somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

আমি ভাল নেই, তারা ভাল থাকে কি করে?

২৮ শে এপ্রিল, ২০১৪ সকাল ১১:৫৯
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

এসএটিভিতে কাজ করি তখন। রানা প্লাজা দুর্ঘটনার দিন পেশাগত দায়িত্ব পালনে সচিবালয়ের উদ্দেশ্যে ছিল আমার যাত্রা। সকাল ঠিক ৮ টা ৫৫ এর দিকে সাভার থেকে ফোন আমার এক আত্মীয়র। তার কথা ছিল এমন, “ভাই তারাতারি ক্যামেরা নিয়া আসেন, হাজার হাজার মানুষ ভবনের নিচে চাপা পড়েছে”
ঘটনার ভয়াবহতা বুঝতে একটুও অসুবিধা হয়নি। সঙ্গে সঙ্গেই জানালাম এ্যাসাইনমেন্ট এডিটরকে। সচিবালয়ে যেহেতু কাজ ছিল, সেদিন আর যাওয়া হলোন না সাভারে। পরদিন সূর্য ফোটার আগেই রানা প্লাজায়। সঙ্গে ক্যামেরাপারসন সানি ভাই। হাজার হাজার মানুষের উতকন্ঠা। লাশ বের হলে কারো কান্নর রোল। আবার জীবিত কেউ উদ্ভার হলে, গন্তব্য এনাম মেডিকেল কলেজে। ভবনের পেছন দিকটায় হাছনা নামের এক নারীরকে হাজারো মানুষের মধ্যে লক্ষ্য করা কঠিন হয়নি। তার স্বামী ভবনের ৫ তলায় দুই ভীমের নিচে চাপা ড়ড়েছে। দেবড় দেখে এসেছে তাকে। কিন্তু কোনভাবেই উদ্ধার সম্ভব হচ্ছেনা।
দক্ষিন দিকের একটি ভবন দিয়ে চলে গেলাম ভবনের উপরে। এই মধ্যে কত চাপা পড়া মানুষ দেখতে পেয়েছি, মনে উঠলে এখনো গা শিউরে ওঠে। সানি ভাই অনেক দিন ক্যামেরার পেছনে কাজ করেন। অভিজ্ঞতাও অনেক। সেই মানুষটিও মাঝে মাঝে আতঙ্ক আর উতকণ্ঠায় কেঁপে উঠছিলেন। আরেক বিল্ডিং এর কর্নিশ দিযে উপরে উঠতেই কযেকজন উদ্ধারকর্মী আমাদের ঘিরে ধরলেন। বললেন, পিছন দিকটার কয়েকজন চাপা পড়েছেন। তবে এখনো বেঁচে আছেণ। উদ্ধারকর্মীরা চাইছেন আমরা সেখানে যাই। পরিস্থিতিরি ভয়াবহতা তুলে ধরি। জীবনের ঝুঁকি নিয়ে গেলাম পেছন দিকটায়। ধ্বংসস্তুপের উপর দাড়াতেই ‘বাঁচাও বাঁচাও’ শব্দ শুনতে পাচ্ছিলাম। তবে যেখান দিযে ওই মানুষগুলোর কাছাকাছি যাওয়া সম্ভব, তা ক্রমশ নিচের দিকে। ভেতরে গেলে যেকোন সময় আবার দুমড়ে মুচড়ে পড়তে পারে অবশিষ্ট দালান। আমাদেরও মৃত্যুও হতে পারে। পরিস্থিতিরি ভয়াবহতা এমন যে, আমার পুরো শরীর কাঁপছিল। সাংবাদিক হিসেবে তখন একটা প্রশ্ন মাথায় বারবার উকি দিচ্ছিল। ভিতরে যাব? সাংবাদিকতা বিভাগের শিক্ষকদের বড় পরামর্শ ছিল, আগে নিজে টিকে থাকা, পরে সংবাদ সংগ্রহ। সাংবাদিকতার এই জ্ঞান তুচ্ছ মনে হয়েছে তখন। একবার মনে হলো বুম, ক্যামেরা বাদ দিয়ে নিচে চলে যাই। আবার মনে আসে পেশাগত দায়িত্বের কথা। দেখলাম, সুরঙ্গের মুখ দিযে কয়েকজন সেচ্ছাসেবক হুরমুড় করে ঢুকে গেল। তাদের এইটুকু মাথায় আসছেনা, তারাও মরতে পারে।
সানি ভাইকে বললাম, চলেন ভিতরে যাই। তার দিকে তাকিয়ে বুঝলাম, সারা শরীর কাপছে তাঁর । শরীর বেয়ে নামছে পানি। তিন বললেন, সাহস পাচ্ছিনা ভাই। এই সময একজন সেচ্ছাসেবক বললেন, “কি সাংবাদিক হইছেন ভাই, কত মানুষ মড়ছে, আর আপনারা নিজের জীবন নিয়ে এত ভাবছেন”। ওই লোকটি বললো, আপনি না পাড়লে দেন, আমি ছবি তুলে নিয়ে আসি। নিজে উদ্যোগী হয়ে সানি ভাইয়ের কাছ থেকে নিলেন ক্যামেরা। কয়েক মিনিটের মধ্যে নিয়ে আসলেন ছবি। সানি ভাই ক্যামেরায় ছবি দেখলেন। কয়েকজন মানুষের বেঁচে থাকার আকুতি। আমি এবার বললাম, ভাই আপনি থাকেন আমি যাব। যদি তাদের বাঁচানো যায়। সানি ভাই একটু ভেবে বললো, চলেন। আমি সামনে বুম নিয়ে পরিস্থিতি বর্ণনা করছি। মুখে কথা আসছিল না। কিছুদুর এগুতেই ‘ভাই বাঁচান’ শব্দ। আর বুমে কথা বলতে পারিনি। একটু সামন্য আগাতে লাল রঙ্গের জামা পড়া এক শ্রমিকক দেখলাম। যার মাজা বাড়াবর ভীম। শুধু মুখ দিয়ে বলছে, “বাঁচান ভাই’। আমার ঠিক এক থেকে দেড় হাত