১
আকবর আলি খান তার বহুল আলোচিত ‘পরার্থপরতার অর্থনীতি’ বইতে একটা অধ্যায়ের নাম দিয়েছেন ‘শুয়রের বাচ্চাদের অর্থনীতি’। জনাব খান সেখানে চমৎকার একটা ঘটনার অবতারণা করেছেন।ঘটনাটা ছিল এরকম,
“ ইংরেজরা যখন ভারতবর্ষ দখল করে রেখেছিল, তখন জনৈক ইংরেজ এখানে চাকরি করতেন। এখানে কাজের স্মৃতিচারনা করতে গিয়ে ঐ ইংরেজ তার স্মৃতিকথায় উল্লেখ করেছেন, তার কাছে নাকি ভারত বর্ষের কোন একজন লোক বলেছিলেন,"এখানকার সমাজে তিন কিসিমের লোক আছে-একদল সজ্জন(যারা কখনো ঘুষ খান না); সংখ্যায় নাই বললেই চলে ৷আরেক দল খারাপ,কিন্তু সংখ্যায় কম(যারা কাজের বিনিময়ে ঘুষ খান )৷আরেক দল, শুয়ারের বাচ্চা (যারা কাজ করার কথা বলে ঘুষ খান কিন্তু ঘুষ খাওয়ার পর কাজ করেন না!)৷সমাজে শুয়ারের বাচ্চাদের সংখ্যাই বেশি!"
বাংলাদেশের অর্থনীতিকে যদি আকবর আলি খান বর্ণিত শুয়রের বাচ্চারাই শুধুমাত্র দখল করত, তাহলেও চিন্তিত হতাম না। কারন আকবর আলি খানের উল্লেখিত শুয়রেরা লুকোচুরি করে, চার দেয়ালের মধ্যে বসে দুর্নীতি করে। বাংলাদেশে দুর্নীতির চিত্র আরও গুরুতরও! এখন আর দুর্নীতি করতে কোন রাখ ঢাক নেই! সমাজের সকল স্তরে অবস্থান নিয়েছে নানান কিসিমের শুয়োরের বাচ্চারা! অবস্থা আজ এমন পর্যায়ে গিয়ে পৌঁছেছে,চোখের সামনে থেকেই এরা লুটেপুটে নিচ্ছে কোটি কোটি টাকা। দেশে সরকার আছে, বিরোধী দল আছে, পার্লামেন্ট আছে, সেগুন বাগিচার মত জায়গায় বিশাল অট্টালিকা নিয়ে দুর্নীতি দমন কমিশন আছে কিন্তু শুয়োরদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেবে এমনকি এদের বিরুদ্ধে কথা বলবে এমন হিম্মত কারো নেই! থাকবেইবা কি করে? ভুত তো সর্ষের মধ্যেই!
আর তথাকথিত স্বাধীন ‘দুর্নীতি দমন কমিশন(দুদক)’কে তো নিন্দুকেরা ‘বিরোধী দমন কমিশন(বিদক)’ বলেই অভিহিত করে থাকেন! কারন এই কমিশন শুধুমাত্র বিরোধীদলের দুর্নীতিবাজদের চেনে, সরকার দলীয়দের চেনে না! উদাহরণ চান? গত সরকারের সময়কার দুদকের মামলার রেকর্ড দেখুন! দেখবেন, দুর্নীতিবাজ সবাই ‘এ’ টিমের! আর এই সরকারের সময় দেখবেন দুর্নীতিবাজেরা সবাই ‘বি’ টিমের! সরকার দলীয় সবাই তুলসী পাতার মত পুত-পবিত্র!
০২
এবার কুরবানির ঈদের সময়কার কথা বলছি। ঢাকা থেকে বরিশাল গিয়েছিলাম। টিকিট নৈরাজ্যের জন্য প্রতিবারই ভেঙে ভেঙে বাড়ি যাই।প্রথমে গুলিস্থান থেকে মাওয়া যাই - বাসে ভাড়া হচ্ছে ৭০ টাকা। ঈদের সময় ভাড়া হয়ে গেল ১০০ টাকা! যাত্রীদেরকে কোন টিকিট দেয়া হয় না। কারন টিকিটে ৭০ টাকা ভাড়া লেখা রয়েছে! সাধারণত মাওয়া থেকে কাওরাকান্দি স্পীডবোটে ভাড়া ১৪০ টাকা। অথচ কুরবানির সময় একজন যাত্রীর কাছ থেকে ভাড়া নিয়ে নিল ২৫০ টাকা! কাওরাকান্দি থেকে মাইক্রোবাসে গৌরনদী ভাড়া হচ্ছে ১৫০ টাকা।অথচ কুরবানির সময় ১৫০ টাকার ভাড়া হয়ে গেল ৩০০ টাকা! তার মানে কি দাঁড়ালো? যেখানে ভাড়া হওয়ার কথা ৩৬০ টাকা , ঈদের সময় বাড়ি চাইলে বরিশালের একজন লোককে ভাড়া গুণতে হয়েছে ৬৫০ টাকা! আপনি একবার চিন্তা করুন,প্রতিবার ঈদের সময় লক্ষ লক্ষ লোক বাড়ি যায়। তাদের কাছ থেকে কি করে কোটি কোটি টাকা ছিনতাই করে নেয় দুর্বৃত্তরা? অথচ আপনি যদি প্রতিবাদ করতে যান, আপনার বাড়ি ফিরতে হবে লাশ হয়ে!
