গ্রামের বাঁশের সাঁকোটা পার হতে হয় অনেক কষ্টে। পা পিছলে যে কোন সময়ে নীচে পড়ে যাওয়াটা তেমন কোন বিচিত্র ঘটনা নয়। তার পর আবার পায়ে চামড়ার বাটা জুতো । সকালের শিশির ভেজা বাঁশের উপর হাঁটা কি এতোই সোজা।
অনেক কষ্টে পা টিপে টিপে তবে না পার হলাম। আবার হাঁটা । একটু হাঁটার পর ইট বিছানো পাকা সড়কে উঠা যায় । এখানে একটু দাঁড়ালেই অনেক রিক্সা । ভাড়া দিতে হবে ৫ টাকা। আমার কাছে ৫ টাকা তখন (২০০৩ সালে) অনেক টাকা । কারণ বেকার মানুষ। একটি টাকাকে মনে হয় এক শত টাকা। রিক্সা চড়া তখন মার্সিডির্সিজ চড়ার মতো বিরাট বিলাসিতা। তার চেয়ে ১০ মিনিট হাঁটতে রাজি। হাঁটলে তো আর পয়সা খরচ হচ্ছে না। এমন যদি হতো যে হাঁটলেও পয়সা দিতে হবে সরকারের লোককে তাহলে তো বেকার লোকদের হতো জ্বালা।
রাস্তার নানান দৃশ্য দেখতে দেখতে ১০ মিনিট পার করে দেয়া আমার কাছে তো কোন বিষয়ই না। প্রতি দিনই তো তাই করি। দ্রুত বেগে ১০ মিনিট হাঁটার পর আরাম বাস স্ট্যান্ডে আসতে পারলাম। বাসের নামটি আরাম। এটি তখন এক মাত্র বাস যা কিনা কাগজে কলমে সরাসরি ঢাকায় যায়। বাকি সব বাসের ভাড়া ৪০ টাকা হলেও এর ভাড়া ৫০ টাকা।
বাসটি কোন মালিক সমিতির হলেও এর কাউন্টার জয়পাড়া হাই স্কুলের জায়গায়। স্কুলের হোস্টেলের একটি রুমও তারা ব্যবহার করছে। শুনতে পেলাম এর মধ্যেও নাকি রাজনীতি আছে। রাজনীতি তো থাকতেই পারে। নইলে কি আর স্কুলের মধ্যে বাস কাউন্টার বসানোর সাহস কারো হতে পারে।
আমি টিকিট কাউন্টারে গিয়ে টিকিট চাইলাম।
-ভাই, একটা টিকিট দেন, শ্রীনগরের। বলে ২০ টাকা এগিয়ে দিলাম।
-আজ শ্রীনগরের টিকেট শেষ। ঢাকার টিকেট নেন।
- কিন্তু আমি তো যাব শ্রীনগর, ঢাকার টিকিট তো ৫০ টাকা । আমি ৫০ টাকা দিয়ে শ্রীনগরের টিকেট কেন নেব?
-যদি যেতে চান তাহলে তো নিতেই হবে।
হাতে সময় নেই। তাছাড়া আরামের সার্ভিস একেবারে খারাপ নয়। এই কারণে ৫০ টাকা দিযেই ২০ টাকার পথের টিকিট নিলাম। এই পথ আমার অনেক চেনা। জয়পাড়া থেকে লৌহজং পর্যন্ত পথের আশে পাশের প্রতিটি বাড়ি প্রতিটি গাছ আমার কাছে অনেক চেনা। যেন এক রকম মুখস্থ। কিন্তু কেন যে বোকার মতো ৫০ টাকা খরচ করে ফেললাম। খুবই আফসোস হচ্ছে- ৩০ টাকা বেশী খরচ করে ফেললাম। ৩০ টাকা রোজগার করা এতো সহজ কর্ম নয়।
পরের স্টেশন দোহার বাজারে গিয়ে (অথবা যে কোন স্টপেজে) ২০ টাকা দিয়ে টিকিট নিলেই আমার মূল্যবান ৩০ টি টাকা বেঁচে যেত। এখন আমার টাকা বাঁচানো অনেক জরুরী। জয়পাড়া আরাম কাউন্টারে সম্ভবত তরুণ ভাই নামে একজন কাজ করতেন। তিনি একটু কষ্ট করে আমাকে এটা বললেই পারতেন।
মানুষের জীবন চক্রের একটি কষ্টকর সময় হচ্ছে বেকার কাল। বেকার কাল সবার জীবনে অবধারিত ভাবে আসবেই। একে এড়িয়ে যাবার কোন উপায় নেই।
বাংলাদেশের সকল বেকাররা সুখী হোক। তাদের সুন্দর একটি কর্মসংস্থান হোক। সাজানো গুছানো একটি জীবন হোক। পৃথিবীতে মানুষ বেশী দিনের আয়ু নিয়ে আসেনি। পৃথিবী অনেক অনেক সুন্দর । টাকা ছাড়া এই সৌন্দর্য উপভোগ করা সবার জন্য সহজ নয়।
#(ঘটনাটি ২০০৩ সালের। আমি তখন লৌহজং কলেজের মাস্টার ছিলাম। )
সর্বশেষ এডিট : ০৫ ই ফেব্রুয়ারি, ২০২৪ বিকাল ৫:২৭