‘মানুষের ভাবনায় যেমনটা ঘটে’ (অ্যাজ আ ম্যান থিংকেথ)
- জেমস অ্যালেন: ১৯০২ খ্রিস্টাব্দে প্রকাশিত
৬টি উদ্ধৃতি
-----------
“আত্ম-নিয়ন্ত্রণই শক্তি। সঠিক চিন্তনে ওস্তাদি। প্রশান্তিতে ক্ষমতা।”
“ব্যক্তির জীবনের পারিপার্শ্বিকতা সব সময় তার অন্ত:স্থিত দশার সাথে একতানে থাকতে দেখা যায়…মানুষ যা চায় তা আকর্ষণ করে না, বরং সে যেমন তাই আকর্ষণ করে।”
“শক্তিশালী ব্যক্তি দুর্বলকে সাহায্য করতে পারে না যদি না দুর্বল ব্যক্তি সাহায্য পেতে আগ্রহী থাকে, এবং এরপরও কথা আছে, দুর্বল ব্যক্তিকে নিজেকেই সবল হতে হবে, তার নিজ চেষ্টায়, অন্য যে ব্যক্তির প্রতি সে বিস্ময়বিমুগ্ধ তার গুণে শক্তিশালী হওয়ার মাধ্যমে। সে নিজে ছাড়া আর কেউ তার অবস্থার পরিবর্তন ঘটাতে পারবে না।”
“যে যেমন ভাবে, সে তাই; সে যেভাবে চিন্তন চালিয়ে যায়, সে তেমনই থাকে…ব্যক্তির সীমাবদ্ধতা এতটুকুই, সে যেমন চিন্তন বেছে নেয় সে তেমন।”
“ব্যক্তি তখনই মানুষ হয় যখন সে ঘ্যানঘ্যান করা আর শাপশাপান্ত করা থেকে বিরত হয়ে যে লুকায়িত ন্যায়বিচার তার জীবনকে পরিচালনা করে সেটির খোঁজ শুরু করে। এরপর সে তার মনকে সেই নিয়ন্ত্রণকারী হেতুর সাথে মিলিয়ে নেয়, এবং নিজকে শক্তিশালী ও উন্নত চিন্তায় সমৃদ্ধ করে। পাশাপাশি পারিপার্শ্বিকতার সাথে যুদ্ধ করা থামায় কিন্তু সেগুলোকে তার উন্নতির হাতিয়ার হিসেবে কাজে লাগানো শুরু করে, এবং তার নিজের ভেতরের সুপ্ত ক্ষমতা ও সম্ভাবনা জাগ্রত করার উপায় হিসেবে কাজে লাগায়।”
“সারাক্ষণ বৈরভাব, নৈরাশ্যবাদিতা, সন্দেহ এবং ঈর্ষা চিন্তায় ডুবে থাকলে ব্যক্তি নিজেই নিজের কয়েদখানা তৈরি করে ফেলে। কিন্তু সবার মঙ্গল চিন্তা করা, সবার সাথে খোশমেজাজে থাকা, ধৈর্যের সাথে সবার মাঝে ভাল কিছু খুঁজতে শেখা – এমন নি:স্বার্থ চিন্তা স্বর্গের দরজা খুলে দেয়। আর দিন দিন প্রতিদিন প্রতিটি প্রাণির জন্য শান্তি কামনার চিন্তা, এমন চিন্তার অধিকারীকে শান্তিতে আচ্ছন্ন করে।”
দুই বাক্যে সারসংক্ষেপ
---------------------
আমরা যা চাই আমরা ঠিক সেটিকে আকর্ষণ করি না। শুধুমাত্র তোমার চিন্তাভাবনাকে পরিবর্তন করেই তুমি তোমার জীবনকে পরিবর্তন করতে পারো।
একই ধরনের বই
----------------
জোসেফ মারফি’র ‘অবচেতন মনের শক্তি’ (দ্য পাওয়ার অব ইয়োর সাবকনসাস মাইন্ড)
ফ্লোরেন্স স্কোভেল শিন এর ‘জীবন রঙ্গ এবং কিভাবে তা খেলতে হয়’ (দ্য গেম অব লাইফ অ্যান্ড হাউ টু প্লে ইট)
গ্রন্থ পর্যালোচনা
----------------
