মুখবন্ধ: গল্পটির সাথে কারো নাম জড়িয়ে গেলে সে ক্ষেত্রে লেখকের কিছু করার নেই, তবে গল্পটি একটি অনুবাদ থেকে নিয়ে কিছু মারিং/কাটিং করে তবে প্রকাশ করছি। গল্পটি কোথায় যেনো পড়েছিলাম কিন্তু মনে করতে পারছি না, যাই হউক, শুধুমাত্র বিনোদনের জন্য আপনাদের সমীপে পেশ করছি।
পরিকল্পিত মার্ডার
“ঢাকা ডিজিটাল মানষিক হাসপাতাল”
মতিঝিলের কাছেই বাংলাদেশ ব্যাঙ্কের পিছনে বেশ বড়োসড়ো জায়গা নিয়ে গড়া হয়েছে, এখানে সব ধরনের সুযোগ সুবিধা আছে, যেমন আছে বই পড়ার জন্য লাইব্রেরী, পত্র-পত্রিকা কয়েকটি রাখা হয়, আরও আছে খেলা-ধুলা, কম্পিউটার সহ গান-বাজনার ব্যবস্হা, যার যা ইচ্ছা করবে, সে তেমনটা করবে, তবে অনীতি করলে, ক্ষতি করলে এমনকি কাউকে মারধোর করলে আছে অমানবিক পৈশাচিক শাস্তি যার কিছুই এখন পূর্যন্ত আমাকে পেতে হয় নি।, আমি একা একটি ঘরে থাকি, এই হাসপাতালের নিয়ম কানুন খুবই কড়া, বাইরে থেকে কেউ যেমন আসতে পারে না তেমনি বাইরে যাওয়া একপ্রকার বেসম্ভব।
আমার ঘরের দুই পাশেই জানালা, সে জানালা দিয়ে গাছ-গাছালি ও মুক্ত আকাশটাকে দেখে দেখে সময় পার করি, এখানে বেশ কিছু ঝোপ-ঝাড় আছে, মাঝে মাঝে আমি মালীকে হেল্প করি, ঝোপ-ঝাড় সহ নাম না জানা গাছগুলোর নাম জেনে নোট বইয়ে টুকে রাখি, মনে মনে ভাবি, ইস, যদি একটা ল্যাপটপ থাকতো তবে বেশ ভালো হতো। সারাক্ষণ যে আমাকে রুমে কাটাতে হয় বা বাগানে ঘুরতে হয় তা কিন্তু নয়, মাঝে সাঝে অন্য রোগীদের সঙ্গে কথা বলা, সঙ্গ দেওয়া, খেলাধুলাও করতে হয়। অনেকে ইচ্ছামতো কাজ করতো যেমন আমি লেখালেখি করি। আর সময় পেলে ছোট ছোট সিরামিকের টাইলস বানায় আর চেষ্টা করি বেতের ঝুড়ি বানাতে।
এবার আসা যাক, আমি কেন এই মানষিক হাসপাতালে? তাই না? খুবই সাধারণ ঘটনা, এক বিকেলে অফিস থেকে বেড়িয়ে পড়লাম, ব্যাঙ্কে লাখ দুয়েক টাকার মতো আছে, ব্যাঙ্কটি আমার অফিসের কাছেই, ব্যাঙ্কটি আমেরিকান ব্যাঙ্ক। ব্যাঙ্কে গিয়ে টাকা সব তুলে নিলাম, পাচঁশত টাকার দুশো নোট। টাকা তুলে উদ্দেশ্যহীন কিছুক্ষণ ঘোরাঘুরি করলাম, ঘন্টা দুয়েক এইরুপ ঘুরে মৌচাকের মোড়ের দিকে এসেই আমি এমন কাজ শুরু করলাম যা কিনা পাগল না হলে কেউ করে না। পাচঁশত টাকার একেকটা নোট মাত্র বিশ টাকায় বিক্রী করা শুরু করলাম, প্রথমে অনেকে ভাবলো নোটগুলো দুই নম্বর, যখন বুঝতে পারলো যে নোটগুলো জাল নয়, তখন ধুন্ধুধুমার কান্ড বেধে গেলো, কার আগে কে