তেয় ছিল-তেমনি ঘৃণা, অনাদর ও উপেক্ষার পাত্র ছিল। কিন্তু হীরা কয়লার খনির মধ্যে থাকিয়া যেমন জহুরীর আগমনের প্রতীক্ষা করে, শুক্তির ভিতর মুক্তা লুকাইয়া থাকিয়া যেরূপ ডুবুরীর অপেক্ষা করিয়া থাকে, বঙ্গভাষা তেমনই কোন শুভদিন, শুভক্ষণের জন্য প্রতীক্ষা করিতেছিল। মুসলমান বিজয় বাঙ্গলা ভাষার সেই শুভদিন, শুভক্ষণের সুযোগ আনয়ন করিল৷ গৌড়দেশ মূসলমানগণের অধিকৃত হইয়া গেল৷ তাঁহারা ইরান-তুরান যে দেশ হইতেই আসুন না কেন, বঙ্গদেশ বিজয় করিয়া বাঙ্গালী সাজিলেন।

মুসলমান সুলতানদের পৃষ্ঠপোষকতায় হিন্দু ধর্মীয়গ্রন্থ ও পুরানগুলো যখন সংস্কৃত থেকে বাঙ্গলা ভাষায় বিরচিত হইতেছিল, ব্রাহ্মণগণ উহা কিরূপ চক্ষে দেখিতেন, তাহা তাহাদের রচিত কয়েকটি সংস্কৃত শ্লোক ও বাঙ্গলা প্রবাদ বাক্য হইতে পরিষ্কারভাবে জানা যায়- 'পুরাণ ও রামায়ণ যাহারা বাঙ্গলা ভাষায় শ্রবণ করিবে, তাহারা রৌরব নামক নরকে গমন করিবে'।

ব্যক্তিগতভাবে কৃত্তিবাস ও কালীদাস এই কুকার্য (অনুবাদের কাজ) করিয়াছিলেন বলিয়া তাহারা ব্রাহ্মণের ক্রোধ বহ্নি হইতে নিষ্কৃতি পান নাই। ব্রাহ্মণ রচিত এই প্রবাদ বাক্য-“কৃত্তিবেশে কাশীদেশে আর বামুন ঘেঁষে এই তিন সর্বনেশে” এখনও স্মরণীয় হইয়া আছে।

এহেন প্রতিকূল ব্রাহ্মণ সমাজ কি হিন্দু রাজত্ব থাকিলে বাঙ্গলা ভাষাকে রাজসভার সদর দরজায় ঢুকিতে দিতেন? সুতরাং এ কথা মুক্তকঠে বলা যাইতে পারে যে, মুসলমান সম্রাটেরা বাঙ্গলা ভাষাকে রাজ দরবারে স্থান দিয়া ইহাকে ভদ্র সাহিত্যের উপযোগী করিয়া নূতনভাবে সৃষ্টি করিয়াছিলেন।" [১]

পলাশী পূর্ববর্তী বাংলা সাহিত্যে মুসলিম সাহিত্যিকদের প্রাধান্য ছিল। ১৭৫৭ সালে বাংলার স্বাধীনতা অস্ত যাবার পর ফোট উইলিয়াম কলেজের পন্ডিত এবং খ্রিষ্টান পাদ্রীরা অপারেশন চালিয়ে বাংলা থেকে আরবি, ফারসি শব্দ বাদ দিয়ে বাংলার বেহাল দশা করেন। সংস্কৃত ব্যাকরণ অনুবাদ করে এক আজব, হাস্যকর ব্যাকরণ তৈরি করেন। ঘটানো হয় সংস্কৃত শব্দের ভয়াবহ অনুপ্রবেশ। এরপর বাংলাতে সংস্কৃত শব্দের পরিমান হয়ে দাঁড়ায় ৮০% [চর্যাপদে সংস্কৃত শব্দ ছিল মাত্র ৫% এবং শ্রীকৃষ্ণকীর্তনে ১২%] [২]

"এই কাজে ইংরাজ পাদ্রীদের সহিত যোগ দিলেন মৃত্যুঞ্জয় বিদ্যালঙ্কার, রামনাথ বিদ্যাবাচস্পতি, রামরাম বসু এবং আরও অনেকে। তখন বাংলা ভাষা হইতে আরবী-ফার্সী শব্দ বর্জন করিয়া ভাষাকে সংস্কৃতায়িত করা হইল।পণ্ডিত ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর প্রমুখ হিন্দু মনীষীরা এই কার্যে অগ্রণী হইলেন। ফলে অল্পদিনের মধ্যেই বাংলা ভাষা রূপান্তরিত হইয়া গেল। এইখান হইতেই বাংলা ভাষার নবযুগ আরম্ভ হইল।

