পারিবারিক জীবনে ভাঙ্গন ও বিপর্যয় অত্যন্ত মর্মান্তিক ব্যাপার। তালাক হচ্ছে এ বিপর্যয়ের চুড়ান্ত পরিণতি। পারিবারিক জীবনে চুড়ান্ত বিপর্যয় থেকে স্বামী স্ত্রী উভয়কে রক্ষার জন্য ইসলামে তালাকের সুযোগ সৃষ্টি করা হয়েছে। স্বামী স্ত্রীর মধ্যে যখন চরমভাবে বিরোধ দেখা দেয়,পরস্পর মিলে মিশে স্বামী স্ত্রী হিসেবে শান্তিপূর্ণ ও মাধুর্য মন্ডিত জীবন যাপন যখন একেবারেই অসম্ভব হয়ে দাঁড়ায়,পারস্পারিক সম্পর্ক যখন হয়েপড়ে তিক্ত, বিষাক্ত, একজনের মন যখন অপরজন থেকে এমন ভাবে বিমূখ হয়ে যায় যে, তাদের শুভ মিলনের আর কোন সম্ভাবনা থাকেনা; ঠিক তখনই এই চুড়ান্ত পন্থা অবলম্বনের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে ইসলামে।
তালাক কি?
আরবি-তে 'তালাক' শব্দের অর্থ হল কোনো কিছু ভেঙ্গে ফেলা বা ছিন্ন করা। বিবাহ-চুক্তির মাধ্যমে স্থাপিত সম্পর্ক আইনসিদ্ধ উপায়ে ভেঙ্গে দেওয়াকে মুসলিম আইনে 'তালাক' বা বিবাহবিচ্ছেদ বলে। মুসলিম আইনে বিবাহবিচ্ছেদ নর-নারীর একটি বৈধ ও স্বীকৃত অধিকার। স্বামী-স্ত্রীর পারস্পরিক সম্পর্ক যদি এমন পর্যায় পৌঁছয় যে, একসঙ্গে থাকা তাঁদের একজন বা দুজনের পক্ষেই সম্ভব হয় না, সেক্ষেত্রে কয়েকটি নির্দিষ্ট উপায়ে বিবাহ-বিচ্ছেদ ঘটানো যেতে পারে।
কি কি উপায়ে বিবাহ বিচ্ছেদ হতে পারে?
(ক) স্বামীর পক্ষ থেকে তালাক;
(খ) স্ত্রীর পক্ষ থেকে তালাক, যদি স্বামী স্ত্রীকে তালাক-ই-তৌফিজের ক্ষমতা দান করে থাকেন;
(গ) খুলার মাধ্যমে;
(ঘ) মুবারাতের মাধ্যমে;
(ঙ) আদালতের মাধ্যমে;
স্বামী কি যখন খুশি তখন তালাক দিতে পারে?
ইসলামী শরীয়া আইনে স্বামীর তালাক প্রদানের ক্ষমতা অসীম এবং শর্তহীন। স্বামী কোন কারন দর্শানো ছাড়াই স্ত্রীকে তালাক দিতে পারেন। কিন্তু স্ত্রীর তালাক প্রদানের ক্ষমতা অসীম নয় বরং শর্তযুক্ত যদি না স্বামী স্ত্রীকে তালাক প্রদানের ক্ষমতা অর্পণ করে। তালাক ইসলামে অনুমোদিত কিন্তু ঘৃণ্য একটি কাজ। নবী (সাঃ) তালাক সম্পর্কে বলেছেন তালাক অপেক্ষা ঘৃনার জিনিস আল্লাহ তায়ালা আর সৃষ্টি করেন নি হযরত আলী (রাঃ) হতে বর্ণিত নিম্নোক্ত বাণী হতে তালাকের ভয়াবহতা উপলদ্ধি করা যায়।তোমরা বিয়ে কর কিন্তু তালাক দিয়োনা কেননা,তালাক দিলে তার দরুন আল্লাহর আরশ কেঁপে উঠে। স্বামী যদিও বিনা কারনে আইনগতভাবে স্ত্রীকে তালাক প্রদানের অধিকারী কিন্তু ইসলাম স্বামীকে তালাক প্রদানের আগে নানান ভাবে সতর্ক হওয়ার আদেশ প্রদান করেছে এবং বিনা কারনে তালাক প্রদানে নিরুৎসাহিত করেছে। ইসলাম বারবার স্বামীকে সতর্ক করেছে