কিনবে। কাউকে কাউকে শুধু তার টাইয়ের বিনিময়ে পাচশত টাকা দিচ্ছিলাম, এমনকি মুখে থাকা জ্বলন্ত সিগারেটও এক হাজার টাকায় কিনতে চাচ্ছিলাম, যদিও দুইটা নোটের বেশী আমি কাউকে দিচ্ছিলাম না, এমন করতে গিয়ে যা হয় আর কি, পুলিশ আসলো, আমাকে এরেষ্ট করা হলো, পুলিশ যখন আমাকে টেনে গাড়ীর দিকে নিয়ে যাচ্ছিলো তখন আমি বাদ বাকী টাকা বাতাসে উড়িয়ে দিলাম, কয়েকজন কনষ্টেবলও দৌড়ে গেলো কড়কড়ে টাকা বাতাস থেকে ধরার জন্য। সে এক কান্ড দেখালাম বটে।
জেলখানায় চালান হয়েই এক্কেবারে চুপচাপ মেরে গেলাম। অনেকে আমার ঘটনা জানলো, কারণ জাতীয় দৈনিকগুলোতে ছবি সহ ঘটনা প্রকাশ করলো, টিভিতে ব্রেকিং নিউজে আমার পাগলামী দেখানো হলো, যোগাযোগ মাধ্যম, ফেইসবুকসহ বিভিন্ন ব্লগে আমাকে নিয়ে ঝড় উঠলো, সবারই কথা আমি পাগল বা মাথা খারাপ রোগী। ফলে অনেক পুলিশ, কারাকর্মীরা জানতে চেষ্টা করতে লাগলো, কেন আমি এমন ঘটনা করলাম, অনেক বন্দী আমাকে পাগল বলে গালাগাল করতে লাগলো। কিন্তু আমি চুপটি করে বসে থাকতাম। এদিকে আমার বউ রোজলীন জেলখানায় কয়েকবার এসেছিলো। বেশ কান্নাকাটি করলো। কারাকক্ষের লোকগুলো যতো না রোজলীনের প্রতি মনোযোগ দিচ্ছিলো, তার চাইতে বেশী উপভোগ করচ্ছিলো একজন পাগলের বউ হিসাবে, কেউ কেউ তার সাথে মশকারী ও করছিলো সমান তালে।
রোজলীন যতবার আসতো আমি তাকে দেখলে আমার ভাবভঙ্গি হিংস্র করে ফেলতাম, গালাগালি করা থেকে চেয়ার পূর্যন্ত ছুড়ে মারা শুরু করলাম। ফলে আমাকে ঘুমের ইনজেকশন দেওয়া হলো। তখনো আমাকে “ঢাকা ডিজিটাল মানষিক হাসপাতালে পাঠানো হয় নি। প্রায় সপ্তাহখানেক পর আচমকা আমি আবার স্বাভাবিক হয়ে উঠলাম এবং কারারক্ষক’কে প্রশ্ন করে জানতে চাইলাম, ‘আমি এখানে কেন? এ জায়গাটাই বা কোথায়? কারারক্ষক উত্তর দিয়ে জানালো গত কিছুদিনের কথা, কিন্তু কোনো ঘটনায় আমার মনে পড়ছে না, কি ঘটেছিলো, এমন ভাব দেখাতে শুরু করে দিলাম।
জেলখানার নিয়মানুযায়ী আমার জন্য একজন মনোবিদ নিয়োগ দেওয়া হলো। মনোবিদের সাথে ভালো আচরণ করলাম, তাকে জানালাম বিগত কিছুদিন কাজের চাপ বড্ডো বেশী ছিলো, হাড়-ভাঙ্গা খাটুনি খাটতে হয়েছে আমাকে, এতে মনোবিদ বুঝতে পারলো আমার টাকা বিক্রীর বিষয়টি আসলে কাজের চাপ থেকেই তৈরী, মনোবিদের মতে, আমি আমার অবচেতন মনে সেই পরিশ্রম পছন্দ করছিলাম না, তাই আমার কষ্টের ফসল বিলিয়ে দিতে চেয়েছি, এতে নাকি দোষের কিছু নেই, এমনি করে বেশ কয়েকবার সিটিং দিয়ে অবশেষে আমি জেল থেকে ছাড়া পেলাম।
