ই-রান, ফার্সি ভাষা, সাহিত্য, সংস্কৃতি, ই-রানি সমাজ নিয়ে আমার মধ্যে ভীষণ আগ্রহ কাজ করে। ‘চিল্ড্রেন অব হ্যাভেন’ মুভিটা সে আগ্রহের আগুনে পারদ ঢেলেছে সন্দেহ নেই।
ইস্তানবুলে প্রথম ই-রানি দর্শনে খানিকটা হকচকিয়ে গেছি বলা যায়। হয়তো এমন আধুনিক ই-রানি নারী আমার কল্পনায় ছিল না। ই-রান ও তু-রস্ক নিয়ে বাংলাদেশের মানুষের যে ধারণা তার সাথে যায় না বলেই হয়তো-এমনটা হয়েছে। তুরস্কেও চলনে বলনে নারীরা বেশ আধুনিক, স্বল্প বসনা।
আমার কাছে আমার ইস্তানবুল জীবনটাকে মনে হয় দ্বিতীয় জন্ম। বাংলাদেশে থাকতে থাকতে যা যা নিয়ে ফ্যান্টাসিতে ভুগতাম ইস্তানবুল শহরটা আমাকে সেসবের সংস্পর্শ দিয়েছে। আমাকে পৃথিবীর পৃথিবী, জীবনের জীবন শেখার পথটা দেখিয়েছে। এই পৃথিবীর একটা শহর নাকি কখনো ঘুমায় না, সেটা হলো ইস্তানবুল।
ইস্তানবুলের কাছে আরও এক কারণে আমি ঋণি-বঙ্গদেশের কথিত ইসলামপন্থীদের নগ্ন-লোভী চেহারা উন্মোচন করেছে এই শহর। বেঁচে থাকলে গল্পে গল্পে স্যাটায়ার করার ইচ্ছা রইল। আদতে বাংলাদেশে যে সবকিছুর নামে স্রেফ ভণ্ডামি চলে, সেই দৃষ্টিভঙ্গিও পূর্ণতা পেয়েছে এখানে এসে।
এই শহরে গিয়ে যেমন সিরিয়ানদের বন্ধু হিসেবে পেয়েছি, সংস্পর্শ পেয়েছি বহু ফিলিস্তিনি, আরব, ইউরোপিয় ও ই-রানিদের। আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থীদের ডর্মেটরিতে থাকায় আফ্রিকা থেকে ইন্ডিয়া হয়ে নানা দেশের শিক্ষার্থীদের সাথে মেশার সুযোগ হয়েছে।
সেখানে গিয়ে ভেঙ্গেছে তুর্কি-কুর্দিদের নিয়ে বহু মিথ বা মিডিয়ার প্রচারণা। কুর্দিদেরও কাছ থেকে দেখেছি। দেখেছি মিডিয়ার এতো প্রচারণার বাইরেও ইরাকি কুর্দি ও তুর্কমেন তুর্কির বন্ধুত্ব, যারা উভয়েই সাদ্দাম হোসেনকে ঘৃণা করে। এক বছর আমি ও এক ই-রানি কুর্দি এক রুমে ছিলাম। ফলে ই-রানি সংখ্যালঘুদের জীবন কিছুটা হলেও বোঝার সুযোগ হয়েছে।
তবে এই দেখা হওয়া, পরিচয় বা কথা হওয়া থেকে পুরো ই-রানি সমাজ নিয়ে কোন কথা বলা সমীচিন হবে না। আমি বলছিও না। শুধু নিজের অভিজ্ঞতা শেয়ার করছি।
সেই সুন্দরী রমনীতে ফিরি। তার সাথে দেখা হওয়ার পর টুকটাক কথাও হয়েছে। পরে আরেক ই-রানি বান্ধবির পাসপোর্ট দেখার সুযোগ হয়েছে। কালো বোরকায় মাথা ঢাকা।
