লিখব লিখব করেও লেখা হচ্ছিলনা, চুপচাপ হয়ত মনের মধ্যে সব কথাগুলোকে সাজাচ্ছিলাম। করোনা নামক ভাইরাসটি চোখে আঙুল দিয়ে আমাদেরকে যেন আয়না দেখিয়ে যাচ্ছে। আমরা নিজের স্বার্থে কতটা নামতে পারি গত কয়েক মাসে তার অনন্য রেকর্ড স্থাপিত হয়েছে। সেসব নিয়েই এলো এবারের রোস্ট পোস্ট!
পূর্বের রোস্ট পোস্ট!
রোস্ট পোস্ট (১) - "আপনি কি কালো, বেঁটে, মোটা? তাহলে আপনার বেঁচে থাকা অর্থহীন!" ওহ মিডিয়া প্লিজ শ্যাট আপ!
রোস্ট পোস্ট (২) - বাংলাদেশী বিয়ে - দুটি মনের মিলন নাকি অপসংস্কৃতি, অসহায়ত্ব, অশ্লীলতা প্রকাশের মাধ্যম? শেম শেম!
রোস্ট পোস্ট (৩) - বিবাহ বানিজ্য, পাত্র পাত্রীর নির্বাক অসহায়ত্ব, অশ্লীলতা - ঝলমলে লাইটিং এর পেছনের অন্ধকারের গল্প!
রোস্ট পোস্ট (৪) - সোশ্যাল মিডিয়া- আমাদের মন মানসিকতা কি বিকৃত হয়ে যাচ্ছে? সুস্থ হবার উপায় কি?
রোস্ট পোস্ট (৫): বাংলাদেশী ধারাবাহিক ভার্সেস ইন্ডিয়ান সিরিয়াল! আমরা কেন জনপ্রিয়তায় এত পিছিয়ে? সাংস্কৃতিক আগ্রাসন থেকে বাঁচার উপায় কি?
-----------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------
বাড়িওয়ালা ভাড়াটে!
এটা কিন্তু একসময়ে মধুর একটা সম্পর্ক ছিল অন্তত আমার দেখামতে। ছোটকালে দেখেছি, যেকোন বিশেষ দিনে বাড়িওয়ালা ও ভাড়াটের মধ্যে খাবার আদান প্রদান হতো। ঈদের নামাজে একসাথে যেতেন। সম্পর্কটা দুই প্রতিবেশীর মতো ছিল - মালিক এবং দাসের মতো নয়। আগেকার দিনেও খারাপ বাড়িওয়ালা ছিলেন নিশ্চই কিন্তু এতটা নৃশংসতা কি ছিল? হুট করে কেন এমন পরিবর্তন! হয়ত অনেক অযোগ্য মানুষের আঙুল ফুলে কলাগাছ হবার কারণে। অর্থ/ক্ষমতা/খ্যাতি সবাই ডিজার্ভ করেনা, মূল্যবোধহীন মানুষদের হাতে এসব দামী জিনিস চলে যাওয়ায় সাধারণেরা হচ্ছেন শোষিত।
কিছু বাড়িওয়ালা তাদের ডাক্তার/নার্স ভাড়াটেকে করোনার ভয়ে বাড়ি ছাড়া করেছেন। যারা দেশের হিরো তাদেরই এমন অনাদর? এসব দেখে কোন বাবা মা তাদের সন্তানকে জমি বেঁচে ডাক্তারির মতো কঠিন সাবজেক্টে পড়তে পাঠাবেন না।
সাধারণ নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবার এবং মফস্বল/গ্রাম থেকে আসা ছাত্রছাত্রীরা কি বিপাকে পড়েছেন! কাজ নেই তাই ভাড়া দিতে পারেননি কমাস, সেজন্যে মধ্যরাতে বের করে দিয়েছেন বাড়িওয়ালা আর জিনিসপত্র ফেলে দিয়েছেন রাস্তায়!
হ্যাঁ আমি বুঝি সকল বাড়িওয়ালা বড়লোক নয়, ভাড়ার টাকায় অনেকের সংসার চলে। তারা সবার ভাড়া মাফ করে দিক সেটা বলছিনা, কিন্তু করোনার সময়ে মানুষকে বের করে দেওয়া এবং তাও বিনা নোটিশে, ইচ্ছেমতো মাঝরাতে! এটাতো দাদাগিরি! কোন সুস্থ মানুষ এসব করতে পারেনা। করোনার চেয়ে বড় ভাইরাস তো এদের মনে আছে!