এই ঘটনার দু’মাস পর আরেকটি ঘটনা ঘটালাম। কথাবার্তা ছাড়া আমি এগারো তলা বিল্ডিং দিয়ে আমার সামনে রাখা মনিটর ছুড়ে মারলাম, যা কাচ ভেঙ্গে বাইরে চলে গিয়ে নীচে দাড়াঁনো গাড়ীর উপর পড়লো, এতে অবশ্য কেউ আহত হয়নি শুধু গাড়ীর ক্ষতি হয়েছে। আমি নাকি নিজেও জাম্প দিতে চেয়েছিলাম কিন্তু আমার সহকর্মীদের জন্য আমি পারলাম না। আমি আরও যা করলাম তা হলো হাত পা ছুড়ে ছুটে গিয়ে আমার সেক্রেটারী জুন ডায়েসের কনুই আর পেটে কামড় বসিয়ে দিলাম, অফিসের বেয়ারা রঞ্জনকে লাথি কষালাম কয়েকবার। কয়েকজন ঘুষি খেলো ঠিকই কিন্তু আমাকে কেউ ছাড়লো না।
এরপর “ঢাকা ডিজিটাল মানষিক হাসপাতালে” আমার জায়গা পাকা হয়ে গেলো। জায়গাটা আমার বেশ ভালই লেগে গেলো, কোনো কাজ নেই, দায়-দায়িত্ব নেই, এটা যে একটা পাগলাগারদ এমন অনুভূতিই হয় না এখানে। বর্তমান সরকার আসলে উন্নতি করছে দেশের। যা করতে চাই, সব এখানে সম্ভব, যেমন নার্সকে গালাগাল দিতে ইচ্ছা করছে, তা শ্লীলতার মাঝে দেওয়া যাবে। মন চাইলো, ওয়াশরুমে ওয়াশ না করে অন্য কারো রুমে ওয়াশ দিয়ে এলাম, কেউ কিছু বলবে না। কি মজা না?
প্রতি শুক্রবার রোজলীন দেখতে আসতো, জায়গাটা আমার ভালো লাগতো এইজন্য যে প্রতি সপ্তাহে একদিন রোজলীনকে দেখতে পাওয়ার চাইতেও যে বাকী ছয়দিন তার কাছ থেকে দূরে আছি এজন্য ভালো লাগতো। তবে যতদিন যাচ্ছে ততই রোজলীনকে আমার অসহ্য লাগছে, তেরো বছর অসহ্য জীবন কাটিয়েছি, একবার ডির্ভোস দিবো ভেবে উকিলও ধরেছিলাম কিন্তু ডির্ভোস দিলে যে আমার সব কিছু তার হয়ে যাবে আবার মাসে মাসে একটা মোটা অঙ্কের টাকাও তাকে দিতে হবে, এইসব ভেবে পিছিয়ে এসেছিলাম। এই হাসপাতালে আমি বেশ শান্ত থাকতাম বটে তবে রোজলীনকে দেখলেই আমি পাগলামী শুরু করে দিতাম। কিছু না পারলে তাকে অকথ্য ভাষায় গালাগালি করতাম, তাকে মাহাবুব, মিজান ইত্যাদি ব্যাক্তির সাথে পরকীয়ার অপবাদ ও কম দেয়নি, কিন্তু রোজলীন সব সহ্য করে আবারও পরের শুক্রবার হাজির হতো। কি যে যন্ত্রণাময় সে সময়টা তা বলে বুঝানো যাবে না।
মনোবিদ আমার সাথে কথা বলতে আসতো। আমরা বিভিন্ন বিষয় নিয়ে কথা বলতাম। রোজলীনের বিষয়েও কথা হতো, সবশেষে প্রায় ছয় মাস পর আবারও আমাকে সুস্ত ঘোষনা করা হলো, আমি মানষিক হাসপাতাল থেকে বেড়িয়ে এলাম।
