আমি ও আমার ছোট ভাই সাগর।
অসাধারন একটা টুর করে আসলাম সিলেট থেকে। আজ সেই টুরের কথাই বলবো। তার আগে বলে নেই, যদি আপনার বাজেট ৪,০০০ টাকা হয়ে থাকে আর আপনারা যদি দলে ৪ জন হয়ে থাকেন আর যদি তিন দিনের টুরে সিলেট যেতে চান তাহলে এই পোষ্ট আপনাদের অনেক কাজে লাগবে।
আমাদের টুরের প্লান টা হটাৎ করেই। কোন রকম পিপারেশন ছাড়াই আমরা টুর করে আসলাম। ১৩ তারিখ রাত ১১:১৫ এ আমরা সিলেটের উদ্দেশ্যে যাএা শুরু করলাম। পৌছালাম ভোর ৪টায়, যদি ট্রেনে ফিরতে চান আর ডিটারমাইন্ড থাকেন যে তিন দিনই থাকবেন তাহলে সিলেট পৌছেই রিটার্ন টিকেট টা করে ফেলবেন, তাহলে বাকি টুরটা টেনশন ছাড়াই করতে পারবেন। অবশ্য বাসের টিকেট যে কোন সময়ই কাটতে পারবেন।
বাস থেকে নেমে চাচার দোকানে চা পান করলাম।
সিলেটে একটা জিনিসের কোনই অভাব নেই, তা হলো হোটেল, এসি/নন-এসি/বিলাসবহুল/সাধারন/অতিসাধারন সব ধরনের হোটেলই আছে। আমরা উঠলাম হোটেল অনুরাগ-এ। এখানে সিঙ্গেল রুম ৪০০টাকা(দুই জন আরামসে থাকতে পারবেন), তিন বেডের রুম ৫০০টাকা(নরমালই ৪জন থাকতে পারবেন,টুরে তো আর আরাম করতে যাবেন না, তাই না?), রাতে ঘুমানো আর জিনিসপএ রাখার জন্যই তো হোটেলে রুম নেয়া। বাজেটের কথা ভাবলে এই দামে এই হোটেল ভাল। এখানে আপনে একটা কঠিন বোনাস পাবেন। কি পাবেন পরে বলছি। সরাসরি টুরে যাই, কেমন ....
প্রথম দিন- ডেস্টিনেশন রিকভারি
আমাদের প্লান ছিল সকাল নয়টায় আমরা জাফলং যাব। কিন্তু কিছু কান্ডজ্ঞানহীন মানুষের জন্য প্রথমদিনের অর্ধদিবস জলে গেল। যা হোক, কোন কারনে জাফলং এর রাস্তার অর্ধেক যেয়ে আমরা ফেরত আসি। দের ভিতরই দেখা হয়ে গেল একটা পুকুর যার ভিতর থেকে গ্যাস বের হচ্ছে, লোকাল একটা ছেলে পানিতে আগুন ধরিয়ে দেখালো।
এই সেই পুকুর যার পানিতে আগুন ধরানো যায়। ড্রাইভার চাচা বললো যে ব্রিটিশরা নাকি এইটা খনন করেছিল গ্যাস উত্তোলনের জন্য কিন্তু তার পর থেকেই এই গ্যাস নষ্ট হচ্ছে।
একটা দিন নষ্ট হয়ে যাবে, কিছুই দেখবো না, তা কি হয়? নো ওয়ে। তাই আমরা চার জন চোল্লাম শাবিপ্রবি ক্যাম্পাসে। দেখলাম দুনিয়ার সবচেয়ে লম্বা পথ-আল্পনা।
এক কথায় অসাধারন। কি বলবো, অসাধারন অসাধারন অসাধারন। আমার বোনও এই খানে পড়ালেখা করেছে, আমিও বেশ কয়েকবার এখানে এসেছি। কি বলবো, তোমরা অসাধারন। আচ্ছা, ৩-ডি ছবিও না আঁকা হয়েছিল? আমরা দেখতে পারি নাই খুইজাই পাইলাম না। কিংবা বুঝিই নাই কোনটা ৩-ডি রাত আট টা পর্যন্ত আমরা সাস্টে ছিলাম, তারপর রাতের খাবার খেলাম "পাঁচভাই রেষ্টুরেন্ট"এ। ভর্তা গুলো স্বাদ এখনো মুখে লেগে আছে। খাবারের দাম এতো কম!!!
ঘটনাবহুল কিন্তু বলার মত না এমন ভাবেই আমাদের প্রথম দিনটা শেষ হয়ে গেল।
দ্বিতীয় দিন- ডেস্টিনেশন মাধবকুন্ড
সকাল ৯ টায় আমরা মাধবকুন্ড দেখার জন্য যাএা শুরু করলাম। পথে দেখার মত প্রাকৃতিক দৃশ্য আছে। পুলাপান কেমনে এই সব না দেখে ঘুমায় আমি বুঝি না। আজব!!!
