পূর্ব রোস্ট পোস্ট: রোস্ট পোস্ট (১) - "আপনি কি কালো, বেঁটে, মোটা? তাহলে আপনার বেঁচে থাকা অর্থহীন!" ওহ মিডিয়া প্লিজ শ্যাট আপ!
রোস্ট পোস্ট (২) - বাংলাদেশী বিয়ে - দুটি মনের মিলন নাকি অপসংস্কৃতি, অসহায়ত্ব, অশ্লীলতা প্রকাশের মাধ্যম? শেম শেম!
-----------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------
বিবাহ বানিজ্য: বিয়ে আজকাল দুটি মনের মিলন কে কেন্দ্র করে ধর্মীয় ও পারিবারিক উৎসবের নাম নয়, টপ টু বটম বানিজ্য হয়ে দাড়িয়েছে। বিয়ে শুরু হবার আগ থেকে বিয়ের পরেও চলতে থাকে বানিজ্যের খেলা।
বিবাহপূর্বে: বিয়ের সাথে বানিজ্য ব্যাপারটি সবসময়েই জড়িত ছিল। তবে এখন তা ডাল পালা গজিয়ে চারা গাছ থেকে বিশাল বটবৃক্ষ হয়েছে। আগে পাত্র ডাক্তারি পাশ করলেই অনেক যোগ্য মনে করা হতো। আজকাল শুধু ডাক্তার হলেই হয়না, তার ওপরে স্পেশালিস্ট ডিগ্রী লাগে। একসময়ে শুধু সরকারি চাকরি হলেই চলত, আজকাল উঁচু পোস্ট না দেখে বাবা মা বিয়ে দিতে চান না। আর প্রবাসী হলেতো সোনায় সোহাগা, কামাই তখন টাকায় নয় ডলারে! দেনমোহরটিও পবিত্র নিয়ম হিসেবে পালিত হচ্ছে না, অত্যাচার ও মাছের বাজারের দরাদরির পর্যায়ে চলে গিয়েছে।
আর পাত্রের বাবা মাই বা ছেড়ে দেবেন কেন? একসময়ে শিক্ষিত পাত্রীর দাম ছিল, এখন চাকরীজীবি বউ চাই। তবে শুধু চাকরি করলেই হবেনা, বাড়ির কাজেও তাকে হতে হবে পটু! সারাদিন চাকরি করে এসে বাড়ির কাজও করবে এমন চায় বেশিরভাগ পরিবার। আর যারা মোটা বেতনের চাকরির ব্যাপারে ছাড় দিতে রাজি থাকে, তারা অন্যদিকে পুষিয়ে নেয়। যৌতুক, ছি ছি কি বলছি! যৌতুক আজকালকার শিক্ষিত পরিবারে দেখাই যায়না, সবাই এ ব্যাপারে অনেক সচেতন। তবে "উপহার" তো আদান প্রদান হতেই পারে। ভারী গয়না দিয়ে মেয়েকে মুড়িয়ে দিতে হবে। পাত্রপক্ষের সবাইকে দামী দামী উপহার দিতে হবে। নাহলে তো পাত্রীপক্ষেরই নাক কাটবে!!!!
বিবাহ চলাকালিন খরচ: বিয়েতে শয়ে শয়ে হাজার হাজার লোককে দাওয়াত করা হয়। অতি বড়লোকেরা বিয়ের কার্ডের সাথে এতগুলো লোককে দামী উপহারও পাঠায়! এইসব লোকদের শত রকমের খাবারের খরচ, তাদের বিনোদনের জন্যে নাচ, গান, কৌতুক ইত্যাদি পরিবেশনা করার খরচ, তারা যেন সাজানো গোছানো চোখ ধাঁধানো লোকেশন ও ডেকোরেশন উপভোগ করতে পারে নসেই খরচ করতে করতে লাখ নয় কোটি কোটি টাকা চলে যাচ্ছে শুধু একদিনের জন্যে!