২০১৫ সালের সামারের ছুটিতে উসমানীয় আমলের তুর্কি ভাষা ও সংস্কৃতি নিয়ে (কামাল পাশা প্রেসিডন্টে হওয়ার আগে যা প্রচলিত ছিল।) আয়োজিত এক সামার স্কুলে যোগ দেই। সেখানে পরিচয় হয় বলকান অঞ্চল, জার্মান বংশোদ্ভূত তুর্কিসহ নানা অঞ্চলের মানুষের সাথে। যাদের মধ্যে ইস্তানবুল বিশ্ববিদ্যালয়ে পিএইচডি করতে আসা এক ই-রানি দম্পতিও ছিলেন। পরিচয় পরবর্তী সময়ে এই দম্পতির সাথে বেশ হৃদত্যা গড়ে উঠে যা এখনো অটুট। বিশেষ করে সেই রমনীর সাথে। সেও বেশভূষায় আধুনিক। টাইটফিট পোশাকের সাথে উড়না পরার চল অন্য দেশগুলোতে নেই।
প্রথম পরিচয়ে ভেবেছিলাম আজারবাইজান থেকে এসেছে। নিজেকে আজারবাইজানি বলেই পরিচয় দেয়। পরে জানতে পারি এটা স্বাধীন দেশ আজারবাইজান না। এই আজারবাইজান ইরানের একটি প্রদেশ যেখানে জাতিগতভাবে আজেরিদের বাস। তার কাছ থেকে জানতে পারি ইস্তানবুলে আধুনিক জীবন যাপন করলেও ইরানে ফিরলে তাকে পর্দা করতে হয়। মাঝখানে ইরানের কি এক দিবসে সে ই-রান এম্বাসি আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে গিয়ে বক্তৃতা করেছে। হিজাবে ঢাকা এক ধার্মিক মহিলা। আমি আর বাংলাদেশি আরেক শিক্ষার্থী তার সাথে এসব নিয়ে খুঁনসুটিও করলাম।
আমার তুর্কি জীবনে বেশকিছু ই-রানি ছেলে-মেয়ে দেখার সুযোগ হয়েছে। যারা সকলেই চলাফেরা ও চিন্তা চেতনায় আধুনিক তথা ধর্মবিমুখ। ইস্তানবুলে নানা দেশের মানুষদের ধর্মকর্ম পালন করতে দেখা গেলেও ই-রানিদের ধর্মের ধারেকাছে ঘেষতে দেখেনি। তারা ধর্মীয় আচার আচরণ পছন্দ করে না। কখনো তাদের দেখিনি মুসলিম কোন উৎসবে শামিল হতে। আর মোটের উপর ই-রানিরা এলকোহল গ্রহণ করে।
আমার কাছে মনে হয়েছে, দীর্ঘদিন নিজ দেশে বাধাধরা নিয়মের মধ্যে জীবন যাপন করতে বাধ্য হওয়ায় ই-রানিরা যেন সীমানা পেরুনোর পর মুক্ত বিহঙ্গের মতো নি:শ্বাস নেয়। এই যে এক রকম জীবন যাপনে তারা বাধ্য হয় সেটা বোধহয় তাদের ধর্মীয় জীবনাচারের প্রতি অনাগ্রহী করে তুলে। বা দেশে ফেলে আসা জীবনটা অস্বীকার করতে চায়।
আমি নিজের অভিজ্ঞতা ইউরোপের বিভিন্ন দেশে থাকে ই-রানিদের সাথে বন্ধূত্ব আছে এমন কয়েকজন বন্ধু/সুহৃদের সাথে শেয়ার করেছি। তারাও বলেছে আরব দেশগুলোর (ই-রান-আরব-তুর্কি।) মধ্যে থেকে আসা মানুষগুলোর মধ্যে ই-রানিরা তাদের ভাষায় আধুনিক ও নাস্তিক হয়। তারা ধর্ম মানে না। এর ফলে জার্মানির মতো রাষ্ট্রগুলোতে সাধারণ জার্মানরা ই-রানিদের পছন্দ করে। তাদের আধুনিক ও বিজ্ঞান মনস্ক বলে স্ব:স্তি বোধ করে।