মাধবকুন্ডের আসল সৌন্দর্য দেখতে হলে যাওয়া উচিত বর্ষা কালে, তখন ঝরনা অনেক বড় থাকে। যেহেতু সিলেট থেকে মাধবকুন্ড যেতে অনেক সময় লাগে তাই আমি আপনাদের সকাল সাতটার দিকে বের হবার জন্য সাজেষ্ট করবো।
সকাল সকাল বের হতে পারলে আপনার বডিফিটনেস যদি পাহাড়ে চড়ার মত হয় তাহলে ঝড়নার পানিতে নামার আগে পাহাড়ি রাস্তা ধরে ঝরনার ঢাল পর্যন্ত ঘুরে আসুন।
সময় লাগবে কিন্তু উঠতে পারলে ফিলিংস টা অসাধারন। আমি কিন্তু উঠি নাই। আফসোস করছি।
ওখান থেকে নেমে ঝাপিয়ে পরুন ঝরনার পানিতে, সাবধানে, পানি খুব বেশি না কিন্তু খুব ঠান্ডা। উঠতে বলে লাভ নাই, এক-দেড় ঘন্টা পানিতে দাপাদাপি করে ফেরার পথ ধরুন। পথে পড়বে চা-বাগান, রাবার বাগান খাসিয়াদের বাড়ি (এখানে নেমে দেখে নিতে পারেন হাতে বুনা তাত,চাইলে খুব কম দামে খাসিয়াদের ট্রেডিশনাল ড্রেসও কিনতে পাবেন এখানে), হাতে টাইম থাকলে ঘুরে আসুন ফেন্চুগঞ্জ সার কারখানা, পল্লীবিদ্যুত পাওয়ার প্লান্ট ইত্যাদি। প্লাস চা-বাগান, রাবার বাগান ইত্যাদি।
ফিরতে ফিরতে সন্ধ্যা হয়ে গেল এরই মাঝে। রাস্তায় একবার ঢু মারলাম রেলস্টেশনে, দেখি টিকেট পাওয়া যায় কি না। (ও একটা কথা ভুলে গেছি, বাস স্টপ, মানে সিলেটে আপনাকে যেখানে নামিয়ে দিবে তার পাশেই রেলস্টেশন, তাই সিলেট নেমেই টিকেট কনফার্ম করেনেন।) মিললো টিকেট তবে ব্লাকে, ২৮০টাকার টিকেট ৫০০টাকা চেয়ে বসলো, নিলাম না, বাসের টিকেট যেকোন সময় পাওয়া যায়। চলে আসলাম হোটেলে। দুপুরে খাওয়া হয়নাই, পেটে ইদুর সাহেব ডৌড়াদৌড়ি শুরু করে দিয়েছে। গোসল করে ফ্রেশ হয়ে আমরা দৌড় লাগালাম "পাঁচভাই"এ। পেট ভরে খেয়ে দেয়ে গেলাম হয়রত শাহজালাল (রাঃ) মাজার জিয়ারত করতে। এখানে ইশার নামাজ পরে ফিরলাম হোটেলে। ক্লান্ত ছিলাম। শোয়ার সাথে সাথে ঘুম।
তৃতীয় দিন- ডেস্টিনেশন জাফলং
সকালের নাস্তা করলাম "পানাহার" রেস্টুরেন্টে। তারপর ১০টায় শুরু হলো আমাদের জাফলং যাএা। পথে প্রথমেই গেলাম হযরত শাহপরান (রাঃ)এর মাজার জিয়ারত করতে। সেখান থেকে লালাখাল (এইটাই মনে হয় সিলেটের সবচেয়ে সুন্দর জায়গা, প্রথমদিনটা নষ্ট না হলে এখানে বোটে ঘুরা যেত, ড্রাইভার ভাই জানালো, বোট নিয়ে ভিতরের দিকে গেলে একটা রিসোর্ট আছে, এক রাত থাকতেই নাকি ৪,০০০টাকা লাগে, না থাকলেও বোট নিয়ে সবুজ পানির লেকটা ঘুরে দেখবেন, মাস্ট সি)
তামাবিল স্থল বন্দর(এখানে কি দেখবো তাই বুঝতেই একটু সময় লেগে গেছিল, পরে বুঝলাম এইটা বর্ডার এরিয়াটা দেখার জন্য পাবলিক আসে, আমিও দেখলাম, দেখলাম পাথর, কয়লা, ইন্ডিয়ান ট্রাক, সিমান্ত চেকপোষ্ট, দুইটা বিদেশী কুত্তা ইত্যাদি)
