ঘুরাঘুরি আমার মজ্জাগত। ফুরসত পেলেই বেরিয়ে পড়ি। পৃথিবীতে এর চেয়ে মজার আর আকর্ষণীয় কিছু থাকতে পারে-এ আমার বিশ্বাস হয়না। ছাত্রজীবনের সেই উদ্দীপ্ত বাধাহীন ঘুরাঘুরির অফুরন্ত দিনগুলো যেন হঠাৎ সোনার শিকলে বাঁধা পড়ল কর্মজীবনে ঢুকার সাথেই। তবু হাজার ব্যস্ততা, যাপিত ক্লান্ত জীবনের ঘানি আমাকে কখনো দীর্ঘ সময় আটকে রাখতে পারেনি। কবি নজরুলের সেই বিখ্যাত কবিতাকে যেন আপ্ত বাক্য জেনেছি-
"এই শিকল-পরা ছল, মোদের এই শিকল-পরা ছল
এই শিকল পরেই শিকল তোদের করবো রে বিকল"
আগেই ভেবে রেখেছিলাম এবার কুরবানির ঈদের ছুটিতে নতুন কোথাও ঢুঁ মেরে আসব-যেখানে আগে কখনো যাইনি। ৮ দিনের ছুটির ৫ দিনই ঈদের আগে সুতরাং ঈদের আগেই এই ছুটির সদ্ব্যবহার করতে হবে এটা নিয়ে আর কোন সংশয় ছিলনা। সিধান্তটা নিয়েই ফেললাম- এবার ঘুরে আসব কুতুবদিয়া আর মহেশখালী দ্বীপ। ভ্রমনে সঙ্গী নির্বাচন আমার দৃষ্টিতে খুব গুরুত্বপূর্ণ। কাছাকাছি মানসিকতার না হলে পুরো ভ্রমণটি মাটি হতে পারে-আর এক্ষেত্রে আমার প্রশ্নহীন পছন্দ মামুন ভাই ওরফে মুশাররফ মামুন, আমার বাল্যবন্ধু ও খালাতো ভাই যে আমার অধিকাংশ খামখেয়ালি আর আকস্মিক ভ্রমণের দ্বিধাহীন সঙ্গী। তবে মামুন ভাই জীবনে প্রথম বারের মতো একটু গাঁইগুই করার চেষ্টা করল। কারণটা এই উনি সদ্য চট্টগ্রাম আদালতে শিক্ষানবিস আইনজীবী হিসেবে কাজ শুরু করেছেন; এমতাবস্থায় চেম্বার থেকে ছুটি নিলে সিনিয়র রুষ্ট হতে পারেন, এছাড়া দৈনিক ২০০ টাকার দিনমজুরিতে উনার হাতে সঞ্চয় বিশেষ নেই। যাহোক ব্যাপক তৈলমর্দন আর নানাবিধ(!) প্রলোভন দেখিয়ে উনাকে রাজি করে ফেলা হল। আমার সহকর্মী বড় ভাই মিনহাজুল ইসলাম যুক্ত হলেন এই ভ্রমনে। বৈষয়িক ব্যাপার স্যাপারে আমি চূড়ান্ত অজ্ঞ। অঙ্ক আর টাকা-পয়সার হিসেব মিলানোতে আমার আবাল্য নির্বুদ্ধিতা আর ব্যর্থতা পরিচিত মহলে প্রবাদপ্রতিম। এই কারনে আমাকে কখনো বাজারে যেতে হয়না, কোন দরকারে বাসায় কারো ডাক পড়লে কাউকে খুঁজে না পাওয়া সত্তেও আমার উপস্থিতি আর অস্তিত্বকে সবাই কিভাবে জানি অগ্রাহ্য করে যায়-যেন আমি থেকেও নেই, যেন এই বিশ্ব ব্রহ্মাণ্ডের কোন বৈষয়িক কাজে আমার কোন সম্পৃক্ততা নেই, কোন প্রয়োজন নেই। তবে ড. আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ এর 'বহে জলবতী ধারা' বইটি পড়ে আমার ধারণাটি উল্টে গেল। নামের মিলের সাথে দেখি আমাদের চরিত্রেরও বেশ মিল বিশেষত এই বৈষয়িক নির্বুদ্ধিতার ক্ষেত্রে। উনার ভাষাতেই বলিঃ
