পূর্বের পর্বে বলেছিলাম যে বাকি তিনটি নিয়ে ফিরব। আজকে কথা রাখতে চলে এলাম। এ পর্বেও জরুরি সব বিষয় তুলে আনার চেষ্টা করেছি সবাই মিলে ডিসকাস করার জন্যে।
পূর্বের পর্বের লিংক: ৬ টি চরম ক্ষতিকর জিনিস যা আপনার বাচ্চা স্কুলজীবনে শিখছে। বড় ক্ষতির হাত থেকে বাঁচাতে সচেতন করুন তাকে এখনই!
-----------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------
৪) বুলি করা!
এটা মারাত্মক এক সমস্যা। প্রতি স্কুলেই কিছু বাচ্চা থাকে যারা বস গোত্রীয়, তাদের কাজ নতুন অথবা শারিরীক/মানসিক/অর্থনৈতিক/পড়াশোনায় দূর্বল শিক্ষার্থীদের ওপরে চোটপাট করা। অনেক সময়ে বাচ্চারা এসব ভয়ে স্কুলে যেতে চায়না, এমনকি সুইসাইড পর্যন্ত করে অত্যাধিক মেন্টাল স্ট্রেসে।
এজন্যে বিশ্বের নানা দেশে স্কুল বুলিং, সাইবার বুলিং বিষয়ক অনেক কর্মসূচি হয়। এটা একধরণের ক্রাইম। প্রতিটি পরিবারকে সচেতন হতে হবে এ ব্যাপার।
১) আপনার বাচ্চা মনমরা হয়ে থাকলে তার কাছে জানতে চান ব্যাপার কি। অনেকসময় ভয়ে এবং লজ্জায় বাচ্চারা এসব বিষয় শেয়ার করতে চায়না। সে সন্দেহজনকভাবে প্রাণহীন হয়ে পড়লে এবং কোনকিছু শেয়ার করতে না চাইলে তার শিক্ষকের সাথে কথা বলুন।
২) আপনার বাচ্চা নিজে কাউকে বুলি করছে কিনা, বা তেমন গ্রুপে যোগ দিয়েছে কিনা সেই ব্যাপারেও খোঁজ খবর রাখুন। ছোটবেলা থেকে দূর্বলের ওপরে অত্যাচারের অভ্যাসটা যেন তার মধ্যে গড়ে না ওঠে। তাছাড়া খারাপ সার্কেলে মিশে নানা ধরণের বাজে কাজে জড়িয়ে পড়বে। হয়ত বড় হবার পরেও নিজেকে শুধরাতে পারবেনা।
৩) মনে রাখবেন স্কুলে সে আলাদা আলাদা পরিবারের ছেলে মেয়েদের সাথে মিশছে। কারো কারো পরিবারে সঠিক মূল্যবোধ গঠনের মতো অভিভাবক নাও থাকতে পারে। মাঝেমাঝে আপনার বাচ্চার বন্ধুদেরকে বাড়িতে দাওয়াত করুন। খেলুন বাচ্চার বন্ধুদের সাথেও। মিশে যান এবং তার ফ্রেন্ড সার্কেলটা কেমন সেটা ভালোভাবে জেনে নিন। সে যার সাথে যেভাবে মিশবে তাই শিখবে। তাই সে কার সাথে কিভাবে মিশছে, প্রভাবিত হচ্ছে সে ব্যাপারে আপনাকে নজর রাখতে হবে।
আমাকে ছোটবেলায় মা কোনকিছু করতে মানা করলে, আমি উদাহরণ দিতাম, "মাআআআ লামিয়া তো এমন করে, মেঘাও এমনি, আমি করলে সমস্যা কি?" মা বলত, "ওদের মা আর তোমার মা এক না, আমি যা শিখাচ্ছি সেই মোতাবেক চলবে!"