তবে তামাবিল থেকে জাফলং যাওয়ার এই দুই-আড়াই কিমি রাস্তাটা অসাধারন সুন্দর। যাই দেখবেন তাই সুন্দর লাগবে। জাফলং পৌছে গাড়ি ছেড়ে দিবেন না।অনেক ড্রাইভার রা অনেক দুর নামিয়ে দেয়, ফলে আপনাকে অনেক রাস্তা হেটে অথবা নৌকাতে আসতে হবে। ড্রাইভারকে বলবেন যেন রাস্তার শেষ পর্যন্ত নিয়ে যায়। এরপর আবার দাপাদাপি, নৌকা নিয়ে ঘুরে আসুন যতদুর যাওয়া যায়।
কমসে কম দুই ঘন্টা পানি থেকে উঠবেন না। এত পরিস্কার পানি ইচ্ছা হলে খেতেও পারেন। ফেরার পথে দেখে যেতে পারেন রাজকুমারী ইরাদেবীর বাড়িটি।
সিলেট ফিরেই পেটপুজার জন্য দৌড়ালাম জিন্দাবাজার। আজ খাবো "পানশি" তে। খাওয়া দাওয়া সেরে পুলাপান খাইলো পান আর আমি খাইলাম "ইনো", এন্টাসিড, সেকলো ইত্যাদি। পেটে হাত বুলাতে বুলাতে গেমান এক মাজারে যেখানে বানর আছে। কলা খাওয়ালাম পুর্বপুরুষদের। সেখান থেকে গেলাম পর্যটন। পর্যটন থেকে কিছু লুলামি করে গেলাম পার্কে। এখানে প্রকাশ্যে একটু-আকটু ১৮+ কাম কাজ হয় আর কি। ইউ নো হোয়াট আই মিন ... পার্কটার চরকি রাইডটিতে চরবেন। উপরথেকে পুরো এরিয়াটা অসাধারন লাগে। ওখান থেকে গেলাম ৭ রং এর চা খেতে। জঘন্য স্বাদ। তাই চার জন গেলে চার কাপ দিবার কোন দরকার নাই, ৪ কাপ নরমাল চা খান সাথে এককাপ ৭ রং এর চা এর অর্ডার দেন, চাইলে ভাগ করে খেতে পারবেন। চা খেয়ে আবার গেলাম রেলস্টেশনে, যদি টিকেট পাওয়া যায়, পাইলাম কিন্তু এক সাথে না, আলাদা আলাদা বগিতে। বাসই শেষ ভরসা। তাই চলে আসলাম হোটেলে। গোসল করে ফ্রেশ হয়ে ঢাকার বাসে উঠে বসলাম। মুখে বললাম, "আবার আসবো"।
এবার, বাঙ্গালী হইয়া ফ্রী এডভাইস দিব না তা কি হয়, বলেন?? এই লন কিছু দরকারি তথ্য...
# ভুলেও ঢাকা থেকে গাড়ি ভাড়া করে আসতে যাবেন না, রাস্তার অবস্থা ভাল কিন্তু পাহাড়ি রাস্তায় সবাই গাড়ি চালাতে পারে না।
# হোটেল আনুরাগের রুম ভাড়াতো আগেই দিয়েছি, এসি রুম ভাড়া মনে হয় ২৫০০ টাকা ডাবল।
পর্যটন মোটেলে দুই ধরনের রুম আছে, সব ডাবল বেড, এসি ও নন-এসি। এসি ২০০০ টাকা, নন-এসি ১৩০০টাকা।
# গাড়ি ভাড়া মাধপকুন্ড যেতে নিবে প্রাইভেটকার ২৫০০-২৮০০ টাকা, নোহা ৩,০০০-৩,৩০০ টাকা, আর জাফলং যেতে নিবে প্রাইভেটকার ২,০০০ টাকা, নোহা ২,৭০০টাকা।
# আমাদের ড্রাইভার, আলমগীর ভাই ছিল হোটেল অনুরাগের কঠিন বোনাস, কোন দাবী ছাড়াই সে আমাদের বোনাস হিসাবে সিলেটের আসেপাশের সুন্দর রাস্তা গুলো তে ড্রাইভে নিয়ে গেছিল। সিলেটে দেখার মত কি কি আছে, তাও সে বলে দিবে। সে গাইড হিসাবেও ভাল, আপনাকে বলে দিবে কখন কি করতে হবে। আসল কথা সে আসলেই সিলেটের রাস্তাগুলো চিনে। সে গাইড না করলে আসলেই আমরা অনেক কিছু মিস করতাম। চাইলে আপনারাও তাকে হায়ার করতে পারেন। তার ফোন নং।
০১৭১২ ০৬৮ ৭০৯।