"এতবড় অমর্যাদা আর দুর্ভাগ্যের নিচে আমার জন্য যে একটা এতবড় সুসংবাদ লুকিয়ে আছে আমি ভাবতেও পারিনি। যে কাজ করতে আমি রাজি নই, বা যে কাজ আমার অপছন্দের, তাতে একবার কোনভাবে নিজেকে অযোগ্য প্রমাণ করতে পারলে আর কোন অসুবিধা নেই। সারাজীবনের মতো ওর অসহ্য যন্ত্রণা থেকে মুক্ত। নিজেদের অস্তিত্ব বা সুখ শান্তির গরজেই অন্যেরা আমাকে ওটা করতে অনুরোধ করবেনা"।
সুতরাং মিনহাজ ভাই এর মতো বৈষয়িক, নীতিবান, হিসেবি আর দূরদর্শী ব্যক্তিকে ভ্রমন সঙ্গী পেয়ে আমরা একই সাথে আনন্দিত আর ভারমুক্ত হলাম। মিনহাজ ভাই সানন্দে 'ট্যুর ম্যানেজার' এর দায়িত্ব নিজের কাঁধে নিয়ে নিলেন। অর্থ আর খাওয়া দাওয়ার মতো ঝামেলাপূর্ণ তুচ্ছ বিষয়ের বদলে আমি প্রকৃতি দর্শনে নিমগ্ন হতে পারবো। আমি হাঁফ ছেড়ে বাঁচলাম।
যাত্রা হল শুরুঃ
প্রথমে ঠিক হল সড়ক পথে চকরিয়ার মগনামা ঘাট হয়ে আমরা কুতুবদিয়া যাব। কিন্তু হঠাৎ জানা গেল মগনামা সড়কের একটি ব্রিজ ভেঙ্গে পড়েছে। সুতরাং আমরা পরিকল্পনা বদল করে চট্টগ্রাম সদরঘাট হয়ে সমুদ্র পথে কুতুবদিয়া যাবার সিদ্ধান্ত নিলাম। জানা গেল লঞ্চ ছাড়বে ভোর সাড়ে ৬ টায়। ২৩ অক্টোবর, ২০১২ সকালে সদরঘাট পৌঁছে একটি টং দোকানে সকালের নাস্তা সারলাম। অখাদ্য পরটা আর ভাজি জোর করে গলধকরন করতে গিয়ে আমার ঢাবি হল লাইফ এর কথা মনে পড়ে গেল। আশেপাশে আর কোন খাবারের দোকান ও নাই। নিজেকে সান্ত্বনা দিলাম-হল এর ক্যান্টিনের খাবারের চেয়ে এ ঢের ভাল! এমন সময় ঘটল এক মজার ঘটনা। আমদের পাশেই তিন তরুণী নাস্তা করছিল। আমাদের এক আইনজীবী বন্ধুর বাড়ি কুতুবদিয়ায়। ওর নাম হল অ্যাডভোকেট রহিম। আমরা আলাপ করছিলাম রহিম কে নিয়ে, ওর বাড়ির অবস্থান, ওকে কল করব কিনা ইত্যাদি। হঠাৎ দেখি তিন তরুণীর একজন আমাদের দিকে তাকিয়ে মিটিমিটি হাসছে। একপর্যায়ে আমদের লক্ষ্য করে শুরু হল মৃদু ফিসফাস আর সে সাথে বেড়ে চলল হাসির উচ্ছলতা। আমরা একটু