আমাদের “মন হলো সেরা বুননশিল্পী”, এই মূল কথাটিই ‘অ্যাজ আ ম্যান থিংকেথ’ বইটিকে এক আসুরিক শক্তি দিয়েছে। মন আমাদের অন্ত:স্থ চরিত্র ও বহি:স্থ পারিপার্শ্বিকতা সৃষ্টি করে। জেমস অ্যালেনের অবদান এটিই যে, আমরা সবাই যে পূর্বধারনা নিয়ে চলি তিনি সেটিকে প্রথমে গ্রহণ করেছেন – এই ধারনা যে আমরা যেহেতু রোবট না, তাই আমরা আমাদের চিন্তাকে নিয়ন্ত্রণ করি – এবং এরপরে এখানে সুপ্ত হেত্বাভাসকে প্রকাশিত করেছেন। আমরা বেশিরভাগ মানুষ বিশ্বাস করি যে মন আসলে বস্তু থেকে পৃথক, এ কারণে আমরা ভাবি যে চিন্তনকে লুকিয়ে রাখা যায় ও দুর্বল করা যায়; এর ফলে আমরা ভাবি এক এবং করি আরেক। মোদ্দা কথা হলো, অ্যালেন বিশ্বাস করতেন যে অবচেতন মন সচেতন মনের মতই হাজারো কাজ করতে পারে, এবং আমরা আপাতভাবে সেই মোহছায়ায় থাকতে পারি যেনবা আমরা কেবলমাত্র সচেতন মন দিয়ে সব নিয়ন্ত্রণ করছি কিন্তু বাস্তবে একটি প্রশ্ন সারাক্ষণ আমাদেরকে কুরে কুরে খেতে থাকে: “আমি কেন নিজকে দিয়ে ঐ কাজটি করিয়ে নিতে পারছি না বা ওটি অর্জন করতে পারছি না কেন?” চিন্তনের উপস্থিতিতে আকাঙ্খা ও ইচ্ছাশক্তি যে আকাঙ্খার সাথে মিল রেখে চলে না, এই বিষয়টি খেয়াল করে অ্যালেন একটি চমকপ্রদ উপসংহারে আসলেন: “আমরা যা চাই তা আকর্ষণ করি না, বরং আমরা যা সেটিই আকর্ষণ করি।” অর্জন তখনি ঘটে যখন আপনি ব্যক্তি হিসেবে অর্জনের বহি:স্থ রূপকে নিজের ভেতর ধারন করেন। আপনি সাফল্য ‘অর্জন’ করেন না, আপনি সাফল্যে ‘পরিণত’ হন। মন ও বস্তুর ভেতর কোনো ফারাক নেই।
আমরা আমাদের চিন্তার সমষ্টি
বইটির যুক্তি প্রশ্নাতীত: উন্নত চিন্তা উন্নত হৃদয় মানুষ তৈরি করে, আর নেতিবাচক চিন্তা মানুষকে দুর্দশাগ্রস্ত করে। নেতিবাচকতায় আবদ্ধ একজন মানুষের কাছে জগতটাকে মনে হয় যেন বিভ্রান্তি আর ভীতিতে ঘেরা। অন্যপক্ষে, অ্যালেন বলছেন, আমরা আমাদের নেতিবাচক ও বিধ্বংসী চিন্তাকে ছেঁটে ফেললে, “পুরো দুনিয়া আমাদের পানে কোমল দৃষ্টিতে চেয়ে থাকে, আর সবাই আমাদেরকে সাহায্য করার জন্য প্রস্তুত হয়ে পড়ে।” আমরা যা ভালবাসি কেবল যে সেটিই আকর্ষণ করি তা নয়, আমরা যা ভয় পায় সেটিকেও আকর্ষণ করি। এমন কেমন ঘটে সে বিষয়ে তার সরল ব্যাখ্যা হলো: যেসব চিন্তা, হোক তা ভাল কিংবা মন্দ, আমাদের মনোযোগ পায় সেগুলি আমাদের অবচেতনে গিয়ে বাস্তব জীবনের পরবর্তী ঘটনাপ্রবাহের জ্বালানি হিসেবে কাজ করে। ইমারসন যেমন বলেছেন, “ব্যক্তি সারাদিন যা ভাবে সে তাই।”
আমাদের পারিপার্শ্বিকতাই আমরা
