somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

রহস্য থ্রিলারঃসব নীল নয় স্বপ্নিল

২২ শে সেপ্টেম্বর, ২০১৪ বিকাল ৩:৪০
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

- এমন ভূতুড়ে মার্কা এলাকায় কেউ বাসা নেয়?

নিলির কথায় একটু মুখটা উঁচু করে তাকাল মুহিব। এলাকাটা ভূতুড়ে না। একটু শান্ত এই যা। ৫-১০ মিনিট হাঁটলেই রাজ পথ, বাজার সব। ব্যস্ত রাস্তার পাশে বাসা নিলে, সারাদিন গাড়ির প্যান প্যান শব্দ। সেসবও নিলির ভাল লাগত না। মফঃস্বল গুলোর এই একটা সুবিধা আছে। একই সাথে গ্রাম শহর দুটোরই আমেজ পাওয়া যায়। শাল বন ঘেরা এই এলাকা গুলোর ক্ষেত্রে কথাটা আরও বেশী প্রযোজ্য। হাই ওয়ের পাশে একটার পর একটা ৫- ৬ তলা বিল্ডিং, শপিং সেন্টার, আলো ঝলমলে রাস্তা ঘাট, জিম, বিউটি পার্লার, রেস্টুরেন্ট, ফাস্ট ফুডের দোকান সব মিলিয়ে একটা শহর শহর ভাব। আর একটু ভিতর দিকে আসলেই শাল বনের শুরু। একটু নীরবতার শুরু। শাল বনের মাঝে মাঝেও আলো জ্বলতে থাকা, একেকটা পাকা, আধ পাকা বাড়ি। মুহিব নিলি আজ যে বাড়িতে এসে উঠল সেটাও পাকা বাড়ি। দুই তলা বাসার নিচ তলায় থাকে বাড়ির বাড়িওয়ালা। আর দো তলা নিলি মুহিব ভাড়া নিল। অবশ্য ভাড়া নেবার পর জানা গেল, বাড়িওয়ালা সপ্তাহে এক দিন এসে এখানে থাকে। আর মাঝে মাঝে কোন আত্মীয় আসলে থাকে এখানে। তার আর একটা বাড়ি আছে, বাজারের দিকে। সেখানেই থাকা হয়। তাই বাড়ি ঘর একটু নিজ দায়িত্বেই দেখে রাখতে হবে মুহিব নিলির।
- এটা ভূতুড়ে কোন এলাকা না। একটু শান্ত হলেই সেটাকে ভূতুড়ে বলা যায়।

কাটা কাটা কথায় উত্তর দিল মুহিব। নিলি একটু দুষ্টামি করেই কথাটা বলেছিল। তবে মুহিবের জবাবটা দুষ্টামি ধাঁচের ছিল না। নিলি চুপ হয়ে গেল। কিছু বলল না। বিয়ে হল, আজ মাত্র ৬ দিন। বিয়ের পরের এই সময়টা স্বামী স্ত্রীর মধ্যে সম্পর্ক থাকবে মিষ্টি। কথা হবে ভালবাসার। তেমন কিছুই হয় না, মুহিব নিলির মধ্যে। নিলির বার বার মনে হয় মুহিব ঠিক নিলিকে সহ্য করতে পারে না। বাবা মায়ের পছন্দেই বিয়ে হয়েছে দুজনের। এই সময়টায় ছেলে মেয়েদের পছন্দ থাকে নিজস্ব। বিয়ের আগে প্রেম ভালবাসা থাকে। নিলির তেমন কিছুই ছিল না। মুহিবের হয়ত ছিল। তাই নিলিকে মানতে পারে না। ঘর গুছাতে গুছাতেই নিলি বলল, একটা কাজ করবে? বাবা মাকে নিয়ে আসো এখানে। তারা তো আর বেশী একটা দূরে থাকেন না। এখানে আমরা এক সাথে থাকলেই পারি।
- বাবা মা এখানে আসবেন না। সেটা তো আগেই বলেছেন। বার বার আবার এই কথা বলার কি আছে?
- না তাও একবার বলে দেখতে পারো।
- থাক, আমার বাবা মার জন্য আর এতো দরদ দেখাতে হবে না। তারা কাছেই থাকেন। প্রতিদিন দুপুরে খাবার দিয়ে যাবেন। তোমার কষ্ট করে রান্না বান্নাও করতে হবে না। পায়ের উপর পা তুলে থাকতে পারবে।
- আমি রান্না পারি।
- তুমি রান্না পারো না, এটা কেউ বলে নি।

নিলি বিমর্ষ মুখে তাকাল মুহিবের দিকে। মুহিব আস্তে করে সরিয়ে নিল মুখটা। এই মেয়ের উপর অকারণেই রাগ লাগে মুহিবের। রাগ করার ঠিক কোন কারণ নেই, তবুও। পৃথিবীর ঘটা সব কিছুর কারণ থাকে না। কিছু জিনিসের কারণ ঠিক সবাই খুঁজে পায় না। কিংবা কেউ ই পায় না। বাড়িটা একটু ঘুরে ফিরে দেখল মুহিব। পিছন দিকটায় একটা ডোবা, কচুরি পানায় ভরা। দো তলা বাড়ির ছাদে ওঠার ব্যবস্থাও আছে। কিন্তু ছাদে কোন রেলিং নেই। বাড়ির সামনে কিছু ফাঁকা জায়গা। সেই ফাঁকা জায়গায়, আগাছা জন্মেছে অনেক। বাড়ির মূল দরজা, টিনের, ভাঙা। এই দরজা দেওয়া না দেওয়া একই। তবুও দিয়েছে। বাড়িওয়ালার মনের ব্যাপার স্যাপার।
- রাতে তুমি কি খাবে?

