কয়েকটি খন্ড চিত্র দিয়ে শুরু করা যাক;
করিম সাহেব রেলের একজন অবসর প্রাপ্ত কমকতা, দুই ছেলে ও এক মেয়েকে নিয়ে ছিল সংসার। মেয়েকে বিয়ে দিয়েছেন আজ প্রায় ৪ বছর জামাই ডাক্তার, থাকে সিলেটে। বড় ছেলেকে বিয়ে দিয়েছেন গত বছর, খুব শখ করে দেওয়া বিয়ে।ছেলে একটি মাল্টিন্যাশনাল কম্পানিতে কমরত আছে, ছোট ছেলে লন্ডণে সিএ পড়ছে। এক কথায় সুখী পরিবার বলতে যা বোঝায় তাই। বড় ছেলের বিয়ের পর ছেলে বৌকে নিয়ে চলে গেল ঢাকাতে। করিম সাহেবকেও অনেকবার অনুরোধ করেছে ঢাকায় গিয়ে ফ্ল্যাটে থাকতে। কিন্তু করিম সাহেব রাজি হননি । ফ্ল্যাটের বদ্ধ বাড়ীতে তার দম বন্ধ লাগে। তবে করিম সাহেবের স্ত্রী ছেলের সাথে ঢাকাতে গেছেন,নতুন বৌ সব কিছু দেখে শুনে নেওয়ার ও থাকে। দিনটা যেমনই কাটুক সন্ধ্যের পর থেকে করিম সাহেব বড় অস্থির হয়ে পড়েন পুরো বাড়ীটাকে তার যেন যমপুরী মনে হয়। টেলিভিশন দেখে আর পেপার পড়ে সময় গুলোকে যেন দম বন্ধ করে পার করতে চান। মনের একাকিত্ব তাকে মাঝে মাঝে এতই গ্রাস করে যে তিনি ভাবেন বাড়ী ছেড়ে পালিয়ে যাবেন। বুকের বাম পাশটাতে কেমন যেন চাপ ধরে আসে, তার খুব ইচ্ছে হয় তার ছেলে মেয়েরা তাকে ঘিরে বসে থাকুক আর তিনি ওদের মায়ের হাত ধরে থাকেন। কিন্তু বাস্তবতা করিম সাহেবের মত অসংখ্য একাকী প্রবীণের ইচ্ছে গুলো পূণ হতে দেন না।
বেণুকা রাণী তিন ছেলের মা, স্বা্মী ছিলেন একজন সামান্য দোকানের কর্মচারী, জীবন কেটেছে নুন আনতে পান্তা ফুরায় অবসাথাতে । তারপরেও অনেক কষ্ট করে সন্তানদেরকে কোন রকম মানুষ করার চেষ্টা করেছেন।কিন্তু হঠাৎ করে স্বা্মীর চাকরী চলে যাওয়াতে বাধ্য হয়ে বড় ছেলের পড়াশুনা ছাড়িয়ে চাকরীতে লাগিয়ে দেন। পরে অন্য সন্তান গুলোর ও আর পড়াশুনা আগায়নি।বেণুকার স্বামীর যেটুকু সঞ্চয় ছিল তিনি সেগুলো দিয়ে ছেলেদের ব্যাবসা গড়ে দেওয়ার চেষ্টা করেছেন। এখন তিন ছেলে বিয়ে করে পৃথগন্ন হয়েছে। বেণুকা এবং তার স্বামীকে ওর ছেলেরা ভাগ করে নিয়েছে ৪ মাস, ৪ মাস করে। প্রথম দিকে বেণুকার খুব কষ্ট হত তিনি জানেন তার স্বামী সকালে গর ম ভাত ছাড়া খেতে পারেন না কিন্তু তার কোন কোন ছেলে সকালে খায় রুটি , তিনি বুঝেন স্বা্মীর কষ্টটা। কিন্তু কিছু করার নেই কারণ সংসার তো আর তার নেই। বেণু চেষ্টা করেন সব বৌয়ের কাজ করে দিতে, মন জুগিয়ে চলতে কিন্তু তারপরেও শান্তি নেই কারণ মাঝে মাঝেই তার বৌমারা তার কাজ করা নিয়ে খোটা দেন । বেনুকার স্বামী প্রভাত চেষ্টা করেন ছেলেদের দোকানের কাজে সহযোগিতা করতে, কিন্তু পান থেকে চুন খসলেই ছেলেরা অশ্রাব্য ভাষায় তাকে গালিগালাজ করে। এবং তাদের এই অভাবের জন্য তারা তাদের বাবাকেই দায়ীই করে। এক নিদারুণ কষ্ট বেনুকা এবং প্রভাতকে বয়ে বেড়াতে হয়। তারা পরামুখাপেক্ষী। তাদের অসুখ হলেও ছেলেদের কাছে বলতে পারেননা কারণ তার মেজ বৌমা একবার বলেই দিয়েছে তিন বেলা খাবার তারা কষ্ট করে দিতে পারে কিন্তু ডাক্তার দেখানোর মত বিলাসিতা তারা করতে পারবেনা। এখন তিন সন্তানের এই পরিবারে বাবা মা এক অসহায় করুণ ভাব নিয়ে বেঁচে থাকে।