অপ্রস্তুত হয়ে গেলাম। কিন্তু মামুন ভাই স্বভাবসুলভ ভাবে উৎসাহী হয়ে উঠলেন। হয়তো ঐ তরুণীর রহস্যময় মৃদু হাসির ভিতর কোন মৃদু সম্ভাবনার ইঙ্গিত তিনি অনুভব করছিলেন! কিন্তু তার ঘণ্টাখানিক বাদেই এই হাসি রহস্য উন্মোচিত হল তবে তা মামুন ভাই এর জন্য মর্মান্তিক ট্র্যাজেডি হয়ে রইল! সেই ট্র্যাজেডি একটু পরে বয়ান করছি।
আমরা নৌকা বেয়ে বড় একটা লঞ্চে গিয়ে উঠলাম। লঞ্চে চড়ার অভিজ্ঞতা আমার এবারই প্রথম নয়। সুন্দরবন ভ্রমণে গিয়ে লঞ্চে চড়ার বহু অভিজ্ঞতা আমার আছে। কিন্তু আগাগোড়া সওদা বোঝাই এরকম লঞ্চে আমি আগে কখনো চড়িনি। লঞ্চের ২য় তলায় আমাদের অবস্থান। চারপাশে চাল, ডাল, তেল, নুন থেকে শুরু করে কাঁচা কলা পর্যন্ত বস্তায় বস্তায় স্তূপ করা হয়েছে। নিচতলার পুরোটাই মাল বোঝাই। লঞ্চের ছাদ মানুষ আর মালে পূর্ণ। আর মালামালের বস্তার মাঝে এক চিলতে ডেক যেখানে নারী-পুরুষ ঠাসাঠাসি করে বসে আছে। অনেকটা দমবন্ধ অবস্থা, এরউপর কিছু লোক সমানে বিড়ি ফুঁকে পুরো জায়গাটি ধূমায়িত করে চলেছে। অদূরে জলের ছিটা গায়ে পড়া নিয়ে কলহে মেতেছে দু রমণী। আমার খারাপ লাগছেনা। আমি একটা বস্তায় পিঠ ঠেস দিয়ে আধশোয়া হয়ে দেখছি চারপাশের মত্ততা, মানুষের যাপিত জীবনের নিত্যতা। এই মানুষেরা এই পথেই, এই ভাবেই নিত্য আসা যাওয়া করে, তাদের নিয়তি এখানেই বাঁধা পড়ে আছে। আমাদের মতো ক্ষণিকের সমুদ্র বিলাস তাদের নয়। তাদের জীবন এই সমুদ্রের মতই ঝঞ্জা-বিক্ষুদ্ধ, অনিশ্চিত। আমি চোখ বন্ধ করে ভাবনার সাগরে ডুব দিলাম।
চোখ মেলে দেখি মামুন ভাই নেই। মিনহাজ ভাই বলল উনি লঞ্চের ছাদে গেছেন। আমিও একটু মুক্ত হাওয়ার লোভে ছাদে গেলাম। দেখি ঐ তিন তরুণীও ছাদেই ঠাই নিয়েছে আর মামুন ভাই এর সাথে ওই রহস্যময় সুহাসিনীর ইশারায় আলাপ হচ্ছে! ইশারায় আলাপ ভিন্ন অন্য উপায় নেই কারন মেয়েটি ছাদের শেষ মাথায় যেখানে অজস্র মানুষ আর মালামালের ভিড় ঠেলে পৌঁছানো রীতিমতো অসম্ভব। আমাকে দেখে মামুন ভাই 'ইশারা আলাপ' এ ক্ষান্ত দিল। ভাবলাম এতক্ষনে বুঝি মামুন ভাই এর 'মৃদু সম্ভাবনা' 'সফল বাস্তবতায়' উন্নীত হয়েছে। কিন্তু না! এমন তাপদগ্ধ রৌদ্রউজ্জ্বল দিনে মামুন ভাই এর চেহারায় শ্রাবণের কালো