এবং এই ভাষা ও ভাবধারা যখন সরকারী স্কুলসমূহে পাঠ্য হইল, তখন মুসলমানেরা এ চরম সংকটের সম্মুখীন হইল। এ ভাষা কিছুতেই তাহারা প্রাণ দিয়া গ্রহণ করিতে পারিল না। একবাক্যে তাহারা তাহাদের সন্তান-সন্ততিদিগকে শিক্ষা দিতে অসম্মতি জানাইল। [৩]

অতঃপর বাংলা একটা 'হিন্দুয়ানি ভাষা' এই প্রবচনের জন্ম হল।

এই সময়ে বাঙালি মুসলমানেরা এই চরম অস্থিত্ব সংকটে পরে। মীর মশাররফ হোসেনের মত সাহিত্যিক যখন বিষাদ সিন্ধু লেখেন গোছল, রোজা, নামাজ এই শব্দগুলো ব্যবহার করার সাহস পায়নি তিনি ব্যবহার করেন স্নান, উপবাস, প্রর্থনা।

আহমদ ছফা এই অবস্থা ব্যাখ্যা করেন,

"পাছে প্রতিবেশী হিন্দু সমাজের পাঠকেরা উপহাস করতে পারেন, এই হীনম্মন্যতা থেকেই কি মুসলমান লেখকেরা আপন সমাজে, পরিবারে; সংসারে সচরাচর ব্যবহৃত আরবি-ফার্সি শব্দসমূহ তাদের রচনায় যতটা সম্ভব পরিহার করতেন? বঙ্কিমচন্দ্র মীর মশাররফ হোসেনের রচনা পাঠ করে মন্তব্য করেছিলেন, ‘এই লেখকের রচনায় পেঁয়াজ-রসুনের গন্ধ বেশি পাওয়া যায় না’। এটাকেই গ্রন্থ রচনার সবচেয়ে বড় প্রশংসা বলে মুসলমান লেখকেরা কবুল করে নিয়েছিলেন"।[৪]

মুসলমানদের বাঙালি বলে স্বীকার করা হতো না। এমনকি শরৎচন্দ্রের মত সুদ্ধ সাহিত্যিকও লেখেন "বাঙালি এবং মুসলমানদের মধ্যে ফুটবল খেলা চলছে"।

ঠিক এই সময়ে ধূমকেতুর মত আর্বিভাব হয় গরীব গ্রাম্য মুসলমান দুখু মিয়ার। দামাল ঝরের মত তিনি বাংলা ভাষার স্রোতকে উল্টে দেন, ফিরিয়ে নিয়ে যান ভাষার মূল ধারায়। শুরু করেন আরবি-ফারসি, উর্দু শব্দ ব্যবহার। যে মুসলমান নামাজ শব্দ লেখার সাহস পেত না সেখানে তিনি লেখেন,

ঘুমাইয়া কাজা করেছি ফজর,
তখনো জাগিনি যখন যোহর,
হেলা ও খেলায় কেটেছে আসর
মাগরিবের আজ শুনি আজান।
জামাত শামিল হওরে এশাতে
এখনো জমাতে আছে স্থান।।

বাজিছে দামামা বাঁধরে আমামা
শির উঁচু করি মুসলমান।
দাওয়াত এসেছে নয়া যমানার
ভাঙ্গা কেল্লায় ওড়ে নিশান।।

যদি তাকে কৈফিয়ত দিতে হতো সম্ভবত আত্মপক্ষ সমর্থনে এ জাতীয় কথা তিনি বলতেন- মুসলমান সমাজে পেঁয়াজ-রসুনের চল আছে! তাই মুসলমানের রচনায় পেঁয়াজ-রসুনের গন্ধ থাকবেই। সেটা গোপন করা কোনো ভালো কাজ নয়। কারো নাসা রন্ধ্রে সে জন্য যদি ব্যাঘাত সৃষ্টি করে, করার কি আছে! এমনকি সে নাসা রন্ধ্র স্বয়ং সাহিত্য-সম্রাট বঙ্কিমচন্দ্রেরও হতে পারে। [৪]

নজরুল মুসলমানদের ঘরে-সংসারে ব্যবহৃত শব্দসমূহ ব্যবহার করে এমন একটা প্রক্রিয়া সূচনা করলেন, যার ফলে বাংলা ভাষার অভিধান-সঙ্কলকদের প্রতি নতুন সংস্করণে নতুন নতুন শব্দ সংযোজনের একটা বাধ্যবাধকতা সৃষ্টি হয়ে গেল। [৪]