নিলির কথায় মুখ ঘুরিয়ে তাকাল মুহিব। ঘরের সব গুছিয়েছে মেয়েটা একাই। কাজ করে একদম ঘেমে আছে। দেখে যেন কেমন করে উঠল বুকের ভিতর। একটু মায়া লাগলো কিনা জানে না মুহিব। মেয়েটার সাথে এমন রাগারাগি করার কোন অর্থ নেই। একটু হাসি দিয়ে বলল মুহিব, তুমি গোসল করে নাও। একদম ঘেমে গেছ। গ্যাসের চুলা ঘরের সাথেই। আমি ডিম ভাজি করে ফেলছি।
- আরে না, তুমি ছেলে হয়ে কেন রান্না করবে? আমি রান্না করে একদম গোসলে যাব।
- আরে যাও, গোসল করে আসো। ক্ষুধা লেগেছে বড়। ভাত আছে বাটিতে। ডিম ভাজি এতো কঠিন কোন কাজ না।

নিলির হঠাৎ করেই খুব ভাল লাগছে। মুহিব বোধহয় বিয়ের পর আজই প্রথম , একটু ভাল করে কথা বলছে। ক্লান্তি ঝরা মুখে একটু হেসে বলল, আচ্ছা দেখে কাজ কর। হাত কেটে ফেলো না আবার।

নিলি গোসল করতে চলে গেল। বাড়িটা বেশ ভালোই। মুহিবদের বাসায় বাথরুম ছিল বাহিরে। টিউবওয়েলে চেপে পানি তুলে গোসল করতে হত। আর যেখানে গোসল করত সেটাকে গোসল খানা বা বাথরুম ঠিক বলা যায় না। তিন পাশে টিন দিয়ে ঘেরা আর একপাশে পলিথিন দিয়ে আটকানো। তাই গোসল খানা। আর এখানে সাপ্লাইয়ের ব্যবস্থা আছে। আছে ঘরের সাথে লাগোয়া বাথরুম। ডিমের জন্য পেয়াজ কাটবার সময়টায় হঠাৎ মুহিব নিলির ডাক শুনল, শুনবে একটু?

মুহিব যেতেই নিলি বলল, দেখো তো, বাথরুমে বোধহয় কোন লাইট নেই।

মুহিব সুইচ টিপে দেখল আসলেই লাইট নষ্ট। এই রাতের বেলা, লাইট কিনতে বাহিরে যাওয়াও ঠিক সম্ভব না।
- নষ্ট হয়ে গেছে। কাল নতুন একটা লাগিয়ে দিব। আজকে একটু সামলে নাও।

নিলি একটু হেসে আচ্ছা বলে গোসল করতে ঢুকে গেল। মুহিব বাহির থেকেই দেখল, দরজাটা একটু ফাঁকা রেখেছে। সেই ফাঁকা দিয়ে ঘরের ভিতরের আলো যাচ্ছে। হয়ত অন্ধকারে গোসল করতে ভয় পাচ্ছে মেয়েটা। মুহিব রান্না ঘরে চলে গেল, ডিম ভাজি করতে। সব কিছু রান্না পারে না মুহিব। আর কয়েকটা ছেলের মতই, অতি সাধারণ ডিম ভাজি, আলু ভর্তা পর্যন্তই রান্না জানার তালিকা। তাও মাঝে মাঝে ডিমে লবণ দিতে মনে থাকে না, কিংবা লবণে মুখে নেয়া যায় না। আজ একটু সাবধানেই ডিম ভাজি করার চেষ্টা করছে। ভুল ভাল না হোক। তেল গরম হচ্ছে। একটু একটু ফুটছে যে তা বুদ বুদ উঠে জানান দিচ্ছে। গরম তেলের বুদ বুদ ওঠা মনোযোগ সহকারে দেখবার মাঝেই হঠাৎ কানে কিছু একটা শব্দ শুনল। একটা চাপা কান্না, একটা চাপা আর্তনাদ। খুব খেয়াল করে না শুনলে তা বুঝতে পারা যায় না। মুহিব কান পেতে শুনতে চাইল, শব্দটা আসছে কোথা থেকে। রান্না ঘর থেকে বেড়িয়ে আশেপাশে তাকাল। বের হতেই শব্দটা আরও তীক্ষ্ণ হচ্ছে। স্পষ্ট হচ্ছে। কণ্ঠটা বড় পরিচিত। নিলি? নিলির মতই লাগছে। মুহিব দৌড়ে বাথরুমটার কাছে গেল। এখান থেকেই শব্দটা আসছে। নিলি চাপা স্বরে কাঁদছে। কাঁদবে কেন মেয়েটা? মুহিবের কথায় কি বেশী কষ্ট পেয়েছে? মুহিব বাথরুমের দরজায় টোকা দিয়ে বলল, নিলি, কি হয়েছে?

ভিতর থেকে কোন সাড়া নেই। কান্নার শব্দটা আরও গাঢ় হচ্ছে। মনে হচ্ছে বাথরুমের ভিতর নিলি কিছুর সাথে ধস্তাধস্তি করছে। মুহিব আবার ডাক দিল, নিলি, তুমি ঠিক আছ?