মেঘের ঘনঘটা ! ব্যাপার হল- আমাদের বন্ধু সেই অ্যাডভোকেট রহিম নাকি কিছুক্ষন আগে উনাকে কল করে বলেছেন যে উনি খুব দুঃখিত যে এই মুহূর্তে উনি কুতুবদিয়া আসতে পারছেন না। আরও জানালেন যে এই লঞ্চেই উনার বাগদত্তা বাড়িতে যাচ্ছেন এবং এই মুহূর্তে সে ছাদে আছে। মামুন ভাই রহিম এর কাছ থেকে ওর হবু পত্নির চেহারার বর্ণনা নিলেন এবং বিস্মিত হয়ে আবিষ্কার করলেন ঘাটের পাড়ে দেখা হওয়া ওই 'রহস্যময় সুহাসিনী' ই সেই বাগদত্তা! তাঁর ওই রহস্যময় হাসির কারন-ঘাটের পাড়ে নাস্তা করার সময় আমরা অজান্তে ওই তরুণীর স্বপ্ন-পুরুষ 'অ্যাডভোকেট রহিম' কে নিয়েই আলোচনা করছিলাম! যাহোক রহিমের মারফতে ওই তরুণী মামুন ভাই এর কথা অবগত হল এবং সে কারনেই ওই 'ইশারা আলাপের' সূচনা যেটির শুধুই অর্থহীন সৌজন্য মূল্য ছাড়া আর কোন তাৎপর্য অবশিষ্ট নেই। এ যেন 'না ফুটিতে ফুল ঝরে গেল হায় বিনা কারনে'। রজনীকান্ত সেন এর সেই গানটি মনের ভিতর গুনগুন করে উঠল আমারঃ
"ফুটিতে পারিত গো ফুটিল না সে
মরমে মরে গেল মুকুলে ঝরে গেল,
প্রাণ ভরা আশা সমাধি পাশে..."
চলন্ত লঞ্চের ছাদের উপর এসে বসলাম যেখান থেকে উভয় পাশই দেখা যায় ।এক পাশে আনোয়ারা সার কারখানা ও মেরিন একাডেমী এলাকা । অন্য পাশে বাংলাদেশের প্রধান সমুদ্র বন্দর এর বিভিন্ন জেটি , যেগুলোতে সারি সারি জাহাজ দাড়িয়ে আছে মাল খালাসের অপেক্ষায় । জাহাজ ছাড়াও এদিকে সেদিকে শত শত মাছের বোট দাড়িয়ে আছে । সাম্পানতো অগণিত । সব কিছু মিলিয়ে অপূর্ব দৃশ্যের সৃষ্টি হয়েছে । আমরা আগে কেউ কখনো কুতুবদিয়া যাইনি। তাই নানান জনের পরামর্শই ভরসা। একজন বলল-'আপনারা উপজেলার ঘাটে না নেমে দরবারের ঘাটে নামেন, ওখান থেকে সদরে গেলে সুবিধা হবে'। আমাদের মাথায় চিন্তা ছিল একটাই রাত টা কুতুবদিয়া উপজেলা সদরেই কাটাতে হবে কারন অন্য কোথাও নিশিযাপনের ব্যবস্থা নেই। সেক্ষেত্রে দরবার ঘাটে নেমে কুতুবদিয়ার 'দরবার শরিফ' দেখে সদরে ফিরে যাওয়া যাবে। লঞ্চ দরবার ঘাটে ভিড়ল। আমরা কুতুবদিয়াতে পৌঁছে গেছি! কুতুবদিয়া বাংলাদেশের কক্সবাজার জেলার অন্তর্গত একটি উপজেলা। এটি একটি দ্বীপ, যা কুতুবদিয়া চ্যানেল দ্বারা মূল ভুখন্ড থেকে বিচ্ছিন্ন। আয়তন ২১৫.