যেন সে তার প্রেয়সী স্ত্রীর সাথে নূন্যতম খারাপ আচরণ না করে। হাদীসে ঘোষণা দিয়েছে, “তোমাদের মধ্যে সর্বোত্তম সে-ই, যে তার স্ত্রীর কাছে উত্তম”। উপদেশ দিয়েছে- “দেখো, যদি তুমি তার (স্ত্রীর) একটি আচরণে অসন্তুষ্ট হও, তা হলে তার অন্য কোন আচরণ নিশ্চয় তোমাকে মুগ্ধ করবে। ফলে সে দিকে লক্ষ্য করে তা ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখো।” (হাদীসের মর্মার্থ) এভাবে বারবার বিভিন্ন ভাবে স্বামীকে ভালো আচরণ করার নির্দেশ দিয়ে বলেছে, একান্তই যদি তোমার সাথে মিল না হয় তবে তাকে বোঝাও। এতেও না হলে একই খাটে আলাদা আলাদা শয়ন করো। এরপর ভিন্ন খাটে শোও। অতপর ভিন্ন ঘরে রাত্রি যাপন কর, এভাবেও ঠিক না হলে উভয় পরিবারের লোক দিয়ে মিটমাট করার চেষ্টা করো। তাতেও সমাধান না হলে তখনি তালাকের বিধান কার্যকর করার উপদেশ দেয়া হয়েছে। যে ইসলামের সত্যিকার অনুসারী সে কখনো এই বিধানকে অগ্রাহ্য করে একত্রে তিন তালাক দিয়ে বিবাহ বন্ধন ছিন্ন করবেনা এমনটাই প্রত্যাশিত। কারন এক সঙ্গে তিন তালাক দেয়াকে রাসূল স. ও তাঁর সাহাবীগণ প্রচন্ড রকম অপছন্দ করতেন। এ জন্য একসঙ্গে তিন তালাককে বিদাতী তালাক বলা হয় ফিকহের পরিভাষায়। মূলত তালাক দেয়ার সুন্নাহ সমর্থিত নিয়ম হলো, একবার কেবল এক তালাক দেয়া। এরপর তিন ঋতু পর্যন্ত অপেক্ষা করা। যদি বনিবনা হয়ে যায়, তাহলে এর মধ্যে ঋতু পরবর্তী পবিত্রতাকালীন সময়ে স্বামী তার স্ত্রীকে ফিরিয়ে নিতে পারবে। আর যদি বনিবনা না হয়, তাহলে তিন ঋতু অতিবাহিত হলে বিবাহ ভেঙে যাবে। কিন্তু মুখে তিন তালাক একত্রে উচ্চারণ করলে ঠিক ই তালাক কার্যকর হয়ে যাবে শরীয়া আইন অনুসারে এবং স্ত্রী তাঁর স্বামীর জন্য হারাম হয়ে যাবে, তাঁদের তালাক পরবর্তী দৈহিক সম্পর্ক জেনা হিসেবে গন্য হবে এবং উদ্ভূত সন্তান অবৈধ বলে পরিগনিত হবে। এখানে বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় আইনের সাথে শরীয়া আইনের একটি বিরোধ রয়েছে। তাহল- বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় আইনে মুখে পরপর তিনবার 'তালাক' উচ্চারণ করলে অথবা একসাথে 'বায়েন তালাক' কথাটি বললেই তালাক কার্যকরী হয় না। ১৯৬১ সালের মুসলিম পারিবারিক আইন অধ্যাদেশের ৭ (১) ধারা অনুযায়ী, স্বামী তালাক দেবার পরপরই তালাক দেবার সংবাদটি একটি নোটিশের মাধ্যমে চেয়ারম্যানকে (যে চেয়ারম্যানের এলাকায় স্ত্রী বাস করছেন) জানাতে হবে।