এসেই এবার সুস্ত স্বাভাবিক জীবন যাপন শুরু করছিলাম, নিজেই গাড়ী ড্রাইভ করছি, অফিস করছি, প্রতি রবিবার রোজলীনকে নিয়ে গির্জায় যাচ্ছি, প্রথম প্রথম রোজলীনের বন্ধুরা-বান্ধবীরা একটু অসংকোচ করতো বটে তবে আস্তে আস্তে তাও কেটে যেতে লাগলো, আমি মোটামুটি সুস্ত, তবে মাঝে মাঝে বিড়বিড় করতাম, উল্টাপাল্টা বকাবকি করতাম, অন্যকে প্রশ্ন করলে আমি আগ বাড়িয়ে উত্তর দিতাম, এতে অনেকে আমার সাথে সহজ হতে পারছিলো না। তবে আমার বিষয়ে সকলে একবাক্যে বলতো, একটু আধটু পাগলামী আছে বটে কিন্তু ক্ষতিকর না। এইভাবে আস্তে আস্তে আমি একটু আধটু পাগলামিও কমিয়ে দেওয়া শুরু করে রীতিমতো ভালো মানুষ হওয়ার চেষ্টা করছিলাম, কোনো পার্টি থাকলে তাতে এটেন্ড করতাম, রোজীনের সাথে নেচে গেয়ে বেশ দিনগুলো পার করছিলাম।
এক রবিবার আমি আর রোজলীনের দাওয়াত ছিলো। বহুদিনের পুরাতন বন্ধু টিটু স্বপরিবারে দাওয়াত দিয়েছে, আমার মনে হলো এইটাই মনে হয় শেষ সুযোগ.....। প্ল্যানটা আমি কষা শুরু করলাম, একদম চুপচাপ থাকবো, একটা ড্রিংক নেবো, ফায়ার প্লেসের পাশেই বসবো। আস্তে আস্তে ড্রিংক শেষ করবো, কেউ প্রশ্ন করলে শূণ্যদৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে থাকবো, মুখের মাংসপেশিকে বেহুদা নাড়াতে থাকবো..... এইভাবে শুরুটা হবে...তারপর?
তারপর ঘন্টাখানেক পেরোলে আচানক উঠে দাড়িয়েঁ হাতের গ্লাস ছুড়ে মারবো কোনও আয়নার দিকে, অন্তত গ্লাসটাতো ভাঙ্গবে বা দুটোই ভেঙ্গে যাক, কেউ না কেউ নিশ্চয় আমাকে থামাতে আসবে, যেই আসুক না কেনো, পায়ের সমস্ত শক্তি দিয়ে তাকে একটা লাথি কষিয়ে দিবো, এরপর ধীর পায়ে আগুনের দিকে এগিয়ে যাবো, সেখান থেকে টেনে বের করবো কয়লা খোচানোর মোটা রড। সেই রড কার মাথায় আঘাত আনবে? খুবই সোজা, রোজলীনের মাথা বরাবর নেমে আসবে সেই রড, একবারই শুধু, তারপর সব শেষ।
মজার বিষয় হলো, আমার কোনো শাস্তিই হবে না, সাময়িক ভারসাম্যহীণতার কথা বলে পার পেয়ে যাবো কারণ আমি যে মানষিক হাসপাতাল থেকে এসেছি বেশি দিন হয় নি। রায় কী হবে তা আন্দাজ করতে পারছি, “ঢাকা ডিজিটাল মানষিক হাসপাতালে” আবারও ফিরে যেতে হবে এবং এবার বছর খানেক আমাকে থাকতে হবে। বছর খানেক পর আবারও ভাব দেখাবো আমি পুরাপুরি সুস্ত হয়ে গেছি।
কি? ভাবছেন আমি কি সত্যি পাগল হয়ে গেছি? আরে না? সবাই তেমনটিই ভাবে, কেননা এটা যে একটা পরিকল্পিত মার্ডার।
লেখকের ছবি:
সর্বশেষ এডিট : ১৯ শে ফেব্রুয়ারি, ২০১৬ বিকাল ৫:০১