জানালা দিয়ে আনমনা হয়ে বৃষ্টি দেখছিল রিয়া। কলবেলের শব্দে চম্কে উঠল। ঘড়িতে তিনটা বেজে পনের। ইউনিভার্সিটি থেকে সেই দেড়টায় ফিরেছে। গোসল সেরে প্রিয় জানালাটার ধারে বসে ভাবনায় এতই নিমগ্ন ছিল যে সময়ের খেয়ালই ছিল না। দৌড়ে বসার ঘরে এস দেখে বাবা এসেছেন। তার শাশুড়ি খেয়ে-দেয়ে হিন্দি সিরিয়াল দেখছেন সোফায় বসে। বেয়াইনের সাথে কুশল বিনিময় শেষ হতেই রিয়া বাবাকে নিজের র”মে নিয়ে এল। ভার্সিটিতে বসে খবর শুনে প্রথমে বাবাকেই ফোনে জানিয়েছিল। এখন কি করবে? সাথে এই ভাবনাটাও ছিল, নাভেদকে খবরটা কিভাবে দেবে, সে কিভাবেই বা নেবে ব্যাপারটা।
একটা সময তিছল যখন এ ব্যাপারে কোনো টেনশনই হত না নাভেদকে জানতে, কিন্তু এখন সময় ভিন্ন। ভার্সিটিতে পড়ার সময় দু’জন একসাথে কত দেশে যে স্কলারশিপের জন্য আবেদন করেছিল তার ইয়ত্তা নেই। আর দু’জনের ভালোলাগা, ভালোবাসার শুর”টাও হয়েছে তখন থেকেই। দু’জনই কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ারিং থেকে পাশ করে, রিয়া ভার্সিটিতেই শিক্ষকতা শুর” করে। আর নাভেদ বাবার ব্যবসার হাল ধরেছে। একমাত্র ছেলে হওয়ায় তার আর কোন অপশন-ও ছিল না। রিয়ার বাবা তাদের বিয়েতে প্রথমে একটু গড়িমসি করলেও শেষ পর্যন্ত মেয়ের মুখের দিকে চেয়ে না করতে পারেন নি। তাছাড়া ছেলের পরিবারও ছোট। আর রিয়াও বাবা-মায়ের একমাত্র সন্তান। যদিও রিয়ার বাবার খুব শখ ছিল ডাক্তার পাত্র দেখে জামাই করার। কিন্তু কি আর করা! মেয়ের কোনো ইচ্ছেতেই যে বাবা বাঁধা দেননি কখনো। তাই আজ যখন শুনলেন রিয়া অষ্ট্রেলিয়ার বিখ্যাত একটি ইউনিভার্সিটি থেকে শতভাগ বৃত্তির অফার পেয়েছে। তার খুশি যেন আর ধরে না। আরে, এ তো শুধু ইচ্ছে নয, এটা ছিল রিয়ার স্বপ্ন। সে আরও পড়াশোনা করবে। নামকরা ইউনিভার্সিটিতে পিএইচটি করবে। বাবার কাছে এসব অজানা ছিল না।
কিন্তু এখন, রিয়ার দুশ্চিন্তাগস্ত মুখের দিকে তাকিয়ে বাবা জিজ্ঞেস করলেন, কি রে? তোর মা আর শাশুড়িকে জানিয়েছিস। নাভেদ কে কি আমি জানাবো? রিয়া বাবার মুখের দিকে চেয়ে বলল; না বাবা আমিই জানাবো ওকে। মাকে ফোনে জানিয়েছে রিয়া। আর শাশুড়ি শুনে কি বলেছেন? তার কথা হল, বিয়ের দেড় বছর হতে চলল, কোথায় নাতি নাতনির মুখ দেখব, তা-না, ্ এখন কি? বউ দুই বছরের জন্য বিদেশ যেতে চায়। তা-ও একা! মানুষই বা কি ভাববে? আর এত পড়াশোনা করে কী-ই বা হবে? অনেক তো পড়া হলো, চাকরিও করছ, আর কি করবে? মন দিয়ে সংসার কর।
রাত ন’টার দিকে নাভেদ অফিস থেকে ফিরে, খেয়েদেয়ে টিভি র”মে বসতেই রিয়া সোফায় বসে আস্তে করে জানাল খবরটা। নাভেদ খুব একটা পাত্তা না দিয়ে অন্যমনস্ক ভাবেই বলল, ভাল! তা তুমি আবার যাওয়ার কথা ভাবছ না তো? ওর এমন ঠান্ডা ভাব দেখে ভীষন অবাক হল রিয়া। বিষ্মিত হয়ে বলল, কি বললে তুমি? যাবার কথা ভাবব মানে তোমার মনে নেই। আমরা দু’জনই তো ঠিক করছিলাম বৃত্তি পেলে বাইরে যাব পড়াশোনা শেষ করতে। ভূলে গেতে এখন?
