আজকে হামাসের সাথে ভালো সম্পর্ক বলে ইরানি মিডিয়াগুলো হামাস ও গাজা যুদ্ধ নিয়ে, বা হামাস ইস্যুতে ইতিবাচক লিখছে। যদি কখনো হামাসের সাথে সম্পর্ক খারাপ হয় তাহলে হামাসকে জোচ্চুর বানাতে সময় নিবে না
এক যুগ ধরে ইরানি মিডিয়ার চরিত্র প্রত্যক্ষ করার কারণে এ কথা হলফ করে বলতে পারি। ইরানি মিডিয়াগুলো আসলে রাষ্ট্রীয় প্রোপাগান্ডা আর রাষ্ট্রীয় মিডিয়ার মধ্যে ভারসাম্য রাখা বা পার্থক্য বুঝতে ব্যর্থ্য হওয়ায় দুনিয়াজোড়া হাস্যরসের জন্ম দিয়েছে।
এবার আসি ইরান-হামাস সম্পর্ক ও হামাসকে ইরানের সহায়তা প্রসঙ্গে। বাংলাদেশের কথিত ‘ইসলামপন্থীদের’ সাথে সৌদি আরবের সম্পর্কের অবনতি, মুসলিম বিশ্বের নানা ইস্যুতে আরব রাষ্ট্রসমূহ, তাদের নেতারা ও গণমাধ্যম সমূহের অব্যাহত নিরবতার ফলে বাংলাদেশ বা মুসলিম বিশ্বে যে নেতৃত্ব শূন্যতা সৃষ্টি হয়েছে সে সুযোগটাই ইরান ঢাকায় কাজে লাগানোর চেষ্টা করছে। মধ্যপ্রাচ্যে একই কাজ তারা মধ্যপ্রাচ্যের সবচেয়ে বড় রাজনৈতিক শক্তি মুসলিম ব্রাদারহুড (আরব দেশগুলোতে নিষিদ্ধ) বা ফিলিস্তিনের হামাসের (পশ্চিমাদের চোখে সন্ত্রাসী) সাথে সম্পর্ক উন্নয়নের মাধ্যমে দীর্ঘ বছর ধরে করছে বা করার চেষ্টা করছে। ইরানের আঞ্চলিক শত্রু সৌদি ও ইসরায়েলকে মোকাবেলায় ইরানের হাতে এর বাইরে কোনো বিকল্পও নাই। চীন ও রাশিয়া মধ্যপ্রাচ্যে যে পরিবর্তন চায় সেই পরিবর্তনের সঙ্গী হয়েছে পশ্চিমা ও তাদের তাবেদার আরবদের চোখে এ দুই ‘নিষিদ্ধ/সন্ত্রাসী’ শক্তি। হামাস বা ব্রাদারহুড যতটা না ইরানের ধর্মীয় মিত্র তারচেয়ে অনেক বেশি আঞ্চলিক।
তবে এবেলা ইরানকে আমার কাছে টেকশই বন্ধু মনে হয় না। মনে হয়েছে উভয়ের প্রয়োজনে কাছাকাছি আসা। ইরানের স্বার্থ না থাকলে যেই হামাসকে আজ সাহায্য করছে কাল তার বিরুদ্ধে হিজবুল্লাহকে লেলিয়ে দিতে দ্বিধা করবে না। ইরান সেটা করে দেখিয়েছেও।
সবচেয়ে বড় কথা হচ্ছে, ইরান শুধু শুধু সাহায্য করে বসে নেই। তারা গাজায় তাদের শিয়া মতবাদের প্রচার ও প্রসার বা চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করছে। বাংলাদেশেও বিভিন্ন ইসলামি দল, এনজিওর মাধ্যমে ইরান এ চেষ্টা করেছে। কিছুটা সাফল্যও তাদের আছে। একসময় সুন্নী ছিল কিন্তু এখন শিয়া বা নিজেকে আর সুন্নী মনে করেন না। সংখ্যায় কম হলেও খোঁজ নিলে ঢাকায় এমন মানুষের দেখা পাবেন। ঢাকাস্থ ইরানি কালচারাল সেন্টার সে লক্ষ্যে স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদে কাজ করছে। তাদের একমাত্র লক্ষ্যই হলো নানাভাবে সুন্নী মুসলিমদের বিভ্রান্ত ও বিভক্ত করা।