সেই নোটিশের একটি কপি স্ত্রীকে পাঠাতে স্বামী বাধ্য। স্বামী যদি চেয়ারম্যান এবং স্ত্রীকে তালাকের নোটিশ না পাঠান, তবে ঐ একই আইনের ৭ (২) ধারা অনুযায়ে স্বামী এক বছর পর্যন্ত কারাদণ্ড বা দশ হাজার টাকা জরিমানা অথবা অথবা দুটি দণ্ডেই দণ্ডিত হবেন। নোটিশ পাবার ত্রিশ দিনের মধ্যে চেয়ারম্যান স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে পুনর্মিলন ঘটানোর উদ্দেশ্যে উভয়পক্ষের প্রতিনিধিদের নিয়ে একটি সালিশী পরিষদ গঠন করবেন এবং তাঁদের মধ্যে সমঝোতা আনার প্রয়োজনীয় সমস্ত ব্যবস্থা নেবেন। কিন্তু সালিশীতে যদি কাজ না হয় এবং নোটিশ দেবার ৯০ দিনের মধ্যে স্বামী যদি স্ত্রীকে দেওয়া নোটিশ প্রত্যাহার না করেন, তবে ৯০ দিন পরে তালাক কার্যকরী হবে। ৯০ দিন পার না হওয়া পর্যন্ত দম্পতিকে আইনসিদ্ধ স্বামী-স্ত্রী হিসেবেই ধরা হবে এবং স্ত্রী ভরণপোষণও পাবে। প্রসঙ্গত উল্লেখযোগ্য যে, মুসলিম পারিবারিক অধ্যাদেশ ১৯৬১ -এর ৭(১) নং ধারা অনুযায়ী - চেয়ারম্যান ও স্ত্রীকে নোটিশ না পাঠালে স্বামী শাস্তি পাবেন ঠিকই, কিন্তু তালাক বাতিল হবে না। তালাক কার্যকরী হবে। (সম্প্রতি একটি মামলায় (মোহাম্মদ সিরাজুল ইসলাম বনাম মোছা:হেলেনা বেগম ও অন্যান্য। সিভিল রিভিশন নং ৬৯৮, ১৯৯২) এ মর্মেই রায় দেওয়া হয়েছে।)
৯০ দিন অতিক্রান্ত হবার আগে কি তালাক প্রত্যাহার করা যাবে?
হ্যাঁ, এই ৯০ দিন অতিক্রান্ত হবার আগে অবশ্যই তালাক প্রত্যাহার করা যাবে। এই সময়টা এইজন্যই রাখা হয়েছে যাতে করে স্বামী-স্ত্রী উভয়পক্ষই ঠাণ্ডা মাথায় সব কিছু ভেবেচিন্তে সিদ্ধান্ত নিতে পারেন - পারস্পরিক আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে সমঝোতায় আসতে পারেন।
বিচ্ছেদ প্রাপ্ত স্বামী কি আবার আগের স্ত্রীকে বিয়ে করতে পারে?
আগেই বলেছি শরীয়া আইন অনুসারে বিচ্ছেদ প্রাপ্ত স্বামী স্ত্রী কে হিলা বিয়ে ব্যতীত পুনরায় গ্রহণ করতে পারেনা। হিল্লা শব্দটি আরবী حلة থেকে এসেছে। এর অর্থ বৈধতা/ বৈধ করণ। চূড়ান্ত বিচ্ছেদের পর ইদ্দত পালন শেষে স্ত্রীর যদি অন্য কোন পুরুষের সাথে বিবাহ ঘটে এবং স্ত্রীর ২য় স্বামী যদি মারা যায় অথবা তাঁকে তালাক দেয় তবে ইদ্দত পালন শেষে প্রথম স্বামী ইচ্ছে করলে পুনরায় তাকে গ্রহণ করতে পারে। তা হলে এমতাবস্থায় মাঝের এই বিয়েটা হিল্লা বা প্রথম স্বামীর জন্য বৈধ করণ বলে গণ্য হলো। আর এ কারণেই একে হিল্লা বিয়ে বলা হয়।