অ্যালেনের বইয়ের আকাশচুম্বী খ্যাতির অন্যতম একটি কারণ হলো বইটির এই যুক্তিপ্রদর্শন যে, “পারিপার্শ্বিকতা ব্যক্তিকে গড়ে দেয় না, সেগুলি তাকে প্রকাশিত করে।” এটি অত্যন্ত হৃদয়বিদারক মন্তব্য বলে মনে হতে পারে, মনে হতে পারে এতে সুবিধাবঞ্চিতদের অবহেলা করার যৌক্তিকতা তৈরি করা হচ্ছে এবং যেন শোষণ ও অন্যায় ব্যবহারকে যুক্তিসম্মত ভাবে তুলে ধরছে। যেন সব কিছুর শীর্ষে অবস্থান করা মানুষদের বরিষ্ঠতা এবং নীচে পড়ে থাকা মানুষের হীনমন্যতা তুলে ধরছে। কিন্তু প্রকৃত আবেদন সেটি না। আসলে প্রতিটি পারিপার্শ্বিকতাই, তা সেটি যতই খারাপ হোক না কেন, আমাদের জন্য সমৃদ্ধির অনন্য উপায় মেলে ধরে। পারিপার্শ্বিকতাই যদি মানব জীবন ও সুখ-সমৃদ্ধির নির্ণায়ক হতো, তাহলে মানবজাতি আজ এতদূর আসতে পারত না। প্রকৃতপক্ষে, পারিপার্শ্বিকতা আমাদের ভেতরের সবচেয়ে ভাল যা আছে তা প্রকাশিত করার সুযোগ করে দেয়। এ কারণেই আমরা যদি কেবল ভাবি যে “আমার প্রতি অন্যায় করা হয়েছে” তাহলে আমরা আমাদের পরিস্থিতি থেকে বেরনোর জন্য কোনো সচেতন প্রচেষ্টা নিব না। এরপরও একটি বিষয় হয়ত খেয়াল করেছেন, যেকোনো জীবনী লেখক এ বিষয়ে ভাল বলতে পারবেন, যে কোনো ব্যক্তির জীবনের শুরুটা প্রায়শই তার জীবনের সবচেয়ে দামি উপহার হিসেবে কাজ করে। অ্যালেনের বইয়ের ঐকান্তিক দিকটি এই যে, এখানে আমাদের বর্তমান অবস্থার জন্য নিজেদের ছাড়া অন্য কাউকে দোষারোপ করা যায় না। এ থেকে আমরা বুঝছি যে আমাদের সম্ভাবনা অসীম, আমরা আমাদের সীমাবদ্ধতায় ডুবে থাকব না।
তোমার মনের পরিবর্তন ঘটানোর মাধ্যমেই তোমার দুনিয়াকে পরিবর্তিত করো
একথা ঠিক যে, যেকোনো ব্যক্তি বা জনপদের জীবনে দারিদ্র আসতে পারে। আর একথা অ্যালেন অস্বীকার করেননি; তবে তিনি যা বলতে চেয়েছেন সেটি হলো এমন পরিস্থিতিতে আত্মরক্ষামূলক কৌশল যেমন ঘটনা সংঘটনকারীকে দোষারোপ করার মাধ্যমে ব্যক্তি যেন আরো বেশি কাদায় আটকে পড়ে। যা আমাদেরকে বিচার করে, আমাদেরকে জগতের কাছে তুলে ধরে, সেটি হলো আমরা কিভাবে সেই সব পারিবার্শ্বিক অবস্থাকে অগ্রগতির হাতিয়ার বা অনুঘটক হিসেবে ব্যবহার করি সেই প্রক্রিয়া। সংক্ষেপে বলা যায়, তারাই সফল ব্যক্তি বা সম্প্রদায় যারা ব্যর্থতাকে কার্যপরস্পরায় ব্যাখ্যা করতে পারে। অ্যালেন দেখেছেন, “আমরা বেশিরভাগ মানুষই আমাদের পারিবার্শ্বিক অবস্থার পরিবর্তন ঘটাতে চাই, কিন্তু নিজেকে পরিবর্তন করতে চাই না- এবং সে কারণে আমরা পুরনো বাক্সেই আবদ্ধ থাকি।” পুরনো পন্থায় আটকে থাকা পর্যন্ত মানুষ সমৃদ্ধি আর সুখের রূপায়ন ঘটাতে পারে না। এ কারণে অ্যালেনের মতমত হলো, মানুষ প্রায় সব ক্ষেত্রেই নির্জ্ঞাতভাবে নিজেই তার সমৃদ্ধি-সৌভাগ্যহীনতার জন্য দায়ী।
প্রশান্তি = সাফল্য