কেউ যদি ভেবে থাকেন, নিরীহ যাত্রীদের কাছ থেকে জোরপূর্বক নেয়া এই অতিরিক্ত ভাড়া চালক-হেলপাররা খাবেন, আমি বলব আপনি বোকার স্বর্গে বসবাস করছেন! যাত্রীদের কাছ থেকে জোর করে আদায় করা লুটের এই কোটি কোটি টাকার সিংহ ভাগই গেছে স্থানীয় ক্ষমতাবান লুটপাটকারীদের পকেটে! অবস্থা দৃষ্টে মনে হচ্ছে, ফ্রি স্টাইলে প্রকাশ্য দিবালোকে ঘটমান এই ছিনতাইকে কেউ দুর্নীতিই মনে করে না! মনে করে, ঈদের সময় এমনই তো হওয়ার কথা! আতংকিত হওয়ার মত ব্যাপার তো সেটাই!
০৩
অভিনেতা মিঠূণ চক্রবর্তীর একটা সিনেমা হয়ত অনেকেই দেখে থাকবেন- মিনিস্টার ফাটা কেষ্ট। যেখানে সমস্যা সেখানেই তা সমাধানের জন্য মিনিস্টার কেষ্ট হাজির! মিডিয়ার বদৌলতে আমরা আমাদের অতি প্রিয় সড়ক ও সেতু মন্ত্রীকে মাঝে মধ্যেই রাস্তায় ডাইরেক্ট একশনে নামতে দেখি! অবশ্য ওনার একশন কখনো চোরদের বিরুদ্ধে হয় না, হয় নিরীহ মোটরসাইকেল চালকের উপর, অথবা খালি গায়ে রাস্তায় বেরুনো কোন পথচারীর উপর! সব খরার বঙ্গ দেশে এটাই বা কম কিসে?
তাইতো অনেকেই ভদ্রলোককে ‘মিনিস্টার ফাটা কেষ্ট’ বলে সম্মানিত করে থাকেন। বলে থাকেন, তিনি বাংলাদেশের সবচেয়ে কর্মতৎপর মন্ত্রী! হ্যাঁ, ভদ্রলোক অত্যন্ত মিষ্টভাষী আর ক্ষুরধার বাগ্মী! উনি রাস্তায় যাওয়ার সাথে সাথে সাংবাদিক ক্যামেরাম্যান, টেলিভিশন চ্যানেলগুলা হাজির!মন্ত্রীর মূল্যবান, আর অত্যন্ত সুন্দর ভাষায় দেয়া সুমধুর বক্তব্য সরাসরি প্রচার করে মিডিয়া গুলো।
আমরা জনগণেরা মন্ত্রমুগ্ধের মত হা করে থাকি! বাংলাদেশের ফাটা কেষ্ট মন্ত্রীরে বাহবা দিতে থাকি! আর ওদিকে পথে পথে সাধারণ জনগণকে জিম্মি করে কোটি কোটি টাকা লুটে নিয়ে যায় লুটপাটকারীরা! মন্ত্রীর তথাকথিত একশন সেখানে বিচারের বাণীর মতই নিভৃতে কাঁদে! আর এভাবেই লুটতরাজেরা এই বঙ্গদেশের জনগণকে পথে পথে চুষে খায়!
আর টেলিভিশন, সংবাদপত্রগুলো এই চিত্র পরিবেশন করে না। করবেইবা কেন? কারন তারাতো অনেক আগেই ক্ষমতাবানদের টয়লেট টিস্যুতে পরিণত হয়েছে!
০৪
হ্যাঁ, উন্নত হয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশ! উন্নত হয়ে যাচ্ছে আকবর আলি খানের বইয়ে উল্লেখিত শুয়োরের বাচ্চারাও! আহেন, মনের সুখে আমরা রবীন্দ্র সংগীত গাই-“ আমারও পরাণও যাহা চায়, তুমি তাই, তাই গো...!” কি চায়, জানেন? উন্নয়ন, মধ্যম আয়ের দেশ!!!!!!
সর্বশেষ এডিট : ০৭ ই অক্টোবর, ২০১৫ রাত ১২:৩৩