আপনার সন্তানকে বুঝিয়ে দিন অন্ধভাবে তার বন্ধুদের ফলো যেন সে না করে। সবাই এক হয়না, যতজনের সাথেই মিশুক তাকে তার পরিবারের আদর্শমতো চলতে হবে সেটা তার মনে গেঁথে দিন। তাহলে কৈশোর, তারুণ্যেও নিশ্চিন্ত থাকতে পারবেন সন্তানকে নিয়ে।
৪) প্রচুর গল্প করুন আপনার বাচ্চার সাথে। আপনি সন্ধ্যা থেকে রাত একটার পর একটা সিরিয়াল দেখে যাচ্ছেন বা অফিস থেকে এসেই ফাইলপত্র ও হিসাবযন্ত্র নিয়ে বসে থাকছেন, সন্তানের দিকে হয়ত কোন খেয়াল নেই। "ও তো নিজ ঘরে পড়ছে/ভিডিও গেমস খেলেছে, আমার আর কি দরকার?" এমনটা প্লিজ ভাববেন না। আপনাকেই ওর সবচেয়ে বেশি দরকার। আপনিই যেন হন ওর বেস্ট ফ্রেন্ড!
৫) প্রেম পিরিতি!
আপনার সন্তান স্কুলে অনেকের সাথে মিশবে। বন্ধুত্ব করবে পড়াশোনার খাতিরে। একদম ঠিক আছে।
তবে ক্লাস ৫ এর বাচ্চারাও অনেক সময় প্রেমে জড়িয়ে পড়ে! নিশ্চই সেটা কোন কাজের কথা না। সবকিছুরই একটা বয়স থাকে। নিজেকেই যে বয়সে মানুষ ঠিকভাবে বুঝে উঠতে পারেনা, তখন অন্য একজনকে বোঝার দায়িত্ব নেবার মানে নেই। সেসময়ে প্রেমে জড়ালে আবেগে ভেসে পড়াশোনা এবং সর্বোপরি জীবনের ক্ষতি বৈ কিছুই হবেনা। ভূগোলের ম্যাপ না এঁকে প্রেমিকার চুল আঁকবে, শ্রমের মর্যাদা নিয়ে রচনা না লিখে প্রেমিকের মর্যাদা নিয়ে রচনা লিখবে। এ ব্যাপারে খেয়াল রাখতে হবে পরিবারকে এবং স্কুলকেও।
একটা সময়ে ছোটরা শুধু ছোটদের অনুষ্ঠানই দেখত। এখন আর তা নয়। ছোট ছোট বাচ্চাও বাবা মায়ের সাথে বসে হিন্দি সিরিয়ালের কুটনামি দেখছে আর বলিউড মুভির রোমান্টিক সব গান আওড়াচ্ছে। এদিকটায় আসলে কারো কোন নজর নেই। এভাবে ছোট বয়সেই তার মনেও রোমান্টিক ভাবের উদয় হয়! স্কুলে বেঞ্চের নিচে প্রেমপত্র চালাচালি করে ভুল বানানে। আপাতদৃষ্টিতে সুইট মনে হলেও আসলে এর পরিণতি খুব একটা ভালো সচরাচর হয়না।
১) এটা আটকাতে বিনোদনের জন্যে বাচ্চাদেরকে তাদের বয়স অনুযায়ী কাজে উৎসাহিত করতে হবে। কম্পিউটার ও ইন্টারনেট ব্যবহার প্রোপার রেস্ট্রিকশন থাকতে হবে। "ভাবী জানেনন, আমার বাচ্চা এইটুক বয়সে ফেসবুক এক্সপার্ট" বলে গর্ব করার কিছু নেই। বয়সের আগে কোনকিছু হাতে দেবেন না বাচ্চার হাতে। সে নেটে কি দেখছে সেই দিকে নজর রাখুন।
২) ফোন ও কম্পিউটারে ভিডিও গেমস নয়, মাঝেমাঝে কাছের পার্কে দৌড় করিয়ে আনুন। আপনার আশেপাশে মাঠ না থাকলে ঘরের মধ্যেই ব্যাট বল খেলতে উৎসাহ দিন। পড়ার মতো নিয়ম করে খেলতে বলুন।
৩) শিশুদের জন্যে প্রচুর ভালো ভালো শিক্ষনীয় কার্টুন, এনিমেটেড মুভি তৈরি হয়। সেসব দেখুন তার সাথে বসে।