যারা বাড়িওয়ালা তারাও হয়ত জীবনের কোন এক পর্যায়ে ভাড়াটে ছিলেন, তাহলে এমন অমানবিক আচরণ কিভাবে করতে পারেন? যেসময়ে একে অপরের পাশে থাকা উচিৎ, তখন উল্টো ঘাড় ধাক্কা দিয়ে মাঝরাস্তায় বের করে দেওয়া হচ্ছে! আমি থ হয়ে যাই, শিক্ষা/সভ্যতা/রুচিবোধ কোন কিছুই কি এদের নেই?
ডাক্তার/নার্স - পেশেন্ট!
একজন ডাক্তার ও পেশেন্টের সম্পর্কটা ভীষন রকম বিশ্বাসের। ভাবুনতো এমন কত শারিরীক ও মানসিক সমস্যা রয়েছে আমরা বন্ধুদের বলিনা, কিন্তু নির্ভয়ে অপরিচিত ডাক্তারদের বলে ফেলি!
যদিও বর্তমানে আমাদের দেশে ডাক্তার/নার্সদের সম্মান অনেকটাই কমে গিয়েছে। ভুল চিকিৎসা, অমানবিক ব্যবহার, মফস্বলের চেম্বারে না যাওয়া, টাকা উপার্জনের জন্যে অপ্রয়োজনীয় টেস্ট/মেডিসিনস প্রেসকাইব করা সহ নানা কারণে সাধারণের মধ্যে বিতৃষ্ণা জমে গিয়েছে এককালের সর্বোচ্চ সম্মনিত পেশাটির ওপরে। খবর তখনই হয় যখন খারাপ কিছু হয়। একজন ডাক্তার নাওয়া খাওয়া ছেড়ে রোগীর সেবা করছেন সেটা কোন চটকদার বিষয় নয়, এজন্যে আমাদের কানে আসেনা। সব ডাক্তার খারাপ নয় এবং আমাদের দেশে একজন ডাক্তারকে ডেইলী যে পরিমাণ রোগী দেখতে হয় তাতে ভুলভ্রান্তি হওয়া স্বাভাবিক। তাই বলব সকল ডাক্তারদের অসম্মান না করে, স্পেসিফিক খারাপ ডাক্তারদের নিয়ে বলুন।
ভূমিকা শেষ, এবারে আসল কথা বলি। ডাক্তার ও পেশেন্টদের অনেক নাটকই দেখল জাতি করোনাকালে। প্রথমে তো ডাক্তার/নার্সরা রোগীদের ধারেকাছে ঘেষে চিকিৎসাই করতে চাইলেন না করোনার ভয়ে! অবশ্য তাদেরও বা দোষ কি? প্রোপার পিপিই না থাকায় তারা মনে সাহস করতে পারেন নি। চারিদিকে অব্যস্থাপনা ছড়াছড়ি। পিপিই পৌঁছায় না, পৌঁছালে পর্যাপ্ত পরিমাণে নয় অথবা এফেক্টিভ নয়। পেশেন্টরাও কম যান না! করোনার সিম্পটন লুকিয়ে চিকিৎসা করাতে যান - তাদের ভয় করোনা জানলে ডাক্তার বের করে দেবেন! এধরণের রোগীদের ট্রিট করতে গিয়ে অনেক ডাক্তার করোনায় আক্রান্ত হয়ে পড়লেন। যে বিশ্বাসের কথা দিয়ে শুরু করেছিলাম, সেই বিশ্বাসেরই ভীষন রকম অভাব তৈরি হয়েছি রোগী ও চিকিৎসকদের মাঝে। দুঃখজনক!
যেই হিরোরা আমাদেরকে এই বিপদ থেকে বাঁচাবে, তারাই একের পর এক সমস্যায় জর্জরিত; বাড়িওয়ালা বের করে দেয়, হোটেলে ব্যবস্থা নিম্নমানের - সেখানেও গাদাগাদি করে থাকা, কর্মক্ষেত্রে পিপিই না পাওয়া সহ আরো কতকি! তাদের সম্মান/সুবিধা তো দূরের কথা, একটু মানবিক আচরণ করতে পারছিনা আমরা। পেপার খুললে প্রতিদিনই ডাক্তারের করোনায় আক্রান্ত/মৃত হবার খবর পাচ্ছি। ভয় লাগে এসব দেখলে - মনে হয় যেন মেধাশূন্য হয়ে যাচ্ছে জাতি!
ডাক্তারের এই অবস্থা হলে, সাধারণ রোগীদের মধ্যে ভীতি বাড়ে স্বাভাবিকভাবেই। আমরা জানতাম আমাদের স্বাস্থ্যক্ষেত্র উন্নত নয়, তবে এতটা খারাপ অবস্থা সেটা চোখে আঙুল দিয়ে দেখাতেই কি করোনা এলো?