কিন্তু আজকাল যা হয় তা হলো, নাটকের ন্যায় স্ত্রীকে চুক্তির মাধ্যমে দ্বিতীয় কোন স্বামীর কাছে বিবাহ দেওয়া হয়। এক্ষেত্রে অনেক সময় ২য় স্বামীর সাথে আর্থিক লেনদেন ও করা হয়ে থাকে। যেন সে এক রাত কাটিয়ে তালাক দিয়ে দেয় এবং প্রথম স্বামী তাকে পুণরায় গ্রহণ করে নিতে পারে। অনেক সময় ২য় স্বামীর সাথে এমন চুক্তিও করা হয় যে সে ওই স্ত্রীর সাথে রাত্রি যাপন করবে কিন্তু দৈহিক সম্পর্ক করতে পারবেনা। এই ধরনের চুক্তিভিত্তিক হিলা বিয়ে ইসলাম সম্মত নয়। নবীজী (স) এ কাজে কঠোর অভিশাপ দিয়েছেন। এতে মূলত নারীকে অবহেলার বস্তুতে পরিণত করা হয়।
এতক্ষণ যা বললাম তা শরীয়ার বিধান। কিন্তু রাষ্ট্রীয় আইনে এই বিধানের আমূল পরিবর্তন করা হয়েছে।
১৯৬১ সনের মুসলিম পারিবারিক আইন অধ্যাদেশ এর ৭ (৬) ধারা অনুযায়ী তালাকের মাধ্যমে কোন বিবাহবিচ্ছেদ ঘটলে, তালাক হওয়া দম্পতি আবার বিয়ে করতে চাইলে নতুন করে বিয়ে করতে হবে। তবে তার জন্য মধ্যবর্তী বা হিল্লা বিয়ের কোনো প্রয়োজন নেই। ১৯৬১ সালের মুসলিম পারিবারিক আইন অধ্যাদেশের মাধ্যমে 'হিল্লা' বিয়েকে নিষিদ্ধ করা হয়েছে। কিন্তু ওই একই অধ্যাদেশ অনুযায়ী স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে যদি তিনবারের বেশি বিবাহ বিচ্ছেদ হয়ে থাকে তবে হিলা বিয়ে ব্যতীত তাঁরা আর পরস্পরকে বিয়ে করতে পারবেনা। একবার হিলা বিয়েকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করে আবার তিন বার বিচ্ছেদের পর সেই হিলা বিয়েকে পুনর্বিবাহের শর্ত হিসেবে যুক্ত করা এই অধ্যাদেশের একটি স্ববিরোধীতা ছাড়া আর কিছু নয়।
স্ত্রী কীভাবে স্বামীকে তালাক দিতে পারে?
(১) তালাক-ই-তৌফিজের মাধ্যমে
(২) খুলার মাধ্যমে
(৩) মোবারাতের মাধ্যমে
(৪) আদালতে আবেদনের মাধ্যম
খুলা বিচ্ছেদ কাকে বলেঃ
যদি স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে পারস্পরিক বনিবনা ভাল না থাকে, তবে স্ত্রী অর্থ বা সম্পত্তির বিনিময়ে স্বামীকে বিচ্ছেদ ঘটাতে রাজী করাতে পারে। যেহেতু অধিকাংশ নারীর সম্পত্তি থাকে না অথবা সম্পত্তি থাকলেও তা নিয়ন্ত্রণ করার ক্ষমতা থাকে না, সেক্ষেত্রে স্ত্রী মোহরানা বা মোহরানার অংশ দিয়ে স্বামীকে তালাক দিতে রাজী করানোর চেষ্টা করতে পারেন।
মোবারাতঃ
যে ক্ষেত্রে স্বামী ও স্ত্রী, উভয়ই একে অন্যের প্রতি বিরূপ মনোভাব পোষণ করেন এবং তাঁরা চুক্তির মাধ্যমে তাঁদের বিয়ের বিচ্ছেদ ঘটান, তখন বলা মোবারাত। খুলার মত মোবারাতও এক ধরণের চুক্তি-ভিত্তিক বিবাহবিচ্ছেদ।
তালাক-ই-তৌফিজ এবং কাবিননামার ১৮ নং কলামঃ
তালাক-ই-তৌফিজ স্ত্রীর নিজস্ব ক্ষমতা নয়। স্বামী যদি স্ত্রীকে তালাক প্রদানের ক্ষমতা দেয়, তবে স্ত্রীও স্বামীর মতো তালাক দিতে পারে। সেক্ষেত্রে স্ত্রীকেও স্বামীর মতো তালাকের নোটিশ চেয়ারম্যানের কাছে পাঠাতে এবং এক কপি স্বামীর কাছে পাঠাতে হবে। স্ত্রীর এই তালাক দেওয়ার ক্ষমতাকে তালাক-ই-তৌফিজ বলে।