সাথে সাথে নাভেদের রাগ যেন মাথায় উঠে যায়। তোমার কি মাথা খারাপ হয়ে গেছে রিয়া. সেটা ভিন্ন ব্যাপার। তখন সবকিছু ভিন্ন ছিল। এখন তুমি এ বাড়ির বউ। একা এত দূর পড়াশোনা করতে যাবে। আত্মীয়-স্বজনেরাই বা কি বলবে? বন্ধু-বান্ধবের কাছে আমার মুখ থাকবে? চিৎকার শুনে শাশুড়িও এসে ছেলের সাথে গলা মেলান। পুত্রবধুকে বোঝাতে থাকেন, আর দরকার কি পড়াশোনার। যথেষ্ট হয়েছে মা, ওসব চিন্তা বাদ দিয়ে সংসারে মন দাও।
সারাটা রাত দু’চোখের পাতা এক করতে পারেনি রিয়া। বারবার মনে হচ্ছে নাভেদ এত সহজ কিভাবে এত সার্থপরের মতো উত্তর দিতে পারল? একবারও ভাবল না। যে সে নিজেও তো একসময় স্বলারশিপের জন্য কত চেষ্ঠা করেছিল।
সকালে ইউনিভার্সিটির ক্লাস সেরে বাবার বাসায় গিয়ে উঠল রিয়া। তার অবসরপ্রাপ্ত বাবা মেয়ের মুখের দিকে তাকিয়েই সব বুঝলেন দুপুরে খাবার পর মা যখন বললেন, কি রে বাসায় যাবি না? রিয়া বুঝতে পারছিল না কি বলবে? জীবনে এত বড় সিদ্ধান্তহীনতায় পড়তে হয়নি কখনো। আজ কি করবে? রাতে নাভেদ সাফ জানিয়ে দিয়েছে? যাবে যাও। তবে এ বাড়িতে আর তোমার ফিরে আসা হবে না। স্বপ্নেও ভেব না যে, আমি তোমার জন্য আমার জীবনের দু’বছর নষ্ট করব। রিয়া শুধু বিষ্ময়ে নির”ত্তর ছিল।
একমাসের মধ্যে রিয়ার ভিসা, থাকার ব্যবস্থা সব হয়ে গেল। ফ্লাইটের দিন শাশুড়িকে ফোন দিতেই বললেন, “যাও আমরা আর কে বলার? আমাদেরকে জানানোর-ই বা কি দরকার?” আর নাভেদ? ফোনই রিসিভ করল না।
আর আধঘন্টা পরই ফ্লাইট। এয়ারপোর্টে পাসর্পোট হাতে বাবার পাশে বসে চোখ মুছছে রিয়া। মা একটু পর পর মেয়েকে জড়িয়ে ধরে কাদঁছেন। চারদিকে সবকিছু কেমন যেন অদ্ভুদ লাগছে রিয়ার।
শেষ মুহূর্তের ঘোষনা শুনে একবার পেছন ফিরে তাকাল সে। ক্ষীণ আশা ছিল, নাভেদ হয়তো আসবে। বাবা-মায়ের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে ধীর লয়ে লাউঞ্জের দিকে পা বাড়ায় রিয়া। সঙ্গী হয় স্বপ্নপূরণের আনন্দ আর দু:স্বপ্নের মতো কাটানো গত কয়েকদিনের অদ্ভূত মিশ্র এক অনুভূতি।
কিন্তু এমন তো হওয়ার কথা ছিল না...