আমার ছোট আপার শ্বশুর একজন মুক্তিযোদ্ধা। সত্যিকারের মুক্তিযোদ্ধা। ‘সত্যিকারের’ বিশেষণটা ব্যবহার করলাম বলে কেন জানি খারাপ লাগছে। কিন্তু বাংলাদেশের সমাজ বাস্তবতায় এটার ব্যবহারের বিকল্প দেখি না। কারন ক্ষুদ্র রাজনৈতিক স্বার্থে কম-বেশি প্রায় প্রতিটা সরকারের আমলেই মুক্তিযোদ্ধাদের সংখ্যা জ্যামিতিক হারে বাড়ানো হয়েছে। ইদানীং আবার নতুন প্রজন্মের মুক্তিযোদ্ধায় দেশ সয়লাব হয়ে যাচ্ছে। হতে পারেন তারাও মুক্তিযোদ্ধা। এটা নিয়ে আমার কোন এলার্জি নাই। কারন কেউ যদি আমার পাশে বসে বলেন তিনি আমেরিকার প্রেসিডেন্ট, তাতে আমার বিচলিত হওয়ার কি আছে? যেহেতু তেনার স্বাধীনতা আছে নিজেকে তিনি তালগাছ ভাবতেই পারেন। আর আমারও যেহেতু স্বাধীনতা আছে, আমি তাকে বালগাছ ভাবতেই পারি। গ্রামদেশে একটা প্রবাদ আছে, ‘ মানলে তালগাছ ,আর না মানলে বালগাছ’ । যাকগে। সে অন্য প্রসঙ্গ। ওদিকে আমি যাব না।
আজ আমি আমার বোনের শ্বশুর একজন বীর মুক্তিযোদ্ধার সাথে আমার কথোপকথন সংক্ষেপে তুলে ধরার চেষ্টা করব। তার আগে এই বীর যোদ্ধাকে নিয়ে কয়েকটি কথা। ৭১ সালে ওনার বয়স ছিল ২০-২১ বছরের মত।উনি ছিলেন বিধবা মায়ের একমাত্র সন্তান। মজার বিষয় হল উনি কোন একাডেমিক পড়ালেখাও করেন নাই। বর্তমানে ওনার ছেলেমেয়েরাও কেউ উচ্চ শিক্ষিত নন। ওনার পরিবার পুরোপুরি কোটার আওতামুক্ত। এবার মূল প্রসঙ্গে যাব।
সেদিন ছিল শুক্রবার।এবার কুরবানির ঈদের পরেরকার সময়। অনেক দিন ধরেই ভাবছিলাম এই বীরের কাছে মুক্তিযুদ্ধের গল্প শুনবো।ভাগ্যক্রমে, উনি আমাদের বাসায় বেড়াতে আসলেন। ঘরের পাশেই মেহগনি গাছের বাগানে নিরিবিলি বসলাম। আমি, বীরযোদ্ধা আমার তাওই(বোনের শ্বশুরকে আমরা তাওই বলি),আর আমার আব্বা। মা চা আর মুড়ি দিয়ে গেলেন।চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে আলাপ জমে ওঠলো ।
আমিঃ আচ্ছা, তাওই আপনি যখন যুদ্ধে গেলেন আপনার মা আপনাকে যেতে দিতে রাজি হয়েছিলেন?
তাওইঃ না। আমার মা পরথমে রাজি হন নাই।
আমিঃ তাহলে তাঁকে রাজী করালেন কিভাবে?
তাওইঃ আমাদের বাড়ির (বরিশালের গৌরনদীতে) আশ-পাশের অনেকেই যুদ্ধে গেছিল। তাই আমিও যাইতে চাইলাম।মা রাজি হইতেছিলেন না। মিলিটারিরা গৌরনদীতে ক্যাম্প বসাইল। জামাত মুসলিমলীগ করা অনেক লোকজনেরাই হিন্দুদের বাড়ি ঘর গণিমতে মাল বইলা লুট করা শুরু করল। রাস্তা-ঘাটে লোকদের, বিশেষ কইরা হিন্দু লোকদের মারতে লাগলো মিলিটারিরা। পরিস্থিতি যহন খারাপ হইতে শুরু করলো মা রাজি হইলেন।মা যহন দেকলেন আশপাশের অনেকেই যাইতাছে পরে রাজী হইছিলেন।
আমিঃ আপনি কি ২৬-২৭ মার্চের স্বাধীনতার ঘোষণা শুনছিলেন? বঙ্গবন্ধুর ২৬ মার্চের ঘোষণা অথবা ২৭ মার্চে বঙ্গবন্ধুর পক্ষে জিয়াউর রহমানের ঘোষণা?
তাওইঃ না। আমি হুনি নাই। তবে শেখ সাহেবের ৭ মার্চের ভাষণ রেডিওতে হুনছিলাম।
আমিঃ ৭ মার্চের ভাষণের সময় কি মনে হইছিল যুদ্ধে যাওয়া লাগতে পারে?
