সেলিম আল দীন সম্পর্কে বলতে গেলে প্রথমেই যেটা বলতে হয় সেটা হচ্ছে তিনি শুধু নাট্য ব্যক্তিত্ব নন তিনি বাংলা নাটকের যুগধারা। মূলত সেলিম আল দীন তথা তাঁর নাটক সম্পর্কে আমার প্রথম জানা আমার মঞ্চ নাটক পাগল ছোট ভাই শুভর মাধ্যমে। প্রথমেই বিস্মিত তারপরে তাঁর প্রতি মুগ্ধতা উত্তরোত্তর বেড়েছে ।
গত ১৮ ই আগষ্ট ছিল সেলিম আলদীনের ৬১ তম জন্মদিন এবং তাঁর জন্মদিন উপলক্ষে এক্সপেরিমেন্টাল থিয়েটার হল এ বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি এবং নাট্যদল স্বপ্নদল আয়োজন করেছিল ৪ দিন ব্যাপি “"সেলিম আল দীন - জন্মোৎসব"”।
যদিও আমি নাট্যব্যাক্তিত্ব নয় কিংবা মঞ্চ নাটকের সাথে জড়িত কেউ নয়,তারপরেও একজন সচেতন দর্শক, পাঠক হিসেবে আমার কাছে সেলিম আল দীনকে মনে হয়েছে এমন একজন ব্যাক্তি যিনি তাঁর সৃষ্ঠিতে সবসময় এক শেকড়ের সন্ধান দিতে চেয়েছেন, নিরন্তর গবেষণায় আমদের পাইয়ে দিতে চেয়েছেন আমাদের ঐতিহ্যের স্বাদ। যা অনেক আগেই আমরা হারিয়েছি কিংবা চিনতেই পারিনি আমদের ক্ষুদ্র জ্ঞান দিয়ে । সেলিম আল দীন চেয়েছিলেন সেই হাজার বছরের পুরান কৃ্ষ্টিকে আমাদের মধ্যে ফিরিয়ে দিতে , অন্ধ অনুকরণের জাল থেকে বের হয়ে এসে একান্তই নিজের ধারায় কালজয়ী কিছু সৃষ্ঠি করতে আর তাতে তিনি পুরোপুরি সফল। তিনি তাঁর রচনাতে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন চমক দিয়েছেন, তিনি রচনা করেছেন বর্ণণাত্মক নাটক যেখানে সংলাপ এবং বর্ণনা একে অপরের সাথে অঙ্গাঅঙ্গি ভাবে জড়িয়ে থাকে । সংলাপ আর বর্ণনার এই কাঠামোটিকে তিনি নাম দিয়েছেন “"দ্বৈতাদ্বৈতবাদী শিল্পতত্ব”" বা “"ফিউশন তত্ব"”।
শুধু বর্ণনা কিংবা সংলাপেই নয়, ভাষাতেও তিনি তার প্রতিভার স্বাক্ষর রেখেছেন যার উদাহরণ চাকা নাটকটি। তবে তাঁর নাটকের দর্শক হিসেবে যে জিনিসটা আরও বেশি আমাকে টেনেছে সেটা তার সৃষ্ঠ নারী চরিত্র গুলো , সেই চুক্কু, আবছা,পরী, কালিন্দী প্রতিটা চরিত্র যেন আমাদের এই জনপদের হাজার বছর ধরে চলে আসা সমাজের নারীদের প্রতিমূর্তি। তাদের হতাশা,ভালবাসা আমাদেরকে এক মোহজালে আটকে রাখে । সেলিম আল দীনের নাটকের আরও একটা বড়দিক কাহিনীর বৈচিত্র্য প্রতিটা নাটকেই ভিন্ন বিষয়। যেমন, হরগজে আমরা দেখি প্রাকৃ্তিক দূযোগের চিত্র, আবার পুত্র নাটকে সন্তানের অকাল মৃত্যুতে এক দম্পতির মনস্তাত্বিক টানাপোড়েন আবার নিমজ্জন আপাত দৃষ্টিতে যা এক গল্প বিহীন নাটক, যেখানে তিনি কাব্যিক সুসমায় নিপুণ ভাবে উপস্থাপন করেছেন ইতিহাসের গণহত্যার ইতিবৃত্ত যার বিস্তৃতি উগান্ডা, রুয়ান্ডা, কসোভো, প্যালেস্টাইন থেকে ইরাক আফগানিস্তান পর্যন্ত। তাঁর রচনার গুনে, তার স্টাইলে এটা শুধু নিছক নাটক না হয়ে, হয়েছে মানব সভ্যতার নিমজ্জনেরই প্রতিচিত্র।
বাংলাদেশ গ্রাম থিয়েটারের ড. জাহারাবী রিপনের এক লেখায় পড়েছিলাম যে, নিমজ্জন এর রচনা কৌশলকে ক্রান্তিক প্রকাশনা কর্তৃপক্ষ বিশ্ব শিল্প দ্বারা ফোররিয়ালিজম প্রথম উদ্ভাবন হিসেবে উল্লেখ করেছেন। বস্তুত পক্ষে, যা ঘটতে পারে তার নিশ্চিত পূর্বাভাস এবং তার সংগঠণ ফোররিয়ালিজম এর প্রধান বৈশিষ্ট্য।
সেলিম আল দীন কে নিয়ে লেখতে কিংবা বলতে গেলে যাদের কথা এমনিতেই চলে আসে তাঁরা হচ্ছেন, নাসির উদ্দীন ইউসুফ বাচ্চু, শিমুল ইউসুফ এবং ঢাকা থিয়েটার। প্রতিটা শিল্পের তার প্রকাশ হওয়ার কিছু মাধ্যম, কিছু ক্ষেত্র লাগে সেগুলো না হলে সেই শিল্প তার যথার্থতা পায় না। ঢাকা থিয়েটার ঠিক সেই মাধ্যম হিসেবেই কাজ করেছে। একজন নাট্যকার তখনই সাকসেস হন যখন তার নাটকের সঠিক এবং পরিপূর্ণ ভাবে মঞ্চায়ন হয়, সেদিক থেকে বলতে গেলে সেলিম আল দীন এর কাজের সঠিক রুপায়ণ করতে পেরেছে ঢাকা থিয়েটার পরবর্তিতে স্বপ্নদল। অনেকে বলে থাকেন সেলিম আল দীন গুরু শিষ্য ধারায় বিশ্বাসী ছিলেন কিন্তু তিনি নাকি কাউকেই যোগ্য উত্তরসূ্রী করে রেখে যাননি । আমি জানিনা যোগ্য উত্তরসূ্রী কিনা তবে স্বপ্নদলের জাহিদ রিপন নিঃসন্দেহে গুরু অনুসারী এবং তাঁর নির্দেশনায় হরগজ নিঃসন্দেহে একটা ভাল কাজ। অনেকে মনে করেন সেলিম আল দীন কে নিয়ে যে মাতামাতি সেটা আসলে হয় ঢাকা থিয়েটার এর মত সংগঠণ এর সাথে জড়িত এই কারণে। তবে এটাও আমরা অস্বীকার করতে পারিনা যে “ঢাকা থিয়েটার”, গ্রাম থিয়েটার এর মত সংগঠণ গড়ে তোলাও কম বড় ব্যাপার নয়।

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।