৮ বর্গ কিলোমিটার। দীর্ঘদিন ধরে কুতুবদিয়া দ্বীপের গঠন প্রক্রিয়া শুরু হলেও এ দ্বীপ সমুদ্র বক্ষ থেকে জেগে উঠে চতুর্দশ শতাব্দীর শেষের দিকে। ধারণা করা হয়, পঞ্চদশ শতাব্দীর শেষের দিকে এ দ্বীপে মানুষের পদচারণা। “হযরত কুতুবুদ্দীন” নামে এক কামেল ব্যক্তি আলী আকবর, আলী ফকির, এক হাতিয়া সহ কিছু সঙ্গী নিয়ে মগ পর্তুগীজ বিতাড়িত করে এ দ্বীপে আস্তানা স্থাপন করেন। অন্যদিকে আরাকান থেকে পলায়নরত মুসলমানেরা চট্টগ্রামের আশেপাশের অঞ্চল থেকে ভাগ্যাণ্বেষণে উক্ত দ্বীপে আসতে থাকে। নির্যাতিত মুসলমানেরা কুতুবুদ্দীনেরপ্রতি শ্রদ্ধান্তরে কুতুবুদ্দীনের নামানুসারে এ দ্বীপের নামকরন করেন“কুতুবুদ্দীনের দিয়া”, পরবর্তীতে এটা ‘কুতুবদিয়া’ নামে স্বীকৃতি লাভ করে। দ্বীপকে স্থানীয়ভাবে ‘দিয়া’ বা ‘ডিয়া’বলা হয়। কুতুবদিয়া সদর উপজেলায় ৬ টি ইউনিয়ন আছে । ইউনিয়ন গুলো হলঃ আলি আকবর ডেইল, বড়ঘোপ, দক্ষিণ ধুরুং, কৈয়ার বিল, লেমসিখালী এবং উত্তর ধুরুং.।
কুতুব আউলিয়ার সুযোগ্য উত্তরসূরি হযরত শাহ আবদুল মালেক আল কুতুবী (রহ.)-এর নামানুসারে এই 'দরবার ঘাট' যার অদূরে পায়ে হাঁটা দূরত্তে হযরত শাহ আবদুল মালেক (রহ) মাজার শরিফ এর অবস্থান যেখানে প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে প্রতিদিন অসংখ্য ভক্ত আসে এক নজর দেখার জন্য। ঘাটে নেমে দেখি ক্ষুধায় পেট চোঁ চোঁ করছে। কে একজন বলল দরবারে সমস্ত দর্শনার্থীদের জন্য দুপুরের খাবারের ব্যবস্থা করা হয়। তাই লঞ্চ থেকে নেমে লাঞ্চ না করে আমরা দরবারের খাবারের আহবান লুফে নিলাম। দুপুর সাড়ে বারটায় আমরা দরবারে পৌঁছলাম। বিশাল আস্তানা। অজস্র ভক্ত ঘুরে বেড়াচ্ছে। দরবারের আদব মোতাবেক আমরা জুতা , বেগ ইত্যাদি ষ্টোর বিভাগে জমা দিয়ে টুকেন নিলাম । দরবারের সামনেই সুন্দর একটা পুকুর। আমরা ওযু করে দরবারের মসজিদে জুহরের নামাজ আদায় করলাম। নামাজ শেষে সামনের বড় লম্বা উঠানে লম্বা দস্তরখান দিয়ে সবাইকে দুপুরের খানার ব্যবস্থা করা হল । খুব সুন্দর সুশৃঙ্খল ভাবে সব কিছু সম্পন্ন হচ্ছে দেখে ভাল লাগল । ভাত, ডাল আর আলুর তরকারি। মিনহাজ ভাই আর মামুন ভাই একটু মুখে দিয়েই উঠে গেল। একেবারেই বিস্বাদ। আমার