শুধু হোস্টই নয়, গেস্টদেরও আছে কিছু দায়িত্ব। কে কত দামী শাড়ি গয়না, স্যুট টাই পরে যেতে পারবে, কে কত দামী উপহার নিয়ে যেতে পারবে সেটারও লোক দেখানো প্রতিযোগিতায় মেতে সবাই।
এই পুরো বিষয়টি নিয়ে আমার আপত্তি থাকত না যদি হাজার হাজার মানুষ আপনজন হতেন, আর নবদম্পতিকে দোয়া ও ভালোবাসা দিতে আসতেন। কিন্তু নাহ! আগত অতিথিদের অনেকেই বর কনের নামই ঠিকভাবে জানেন না। আজকাল বিয়েতে কোন দূর সম্পর্কের আত্মীয়ের প্রতিবেশীর গ্রামের বন্ধুর বোনকেও দাওয়াত দিতে হয়! এটা তখন আর আপনজনদের সাথে মনের আনন্দ উদযাপন নয়, কার বাবা তার মেয়ের বিয়েতে কত বেশি লোক খাওয়াতে পারল সেই প্রতিযোগিতা মনে হয়। এসব অতিথিদের অনেকের মধ্যেই ভালোবাসা ও আন্তরিকতা দেখা যায়না খুব একটা। কেননা তারা তো বিচারক হয়ে আসেন! বুঝলেন না? শেষ সেকশনে বিষয়টি নিয়ে বিস্তারে আলোচনা করেছি।
অশ্লীলতা: বিয়ে একটি পবিত্র ধর্মীয় রীতি। যেকোন ধর্মের বিয়েতেই ঈশ্বরকে সাক্ষী রেখে - কাজী সাহেব, পুরোহিত অথবা ফাদার পবিত্র ধর্মীয় কথামালার মাধ্যমে দুটো মানুষকে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ করেন। তাই এই উৎসবটিত যথাযথ পবিত্রতা বজায় রাখা দরকার। আজকাল তা আর হচ্ছে কোথায়?
বিয়ের দাওয়াতে আসা মানুষজনকে বিনোদিত করতে রিয়ালিটি শো করা ছোটখাট তারা অথবা উঠতি মডেলদের নিয়ে এসে পারফর্ম করায়। ভিনদেশী সেসব গানের কথায় এবং নাচের অঙ্গভঙ্গি ও পরিবেশনা শালীনতার বহু মাইল দূরে থাকে। আমাদের সংস্কৃতিতে গুরুজনদের সামনে টিভিতেও যদি কোন বেশি ইনটিমেট গান অথবা স্বল্পবসনা নায়িকার এক্টিং চলতে থাকে ছোটরা অস্বস্তি বোধ করে। চ্যানেল পাল্টে ফেলে। সেখানে এভাবে লাইভ অশালীনতা পরিবারের সবাই কিভাবে উপভোগ!! করতে পারে?
উপরোন্ত, আমাদের সংস্কৃতিতে কিছু নিয়ম কানুন রয়েছে। গুরুজনদের শ্রদ্ধা ও ছোটদের আদরের ব্যাপার রয়েছে। আমাদের সমাজে দশ বছর ধরে সংসার করা স্বামী স্ত্রীও একে অপরকে জড়িয়ে ধরে চুমু খায় না গুরুজন ও বাচ্চাদের সামনে। সেখানে হবু বর ও কনে একে অপরের কোলে উঠে, জড়াজড়ি করে নানান ধরণের পোজ দিয়ে যেসব ছবি তুলে যায় সবার সামনে! দেখলে চোখ কপালে ওঠে। আর শুধু বর কনেই নয়, বরের সাথে কনের বোন ও বান্ধবী, কনের সাথে বরের ভাই ও বন্ধুরাও অশালীন মাত্রার কাছাকাছি এসে ছবি তোলে। আমরা যে সমাজে বড় হয়েছে, সেখান থেকে এই প্রাণীরা এমন অসভ্য কিভাবে হয় আমি বুঝিনা।
হবু বর কনে ছবি অবশ্যই তুলবে স্বজনদের সাথে। তাতে কোন আপত্তি থাকতে পারেনা। বিয়ের স্মৃতিগুলো ছবিতে ছবিতে অমলিন হয়ে থাক, তবে সেটা বাংলাদেশী সংস্কৃতির মায়া ও আদব কায়দাকে ধারণ করে।
পাত্র পাত্রীর নির্বাক অসহায়ত্ব:
আমাদের দেশে নিজের বিয়ে নিজে এনজয় করতে পারে কয়জন? ছবি তোলার মুহূর্তটুকু বাদে বর ও কনেকে কমই হাসতে দেখা যায়। দুজনের চোখে মুখে একঘেয়েমি ও ক্লান্তির ছাপ সহজেই ধরা যায়। ভারী শাড়ি ও গয়নায় দমবন্ধ হয়ে যাবার উপক্রম হয় কনের। পাগড়ি ও শেরওয়ানীতে বরের অবস্থাও গরমের দেশে খুব একটা সুবিধার হয়না। বিয়ের মূল অংশটুকু তো আধা ঘন্টাও লাগার কথা নয়। কিন্তু অনুষ্ঠান চলতেই থাকে, চলতেই থাকে। স্টেজে পুতুলের মতো বসে থাকে দুটি মানুষ, একেকজন পরিচিত অপরিচিত অতিথি এসে তাদেরকে নিয়ে একেকটি কমেন্ট করে যায়। কেউ ভালো কথা বলে, তো কেউ ইশারায় খোঁচাও দিতে ভোলেনা পাত্র পাত্রী অথবা পরিবারের লোককে। সেভাবে ঘন্টার পর ঘন্টা বসে থাকতে হয়। পাত্র পাত্রী যেন চিড়িয়াখানার প্রাণী, প্রদর্শনীর জন্যে রেখে দেওয়া হয়েছে, সবাই ইনভাইটেশন কার্ড নামক টিকিট কেটে দেখে যাচ্ছে!