সে ডাকেরও জবাব মিলল না। বাথরুমের মধ্যে নিলির কান্নার সাথে অন্য শব্দ গুলো বাড়ছে। মুহিব দরজা ধরে ধাক্কা দিল। দরজাটা খোলা দেখে গিয়েছিল। এখন বন্ধ। ব্যাপারটা অদ্ভুত। দরজায় ধাক্কা দিয়ে বেশ কয়েকবার ডাকল নিলিকে। নিলি দরজা খুলছে না। আরও জোরে ধাক্কা দিল। দরজায় বেশ জোরে শব্দ করল। মুহিবের খুব অস্থির লাগছে। এমন পাগলামির কোন মানে হয়? হঠাৎ নিলির কান্না মিলিয়ে গেল। কোন শব্দ নেই। মুহিব দরজা ধাক্কা দিয়েই যাচ্ছে। নিলিকে ডেকেই যাচ্ছে। কি করবে ভেবে পায় না মুহিব। কিছু একটা করতে হয়। কাঠের দরজাটায় পুরো শরীরের শক্তি দিয়ে, একটা শাবল দিয়ে কয়েকটা বারি দিতেই, দরজার ভিতরের লকটা খুলে গেল। মুহিব হন্তদন্ত হয়ে বাথরুমে ঢুকতেই নিলিকে দেখল, বাথরুমের ফ্লোরে আধ ভেজা অবস্থায় পড়ে আছে। শরীর ধরে ধাক্কা দিয়ে ডাকল নিলিকে কয়েক বার। নিলি কোন সাড়া দিচ্ছে না। জ্ঞান হারিয়েছে। ভয় লাগছে মুহিবের। কি একটা ঘটনা ঘটে গেল। নিলিকে তুলে বিছানায় এনে শুইয়ে দিল। বাবা মা কে জানানো দরকার। রাত হোক আর যাই হোক। এইটুকু পথ ঠিকই চলে আসতে পারবেন। ফোন দিয়ে জানালও মাকে। মা আসছেন ছোট ভাইটাকে নিয়ে। নিলির পাশে, মুহিব চুপচাপ বসে আছে। নিলির শরীর শক্ত হয়ে আছে। কেমন যেন বেঁকে আছে। দেখে বড় ভয় লাগছে মুহিবের। আশপাশ থেকে একটা পোড়া গন্ধ আসছে। মুহিব নিলির শরীরে হাত দিয়ে রেখেছে একটা। পোড়া গন্ধটা যত বাড়ছে, নিলির শরীর তত ঠাণ্ডা হচ্ছে। মনে হচ্ছে শরীর হচ্ছে আরও শক্ত। জ্ঞানহীন নিলির শরীর আরও কুঁচকে যাচ্ছে। মুহিব পানি এনে দিতে চাইল নিলির মুখে। যদি জ্ঞান ফিরে। উঠতে যাবে তখনই বিদ্যুৎ চলে গেল। সুনসান নীরবতায়, শুধু নিলির নিঃশ্বাসের শব্দ পাওয়া যাচ্ছে। পোড়া গন্ধটা বাড়ছে। একটা শব্দ করছে নিলি। দাঁতে দাঁত ঘষে। নিলি জ্ঞান হারানো অবস্থায়ও এমন করছে কেন? মুহিব বড় সাহসী ছেলে, তবুও ভয় করছে। বোধ বুদ্ধি মনে হয় লোপ পাচ্ছে। কি করা উচিৎ বা উচিৎ নয় ঠিক বুঝতে পারছে না।

মুহিবের দাড়িয়ে আছে, নিলির মাথার কাছে। মুহিবের মা এসেছেন, সাথে মুহিবের ছোট ভাইটা। মা এসেই মুহিবকে ধমকা ধমকি করলেন কতক্ষণ, এতোটা সময় গাধার মত বসে থাকার জন্য। হাতে পায়ে তেল মালিশ করে দিলেন মা। টেনে টেনে হাত পা করলেন সোজা। তবুও বার বার বেঁকে যাচ্ছিল। একটু সময় পরেই নিলির জ্ঞান ফিরল। ফিরেই অবাক চোখে তাকাল, চারপাশে। যেন চারপাশের মানুষ গুলোর কাউকেই চিনে না নিলি। মুহিব স্বস্তির একটা নিঃশ্বাস ছাড়ল। মনে হচ্ছে দম নেবার একটা সুযোগ পেয়েছে, এতক্ষণ আঁটকে থাকা দমটা। মা জিজ্ঞেস করলেন, কি হয়েছিল মা?
নিলি কিছুই বলল না। মনে হয় শুনতেই পায় নি কিছুই, এমন একটা অবস্থা। মা কিছু একটা বুঝলেন। সেটা মুহিবকে বলা যাবে না। বলা যাবে না কাউকে। মুহিবকে বললেন, মনিরকে নিয়ে তুই সোফার ওখানে বিছানা করে ঘুমা। আমি বউ মা র সাথে ঘুমাচ্ছি।

মুহিব হ্যাঁ না কিছু বলেই মনিরের হাত ধরে চলে গেল ঘর থেকে।

মা নিলির মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে লাগলেন। হাত বুলাতে বুলাতেই জানতে চাইলেন, তোমার সাথে কি আগেও আসতো?

নিলি চোখ নামিয়ে চুপ করে রইল। কিছু বলল না।
- বল, মা। হয়ত তোমার বাবা মা এই ব্যাপারটার কথা জানাতে চান নাই। যদি মেয়ের বিয়ে না হল, এই ভয়ে। আমাকে বল।

নিলি গায়ে পরে থাকা জামাটার হাতা অনেক খানি উঁচু করল। উঁচু করিয়ে মায়ের দিকে দেখাল। মা সেদিকে তাকিয়ে বললেন, কবে থেকে সাথে আছে?
- ছোট বেলা থেকে। অনেক দিন সমস্যা হয় নি। আজ আবার...।
- থাক মা। মুহিবকে কিছু বইল না এখনি। আমাদের এদিকে একজন ভাল ওঝা আছেন। তার নাকি জ্বিন ভূত বশে। ভূত প্রেতের আছর তাড়ানোয় সে বড় পাকা। তাকে দেখালে একবার ঠিক হয়ে যাবে।
- জ্বি মা।