নিকাহনামা/কাবিননামার ১৮ নং ঘরে "স্বামী স্ত্রীকে তালাক প্রদানের ক্ষমতা অর্পণ করছে কি না? করে থাকলে কী শর্তে?" এই প্রশ্নটি থাকে। স্বামীর একতরফা ক্ষমতার কারণে স্ত্রীকে বহু নির্যাতন সহ্য করেও স্বামীর সাথে থাকতে হয়। ১৯৩৯ সালের মুসলিম বিবাহবিচ্ছেদ আইনে বর্ণিত শর্তগুলো (যেমন, নির্যাতন, নিরুদ্দেশ) না থাকলে বা খুলা কিংবা মুবারাতের মাধ্যমে হুলার স্বামীর কাছ থেকে বিচ্ছেদ না পেলে একটি মেয়ের পক্ষে বিয়ে থেকে মুক্তি পাওয়া অসম্ভব। সেক্ষেত্রে স্ত্রী অপেক্ষাকৃত কম জটিলতায় তালাক-ই-তৌফিজের মাধ্যমে মুক্তি পেতে পারে। তাই এর গুরুত্ব অপরিসীম। নিকাহ্নামার ১৮ নং ঘরটি এজন্য অত্যন্ত গুরুত্বের সাথে পূরণ করা উচিত। অনেক সময় কাজীরা এ প্রশ্ন করেন না এবং ঘরটি শূন্য থাকে। আবার অনেক সময় এই ঘরটি পূরণ করার কথা বললে বর পক্ষের অনেক মুরুব্বী বলে থাকেন বিয়ের মতো এরকম একটি শুভ কাজের সময় কেন তালাকের মতো অশুভ ব্যাপার নিয়ে ঘাটাঘাটি? এভাবে কৌশলে বরপক্ষের লোকজন এই ব্যাপারটি উপেক্ষা করে যায় আবার কনে পক্ষের লোকজন সংকোচ বা লজ্জায় এই ঘরটি পূরণ করেন না। ফলে কখনো দাম্পত্য কলহ তৈরি হলে মেয়েটি তালাকের এই অধিকারটি প্রয়োগ করতে পারেনা, তাঁকে খুলা বা মুবারাতের আশ্রয় নিতে হয়। কিন্তু সেখানেও স্বামীর সম্মতি প্রয়োজন। স্বামী স্বেচ্ছায় রাজি না থাকলে এই প্রক্রিয়ায়ও বিয়ে ছিন্ন করা সম্ভব হয়না। শেষ ভরসা হল আদালতের মাধ্যমে বিবাহ বিচ্ছেদের আবেদন করা। কিন্তু আইনে উল্লেখিত ঘটনা না ঘটলে বা নির্দিষ্ট শর্তসমূহ পূরণ না হলে এই প্রক্রিয়ায় ও বিবাহ বিচ্ছেদ অসম্ভব। তাছাড়া বাংলাদেশের সমাজ বাস্তবতায় আদালতের মাধ্যমে বিবাহ বিচ্ছেদ একজন নারীর জন্য সময় এবং অর্থ সাপেক্ষ। এছাড়া সামাজিক অপমানবোধের ব্যাপার তো রয়েছেই। তাই কাবিননামার ১৮ নং কলামে Tick চিহ্ন দিয়ে তালাকে তউফিজের অধিকার নিশ্চিত করা প্রতিটি মেয়ের জন্য অবশ্য কর্তব্য। অভিভাবকদের সচেতনতাও এক্ষেত্রে খুব জরুরী। আর কাজীদের অবশ্যই দুপক্ষকে দিয়ে ঘরটি সম্পর্কে অবগত করানো উচিত।
স্ত্রী কর্তৃক আদালতে আবেদন মাধ্যমে তালাকঃ
১৯৩৯ সালের মুসলিম বিবাহ বিচ্ছেদ আইনের অধীনে স্ত্রী নিম্নোক্ত ৯টি কারণের যে কোনো এক বা একাধিকের ভিত্তিতে আদালতে বিবাহ বিচ্ছেদ প্রার্থনা করতে পারেন:
(১) স্বামী ৪ বছরের অধিক সময় নিরুদ্দেশ থাকলে;
(২) দুই বছর যাবত্ স্ত্রীর খোরপোষ দিতে স্বামী ব্যর্থ হলে;