আমাদের পরিবারের পরিচিত এক ব্রাজিলিয়ান আছে, তিনটি কিউট বাচ্চার বাবা। তিনি গল্প করতে করতে বলছিলেন একদিন, "কতদিন যে বড়দের কোন অনুষ্ঠান দেখিনা!" তিনি সারাদিন কাজ শেষে বাড়িতে এসে বাচ্চাদের সাথে ইউটিউবে ছোটদের প্রোগ্রাম দেখেন।
এটাই সঠিক। বাচ্চাদেরকে পাশে বসিয়ে হা করে রোমান্টিক সিন দেখবেন আর তারা আমের মতো লাল টুসটুসে হয়ে পেকে যাবে না সেটা কিভাবে আশা করেন? বাচ্চাদের ধারণক্ষমতা মারাত্মক এটা কখনো ভুলবেন না। "ওরা বাচ্চা, ওরা তো কিছু বুঝবেনা" এটাই বড়দের সবচেয়ে বড় ভুল। ওরা যা বোঝে তা বরং আপনিও বুঝবেন না।
৪) মনে রাখবেন, এসব ব্যাপারে যত লুকানোর চেষ্টা করবেন ততো ক্ষতি। যে মুহূর্তে মানা করবেন অপোজিট সেক্সের সাথে মিশতে, সেই মুহূর্তে তার কৌতুহল বেড়ে যাবে। নানা উল্টাপাল্টা সোর্স থেকে এসব বিষয়ে জানার চেষ্টা করবে এবং ভুলভাল ধারণায় ক্ষতিগ্রস্ত হবে। আসলে খোলামেলা আলোচনা ছাড়া কোন গতি নেই।
আমার এখনো মনে আছে যখন ৭ বা ৮ এ উঠেছিলাম, আমাদের বাংলা টিচার বলেছিলেন, প্রেম করলে ভার্সিটিতে, এখানে যেন কারো নামে বদনাম না শুনি! আমরা মেয়েরা সব লজ্জায় মুখ ঢাকছিলাম তার কথায়। প্রেম যে বড় লজ্জায় বিষয়! হাহা।
তবে আজকালকার যুগে আরো আগেই বাচ্চাদের সাথে এসব নিয়ে কথা বলা উচিৎ। তারা এসব বুঝিবে না ভাবিয়া ভুল করিবেন না। বরং তাহারা ডিজিটাল বাচ্চা, তাহাদের মগজ বড়দের চাইতেও অধিকগুণে পরিপক্ক এসব ব্যাপারে! অল্প বয়সে প্রেমে জড়িয়ে যাবার খারাপ দিকগুলোর ব্যাপারে তাদেরকে সাবধান করুন। ছোট বয়সে প্রেম করে জীবনের ক্ষতি করেছে এমন ছেলেমেয়েদের উদাহরণ দিন। অপোজিট সেক্সের সাথে সুস্থ বন্ধুত্বে এবং সম্মানজনক আচরণে উৎসাহ দিন।
৬) পড়াশোনা পড়াশোনা পড়াশোনা!
আপনার বাচ্চা কি ভোরে বেড়িয়ে যায় ব্যাচ টিউটরের জন্যে? তারপরে দুপুরে স্কুল শেষ করে দৌড়ায় কোচিং এ? বিকেলে বাড়িতে এসে হাত মুখ ঠিকভাবে ধোবার আগেই চলে আসে টিউটর? স্কুল, কোচিং, টিউটরের একই বিষয়ের আলাদা আলাদা হোমওয়ার্ক করতে করতে কি তার রাত একটা বাজে? আবারো সেই ভোরে উঠে একই রুটিন?
আপনি কি বুঝতে পারছেন পুরো ব্যাপারটি কত অমানবিক? একজন শিশুর জীবন এমন হতে পারেনা। শুধু শিশু কেন, বড়দেরও দৈনিক কিছু ঘন্টা বিনোদনের দরকার হয়। স্কুলে ১০০ টা বাচ্চার মধ্যে অনেককিছু বুঝতে পারেনা বাচ্চা। এজন্যে কোচিং বা টিউটরদের দিকে হাত বাড়ায় অভিভাবকেরা। ঠিক আছে। কিন্তু আমি কখনোই বুঝতে পারিনা কোচিং, প্রাইভেট টিউটর, ব্যাচ টিউটর সব একসাথে কেন লাগে?