নিলি জামাটার হাতা নামিয়ে, তাবিজটা আবার ঢেকে ফেলল। তাবিজটা নিয়েছিল সেই ছোট বেলা নিলি। গ্রামের এক ওঝা দিয়ে দিয়েছিল। দেবার সময় বার বার বলেছিল, ভুলেও যেন একা একা সন্ধ্যার পর বা দুপুর বেলা বন জঙ্গলের মাঝে না যায়। নিলির সাথে খারাপ কিছু আছে। কেউ বলে খারাপ ভূত, কেউ বলে জ্বিন। কোনটা সত্যি কে জানে? মাঝে মাঝেই নিলির উপর ভর করে। আর তখনই নিলির এই অবস্থা হয়। গোসল করার সময়, বাথরুমের দরজাটা লাগাতে ইচ্ছা করছিল না। ভয় করছিল। এই বাড়িতে আসার পর থেকেই ভয়টা করছিল। বার বার মনে হচ্ছিল নিলির, আশেপাশে কেউ এক একজন আছে। মুহিব ছাড়া অন্য একজন কেউ। যে নিলির দিকে খেয়াল রাখছে। নিলির ঘাড়ে নিঃশ্বাস ফেলছে। নিলি যা যা করছে দেখছে। নিলি একটু একা থাকুক তাই চাচ্ছে। দরজা যখন খুলে গোসল করছিল তখন, বাহিরে দাড়িয়ে ছিল। নিলির ভয় করছিল, কখন নিলির বাথরুমের দরজার ফাঁকা দিয়ে ভিতরে চলে আসে। সেই ভয়ে দরজা বন্ধ করতেই মনে হল শরীরের উপর সেটা এসে ভর করেছে। ভয়ে নিলি চিৎকার করছিল, কিন্তু চিৎকার বের হচ্ছিল না। কেঁদে কেঁদে মুহিবকে ডাকতে চাচ্ছিল, কিন্তু সেটা শরীরের শিরা উপশিরা মাংস ভেদ করে পুরো শরীরে জাপটে ধরছিল। শরীর শক্ত হয়ে কুঁচকে কখন যেন নিলি জ্ঞান হারিয়ে ফেলল, বলতে পারে না। মাঝের সময়টায় কি হয়েছে তার কিছুও জানে না।

সকাল সকাল মা উঠে চলে গেলেন। রান্না করে দিয়ে গেছেন মুহিব আর নিলির জন্য। মুহিবকে বার বার বলে গেছেন, নিলির সাথে যেন খারাপ ব্যবহার না করে। নিলিকে দিয়ে যেন কোন কাজ না করায়। মুহিব একটু রেগেই বলল, এমন বউ বিয়ে করার কি দরকার? বসিয়ে বসিয়ে শুধু খাওয়াব। তোমার এখন বয়স হইছে। কই বউ সংসার দেখবে, কাজ করবে। তা না, উল্টা তুমি এসে আমাদের এখানে রান্না করে দিয়ে যাচ্ছ।

মা বুঝালেন, বেশ কিছুটা সময় নিয়ে ছেলেকে বুঝালেন, নিলি এখন অসুস্থ। এখন এসব না বলতে। কাল নাকি কোথায় নিয়ে যাবেন নিলিকে।
মুহিব বলল, অসুস্থ, ডাক্তার দেখালেই হয়।
- তুই অনেক কিছুই বুঝিস না। সব রোগের ওষুধ ডাক্তার দিতে পারে না।

মুহিবের মায়ের মুখের উপর আর কিছু বলার ছিল না। সারাদিনের মধ্যে নিলির কোন অস্বাভাবিক আচরণ চোখে পড়ল না। জোর করে হলেও নিলির সাথে ভাল ব্যবহার করল। বিরক্তিকর ব্যাপার সব। মায়ের জোরাজোরিতেই অফিসে বলে কয়ে ১০ দিনের ছুটি নিল। নতুন বিয়ে, পেয়েও গেল। এখন মুহিবের মনে হচ্ছে, ছুটির চেয়ে অফিসে কাজের মধ্যে সময়টাই ভাল কাটতো। এখানে আরও অসহ্য লাগছে। চোখের সামনে একটা অসহ্যকর মানুষকে দেখছে।

সন্ধ্যা পেরিয়ে যাবার পর চারপাশের নৈঃশব্দ্যতা বাড়ছে। বাড়ছে চারপাশে ঝি ঝি পোকার ডাক। আজ আকাশে চাঁদ নেই কোন। হয়ত উঠে নি, কিংবা আকাশে মেঘ। কিছু একটা হবে। ঘরে বসে বসে কিছু করার নেই। একটা টেলিভিশন আনিয়ে নিতে হবে। সময় তাও কাটান যেত।
- চল বারান্দায় বসি।

নিলি এসে পাশে বসে বলল।
- কেন?
- এমনি। বাতাসে বসলাম।
- ঘরের মধ্যে ফ্যান ঘুরছে। ফ্যান রেখে বারান্দায় যাবার মত কিছু নেই। ওখানে এসি লাগানো না।

নিলি চুপচাপ দাড়িয়ে রইল। মাঝে মাঝে খারাপ ব্যবহার করে মুহিবের নিজেরই প্রচণ্ড খারাপ লাগে। খারাপ ব্যবহার করলে মেয়েটা চুপচাপ শুনে। কিছুই বলে না। একটা অবলা ভাব দেখায়। অবলা মানুষের উপর রাগ করা যায় না। কারও কাছে, আবদার করে তা পাবার সবচেয়ে বড় উপায় হল, তর্ক না করা। যার কাছে চাইল, সে যদি না দিতে চায়, তবে আচ্ছা বলে চুপ থাকলেই হল। না বলা লোকটার মাঝে একটু হলেও সহানুভূতি আসে। একবার হলেও মনে হয়, না বলাটা ঠিক হয় নি। মুহিবের বেলায়ও তাই ঘটল। নিলির দিকে তাকিয়ে বলল, আচ্ছা চল।

নিলি মিষ্টি একটা হাসি দিল।

বারান্দাটায় বসে আসে দুজন। ঠিক অত বড় যে তা না। তবে দুইটা চেয়ার ভালভাবেই বসে যায় সেখানে। বারান্দা গ্রিল দিয়ে আটকানো। তাকিয়ে আছে দুজন অনেকটা দূর। সত্যি অনেক সুন্দর বাতাস আসছে। সেই বাতাসে শরীর জুড়িয়ে যাচ্ছে। আকাশে চাঁদ না থাকলেও, অন্ধকার দেখতে খারাপ লাগছে না। অন্ধকারে গাছের পাতার নড়াচড়া দেখছে। নিলি আস্তে করে মাথাটা রাখল মুহিবের কাঁধের উপর। একটা হাত রাখল হাতের উপর। মুহিব অনুভূতিহীন ভাবে বসে আছে। নিলি মুহিবের হাতটা একটু জোরে চেপে ধরে বলল, তুমি আমাকে বিয়ে করে সুখী না, তাই না?