স্বামী-স্ত্রী/বাবা মা-সন্তান!
এতক্ষন যা বললাম সেগুলো প্রফেশনাল সম্পর্ক ছিল। টাকা ও সার্ভিসের আদান প্রদান যেখানে হয় সেখানে নাহয় মানবতা আশা করলামই না। কিন্তু ব্যক্তিগত সম্পর্কগুলো? বউমার একটু হাঁচিকাশি হলো ব্যাস! করোনা সন্দেহে শ্বশুড়বাড়ির মানুষ বাপের বাড়িতে তাড়িয়ে দিল! মেয়েদের আসল বাড়ি নাকি শ্বশুড়বাড়ি - এই মন্ত্রে দীক্ষিত করে তাদেরকে পাঠানো হয় অন্য বাড়িতে। কিন্তু শ্বশুড় বাড়ির মানুষেরা এসবে বিশ্বাস করেন না, তাই বউ অসুস্থ হলেই তাদের "নকল" বাপের বাড়িতে পাঠিয়ে দেওয়া হয়!
উল্টো কেসও দেখা যায়। করোনায় আক্রান্ত পিতামাতাকে সন্তান/বউমা বের করে দেয় খোলা আকাশের নিচে। মৃত স্বজনকে দেখতেও যায়না করোনার ভয়ে। মহৎ কিছু ভলান্টিয়াররা চিতায় আগুন দেয়, কবরে মাটি দেয়! কিন্তু এটুকু মহত্ব নিহতের আত্মীয়দের হয়না!
বিশ্বব্যাপী করোনার কারণে নারী নির্যাতন বহুমাত্রায় বেড়েছে - বিশ্ব মিডিয়ায় খবর পাঠকেরা এমনটাই বলছেন। যেহেতু স্বামী ও শ্বশুড়বাড়ির মানুষেরা সারাক্ষন বাড়িতেই অলস মস্তিষ্ক নিয়ে বসে আছেন, মানসিক/শারীরিক নানা ধরণের অত্যাচারে নারীরা জর্জরিত। অন্যদিকে, কিছু কিছু পুরুষের মতে তারাই নির্যাতিত ছলনাময়ী/লোভী নারীজাতির অত্যাচারে! নারীরা ন্যাকা কান্না কাঁদছেন এবং মিডিয়া একতরফা ভাবে সেটা প্রচার করছে! কোন পক্ষের কথা শুনবেন এবং মানবেন সেটা যার যার বিষয়। কিন্তু "মাইয়াগো মাইয়াগো তুই অপরাধীরে, পোলা ও পোলারে তুই অপরাধীরে!" গানের যুগে নারী ও পুরুষের পারস্পারিক শ্রদ্ধাবোধ যে তলানীতে সেটুকুতে অন্তত আমরা সহমত পোষণ করতেই পারি।
নাগরিক-দেশ!
দেশ এবং তার নাগরিকদের সম্পর্ককে এতটা গুরুত্বপূর্ণ মনে করা হয় যে আমরা একে মা ও সন্তানের সম্পর্ক মনে করি। মাতৃভূমি দেশের আরেক নাম! সবাই হয়ত দেশের জন্যে জীবন দেবার সাহস করবে না, কিন্তু নিজের জীবন বাঁচাতেও আমাদের এত আপত্তি?
স্বল্পআয়ের মানুষদের বের হতেই হয়, তাদেরকে কিছু বলছিনা। কিন্তু যারা মার্কেটিং/ডেটিং/সমুদ্রভ্রমণ/পিকনিক/জাস্ট বোরড রিজনসে বাইরে যাচ্ছেন তাদেরকে কি করা উচিৎ? সত্যি কথা হলো, লকডাউন ঠিকমতো আমাদের দেশে কখনো হয়ইনি। একদিকে লকডাউনের ম্যাসেজটি সাধারণের মাঝে পৌঁছে দিতে পারেনি দায়িত্বপ্রাপ্ত মানুষেরা। অন্যদিকে মানুষেরা করোনাকে একটি চাইনিজ রোগ মনে করে, জেদ দেখিয়ে, পুলিশের মার খেয়েও বাইরে ঘুরে বেড়িয়েছেন।
আবার কিছু কিছু প্রবাসীরাও কম যান না। তারা তো টাকা দিয়ে দেশকে কিনে নিয়েছেন। তারা যে দেশের জন্যে নিঃস্বার্থ কোন দান করেননি বরং নিজের মা/বউ/বাচ্চার খরচ পাঠিয়েছেন সেটা তো স্বীকারই করবেন না।
আমি মানছি প্রবাসীরা অনেক হেনস্থার শিকার হয়েছেন করোনার কারণে। লম্বা জার্নির পরে, কোয়ারেন্টাইনের নামে অনেকক্ষন তাদেরকে আটকে রাখা হয়েছে অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে। কিন্তু সেটা নিজের দেশকে গালি দেবার যৌক্তিক কারণ হতে পারেনা। করোনা হওয়া মাত্রই তো দেশ মায়ের কোলে পালিয়ে এসেছিলেন। একবারো ভাবেননি যে গরীব দেশের মানুষদের করোনার হুমকিতে না ফেলি, আমরা না গেলে দেশে করোনা ছড়াবেই না, আর আমরা গেলে এত বাজে ভাবে ছড়াবে যে সেটা সামলানো যাবেনা। সেই দেশটিকে বাজেভাবে গালি দিতে বিবেকে বাঁধলনা আপনাদের?