নজরুল বাংলা ভাষা এবং সাহিত্যে শুরু করেন নয়া যামানা। বাঙালি মুসলমানরাও আবার অনুভব করতে শুরু করলো যে বাংলা তাদেরও ভাষা। শতাব্দীর ঘুম ভাঙলো। হঠাৎ করে নিস্ফলা বাঙালি মুসলমানের ঘরে আলাদিনের আশ্চর্য প্রদীপের মত জন্ম নিতে শুরু করলো জসীম উদ্দীন, ফররুখ আহমদ, সৈয়দ আলী আহসান, সুফিয়া কামাল, গোলাম মোস্তফা, বন্দে আলী মিয়া, গোলাম মুহাম্মদ, মতিউর রহমান মল্লিক, আল মাহমুদসহ আরো কত শত মানিকের...

আজ কাজী নজরুল ইসলামের ১২১ তম জন্ম বার্ষীকি। শুভ জয়ন্তী কবি!

তথ্যসূত্রঃ

১. ড. দীনেশচন্দ্র সেন, বঙ্গ-ভাষার উপর মুসলমানের প্রভাব, ‘সওগাত’, ১৩৩৫ সালের চৈত্র সংখ্যায় প্রকাশিত

২. নুরুল কবির, বাংলা ভাগে ভাষা ও সাহিত্যের রাজনীতি পর্ব ২

৩. গোলাম মোস্তফা, বাংলা ভাষার নূতন পরিচয়, গোলাম মোস্তফা প্রবন্ধ সংকলন, আহমদ পাবলিশং হাউস

৪. আহমদ ছফা, নজরুলের কাছে আমাদের ঋণ
সর্বশেষ এডিট : ২৬ শে মে, ২০২০ দুপুর ২:৪২
৭টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

অন্যায় অত্যাচার ও অনিয়মের দেশ, শেখ হাসিনার বাংলাদেশ

লিখেছেন রাজীব নুর, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ বিকাল ৪:৪০



'অন্যায় অত্যাচার ও অনিয়মের দেশ, শেখ হাসিনার বাংলাদেশ'।
হাহাকার ভরা কথাটা আমার নয়, একজন পথচারীর। পথচারীর দুই হাত ভরতি বাজার। কিন্ত সে ফুটপাত দিয়ে হাটতে পারছে না। মানুষের... ...বাকিটুকু পড়ুন

মুক্তিযোদ্ধাদের বিবিধ গ্রুপে বিভক্ত করার বেকুবী প্রয়াস ( মুমিন, কমিন, জমিন )

লিখেছেন সোনাগাজী, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ বিকাল ৫:৩০



যাঁরা মুক্তিযদ্ধ করেননি, মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে লেখা তাঁদের পক্ষে মোটামুটি অসম্ভব কাজ। ১৯৭১ সালের মার্চে, কৃষকের যেই ছেলেটি কলেজ, ইউনিভার্সিতে পড়ছিলো, কিংবা চাষ নিয়ে ব্যস্ত ছিলো, সেই ছেলেটি... ...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। সাংঘাতিক উস্কানি মুলক আচরন

লিখেছেন শাহ আজিজ, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ সন্ধ্যা ৭:০৪



কি সাঙ্ঘাতিক উস্কানিমুলক আচরন আমাদের রাষ্ট্রের প্রধানমন্ত্রীর । নাহ আমি তার এই আচরনে ক্ষুব্ধ । ...বাকিটুকু পড়ুন

একটি ছবি ব্লগ ও ছবির মতো সুন্দর চট্টগ্রাম।

লিখেছেন মোহাম্মদ গোফরান, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ রাত ৮:৩৮


এটি উন্নত বিশ্বের কোন দেশ বা কোন বিদেশী মেয়ের ছবি নয় - ছবিতে চট্টগ্রামের কাপ্তাই সংলগ্ন রাঙামাটির পাহাড়ি প্রকৃতির একটি ছবি।

ব্লগার চাঁদগাজী আমাকে মাঝে মাঝে বলেন চট্টগ্রাম ও... ...বাকিটুকু পড়ুন

দ্য অরিজিনস অফ পলিটিক্যাল জোকস

লিখেছেন শেরজা তপন, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ রাত ১১:১৯


রাজনৈতিক আলোচনা - এমন কিছু যা অনেকেই আন্তরিকভাবে ঘৃণা করেন বা এবং কিছু মানুষ এই ব্যাপারে একেবারেই উদাসীন। ধর্ম, যৌন, পড়াশুনা, যুদ্ধ, রোগ বালাই, বাজার দর থেকে... ...বাকিটুকু পড়ুন

×