মুহিব প্রশ্নটা শুনে থমকে গেল। একটু আলো একটু আঁধারে নিলির মুখের দিকে তাকাল। নিলি তাকিয়ে আছে বাহিরে। হয়ত মুহিবের দিকে তাকিয়ে এই প্রশ্ন করার সাধ্য নেই ওর। নিলি বলে যাচ্ছে, তুমি কি কাউকে পছন্দ করতে বিয়ের আগে?
মুহিব শান্ত গলায় উত্তর দিল, না।
- করলে আমার সমস্যা নেই। এখন তো আমার সাথেই তোমার জীবন জড়িয়ে গেছে, তাই না? আমাকে একটু সুযোগ দাও, আমি ঠিক সব গুছিয়ে নিতে পারব। দিবে না সুযোগ?

মুহিব এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে নিলির দিকে। মুহিবের হাতের উপর এক ফোঁটা পানি পড়ল। নিলি কাঁদছে নিঃশব্দে। কান্না সামলে বলল, আমার জীবনে তুমিই একজন। যাকে আমি ভালবাসি।

মুহিব কিছু না বলে, উঠে দাঁড়াল। কথা গুলোর উত্তর দিল না। হাত ঘড়িতে সময় দেখল ৮ টা ৪৬। নিলির হাত ছাড়িয়ে বলল, বাথরুমের লাইট কেনা হয় নি, সেটা মনে করিয়ে দিবে না? আমি লাইট কিনে নিয়ে আসি। তুমি থাকো একটু।
- এই রাতে যেতে হবে না। আমার ভয় করে একা।
- ভয়ের কিছু নেই। ১০ মিনিট লাগবে। তুমি বারান্দায় বসে থাকো।

মুহিবকে মানা করবার সাহস নিলির নেই। অজানা এক কারণে মুহিবকে ভয় পায় নিলি। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে নিলি বলল, আচ্ছা।

মুহিব চলে গেল। নিলি বসে আছে যেখানটায় ছিল সেখানটাতেই। বাতাসের বেগ বাড়ছে। মুহিবকে দেখল টিনের দরজাটা সরিয়ে বাহিরে বের হয়ে যেতে। আবার ভয়টা কাজ করছে নিলির। নিলির মনে হচ্ছে ঠিক পিছনে কেউ একজন দাড়িয়ে আছে। নিলির শরীর একদম ঠাণ্ডা হয়ে গেছে। জমে গেছে ভয়ে। পিছন ফিরে তাকাতে ভয় লাগছে। মনে হচ্ছে তাকালেই দেখবে, কুৎসিত চেহারার কেউ দাড়িয়ে আছে। ১০ মিনিট এতোটা সময় কেন যে লাগছে। নিলি এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে, বাহিরের টিনের দরজাটার দিকে। মুহিব আসবে কখন? মনে মনে একটানা দোয়া পড়ে যাচ্ছে। মা বলেছেন, ভয়ের সময়টায়, "লা-ইলাহা ইল্লা আনতা সুবহানাকা ইন্নি কুনতু মিনাজজ্বলিমিন।"
এই দোয়াটা পড়তে। সব বিপদ কেটে যাবে। তাই পড়ে যাচ্ছে নিলি। হঠাৎ দরজা দিয়ে কেউ ঢুকল , বাড়ির বাহিরের টিনের দরজার ওখান দিয়ে। মুহিব নয়। মুহিব এই পোশাকে যায় নি। যে ঢুকেছে, তার শরীরে পুরোটা জুড়ে বড় আলখাল্লা। কালো রঙের। কে আসল? নিলির মনের ভয়টা আরও ঝেঁকে বসল। শব্দ করে দোয়াটা পড়ছে। চোখ বন্ধ করে রেখেছে নিলি। হঠাৎ একটা চাপা রকম আওয়াজ হল। এরপর কোন বলা কওয়া ছাড়াই, পুরো বাড়ি কাঁপতে লাগলো। নিলি চেয়ারে নিজেকে সামলে রাখতে না পেরে, পড়ে গেল। পুরো বাড়িটা কেপে যাচ্ছে। ভুমিকম্প হলে যেভাবে কাঁপে সেভাবে। তবে প্রায় মিনিট খানেক ধরে বাড়িটা কাঁপছে। নিলি সামনের সব অন্ধকার হয়ে যাচ্ছে। মাথাটা ঘুরছে। মনে হচ্ছে আবার জ্ঞান হারাবে।

- নিলি, নিলি, এভাবে এখানে পড়ে আছ কেন?

মুহিবের কথায় চোখ মেলে তাকাল। বাড়িটা কাঁপা বন্ধ হয়ে গেছে কখন জানে না নিলি। পুরো শরীর ঘেমে অস্থির। ফ্যালফ্যাল করে চারপাশে তাকাচ্ছে নিলি। নিলিকে তুলে বিছানায় বসাল মুহিব। ভয়ের রেষটা কাটেনি এখনও। তাই মুখ দিয়ে কিছু বের হচ্ছে না। মুহিব জিজ্ঞেস করেই যাচ্ছে, কি হয়েছে?
সেসবের উত্তর নিলি দিচ্ছে না। বিদ্যুৎ চলে যেতেই মুহিব একটা মোমবাতি ধরিয়ে সামনে এসে দাড়াল নিলির। নিলির চোখ মুখে কেমন অন্য রকম একটা ভাব। চোখ মুখ শরীর সব শক্ত হয়ে যাচ্ছে। মুহিব মোমবাতি নিয়ে আসতেই, চিৎকার শুরু করল নিলি। মুহিবকে কাছে আসতে দিচ্ছে না। মুহিবের দিক থেকে মুখ সরিয়ে অন্য দিকে ঘুরিয়ে রাখল। মুহিব আবার মোমবাতিটা নিয়ে কাছে আসল নিলির। মোমবাতির দিকে তাকাতেই আবার চিৎকার করে উঠল, সর তুমি। সর এখান থেকে। হাতের ওটা সরাও।