তাওইঃ না। ওই সময় এই রহম কিছু মাতায়ই আহে নাই। আসলে হিন্দুগো উপর অত্যাচার,হ্যাঁগো বাড়ি-ঘর লুট, আর লোক জনরে যেভাবে মাইরা ফালাইছে তা দেইখাই যুদ্ধে যাওনের সিদ্ধান্ত নিছিলাম।
আমিঃ ইন্ডিয়া গিয়াছিলেন কবে? কাদের সাথে গিয়াছিলেন?
তাওইঃ যুদ্ধ শুরু হওনের মাস দুয়েক পর। আমার এক চাচাত ভাই আর্মিতে চাকরি করতেন। তার সাথে গিয়াছিলাম। আমরা এক গ্রামের প্রায় ১০-১২ জন ছিলাম।
আমিঃ যাইতে কয়দিন লাগছিল? যাওনের খরচপাতি পাইছিলেন কোথায়? শুধু কি ১০-১২ জনই গিয়াছিলেন?
তাওইঃ যাইতে ১৫ দিন লাগছিল। হাঁইটাই গিয়াছিলাম। আমরা অনেক লোক আছিলাম। আমাদের গ্রামেরই শুধু ১০-১২ জন।আর খরচার কথা কি কমু! আমার মায়ের বিয়ের সময় পাওয়া ৫টা সোনার দানা ছিল। মায় যখন হুনল আমি যামুই তহন আমারে সোনার ওই ৫টা দানা আইন্না দিল। পাশের বাড়ির এক চাচির ধারে তা বেচছিলাম। দাম দিছিল ৬০ টাকা। মায়রে ১০ টাকা দিয়া বাকি ৫০ টাকা লগে নিছিলাম। যারা যারা গেছিলাম সবাই চান্দা দিয়া চিড়া আর মিডা কিনছিলাম। হারা পথ ওইয়াই খাইয়া আছিলাম।
আমিঃ আচ্ছা তাওই যাওনের সময়কার বিশেষ কোন স্মৃতির কথা মনে পড়ে?
তাওইঃ পড়ে। আমি যহন ইন্ডিয়া যাই ওই সময় আউশ-আমন ধান হইছিল আমাগো। বর্গা জমি চাষ করছিলাম অন্য মানুষের। যেদিন আমি গেলাম তার কয়েক দিন আগেই ধান কাটছিলাম। আমার মা যেই হুনলেন রাত্রির বেলা আমি যামু হারাদিন ওই ধানের পেছনে পইড়া রইলেন। ধান পিডাইয়া মাড়াই কইরা ঢেঁকিতে কিছু ধান কুডলেন। আমারে আড়াই সের চাউল দিয়া দিছিলেন লগে। আমি গামছায় বাইন্ধা হেই চাউল ইন্ডিয়া নিয়া গেছিলাম। পথে রান্দনের সুযোগ পাই নাই। ইন্ডিয়া ক্যাম্পে গিয়া রাইন্দা খাইছি।
(তাওইর চোখে পানি ছল ছল করছি্ল-হয়ত তাঁর মায়ের কথা ভেবে অথবা হয়ত যে দেশের জন্য যুদ্ধ করেছিলেন তার কথা ভেবে। কারন জানতে চাওয়ার সাহস পাই নাই)
আমিঃ তাওই, ইন্ডিয়ায় আপনাদের ট্রেনিং হইছিল কোথায়? কতদিন লাগছিল?
তাওইঃ আমাগো ট্রেনিং ক্যাম্প আছিল বিহারে। প্রায় পাঁচ মাসের মত আছিলাম। হেরপর দেশে আইসা যুদ্ধে অংশ নিছি।
আমিঃ তার মানে ৩ মাসের মত সরাসরি অপারেশনে অংশ নিয়েছিলেন?
তাওইঃ না, তিন মাস হবে না। আড়াই মাসের মত।
আমিঃ দেশে আইসা কাদের বিরুদ্ধে অপারেশনে অংশ নিছিলেন? কোন মিলিটারিরে কি নিজের হাতে মারতে পারছিলেন?
তাওইঃ আসলে আমাগো কাম আছিল দালালগো ধইরা আইনা কমান্ডারের হাতে পৌঁছাইয়া দেওয়া। অনেকেরেই ধইরা আনছি।পরে আবার তাদের অনেকেরে মাইরা ফালান হইছে।কমান্ডার অনেকেরে ছাইড়া দিছে। ওদের ধরতে গেলে ওরাও পালটা হামলা করত । তখন আমরাও হগলে মিল্লা এক সাথে হামলা করছি। দেহা গেছে জাইগায়ই ওদের লোক মারা গেছে।
আমিঃ তাহলে কোন মিলিটারিরে নিজের হাতে আপনি মারেন নাই?