দুরে মানুষটি। তাকে ধরতে পারছিলাম না। কারন, মাথা ঠেকে যাচ্ছিলো কক্রিংটের দেয়ালে। কি করব, করা উচিত বুঝতে পারছিলাম না। পাশে দেখছি কয়েকজনের থেতলে যাওয়া লাশ। ঠিক হরর সিনেমার মত। মনে হচ্ছিল অজ্ঞান হয়ে যাব। আবার মানুষ হিসেবে নিজেকে খুব ছোট মনে হচ্ছিল। এতকাছে একজন মানুষ বেঁচে থাকার আকুতি জানাচ্ছে, আমি কিছু করতে পারছিনা। আবার যেকোন সময় কংক্রিটগুলো ভেঙ্গে পড়ার আশঙ্কা। সানি ভাই বাড় বাড় বলছিলেন বেড় হয়ে আসতে। আমি বাকরুদ্ধ হয়ে গেছি। কিছু বলতে পারছিনা। কি করা উচিত আমার?
অবশেষে বাধ্য হলাম বের হতে। বেরুবার সময় একটা থেতলে যাওয়া পা লাগলো শরীরে। রক্ত শুকিয়ে গেছে। অনভুতি যেন ভোতা হয়ে গেছিল তখন।
রানা প্লাজার দুর্ঘটনা তারপর টানা ৬দিন সংবাদ সংগ্রহ করেছি সাভারে। কখনো লাশের সামনে, কখোনে জীবত উদ্ধার হওয়া থেতলে যাওয়া শরীরের সামনে, কখোনো স্বজন হারা মানুষের সমানে। মনে আছে, একজন স্বাভাবিক মানুষ হয়েও প্রায় একমাস কোন রাতেই ঘুমোতে পারিনি। এখনও ছবিগুলো যখন চোখের সামনে ভেসে আসে তখন রাতে ঘুমাতে পারি না। ভাবি, যারা ওই ভয়াবহ মৃত্যুকুপ থেকে জীবিত হয়ে ফিরে এসেছেন তাদের কি অবস্থা। আমার যদি এই অবস্থা হয়, তবে তাদের পরিস্থিতি আরো ভয়াবহ। হয়ত সারাজীবনেও স্বাভাবিক হতে পারবেন না আহত শ্রমিকরা। এরকম এজনের সাক্ষাতকার নিয়েছিলাম সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালে। রেবেকা নামের ওই নারী ছিল সাত মাসের অন্তস্বত্তা। কাজ করিছলেন ভবনের সপ্তম তলায়। তার এক পা কেটে ফেলতে হয়েছে বাঁচানের জন্য। গর্ভপাত কারাতে হয়েছে তাকে। তার বাচ্চাটা পৃথীবির আলোর মুখ দেখতে পাননি। কয়েকদিন আগে সেই নারীর স্বামীর সাথে কথা হলো। বললেন, এখন রেবেকা মানুষিক ভারসাম্যহীন। মাঝে মাঝে আটকে রাখতে হয়।
ঘটনার একবছর পার হলো। এর মধ্যে নানা ধরণের পলোআপ প্রতিবেদন তৈরি করেছি। বিজিএমইএ, সরকার, বিদেশেী ক্রেতাদের নানা প্রতিশ্রুতির সংবাদ এসেছে গণমাধ্যমে। কিন্তু রানা প্লাজার ক্ষত কতটুকু সারাতে পেরিছি আমরা? কয়েকদিন আগে এ্যাকশন এইড বাংলাদেশের এক সমীক্ষায় দেখলাম রানা প্লাজায় ক্ষতিগ্রস্ত পরিরবারের ৭৪ ভাগই সঠিকভাবে সহযোগিতা পাননি, ফিরতে পারেননি কাজে। এদের অধিকাংশই দীর্ঘমেয়াদী শারিরিক ও মানুষিক সমস্যায় পড়েছে। সরকার বিজিএমইএ বিশেষ অর্থ সহয়তার ঘোষনা দিয়েছিল ওই ঘটনার পর। যদি সেটা হতো এবং দুর্নীতিমুক্ত ভাবে কাজে লাগত, তবে ৭৪ ভাগ মানুষের অবস্থা এরকম কেন? কি অবস্থা মালিকদের। প্রায় সাড়ে তিন হাজার সক্রিয় গার্মেন্ট প্রতিষ্ঠানের মালিকার জনপ্রতি মাত্র ২৫ হাজার টাকা করে দেয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন ঘটনার পর। মাস কয়েক আগে খোজ নিয়ে জেনেছিলাম, অনেক মালিকই তা দেননি।
ইতিহাসের একটি কথা খুব মনে পড়ছে। দ্বীতিয় বিশ্বযুদ্ধের সময় হিটলারের নাতসি বাহীনি, সাধারণ মানুষদের ডেকে ডেকে গ্যাস চেম্বারে ঢুকাতো। এরপর চেম্বারের মুখ বন্ধ করে হাজার হাজার মানুষকে হত্যা করিছিল ওই বাহিনী। ওই ঘটনার জন্য আজও হিটলার বিশ্বব্যাপি খলনায়ক। সাভারের ঘটনায় ভাবন মালিক, কারখানা মালিক, বিজিএমইএ কিংবা সরকারকে হিটলালের নাতসি বাহিনীর ভুমিকার সঙ্গে তুলনা করলে ভুল হবে? যারা ভবন ঝুকিপূর্ন জেনেও পাঁচ হাজার শ্রমিককে ডেকে ডেক কারখানায় ঢুকিয়েছেন, মরতে বাধ্য করিয়েছেন ১১২৯ জন মানুষকে। তাদের কি বলা যায়। ইতিহাসকেও হার মানিয়েছে বাংলাদেশ। হিটলারকে নাতসি বাহিনীর নির্মাতা বলা যাবে। তবে রানা প্লাজার দায় কার, তা বলতে মানা।
৪টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