নিলির কণ্ঠ অন্যরকম লাগছে। কেমন একটা অদ্ভুত রকম শব্দ করছে গলা থেকে। মোমবাতিটার দিকে কেমন করে যেন তাকাচ্ছে নিলি। মনে হচ্ছে বড় ভয় পাচ্ছে আগুনটা। মোমবাতিটা দূরে সরিয়ে রেখে নিলির পাশে এসে বসল মুহিব।
- নিলি এমন করছ কেন?

গা মোচড়ানো শুরু করল নিলি। বিছানায় শুয়ে পেটটা উপর দিকে তুলে হাত পা দিয়ে শক্ত করে চেপে ধরল বিছানায়। আর চিৎকার করে কাঁদছে। শব্দ করে। মুহিব, ধরে ঠিক করতে চাইল নিলিকে। নিলিকে ধরতেই এক ঝটকায় সরিয়ে দিল মুহিবকে। বিছানা থেকে ছিটকে দূরে গিয়ে পড়ল মুহিব। এতো শক্তি নিলির গায়ে থাকার কথা না। মনে হচ্ছে, শরীরের মধ্যে অনেক শক্তিধর কিছু প্রবেশ করেছে। দ্রুত মাকে কল করল মুহিব। এখনি আসতে বলল, বাসায়। নিলির অবস্থা ভাল না। কেমন পাগলামি করছে। নিলির শরীর অমন ধূমরে মুচড়ে বিছানায় এলোমেলো ভাবে ছটফট করতে লাগলো। যেভাবে হাত পা ছিটকাচ্ছে, সামনে যাওটাও ভয়ের ব্যাপার। তবুও নিলির কাছে গেল মুহিব। শরীরটা অনেক শক্ত করে চেপে ধরল।
- নিলি শান্ত হও, প্লিজ। কি হয়েছে তোমার?

নিলি উত্তর দেয় না। চোখ উল্টে, দাঁতে দাঁত চেপে, তাকায় মুহিবের দিকে। মুহিব সে দৃশ্য দেখে ভয় পেয়ে যায়। অস্বাভাবিক কিছুতে বিশ্বাস নেই মুহিবের। জীবনে হয়ত এতো ভয়, এতোটা অস্বাভাবিক কিছু এই প্রথম দেখছে মুহিব। নিলির এই দৃষ্টির দিকে তাকিয়ে, মাথার ভিতর ঝিম ঝিম করে উঠল।
দরজায় নক হতেই বুঝতে পারল, মুহিব মা এসেছে। দরজা খুলে দিল। মাকে নিয়ে ঘরে আসতেই দেখল নিলি শান্ত, আর অমন ছটফট করছে না। শান্ত হয়ে বিছানার মাঝখানে শুয়ে আছে। হাত পা গুলো একসাথে করে। হাতের মুঠি বন্ধ। মা এসে নিলিকে ডাকলেন, সাড়া পাওয়া গেল না। আবার জ্ঞান হারিয়েছে। মায়ের দিকে অসহায় ভাবে তাকাল মুহিব।
- কি হয়েছে নিলির, মা?
- মনির ওঝা নিয়ে আসতেছে। রাতের বেলা তিনি আসবেন কিনা সন্দেহ। তবুও মনিরকে বললাম, জোর করে নিয়ে আসতে। তোর বউয়ের উপর খারাপ জিনিসের ভর আছে?
- কিসের ভর?
- এসব নিয়ে তুই তর্ক করবি না। তুই সব কিছু জানিস না। ওর হাতে তাবিজ আছে। অনেক আগে থেকেই ওর সাথে খারাপ জিনিসটা আছে।

মুহিব এখন বড় বিধ্বস্ত। এসব আজগুবি জিনিসে মা বিশ্বাস করেন। মুহিব না। তবুও এই অবস্থায় তর্ক করতে ইচ্ছা করছে না। তাছাড়া নিজের চোখেও আজ যা দেখল, সেসব অবিশ্বাস করা যায় না।

মনির কিছুক্ষণের মধ্যেই একজন লোক নিয়ে আসল। কাঁধে একটা ঝোলা ঝুলানো। মাথার চুল জট পাকানো। হাতে একটা বড় লাঠি। শরীরের কাপড়ে একটার পর একটা তালি মারা। এই লোক ভূত প্রেত তাড়াবার ওঝা। এই লোককে দেখতেই ভূতের মত লাগছে। কিসব বের করে ধোঁয়া বানাল লোকটা।
- হুম বড় শক্তিশালী জিনিস। বড় খারাপ আত্মা ভর করেছে মেয়ের উপর।

বলছে লোকটা। কিসব করল কতক্ষণ ধরে। কিসব মন্ত্র পড়ল। সেই ধোঁয়া নিলির নাকের কাছে নিল। কিছুক্ষণের মধ্যেই নিলির জ্ঞান ফিরে আসল। ওঝা লোকটা গম্ভীর গলায় বলল, হুম চলে গেছে। নজরে নজরে রাখতে হবে, একা পেলেই আবার ফিরে আসবে।

আর একটা মাদুলি রকম কিছু বেধে দিল অন্য হাতে নিলির। ওঝা বললেন, খারাপ আত্মারা লোহা ভয় পায়, আগুন ভয় পায়, ধোঁয়া ভয় পায়।