অ্যালেন যে “সঠিক চিন্তন” এর কথা বলেছেন সেখানে তার চিন্তাধারায় বুদ্ধের শিক্ষার প্রভাব আছে বলে মনে করা হয়। সেই সাথে মনের স্থিরতা ও অচঞ্চলতাই যে সাফল্যের শ্রেষ্ঠ পথ, এটি তিনি পরামর্শ হিসেবে জানিয়েছেন, এখানেও বুদ্ধের শিক্ষার প্রতিফলন দেখা মেলে। যেসব ব্যক্তি শান্ত, নিরুদ্বেগ এবং নির্দিষ্ট লক্ষ্য-উদ্দেশ্যপূর্ণ, তাদের দেখে মনে হয় যেন এসবই তাদের জন্মগত বৈশিষ্ট্য। কিন্তু প্রায় সব ক্ষেত্রেই দেখা যায় যে, এসবই তাদের আত্ম-নিয়ন্ত্রণের ফলাফল।
এসব লোকের জোরটা কোথায়? তাদের সাফল্য অর্জনের দক্ষতার উৎস কি? এইসব লোকেরা খুব ভালভাবে জানে কিভাবে তাদের চিন্তা কাজ করে; আসলে এ বিষয়ে তাদের উন্নত জ্ঞানের কারণেই তারা অন্যদের চেয়ে বেশি সফল হয়ে থাকে। এটি একদিনে হয় না; বেশ কিছু বছর ধরে “চিন্তা সম্বন্ধে চিন্তা করার” মাধ্যমেই এই দক্ষতা তৈরি হয়। অ্যালেনের মতে, এমন লোকেদের এক ধরনের চুম্বকশক্তি সম্পন্ন আকর্ষণ কাজ করে কারণ তারা যেকেনো ছোটখাট ঘটনার দ্বারা উদ্বেলিত হয় না। “ঝঞ্ঝাবিক্ষুব্ধ আত্মা” সাফল্য অর্জনের জন্য যুদ্ধ করে চলে, কিন্তু অস্থিত ব্যক্তির কাছে সাফল্য ধরা দেয় না।
শেষ দুটি কথা
বইটি প্রথম প্রকাশের পর ১০০ বছরেরও বেশি সময় পার হলেও পাঠকেরা এখনও বইটি সম্বন্ধে খুব প্রাণোচ্ছল পর্যালোচনা করে চলছে। বইটির সাধারণ গদ্য পাঠককে আকর্ষণ করে। আর লেখক সম্বন্ধে আমাদের জানার পরিধি তেমন বেশি না হলেও বইটির আবেদন এক চিলতেও কমেনি। তবে বর্তমানে জেন্ডার সচেতনার বহি:প্রকাশ হিসেবে বইটির বিশেষ দুটি সংস্করণও প্রকাশিত হয়েছে: মার্ক অ্যালেন (লেখকের কোনো আত্মীয় নন) এর সম্পাদনায় ‘অ্যাজ ইউ থিংক’ এবং ডরোথি হাল্স্ট এর সম্পাদনায় ‘অ্যাজ আ উওম্যান থিংকেথ’ নামের সংস্করণগুলি।
জেমস অ্যালেন
জেমস অ্যালেন এর জন্ম ১৮৬৪ সালে ইংল্যান্ডের লেস্টারে। ১৫ বছর বয়সে তাকে আয় রোজগারের জন্য স্কুলের লেখাপড়া ছাড়তে হয়। পারিবারিক ব্যবসায় ধ্বস নামার কারণে তার বাবা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পথে রওনা হন এবং পথিমধ্যে সবকিছু হারিয়ে হত হন। ১৯০২ সালে লেখালেখিতে পুরো সময় দেওয়ার পূর্ব পর্যন্ত অ্যালেন ইংল্যান্ডের বিভিন্ন প্রস্তুতকারক ফার্মে কাজ করেন। এরপর তিনি ইংল্যান্ডের দক্ষিণ-পূর্বে ইলফ্রাকোম শহরে পড়া, লেখা, বাগান করা আর ধ্যানের মাঝে নিজেকে ডুবিয়ে রাখেন। তাঁর এক দশকের লেখালেখির ফসল হিসেবে ১৯টি বইয়ের মধ্যে ‘অ্যাজ আ ম্যান থিংকেথ’ বইটি দ্বিতীয়। এটি তাঁর সেরা সৃষ্টি হিসেবে মনে করা হলেও আসলে এটি কেবল তাঁর স্ত্রীর পীড়াপীড়িতেই প্রথম প্রকাশিত হয়। অ্যালেন ১৯১২ সালে পরলোক গমন করেন।
অনুবাদ-রূপান্তর©হাসিনুল ইসলাম
সর্বশেষ এডিট : ০৯ ই মার্চ, ২০১৮ রাত ১১:১৫

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।