ছি , অবৈধ দখলদার॥ আজকের প্রতিটি অন‍্যায়ের বিচার হবে একদিন।

লিখেছেন ক্লোন রাফা, ০৪ ঠা ডিসেম্বর, ২০২৫ দুপুর ১২:১০



ধিক ‼️বর্তমান অবৈধভাবে দখলদার বর্তমান নরাধমদের। মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীন বাংলাদেশে । বীর মুক্তিযোদ্ধাদের ক্ষমা চাইতে হলো ! রাজাকার তাজুলের অবৈধ আদালতে। এর চাইতে অবমাননা আর কিছুই হোতে পারেনা।... ...বাকিটুকু পড়ুন

আম্লিগকে স্থায়ীভাবে নিষিদ্ধে আর কোন বাধা নেই

লিখেছেন সৈয়দ মশিউর রহমান, ০৪ ঠা ডিসেম্বর, ২০২৫ দুপুর ১২:২২


মঈন উদ্দিন ফখর উদ্দিনের ওয়ান-ইলেভেনে সরকারের ২০০৮ সালের ডিসেম্বরে ভারতের সহায়তায় পাতানো নির্বাচনে হাসিনা ক্ষমতায় বসে। এরপরই পরিকল্পিত উপায়ে মাত্র দুই মাসের মধ্যে দেশপ্রেমিক সেনা অফিসারদের পর্যায়ক্রমে বিডিআরে পদায়ন... ...বাকিটুকু পড়ুন

আওয়ামী লীগের পাশাপাশি জামায়াতে ইসলামীকেও নিষিদ্ধ করা যেতে পারে ।

লিখেছেন সৈয়দ কুতুব, ০৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ১২:৪৫


বাংলাদেশে আসলে দুইটা পক্ষের লোকজনই মূলত রাজনীতিটা নিয়ন্ত্রণ করে। একটা হলো স্বাধীনতার পক্ষের শক্তি এবং অন্যটি হলো স্বাধীনতার বিপক্ষ শক্তি। এর মাঝে আধা পক্ষ-বিপক্ষ শক্তি হিসেবে একটা রাজনৈতিক দল... ...বাকিটুকু পড়ুন

J K and Our liberation war১৯৭১

লিখেছেন ক্লোন রাফা, ০৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ৯:০৯



জ্যাঁ ক্যুয়ে ছিলেন একজন ফরাসি মানবতাবাদী যিনি ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তান ইন্টারন্যাশনাল এয়ারলাইন্সের একটি বিমান হাইজ্যাক করেছিলেন। তিনি ৩ ডিসেম্বর, ১৯৭১ তারিখে প্যারিসের অরলি... ...বাকিটুকু পড়ুন

এবার ইউনুসের ২১শে অগাষ্ঠ ২০০৪ এর গ্রেনেড হামলার তদন্ত করা উচিৎ

লিখেছেন এ আর ১৫, ০৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ৯:৪০



এবার ইউনুসের ২১শে অগাষ্ঠ ২০০৪ এর গ্রেনেড হামলার তদন্ত করা উচিৎ


২০০৪ সালের ২১ শে অগাষ্ঠে গ্রেনেড হামলার কারন হিসাবে বলা হয়েছিল , হাসিনা নাকি ভ্যানেটি ব্যাগে... ...বাকিটুকু পড়ুন

×