মুহিব অবচেতন ভাবেই ভাবল, সে জন্যই হয়ত নিলি মোমবাতির আগুনটা ভয় পাচ্ছিল।

নিলি শুয়ে আছে। পাশে বসে আছে মুহিবের মা, মুহিব, আর ঝিমাচ্ছে মনির। নিলি এখন একটু স্বাভাবিক। বাড়ি কেঁপে ওঠার ঘটনাটা, একটা লোকের বড় আলখাল্লা পড়ে বাড়িতে আসার ঘটনাটা সবটাই বলল নিলি। বিশ্বাস অবিশ্বাসের দোলাচলে ভাসছে এখন মুহিব। কোনটা বিশ্বাস করবে, কোনটা করবে না, সেটা নিয়ে বড় অস্বস্তিতে আছে।
মা মুহিবের দিকে তাকিয়ে বলল, বাবা, বাসাটা পরিবর্তন কর। সেদিন শুনলাম, এখানে নাকি অনেক আগে শ্মশান ছিল। সেই জায়গা তোদের বাড়িওয়ালা কিনে এখানে বাসা করেছে। এখানে এসব হইতেই পারে। এই জন্যই বাড়ি বানিয়ে তোদের বাড়িওয়ালা থাকে না।
মুহিব শান্ত গলায় বলল, দেখি।

রাতটা বেড়ে যাচ্ছে। নির্ঘুম কাটছে মুহিবের। মা ঘুমিয়ে গেছেন, ঘুমিয়ে গেছে মনির। মুহিব দাড়িয়ে আছে বারান্দাটায়। নিলি এসে পাশে দাঁড়াল। চমকে তাকাল মুহিব। নিলির দিকে তাকিয়ে বলল, জেগে আছ কেন এখনও?
- ঘুম আসছে না।
- ঘুমাও যাও।
- হ্যাঁ। তুমিও ঘুমাবে চল।
- পরে।
- একটা কথা বলব?
- বল।
- জানো, তুমি যখন বাহির থেকে ,বাসায় এসে আমাকে ডাক দিয়েছিলে তখন আমি তোমার পিছনে একটা কুৎসিত চেহারার কাউকে দেখেছি। কালো আলখাল্লা পরা। ঐ যে আমাদের দরজা দিয়ে ঢুকল, তেমন কাউকে।

মুহিব মুখ শক্ত করে নিলির দিকে তাকাল। চিৎকার রকম শব্দ করে বলল, আজগুবি কথা বলার জায়গা পাও না, না? তুমি এসব কেন করছ ভাবছ আমি জানি না? তুমি এসব করে আমার কাছ থেকে সহানুভূতি চাচ্ছ। তাই এসব অভিনয়। আমার জীবনটা একদম এলোমেলো করে দিছ তুমি।

নিলি শূন্য চোখে তাকিয়ে আছে মুহিবের দিকে। এভাবে মুহিব চিৎকার করবে বুঝতে পারে নি। মার ঘুম ভেঙে গেছে। মুহিব বলে যাচ্ছে, এসব করে কখনও কারও মনে জায়গা পাওয়া যায় না। এসব ভূত প্রেতের অভিনয় করা বাদ দাও। নিজের তো কিছুই হচ্ছে না, মাঝখান দিয়ে যন্ত্রণা দিচ্ছ আমাকে। এসব যদি আগে থেকেই তোমার অভ্যাস থাকে, আমার গলায় ঝুললে কেন? পৃথিবীতে মানুষের অভাব পড়ছে? যত্তসব!

নিলি আর মায়ের সামনে থেকে বের হয়ে গেল মুহিব। মা পিছন থেকে ডাক দিল, কই যাস তুই?
- মরতে যাই। যে বউয়ের সাথে বিয়ে দিছ, দুই দিন পর এমনিই মরে যাব।

দরজাটায় প্রবল শব্দে বারি দিয়ে বের হয়ে গেল ঘর থেকে মুহিব। নিলি কাঁদছে। নিলি মিথ্যে বলে নি। তবুও অবিশ্বাস করছে মুহিব। এসবের কিছুই অভিনয় করছে না নিলি। তবুও কি সব হল।
মনিরও উঠে গেছে।
- মা প্রশ্রাব করব।
- যা।
- ভয় করে।

এতো বড় ছেলেরও নাকি ভয় করে। এবার ইন্টার পরীক্ষা দিল মনির। মা মনিরের সাথে বাথরুমটার সামনে গিয়ে দাড়ালেন। নিলিকে বললেন, শুয়ে পড়তে। নিলি লাইট নিভিয়ে দিল।

মুহিব এলোমেলো হাঁটছে রাস্তায়। মাথার ভিতর কিছু এলোমেলো চিন্তা, একের পর এক বেজে যাচ্ছে। চাপ দিয়ে যাচ্ছে। এই অস্বস্তি থেকে মুক্তি চায় মুহিব। যে জিনিসে কখনও বিশ্বাস করে নি। তা বিশ্বাস করতে চায় না। কেউ একজন হয়ত সাহায্য করতে পারবে এই ব্যাপারে। চিন্তা শক্তি লোপ পাচ্ছে বোধ হয় মুহিবের। কে পারবে সাহায্য করতে? নামটা মাথার ভিতর ঘুর পাক খাচ্ছে কিন্তু মনে আসছে না। মোবাইলটা বের করে, এক এক করে সব নাম দেখতে লাগলো যাদের নাম মোবাইলে সেভ করা। এতোটুকু জানে, যার কথা ভাবছে, তার নাম মোবাইলে সেভ করা আছে। রাদিব। এই তো নাম পাওয়া গেছে। রাদিব পারবে সাহায্য করতে। কেন মনে হল, রাদিব পারবে সাহায্য করতে, জানে না মুহিব। তবুও মনে হচ্ছে। রাদিব মুহিবের স্কুল জীবনের বন্ধু। স্কুল জীবন পেড়িয়ে, আলাদা কলেজে পড়েছে। যোগাযোগ ছিল তবুও। মুহিব ভর্তি হল, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে আর রাদিব মেডিকেল কলেজে। তবুও মাঝে মাঝে খোঁজ নিত রাদিব। মুহিবের বড় লজ্জা লাগত, পড়ালেখার দিকে দিয়ে, অবস্থানের দিক দিয়ে রাদিব খুব উপরে মুহিবের তাই। যখন তখন কল দিলে ভাবতে পারে, কোন মতলবে কল দিচ্ছে। কিন্তু আজ সেই কোন মতলবেই কল দিবে। সময়টা দেখল মুহিব। ৩ টা ৪০। এতো রাতে কাউকে কল দেয়াটা ভদ্রতার মধ্যে পড়ে না। তবুও এখন মাথা থেকে চিন্তাটা তাড়ানো দরকার। এখন এখনি কল দিবে রাদিবকে। ধরবে কিনা জানে না। ডাক্তার মানুষ নানা কাজে ব্যস্ত থাকে। কল দিতেই ওপাশ থেকে একদম শান্ত গলায় উত্তর, বন্ধু এতো দিন পর হঠাৎ? ঘুম আসছে না? কথা বলার জন্য ফোন দিলে?