শুধু কি তাই? জীবন বাঁচাতে এসেছেন ঠিক আছে, জীবন বাঁচানো ফরজ কাজ। তো এসেই ১০০ লোক দাওয়াত দিয়ে বিয়ে করতে হলো? করোনার মধ্যে বিয়ে করে বাচ্চার নাম করোনা রাখতে না পারলে জীবন ব্যর্থ হয়ে যেত আপনাদের? ১৪ দিন আইসোলেশনে না থেকে পরেরদিনই পাড়া বেড়াতে চলে গেলেন, করোনার বিষ ছড়িয়ে দিলেন গরীব রিকশাওয়ালা, দোকানদার, চা মামা এবং নিজেরই প্রিয় স্বজনদের মাঝে। ছি ছি! আর বাংলাদেশের কিছু মানুষ এত সরল যে এতকিছুর পরেও এসব প্রবাসী "ভাই" দের পক্ষে সাফাই গাইছেন! মানছি প্রচুর প্রবাসী দেশের জন্যে অনেক অবদান রাখছেন প্রতিনিয়ত। কিন্তু তার মানে এই নয় যে খারাপ প্রবাসীদের অন্যায়জনক আচরণের বিরুদ্ধে আমরা প্রতিবাদ করবনা।
-----------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------
আমি কোনভাবেই বলছিনা আমাদের দেশের/পৃথিবীর সব মানুষ খারাপ হয়ে গিয়েছে। ডাক্তার/নার্সেরা অক্লান্ত পরিশ্রম করছেন, অনেক বউ ঝুঁকি নিয়ে করোনায় আক্রান্ত স্বামীর সেবা করছেন, বাবারা নিজের সন্তানকে বের হতে না দিয়ে যেকোন প্রয়োজনে নিজেই বাইরে যাচ্ছেন, কিছু বাড়িওয়ালা ভাড়া মাফ করে দিয়েছেন, প্রচুর মানুষ দান করছেন কর্মহীন গরীব ও নিম্ন মধ্যবিত্তদের, এবং পুলিশেরা যে ঝুঁকিটা নিচ্ছেন সেটার জন্যে যতো প্রশংসাই করিনা কেন কম হয়! কিন্তু পোস্টে সেসব নিয়ে বলা হয়নি কেননা এটাই তো স্বাভাবিক - যে যার জায়গা থেকে দায়িত্ব পালন করবেন, মানুষ হয়ে মানবতা দেখাবেন। রোস্ট পোস্টের কাজই হলো সমাজের অসংগতিলোকে তুলে আনা, তাই পোস্টে পজিটিভ কিছু ছিলনা। তবে যারা করোনার মধ্যে দয়া ও মানবতার মান রাখছেন তাদেরকে কোটি কোটি সালাম জানিয়ে শেষ করছি।
এই! এই পাঠকেরা চলে যাবেন না, আরেকটি জরুরী কথা। অন্যকেউ মানুক না মানুক আপনি করোনায় নিজেকে নিরাপদে রাখার জন্যে সকল বিধি মেনে চলুন। বাইরে কম যাওয়া, গেলে মাস্ক/গ্লভসের ব্যবহার, বারবার হাত স্যানিটাইজ করা, ভুলেও চোখ/নাক/মুখে হাত না দেওয়া এবং বাইরে থেকে কোনোকিছু কিনে আনলে সেটাকেও ভালোভাবে পরিষ্কার করুন। মনে রাখবেন, আপনার সবচেয়ে কাছের মানুষটিও করোনায় আক্রান্ত হতে পারেন আপনার অসাবধানতায়! ভালো থাকুন, নিরাপদে থাকুন!
সর্বশেষ এডিট : ২৩ শে জুলাই, ২০২০ রাত ৮:২৮