উপরের যে দুটো ঘটনা বললাম আমি জানি আপনারা প্রত্যেকেই এই বিষয় গুলোর সাথে পরিচিত আছেন। এই যে অসহায়ত্ব, একাকিত্ব এগুলো নিয়ে আমাদের ভাবা প্রয়োজন। কারণ আমরা প্রত্যেকেই একদিন বৃদ্ধ হব। এই যে তিল তিল করে গড়ে তোলা জীবন তার এমন করুণ ভাবে শেষ আমরা কেউই আশা করিনা।প্রত্যেক মানুষ চায় তার কাজের মূল্যায়ন তাঁর একটু দাম থাকুক সমাজে, তাঁর সংসারে। কিন্তু যখন সে বাধ্যকে পৌঁছে যায়, তখন সে অবাক ভাবে দেখে তার উপস্থিতি কেউই গণ্য করছেনা, কেউ তার মতামত কে প্রাধাণ্য দিচ্ছেনা। তখন এক ধরণের বিষন্নতা সেই মানুষটার উপর ভর করে আর সেটা কাটিয়ে উঠতেই সে আর ও নিজেকে জাহির করার চেষ্টা করে। কিন্তু এর ফলাফল হয় আরো খারাপ, তরুণরা এদের এইসব কথা গুলোকে প্রলাপ বলেই উড়িয়ে দেই এবং দিনে দিনে এই প্রবীণরা আরো বেশি শারীরিক, মানসিক ভাবে ভেঙ্গে পড়ে।
তবে কি এই প্রবীনরা যাদের ঘামে শ্রমে নিমিত হয়েছে এই দেশ,যাদের চিন্তা-ভাবনা আমাদের দেখাতে পারে আলোরপ থ, যাদের অভিজ্ঞতা হতে পারে আমদের পথপ্রদশক, তারা কি এভাবেই মরে যাবে। হয়ত অনেকেই বৃ্দধাশ্রমের কথা বলবেন, কয়েকদিন আগে শাহাদুজ্জামান প্রথম আলোতে এই বিষয়টি নিয়ে লিখেছিলেন ।কিন্তু বৃ্দধাশ্রম নিয়ে আমার মনে একধরণের অস্বস্তি কাজ করে, কারণ পৃথিবীর আর দশটা দেশের থেকে আমাদের মূল পাথক্য আমাদের আবেগের জায়গাতে।কারণ আমরা জন্ম থেকে শিখে আসি পিতা মাতার স্থান ঈশ্ব্ররের পরেই, এমনকি ইসলাম ধমে বলা আছে মায়ের পায়ের নিচে সন্তানের বেহেশত। যে দেশে এই ভাবে বাবা-মায়ের সম্মান দেওয়ার রেওয়াজ আছে, তবে সেখানে কেন বৃ্দধাশ্রম ভাবনা। বিষয়টা কি আমাদের মূ্ল্যবোধের অভাবকে প্রকট করে না ?
তবে প্রবীণদের সমস্যা গুলোকে শুধু আবেগের দৃষ্টি দিয়ে দেখলে চলবেনা এর অথনৈতিক দিকটাও একটা বড় বিষয়। আমদের মত তৃ্তীয় বিশ্বের একটি দেশে প্রবীনদের জন্য সরকারী ভাবে কোন খরপোশের ব্যাবস্থা নেই, নেই কোন চিকিৃৎসার নূ্ন্যতম সুযোগ।আর এই কারণেৃ অনেকের ইচ্ছা থাকলেও স্বল্প ইনকামের জন্য পারছেনা পিতা মাতার সেবা করতে।কারণ একজন গামেন্টস কমী যার সব সাকুল্যে মাসিক ইনকাম ৫,০০০ টাকা , তবে তার নিজের চলে কতটুকু বাবা-মাকে সেবা করা সম্ভব তা অবশ্যি ভাবার বিষয় ?
তাই পরিবার থেকে শুরু করে রাষ্ট্র সবাইকে এটা নিয়ে ভাবা উচিত। এখনও আমাদের দেশের ভোটারদের ৩০ শতাংশ বৃ্দধ কিন্তু কোন সরকারেরই এক ভোট ছাড়া তাদের নিয়ে ভাবতে দেখিনা। এখনকার অনেক বৃ্দধ দাদা দাদী,নানা নানী তাদের নাতি নাতনীদের নিয়ে স্কুল যাওয়া আসা করছেন, তার অথনৈ্তিক কোন মূ্ল্যই আমরা দেইনা। সবচেয়ে বড় জিনিস একজন অভিভাবক একটা মানুষের জীবনকে যে কত বড় নিরাপত্তা দেই তা একটু আমরা চোখ বন্ধ করলেই রিয়েলাইজ করতে পারি।তাই আমি চাই আমদের সবস্তরের মানুষের ভেতরে সচেতনতা বাড়ুক, বাড়ুক আমাদের মূল্যবোধ। আমদের প্রবীণ নাগরিকরা বোঁঝা নয়, তারা আমাদের প্রেরণা, আ্মাদের উৎসাহ দাতা।সরকারী ভাবে উচিত তাঁদের জন্য নূ্ন্যতম নাগরিক সেবা পৌঁছে দেওয়া, এবং তাঁদের অভিজ্ঞতাকে কোন ক্রিয়েটিভ কাজে ব্যাবহার করার চেষ্টা করা।সেটা হতে পারে শিশু রক্ষণাবেক্ষণ কিংবা আরো কিছু……….
কারণ আমরা জানি পুরানো চাল ভাতে বাড়ে।