তখন বেজায় ক্ষুধা। আমি তখন আবারও হল এর ক্যান্টিন এর খাবারের কথা তুলনাপূর্বক গলধকরনে মন দিলাম। খাওয়া সেরে দ্রুত আবার বেরিয়ে পড়লাম- দ্বীপটা ঘুরে দেখার জন্য মনটা অস্থির হয়ে আছে। কুতুবদিয়া শাহী দরবার থেকে প্রায় তিন মাইলের মত পশ্চিমে কুতুবদিয়া বাতিঘর। সমুদ্র দেবীর ভাঙ্গনের ফলে দ্বীপটা নিজেকে সঙ্কুচিত করে ফেলায় পুরনো বাতি ঘর এখন হাটু অবধি পানির মাঝে পরিত্যক্ত অবস্থায় ভেসে আসা জঞ্ছালের মত কাত হয়ে কাবু হয়ে থাকে। আমরা আর ও পথ মাড়ালাম না। সন্ধ্যার আগেই উপজেলা সদরে পৌঁছতে হবে। আমার ছাত্র টাইফুন সকালে লঞ্চে উঠার পর থেকেই যোগাযোগ রাখছিল । কুতুবদিয়ার পাশে মগনামা ঘাটে তাঁর বাড়ি। কুতুবদিয়ার নাড়ি নক্ষত্র তাঁর চেনা। আমরা দরবার সড়ক থেকে একটা জিপ গাড়ীতে উঠলাম। রাস্তার অবস্থা ভয়ঙ্ককর খারাপ। রাস্তার ধার ঘেঁষে বিস্তীর্ণ লবন উৎপাদন মাঠ। ভয়াবহ ঝাঁকুনি সহ্য করে অবশেষে বিকেল সাড়ে ৪ টায় আমরা উপজেলা সদরে পৌঁছলাম। টাইফুন সত্যিকারের টাইফুনের মতই ঝড়ের বেগে আমাদের রিসিভ করতে চলে এল। সে স্পীড বোটে সমুদ্র পাড়ি দিয়ে মগনামা ঘাট থেকে কুতুবদিয়া এসেছে আমাদের রিসিভ করার জন্য! প্রাথমিক আপ্যায়ন সেরে টাইফুন বলল যে জেলা পরিষদ ডাক বাংলো তে আমাদের থাকার ব্যবস্থা করা হয়েছে। সমুদ্রের পাশেই সুন্দর একটা বাংলো কিন্তু বুঝাই যায় যে এটা অবেহেলিত এবং সচরাচর এটার ব্যবহার হয়না। আমরা ২য় তলার একটা রুমে উঠলাম। আমাদের জন্য সবকিছু সহজ হয়ে উঠল টাইফুন আর ওর বন্ধুদের আন্তরিকতায়। বারবার এসে খোঁজ নিচ্ছে কিছু লাগবে, কিনা কোন অসুবিধা হচ্ছে কিনা। খানিক বিশ্রাম সেরেই আমরা সিদ্ধান্ত নিলাম এবার দেশের প্রথম বায়ু বিদ্যুৎ কেন্দ্রটি দেখতে যাব। টাইফুন কে সাথে নিয়ে আমরা বেরিয়ে পড়লাম। রিক্সা নিয়ে রওনা হলাম। ভাড়া ৩০ টাকা। অবাক হয়ে খেয়াল করলাম বিদ্যুৎ কেন্দ্রে যাওয়ার সড়কটি অসাধারন সুন্দর এবং নিখুঁতভাবে পিচঢালা। এর আগের দীর্ঘ ঝাঁকুনির তিক্ততা মুহূর্তে ভুলে গেলাম। রিক্সা থেকে যেখানে নামলাম সেখান থেকেই আদিগন্ত অবাধ্য সমুদ্রকে বেঁধে রাখা বাঁধের শুরু। জমানো কনক্রিটের স্লাব দিয়ে বাঁধানো এই দীর্ঘ বাঁধটি অসাধারন