গাজা, বাস্তবতা ও শিয়া ডকট্রিন: গাজার বাস্তবতা আরও কঠিন। আরব দেশগুলোর মুখ ফিরিয়ে নেয়া ও মিশরে স্বৈরশাসকের আসন গেড়ে বসায় ফিলিস্তিনি মুক্তিকামী সংগঠন হামাস বড্ড অসহায়। ফলে হামাসকে নিজের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে ইরানের সাহায্য গ্রহণ করতে হয়। তবে এ নিয়ে হামাসের নেতা ও সমর্থকদের মধ্যে মতভেদ আছে। ফিলিস্তিনিদের একটা বড় অংশ চায় না ইরান গাজায় পূর্ণ মিশন গেড়ে বসুক। ইরানি প্রভাব ও শিয়া মতবাদের বাড় বাড়ন্ত নিয়ে হামাস নিজেই সবচেয়ে বেশি ভীত। গাজায় মানব সেবার নামে শিয়া মতাদর্শ ছড়ানোর কাজ করে আসছিল বেশকিছু ইরানি এনজিও। যারা কয়েকশ সুন্নীকে শিয়া মতবাদে কনভার্টও করেছে। ফলে হামাস ভীত হয়ে অধিকাংশ ইরানি এনজিওর কার্যক্রম গাজায় বন্ধ করে দেয়। এতে ইরান প্রচণ্ড ক্ষীপ্ত হয়। হামাসকে চূড়ান্তভাবে এর মূল্যও চুকাতে হয়।
ইসলামী জিহাদ নামে গাজায় যে আরেকটি প্রতিরোধ আন্দোলন রয়েছে সেটি ভেঙ্গে বেশ কয়েক বছর আগে ছোট আকারে আরেকটি নতুন সশস্ত্র গোষ্ঠীর জন্ম হয়েছে। যা করেছে কনভার্টেড শিয়ারা। মানবিকতার সুযোগ নিয়ে ইরানের চালোনো এই মিশনারি কার্যক্রমকে আমার কাছে অমানবিক মনে হয়েছে। ইরানরে এই ভূমিকা গ্রহণযোগ্য না। একটি আদর্শ রাষ্ট্র এভাবে একটি অসহায় জনগোষ্ঠীর অসহায়ত্বের সুযোগ নিতে পারে কি না সে প্রশ্ন থেকে যায়। অথচ তারা একই ধর্মের মানুষ।
শুধু তাই না ইরান হামাসের কাছ থেকে সাহায্যের বিনিময়ও নেয়। সেটা প্রধানত মিশরের সিনাই উপত্যকায়। এছাড়া জর্দান, সিরিয়া ও লেবাননে আছে দুই পক্ষের নানা হিসেব নিকেষ। ইসরায়েলের বিরুদ্ধে হামাসের বহু অসংযত আচরণের পেছনে কাজ করে ইরানের ইচ্ছার প্রতিফলন।
সিরিয়ায় গৃহ যুদ্ধ শুরু হলে ইরান হামাসকে আসাদের পক্ষে যুদ্ধ করতে বলে। হামাস তাতে রাজি হয়নি। একদিকে ইরানের কথা না শোনা, অন্যদিকে গাজায় ইরানি এনজিওগুলোর কার্যক্রম বন্ধ ও কনভার্টেড শিয়া গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে অভিযান ইরান ও হামাসের সম্পর্ককে তলানিতে নিয়ে ঠেকায়। হিজবুল্লাহ লেবানন থেকে হামাসকে বের করে দেয়। বহু হামাস সদস্য হিজবুল্লার হাতে মারধরের শিকার হয়। বন্ধ হয়ে যায় সাহায্য-সহযোগিতাও। তবু মাথা নত করেনি হামাস। পরিণাম হিসেবে, দামেস্ক থেকে তাদের রাজনৈতিক কার্যালয় সরিয়ে দোহায় নিয়ে যেতে হয়।
আর এ দ্বন্দ্বের চূড়ান্ত পরিণতি-হামাস প্রধান (রাজনৈতিক) হিসেবে খালেদ মিশালের স্বেচ্ছায় পদত্যাগ। ইরানের বিপ্লবী গার্ড খালেদ মিশালের নেতৃত্বে অস্ব:স্তি বোধ করে। মিশালকে হানিয়ার তুলনায় ইরান বিষয়ে কট্টর বলে বিবেচনা করা হয়। আরবদের সাথে মিশালের যোগাযোগ গভীর হওয়ায়-ইরান মিশালকে আস্থায় নিতে পারে না। ফলে হামাসের শীর্ষ নেতৃত্বের চাওয়া সত্ত্বেও মিশালকে সরে যেতে হয়। এতে খুশি হয় ইরান।
প্রায় এক দশকের টানাপোড়েন শেষে হামাস-তেহরান সম্পর্ক আবার পূর্ণ গতি পায়।
(চলবে।)
সর্বশেষ এডিট : ১১ ই জানুয়ারি, ২০২৪ দুপুর ১২:৫০