# জাফলং দেখার আগে মাধবকুন্ড দেখা উচিত বলে আমি মনে করি। জাফলং দেখবেন লাষ্টের দিন, যখন ফিরবেন তখন যেন চোখে জাফলং ভেসে থাকে।
# এক এক দিন এক এক জায়গায় খাবেন, পাঁচভাই বা পানসি তে খাবারের দাম অনেক কম (পুলাপান বললো কক্সবাজারের চেয়ে নাকি সিলেটের খাবারের দাম বেশী!!!)। আমরা চারজন গলা পর্যন্ত খেয়ে বিল হইছে মাএ ২৯০ টাকা, ভর্তা গুলো মাস্ট ট্রাই করবেন। কোয়েল খাইয়া আমি হতাশ।
# লোকাল লোকজন অতিথিপরায়ন কিন্তু তাদের সাথে তর্কাতর্কি তে না যাওয়াই ভাল।
# টুরে অযথা বীরত্ব না দেখানোই উচিত, হয়তো কিছুই হবে না কিন্তু যে দেশের সীমান্তরক্ষীরা ফেলানীকে মেরে কাটা তারে ঝুলিয়ে রাখে তাদের "কিছু করবে না" এই বিশ্বাস আমি করতে রাজি না।
# উগ্র ড্রেস পরা উচিত না সিলেটে, মনে রাখবেন আপনি যাচ্ছেন "বার আওলিয়ার মাজারের শহরে"। ভদ্রতা বজায় রাখুন।
# জাফলং যান আর মাধবকুন্ড যান, যেখানেই যান, পানিতে আপনে নামবেনই, তাই কাপড় চোপড় সাথে রাখবেন। ভাড়াও পাবেন তবে নিজেরটাই ব্যবহার করা উচিত।
# মাজারে যাবেন কিন্তু লক্ষ রাখবেন আপনার সব ভক্তি যেন আল্লাহর প্রতিই থাকে। সব আল্লাহর ইচ্ছায় হয়, মাজারে গিয়ে মাথা ঠেকাবেন না।
# পাঠিকাদের বলছি, ভুলেও মেকআপ নিয়েন না, অনেক গরম পরিবেশ, একটুপর আপনাকে ভুতের মত লাগবে। হাঃহাঃহাঃ
# টুরে যাবেন তো হালকা ড্রেস পরার চেষ্টা করুন। ভারি ড্রেসে আপনি সহজে মুভ করতে পারবেন না।
# প্রয়োজন পরতে পারে, ফাস্ট এইড বক্সটা সাথে রাখুন। এসিডিটি বা ঠান্ডা-জ্বরের প্যারাসিটামল সাথে রাখুন।
# অনুমতি না নেওয়া থাকলে চা-বাগানের বেশি ভিতরে ঢুকা উচিত না।
# সবারই ক্যামেরা নেওয়ার দরকার নাই, ৫ জনের দলে একটা ক্যামেরাই এনাফ। বেশী জিনিস থাকলে শান্তিতে পানিতে দাপাদাপি করতে পারবেন না, টেনশন কাজ করবে।
# কোন ছাইয়া পাবলিকদের দলে ভিরাবেন না, মনে রাখবেন, একজন স্বার্থপর টুর মেম্বার আপনার স্বাধের টুরের ১২টা বাজায় ফেলতে পারে।
# সিলেট যেয়েই একজনকে টাকাপয়সার খরচের জন্য নিয়োগ করুন, আমরা চারজন প্রতিদিন সকালেই থাকা-খাওয়া-বেড়ানো-এদিকসেদিক বাবদ জন প্রতি ১,০০০টাকা করে দিয়ে দিতাম। ফলে খরচের একটা সুন্দর হিসাব চলে আসতো। সব কিছু মিলিয়ে দৈনিক ১,০০০টাকার বেশি লাগে না। যত বেশি টুর মেম্বার খরচ তত কম।
# সহনশীল হন, টুর মেম্বারদের উপর বিশ্বাস রাখুন, দেখবেন টুরটা অসাধারন হবে।
# টুর কখনোই লেনদি করবেন না, ২ দিন/৩ দিন/৪ দিনের ভিতর করার চেষ্টা করুন। টুর "অল টাইম দৌড়ের উপর" টাইপ হওয়া উচিত। বোর হবার চান্সই দিবেন না নিজেকে।
নেক্সট টুর চট্রগ্রাম-কক্সবাজার-সেন্টমার্টিন, মে-জুন এর দিকে যাব। দোয়া করবেন।
সর্বশেষ এডিট : ১৮ ই মার্চ, ২০১৩ সকাল ১১:৩৮