আমার এ ধারণা হয়তো বাংলাদেশি যারা ই-রানে বসবাস করছে তাদের অনেকের সাথে মিলবে না। আবার তারা হয়তো ই-রানে থাকে বলে ই-রানিদের এই মনোভাব টের পাবে না। এখানে আসলে দুই ধরনের অভিজ্ঞতার সম্মিলন ঘটছে। তবে ই-রানিদের যে মানসিকতা আমি আমার বিদেশ জীবনে দেখেছি তাতে ই-রানের যে ইসলামী বিপ্লব তার ভবিষ্যৎ নিয়ে একটা আশংকা জাগে। পশ্চিমারা এ রাষ্ট্র ভাঙ্গার আগেই হয়তো দেশটির জনগণ বিপ্লবকে মুছে ফেলতে চাইবে বা তারা সংখ্যাগরিষ্ঠ হয়ে রাষ্ট্রব্যবস্থা পাল্টাতে চাইবে।
সাবেক সাম্রাজ্য হিসেবে ই-রানিরা শত শত বছর ধরে বৈশ্বিক ক্ষমতার বাইরে। আরবদের ক্রমবর্ধমান বিবাদ আর নিজেদের বিকিয়ে দেয়ার সুযোগে মধ্যপ্রাচ্যে ই-রানের প্রভাব বাড়লেও, ই-রান পবিত্র আল আকসার রক্ষার ভ্যানগার্ড হামাসের প্রধানতম সহযোগী হিসেবে কাজ করছে এটা জানার পরও বলতে হয় ইরানের হাতে প্রত্যক্ষ রক্তের দাগ। যে কা-সেম সো-লাইমানী আমেরিকার হাতে শহীদ হয়েছেন তার হাত দিয়ে মধ্যপ্রাচ্যের সুন্নী মুসলমানদের তাজা রক্তের নহর বয়েছে। এবেলা ই-রান বা সো-লাইমানীর বিবেচনায় মুসলিম বিষয়টা আসেনি। প্রতিপক্ষ মানে শত্রুপক্ষ। তারা কোন ধর্মের তা ই-রান বিবেচনায় নেয় বলে কখনো মনে হয়নি।
আমি যে কারণে সৌদির সমালোচনা করি। তুরস্কের বিরুদ্ধে লিখি ঠিক একই বিবেচনা বোধ থেকে ই-রানের সমালোচনা করাটাও জরুরি মনে করি। বিশেষ করে ই-রানের শিয়া ডকট্রিনিজমের। যা তারা নানা সুন্নী দেশে নানাভাবে পাচার করার চেষ্টা করে। অথচ আমরা মুসলমান-এটাই হতে পারত আমাদের সবেচয় বড় পরিচয়। পশ্চিমা সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে যে কারো লড়াইকে আমি সমর্থন করে, একইসাথে সংশ্লিষ্ট গোষ্ঠীর কাছ থেকে দায়িত্বশীল আচরণ আশা করি।
ই-রান যদি ভবিষ্যতে শিয়া-সুন্নী ইস্যুতে চালানো প্রোপাগান্ডা থেকে বের হয়ে এসে পুরো মুসলিম উম্মাহকে ধারণ করার চেষ্টা করে তাহলে এটা শুধু মুসলিম বিশ্ব না পুরো পৃথিবীর জন্য কল্যাণকর হবে। ই-রানি মিডিয়াগুলো সমস্ত মুসলিম দেশগুলোর স্বার্থে একটা ঐক্যবদ্ধ ও নৈতিক অবস্থান নেবে। সত্য প্রকাশ না করুক, অন্তত মিথ্যা প্রোপাগান্ডা চালাবে না। যে ভারসাম্য আমরা কমবেশি দেখি কাতারি ও তুর্কি মিডিয়া ও দেশটির রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের বক্তৃতা ভাষণে।
ইরানের সুমতী হোক।
(সমাপ্ত)
(সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ফিল্টারিং হয় বলে কিছু নামে হাইফেন ব্যবহার করা হয়েছে।)
সর্বশেষ এডিট : ২৫ শে আগস্ট, ২০২১ বিকাল ৫:১৯