তাওইঃ (হেসে দিয়ে) না। নিজের হাতে একলা একলা আমি গুলি কইরা কাউরে আমি মারি নাই। দলগত ভাবে মারছি।
আমিঃ দেশ স্বাধীন হওয়ার পর কি অবস্থা ছিল দেশের?
তাওইঃ যারা যুদ্ধের সময় হিন্দুগো বাড়ি ঘর লুট করছিল হ্যাঁগো অনেকেই মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকায় নাম লেহাইল। অনেকে মেম্বার-চেয়ারম্যান হইল।সালিশি দরবারে হ্যাঁরাই হর্তা কর্তা। আমরা অশিক্ষিত মানুষ। আমাগো কি আর কেউ দাম দেয় ? তয় শেখ সাহেবের আমলেই আমার নাম মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকায় উঠছিল। অনেকের তো তাও ওঠে নাই।
আমিঃ আপনে কইলেন রাজাকাররা অনেকে মেম্বার-চেয়ারম্যান হইছে। সরকার তো এহন অনেক রাজাকারের বিচার করনের উদ্যোগ নিছে। কয়েক জনের তো ফাঁসিও হইছে।
তাওইঃ রাজাকার কি খালি ৪-৫ জন আছিল? রাজাকার তো প্রত্যেক গ্রামেই আছিল। হ্যাঁগো বিচার হয় নাই। হইবেও না কোনদিন। আমার অবশ্য এইগুলা নিয়া এহন আর কোন মাথা ব্যতা নাই। বিচার হইলেই কি আর না হইলেই কি। কত রাজাকার বিচারের আগেই মইরা গেল। মিলিটারিগো লগে থাইক্কা ডিসেম্বর মাসের মাস খানেক আগে এহাকজন মুক্তিযোদ্ধা হইয়া গেল!
আমিঃ আচ্ছা তাওই, মুক্তিযুদ্ধের এত বছর পর কি আপনার মনে হয় মুক্তিযুদ্ধে গিয়া ভুল করছিলেন? দেশ স্বাধীন না হওয়াই ভাল আছিল?
তাওইঃ না। তা কেন হইবে? অবশ্যই ভাল কাম করছিলাম। আর দেশ স্বাধীন হইছে দেইখাইতো ঘরে ঘরে আই এ পাশ, বি এ পাশ পোলাপান। তয় একটা জিনিস কি জানো বাবা মাঝে- মধ্যে টেলিভিশন খুললে খারাপ লাগে। অনেকেরেই দেহি মুক্তিযুদ্ধ লইয়া,শেখ সাহেবরে লইয়া ব্যবসা করে।
আমিঃ তাওই চাটুকারেরা তো সব সময়ই ছিল, থাকবে। মন খারাপ করবেন না। আমি আপনার পা ছুঁয়ে একটু সালাম করব? আমার মাথায় একটু হাত রেখে আপনি আদর করবেন? আমাকে একটু দোয়া করবেন?
....................................... ..................... .................................... ....................................
কথার শেষের দিকে তাওই কিছু বলছিলেন না। আমিও না। তাওইর চোখে পানি। আমার বুকটা খা খা করছিল।আফসোস লাগছিল নিজের জন্য। মনে হচ্ছিল আমি আমার তাওইর মত কেন হতে পারলাম না!
#যারা পাকিস্তানিদের মুরগী সাপ্লাই দিয়েছিলেন আর এখন মুক্তিযুদ্ধের চৌকিদার সেজে বড় বড় লেকচার মারেন, তাদের জিহ্বাটা ছিঁড়ে ফেলার মত হিম্মত মহান রাব্বুল আলামিন আমারে কেন দিলেন না?
#যারা রাজাকারদের সাথে জোট করেছিলেন কিংবা করেছেন আর ফুল দিতে মিরপুর স্মৃতিসৌধে কিংবা সাভারে স্মৃতিসৌধে যান, তাদের মুখে কেন আমি থু থু মারতে পারি না?
#যারা যুবক- যুবতি বয়সি আছিলেন অথচ মুক্তিযুদ্ধে যাওনের বিন্দুমাত্র তাড়না বোধ করেন নাই ,চাকরির নামে যুদ্ধের নয়মাস পাকিস্তানীদের গোলামী করেছিলেন, বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া সচেতন ছাত্র হয়েও মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেন নাই; আর এখন মুক্তিযুদ্ধ ব্যবসায়ী হয়েছেন, মুক্তিযুদ্ধের সঠিক ইতিহাসকে ছিনতাই করেছেন, মুক্তিযুদ্ধের সুমহান চেতনাকে নিজেদের টয়লেট টিস্যু বানাতে চাইছেন- তাদের বুকে রাইফেল না হোক,গালে কসিয়ে একটা চড় মারনের সাহসও কেন আমার হল না?
কাপুরুষ আমি। আসলেই......
সর্বশেষ এডিট : ১৯ শে ডিসেম্বর, ২০১৫ রাত ১০:৪০