১) কোচিং, বা ব্যাচে অল্প বাচ্চার মধ্যে যদি আপনার বাচ্চা বোঝে তো ভালো, সেটাই যথেষ্ট। আর তা নাহলে জাস্ট প্রাইভেট টিউটর রেখে দিন। এইটুক এইটুক বাচ্চাদের সমাজের এক টিউটর, অংকের আরেক। কেননা অংকের শিক্ষক সমাজ শেখায় না। মানে কি? সব সাবজেক্টেই টিউটর লাগবেই, নাহলে স্ট্যাটাস থাকবেনা এমন একটা ভাব যেন সবার মাঝে। সমাজ, ধর্মের মতো বিষয়গুলো একটু মন দিয়ে পড়লে বোঝার কথা। না বুঝলে আপনিই ওকে বুঝিয়ে দিতে পারেন। যদি আপনার বাচ্চা অংক, বিজ্ঞানে দূর্বল না হয়, স্কুল একবার বোঝানো মাত্র ধরে ফেলে তবে সেসবের টিউটরেরও প্রয়োজন নেই। যে বিষয়ে আপনার সন্তান দূর্বল শুধু সেই বিষয়ের জন্যে টিউটর রাখুন। সবচেয়ে ভালো হয়ে আপনি নিজেই তাকে পড়ালে। এতে করে কিছু সময় দিতে পারবেন নিজের সন্তানকে আর বাচ্চাটিকে খাওয়া শেষ না করেই টিউটরের কাছে দৌড়াতে হবেনা।
২) নিজের সন্তানের প্রয়োজন বুঝুন দয়া করে। পড়াশোনার পাশাপাশি খেলাধূলার বা সৃষ্টিশীল কিছুর দিকেও নজর দিতে বলুন তাকে। সে যেন কিছু একটা করে জীবনে দাড়াতে পারে সেটা দেখাই তো আপনার দায়িত্ব। সেটা পড়াশোনাই হতে হবে এমনকোন কথা নেই। সবাই পড়াশোনায় ভালো হয়না, কেউ কেউ অন্য প্রতিভা নিয়ে জন্মায়। ভবিষ্যৎ এর কথা ভেবে তার শৈশব, কৈশোর কে হত্যা করবেন না। মনে রাখবেন, জীবন একটাই। এখানে হাসি, আনন্দ, বিনোদের প্রয়োজন রয়েছে।
আর বাচ্চার মার্কের কথা কি শুধু ওর জন্যেই ভাবেন? নাকি পাশের বাড়ির ভাবী, অফিস কলিগের বাচ্চার মতো রেজাল্ট না করলে মুখ দেখাতে পারবেন না সেই ভাবনা কাজ করে? ড্রাইভারের সন্তান গোল্ডেন পেল, আপনারটা ডায়ামন্ড না পেলে তো নাক কাটা যাবে। সেজন্যে দিনে চৌদ্দবার বাচ্চাকে চাপ দিচ্ছেন, ড্রাইভারের বাচ্চার কোন সুযোগ সুবিধা নেই, তার পেছনে আপনি অনেক টাকা ঢালছেন কিন্তু সে কিছুই করতে পারছে না এসব বলে তাকে ভেঙ্গে গুড়িয়ে দিচ্ছেন ভেতর থেকে। আপনার এমন আচরণে সে হীনমন্যতায় ভুগে আরো জেদী, বদমেজাজী হয়ে যাবে এবং একসময়ে হাতের বাইরে চলে যাবে। দয়া করে নিজ স্বার্থে নয়, বাচ্চার সুখের কথা ভেবে তাকে মানুষ করুন। তাহলে আপনার সাথে তার সম্পর্কে তিক্ততা আসবেনা কখনো।
পাখিকে মাছের মতো সাঁতার কাটতে বলবেন না দয়া করে, তার জন্মই যে মুক্ত আকাশে ওড়ার জন্যে!
-----------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------
আমি পোস্টে যেসব ভুলের কথা বলেছি তা অনেক বাবা মা ও শিক্ষক করে থাকেন। আশা করি এই পোস্টটি কারো না কারো চোখ অন্তত খুলবে। আমি জানি স্রোতের বিপরীতে চলার কথা বলছি। আজকালকার যুগে এমন বাবা মা, পরিবার হওয়া কঠিন। কিন্তু নিজের সন্তানের সুখ এবং দেশের সুন্দর ভবিষ্যতের জন্যে ধীরে ধীরে এসব পরিবর্তন আমাদেরকে আনতেই হবে।
পূর্বের পোস্টে অসাধারণ সব মন্তব্যে এসেছে। আমি প্রতিমন্তব্যে তো ধন্যবাদ দিয়েছিই, আবারো দিচ্ছি। আপনাদের গুরুত্বপূর্ণ, গোছালো মতামতের কারণে পোস্টের মান বাড়ে। থ্যাংকস এ লট!
সর্বশেষ এডিট : ২০ শে আগস্ট, ২০১৮ রাত ৯:০৭