চট্টগ্রাম কলেজে উচ্চ মাধ্যমিকে ভর্তি হওয়ার পর প্রথমেই যেই কথাটি শুনেছিলাম তা হলঃ 'এটি নাকি এক টুকরা জান্নাত, এখানে কোন সন্ত্রাস নাই, মারামারি নাই, যৌন নিপীড়ন নাই'। আর এসব সম্ভব হয়েছে ক্যাম্পাস টা শিবির নিয়ন্ত্রিত হওয়ার কারনে! ১ম বর্ষের ১ম সাময়িক পরীক্ষার ফলাফলের টেবুলেশন নিয়ে একদিন ক্লাসে ঢুকে পড়ল শিবির নেতারা। স্যার কে ক্লাসের বাইরে পাঠিয়ে দিয়ে ১ম বর্ষের 'শিবিরীয়' কমিটি ঘোষণা করা হল। ১ম সাময়িক পরীক্ষায় শীর্ষ স্থান অর্জনকারীদের বাধ্যতামুলকভাবে সেই কমিটির সদস্য করা হল-তাঁদের বেশিরভাগের অজান্তেই!! বিস্মিত আমি জানলাম-আমি নাকি 'বায়তুল-মাল- সম্পাদক'...!! পরীক্ষায় যৌথভাবে ১ম হওয়া সত্ত্বেও আমাকে 'সভাপতির' পদটি না দেয়ার সম্ভাব্য কারন ছিল হয়তো আমার 'দ্বীনি আমল' এর দুর্বলতা এবং মেয়ে বন্ধুর সংখ্যাধিক্য!
আমাদের মানবিক বিভাগের ক্লাসে ছেলেদের তুলনায় মেয়েদের সংখ্যা প্রায় দ্বিগুণের বেশি ছিল। সারাজীবন 'বয়েজ' স্কুলে পড়ে আসা এই আমি এই বিপুল মেয়েদের কাছ থেকে 'বায়তুল-মাল' আদায়ের গ্লানিতে কুঁকড়ে গেলাম। এক পর্যায়ে টিকতে না পেরে শিবিরের 'দায়িত্বশীল' দের হাতে পায়ে ধরে নিষ্কৃতি নিলাম। হাঁফ ছেড়ে বাঁচা গেল!
যাহোক, দিন যায় আর আমার এই জান্নাতের মোহ কর্পূরের মতো উবে যেতে থাকে, কলেজে ঢুকলে মনে হয় যেন কোন নিষিদ্ধ দুর্গে পা রেখেছি-চারপাশে শুধু নিষেধাজ্ঞার বেড়াজাল। ক্লাসে ছেলে এবং মেয়েদের আলাদা আসন ব্যবস্থা, একই ক্লাসে পড়ি কিন্তু ছেলে-মেয়ে কথা বলা পাপ, একসাথে বসা, আড্ডার তো প্রশ্নই আসেনা। কলেজে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান মানেই 'ইসলামী সঙ্গীত', নেতাদের জিহাদি বক্তব্য আর শিবিরের জয়গান। ক্যান্টিনের মাঝখানের অস্থায়ী দেয়াল তার দু'পাশের ছেলে-মেয়ের নীরব দীর্ঘশ্বাসের সাক্ষী হতে থাকে। শিবিরের দায়িত্বশীলরা (!) চারিদিকে সতর্ক সান্ত্রীর মতো ওঁত পেতে আছে 'যুগল' ধরার ব্যগ্রতায়! কোন ছেলে-মেয়ে কথা বলছে দেখলেই এরা অবধারিত ভাবে ধরে নেয়-এরা প্রেমিক, এরা এই জান্নাত কে পাপবিদ্ধ করছে!
আর এর অবধারিত ফলাফল- চট্টগ্রাম কলেজের আশপাশ ঘিরে অজস্র 'আঁধার' চাইনিজ রেস্তোরার ক্রমবিকাশ! সেই অন্ধকার নিরাপদ রেস্তোরাঁ গুলোয় নিশ্চয় আসমান থেকে 'এলিয়েন' রা এসে ডেটিং করেনা, এই রেস্তোরাঁ গুলোর খদ্দের দের অধিকাংশই এই জান্নাতি চট্টগ্রাম কলেজ আর মুহসিন কলেজের শিক্ষার্থীরা ! সুস্থ সম্পর্কের গলা টিপে ধরলে বিকৃত উপায়ে তাঁর বিস্তৃতি ঘটবে সেটাই স্বাভাবিক। কলেজের সেই দায়িত্বশীল শিবির-সান্ত্রীদের অনেক কেই আমি গোপনে বান্ধবী সমেত সেসব আঁধার জায়গায় ঢুকতে দেখেছি!
চট্টগ্রাম কলেজে পড়াকালীন আমার দুটি বছর সাংস্কৃতিক, মানবিক ভাবে বন্ধ্যা ছিল, মুক্ত বুদ্ধি আর মুক্ত চিন্তার বিকাশ রুদ্ধ ছিল, শিবির ছাড়া আর কোন রাজনৈতিক দলের দেখা পাইনি, এই দুটি বছর ছিল সাম্প্রদায়িকতার বছর, গোঁড়ামির বছর, ধর্মান্ধতার বছর। এই দুটি বছর আমাকে নারী-পুরুষের স্বাভাবিক, সুস্থ সম্পর্ক আর বন্ধুত্ব কে অশ্রদ্ধা করতে শিখিয়েছে।
পুনশ্চঃ অতঃপর আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়া লিখা করেছি এবং আমার বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিতরে বা আশেপাশে কোন অন্ধকার রেস্তোরাঁ ছিলনা, আজ ও নেই..!!