সুন্দর। একপাশে উত্তাল সমুদ্র অন্য পাশে পাথরের বাঁধ। এরকম নীল জলের সাগর আমি আগে দেখিনি। প্রমত্ত একেকটি ঢেউ এসে আছড়ে পড়ছে পাথরের গায়ে। এ যেন জলের তরল ফেনিল কোমলতা দিয়ে সাগরকন্যার পাথর-হৃদয় গলানোর অবিরাম অর্থহীন প্রচেষ্টা! নারীর কপালের লাল টিপের মতো সূর্যটা ধীরে ধীরে ডুবে যাচ্ছে। অন্ধকারের আঁচল গায়ে ধীর পায়ে নেমে আসছে সন্ধ্যা। জীবনানন্দ দাশের কবিতার কটি লাইন আমার মনে গুঞ্জরিত হয়ে উঠলঃ
"সমস্ত দিনের শেষে শিশিরের শব্দের মতন
সন্ধ্যা আসে; ডানার রৌদ্রের গন্ধ মুছে ফেলে চিল;
পৃথিবীর সব রঙ মুছে গেলে পাণ্ডুলিপি করে আয়োজন,
তখন গল্পের তরে জোনাকির রঙে ঝিলমিল।
সব পাখি ঘরে আসে — সব নদী; ফুরায় এ-জীবনের সব লেনদেন; থাকে শুধু অন্ধকার..."
অন্ধকার কে সাক্ষী রেখে আমরা বাংলোতে ফিরে এলাম। রাতের খাবার সেরে টাইফুন আর বন্ধুরা দাওয়াত দিল পূজা দেখার। ওদিন ছিল দুর্গাপূজার নবমীর রাত। আমি আর মামুন ভাই ঘুরতে বের হলাম। পূজামণ্ডপে গিয়ে দেখি বিরাট আনন্দ-যজ্ঞ। বিকট শব্দে হালের গান বাজছে আর তাঁর সাথে পাল্লা দিয়ে নেচে চলেছে তরুন-কিশোর-শিশুরা। উদ্দাম, উদ্দীপ্ত আর প্রাণের মেলা। একটা গান শুনে খুব মজা লাগল। এই গানটা অবশ্য টিভি খুললেই এখন বেজে উঠে-
"ও দারোগা, চোর পুলিশের পিরিত জমেছে...!!"
চোর আর পুলিশে পিরিতি হলে আইন শৃঙ্খলার যে কি হবে তা নিয়ে শঙ্কিত বোধ করলাম। কিছুক্ষণ থেকে আমরা বাংলোর পাশে সাগর তীরে চলে এলাম। একটা ভ্যান এর উপর বসে আছি আমরা দুজন। সামনে উথাল পাথাল সাগর, বিবাগী হাওয়ায় চুল উড়ছে আর আকাশ থেকে গলে গলে পড়ছে তরল জ্যোৎস্না। এমন রাত আমাকে মাতাল করে তোলে। আমি চন্দ্রাহত হয়ে বিবশ পড়ে থাকি। রাতের চেয়ে সুন্দর কিছু আর হয়না। দিনের বেলায় ও রাতের নেশায় বুঁদ হয়ে থাকি। কবি আবুল হাসান হয়তো আমার মতো মানুষের কথা ভেবেই লিখেছিলঃ
"যেখানেই যাই আমি সেখানেই রাত!
স্টেডিয়ামে খোলা আকাশের নিচে রেস্তোরাঁয়
অসীমা যেখানে তার অত নীল চোখের ভিতর
ধরেছে নিটোল দিন নিটোল দুপুর
সেখানে গেলেও তবু আমার কেবলই রাত
আমার কেবলই শুধু রাত হয়ে যায়...!!"
( কুতুবদিয়া পর্বের এখানেই ইতি। আগামী পর্বে ইচ্ছা আছে মহেশখালীর গল্প বলার)