(৩) স্বামী ১৯৬১ সালের মুসলিম পারিবারিক আইনের বিধান লঙঘন করে অতিরিক্ত স্ত্রী গ্রহণ করলে;
(৪) স্বামী সাত বছর বা তার বেশি সময় কারাদণ্ডে দণ্ডিত হলে;
(৫) কোনো যুক্তি-সঙ্গত কারণ ছাড়া তিন বছর ধরে স্বামী তাঁর দাম্পত্য দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হলে;
(৬) স্বামী বিয়ের সময় পুরুষত্বহীন থাকলে এবং তা মামলা দায়ের করার সময়পর্যন্ত বজায় থাকলে;
(৭) স্বামী দুই বছর ধরে পাগল থাকলে অথবা মারাত্বক যৌনব্যধিতে আক্রান্ত থাকলে;
(৮) নাবালিকা অবস্থায় বিয়ে হয়ে থাকলে অথবা সাবালকত্ব লাভের পর অর্থাত্ ১৮ বছর পূর্ণ হবার পর স্ত্রীর বিয়ে অস্বীকার করলে (কিন্তু এক্ষেত্রে স্বামীর সঙ্গে যৌন সম্পর্ক স্থাপিত হয়ে থাকলে এরকম মামলা দায়ের করা যাবে না)
(৯) নিম্নলিখিত যে কোনো অর্থে স্ত্রীর সাথে স্বামী নিষ্ঠুর আচরণ করলে:
(ক) যদি স্ত্রীকে শারীরিক বা মানসিক নির্যাতন করা;
(খ) কুখ্যাত মহিলাদের (women of ill reputation) সঙ্গে স্বামীর মেলামেশা করা কিংবা নৈতিকতা-বর্জিত জীবন যাপন করা।
(গ) নৈতিকতা-বর্জিত জীবন যাপনের জন্য স্ত্রীকে বাধ্য করা;
(ঘ) স্ত্রীর সম্পত্তি হস্তান্তর করা, কিংবা স্ত্রীকে তার সম্পত্তির বৈধ অধিকার প্রয়োগে দেওয়া;
(ঙ) স্ত্রীকে তার ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠান পালনে বাধা দেওয়া;
(চ ) যদি স্বামীর একাধিক স্ত্রী থাকে, তবে পবিত্র কোরানের নির্দেশে তাদের সাথে সমান ব্যবহার না করা;
তবে উপরোক্ত কারণগুলির ভিত্তিতে মামলা দায়ের করতে হলে স্ত্রীর কাছে সুনির্দিষ্ট সাক্ষ্যপ্রমাণ থাকতে হবে।
তালাক কখন কার্যকরী হয় না?
গর্ভবতী অবস্থায় তালাক দিলে সন্তান প্রসব না হওয়া পর্যন্ত তালাক কার্যকরী হবে না। সন্তানের বৈধতা বা পিতৃত্ব নির্ধারণের জন্যই এ আইন তৈরি করা হয়েছে।
(বিয়ে মানবজীবনের সুন্দরতম একটি সম্পর্ক। ভালবাসা-প্রেমে-শ্রদ্ধায়-মমতায় এই বন্ধনে নারী পুরুষ আমৃত্যু আবদ্ধ থাকবে এটাই আমাদের চাওয়া। কারো জীবনে তালাকের নির্মম খড়গ নেমে আসুক, আমরা কেউ নিশ্চয় তা চাইনা-তারপরও তালাক জীবনের কঠিন বাস্তবতা। কেউ যদি এই বাস্তবতার সম্মুখীন হয় সে যেন আইনের মারপ্যাঁচে দেশেহারা না হয়ে পড়ে, তাঁর অধিকার থেকে অন্য কেউ যেন তাঁকে বঞ্চিত না করতে পারে, সেই সচেতনতা তৈরির উদ্দেশেই এই লিখা।
আইনের ব্যাখ্যায় কোন ভুল হলে ক্ষমাপ্রার্থী। এক্ষেত্রে যে কোন সংশোধন আমাকে সমৃদ্ধ করবে। সবাই ভাল থাকুন।
সর্বশেষ এডিট : ০৭ ই জানুয়ারি, ২০১৩ রাত ১০:২৬