"মেয়ে তো শ্যামলা, মেকআপের মাঝেও বোঝা যাচ্ছে", "ভাবী মেয়ে হিসেবে ছেলে একটু বেঁটে হয়ে গেল না?", "ভাই প্রবাসী পাত্র পেলেন না? শুনলাম ছেলে দেশে সামান্য ব্যাংকে জব করে!", "ওদের নাকি প্রেমের বিয়ে! টিকলে হয়, বিয়ের পরে প্রেম আর থাকে না, কম তো দেখলাম না!", "না জেনে শুনে বিয়ে করেছে, বিয়ের পরে এডজাস্ট করতে পারবে? আধুনিক যুগে যত্ত সব ব্যাকডেটেড ব্যাপার স্যাপার!" "বিয়ের আয়োজন একদম ভালো হয়নি, কৃপণ মনে হয়!", "বিরিয়ানিতে মাংস কম, মেহমানদারীর কি ছিড়ি!"
যেকোন বিয়েতে গোল হয়ে তিন চারজন মানুষ হাতে কুলফি, কোল্ড ড্রিংক, কাবাব বা অন্যকিছু সাবাড় করতে করতে ওপরের কথাগুলোই বলতে থাকে। আরেহ ভাই, দুটো মানুষ নতুন জীবন শুরু করতে যাচ্ছে। স্বাভাবিকভাবেই কেউ পারফেক্ট না। কিন্তু তারা পারফেক্ট সুখের সংসার যেন করতে পারে সেই দোয়া করতে কি টাকা লাগে? আন্টিরা, আপনারা যে চেহারায় এত মেকআপ লাগান, দেখতে তো পেত্নীর মতো লাগে। কথাবার্তার মধ্যেও রাক্ষসীপনা দেখাতেই হবে? চেহারা সুন্দর করার জন্যে কোটি কোটি টাকা ব্যয় করেন, বিনা খরচে মনকেও সুন্দর করার ইচ্ছে করেনা? আর আংকেলগণ, জীবনে ভালো খাবার খান নি যে কারো বিয়েতে গিয়ে টেবিল ম্যানার্সের বারোটা বাজিয়ে ভুভুক্ষের মতো কবজি ডুবিয়ে খেয়ে যান? খান ভালো কথা, আয়োজন ও মেহমানদারী নিয়ে প্রশ্ন তুলতে লজ্জা লাগেনা? আপনাদের মতো মানুষদের কারণে বিয়ের মতো পবিত্র বন্ধন আনন্দ নয় বরং অত্যাচারের মধ্য দিয়ে কেটে যায়। সমাজের কিছু কিছু সরল মানুষ আপনাদের মতো মানুষদের কুটিল ও জটিল মনকে গুরুত্ব দিলেও, আমি আপনাদের মতো মানুষদের ভাবনা চিন্তার খ্যাতা পুড়ি!
-----------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------
পূর্বের পর্বে সবগুলো পয়েন্ট শেষ করতে পারিনি, পোস্ট লম্বা হয়ে যাবার আশংকায়। তাই আগেই বলেছিলাম আরো একটি রোস্ট পোস্ট আসবে এই বিষয়ে, এসেও গেল।
আপাতদৃষ্টিতে ঝলমলে ও পরিচ্ছন্ন মনে হওয়া বিয়ে বাড়ির ভেতরের অন্ধকার, ধুলাবালি ও মাকড়সার জালের গল্প শেষ হলো। পাঠক নিজের বা আত্মীয়দের বিয়েতে দেখা অসংগতি অথবা কোন খারাপ অভিজ্ঞতার কথা শেয়ার করতে পারেন।
ছবিসূত্র: অন্তর্জাল!
সর্বশেষ এডিট : ১৬ ই আগস্ট, ২০১৯ রাত ৮:৩১