একাই বলল রাদিব।
- না আসলে, তোকে একটু দরকার বন্ধু। আমি জানি এতো দিন পর কল দিয়ে ভাল খারাপের খোঁজ নেয়া দরকার। আমি সেসব না নিয়েই বলছি, যেভাবে পারিস কাল একটু আমাদের বাসায় আয়।
- কি হইছে? বিয়ে করলা বন্ধু , দাওয়াত দিলে না। আচ্ছা আসব।

এতো সহজে রাদিব রাজি হবে ভাবতে পারে নি মুহিব। অবশ্য রাদিব ছেলেটাই এমন। সবসময়ই মুহিবকে ভাল বন্ধু ভেবে এসেছে। হয়ত মুহিব ভাবে নি সেভাবে।
- আচ্ছা, আসলে সব জানতে পারবি। বাজারে এসে সকালে আমাকে কল দিস। আমি নিয়ে আসব তোকে।
- আচ্ছা। ঠিক আছে। ভাবীকে আমার সালাম দিস।

মুহিব আর কিছুই বলল না। কেটে দিয়ে মোবাইলটা পকেটে রাখতেই আবার বেজে উঠল। মা কল দিয়েছেন। কেটে দিল একবার। বাসায় যাবার জন্য দিচ্ছে। আজকে রাতটা মুহিব রাস্তায় হেঁটেই কাটিয়ে দিবে। আবার দিচ্ছে। যতবার কেটে দিচ্ছে, ততবারই কল করছে। মুহিব বিরক্ত হয়েই কল ধরল। মা আতঙ্ক গ্রস্থ কণ্ঠে বললেন, বউ মাকে পাচ্ছি না। তুই বাসায় আয় তাড়াতাড়ি।

মুহিব দ্রুত বাসায় চলে আসল। মা আর মনির চিন্তিত মুখে বসে আছে। মুহিব বলল, কি হইছে?
- বউ মা নেই ঘরে?
- ঘরে নেই মানে? কই যাবে? তোমরা ছিলে না?
- হ্যাঁ ছিলাম তো ঘরে। মনির বাথরুমে গেল, ওর ভয় করছিল। আমি দাড়িয়ে ছিলাম তাই ওখানে। বউ মা ঘরের লাইট বন্ধ করে দিছিল। এরপর ঘরে এসে দেখি নাই। মাঝ খানে লাগছিল, বউ মা বাহিরে যাইতেছে।
- এইটুকু সময়ের মধ্যে কই যাবে?
- আমরা সাথে সাথে বাহিরে গিয়ে দেখছি। আশেপাশে কোথাও ছিল না। ঘরে আসলাম তখন, ঘরেই ভাল করে খুঁজলাম। তাও পাই নি।

মুহিব মাথায় হাত দিয়ে বসে পড়ল। কি করবে ভেবে পায় না।
মনির বলল, ভাইয়া, আম্মু যখন ঘরের ভিতর দেখছিল। তখন আমার মনে হইছিল, তোমাদের সিঁড়ি দিয়ে কেউ নামতেছে দৌড়ে। আমি ভয়ে বলি নাই কিছু আম্মুকে।

মুহিব চোখ বড় বড় করে তাকাল মনিরের দিকে।
------------
- কি ব্যাপার তোর বাসায় এতো মানুষ কেন? অনুষ্ঠান হচ্ছে নাকি?

রাদিবের কথায় একটু শুকনো হাসি হাসল মুহিব। বাসায় মুহিবের বাবা, মা, নিলির বাবা, মা, মনির, আর মুহিবদের বাড়ির বাড়িওয়ালা। সবার চোখে মুখে চিন্তার ছাপ। বাড়িওয়ালা বলছেন, কি একটা চিন্তায় ফেললেন আপনারা? মেয়ের এমন ভূত টুতের আছর আছে আমাদের আগে জানাবেন তো? এসব ঝামেলা বাসা ভাড়া দিতে মন চায়? এখন কিছু একটা হইলে তো, সমস্যা।

রাদিবকে একটু দূরে সরিয়ে আনল মুহিব। ছাদের উপর দুজন দাঁড়াল। মুহিব রাদিবের দিকে তাকিয়ে বলল, তারপর বল, তোর কি অবস্থা? এম বি বি এস পাস করেই বসে থাকবি? আর কোন ডিগ্রি নিবি না?
- যতদূর করেছি তাই অনেক। আমার কথা বাদ দে। সমস্যা কি হইছে সেটা বল?
- না মানে কাল রাতে তোর সাথে কথা বলার পর থেকে, নিলি মানে তোর ভাবীকে পাচ্ছি না। আমি বাসার বাহিরে ছিলাম তখন। বাসায় এসে দেখি এই অবস্থা।
- তোর সাথে কি ঝামেলা ছিল?
- একটু একটু।
- ভাবীর পরিচিত কোন বান্ধবীর বাসায় যেতে পারে রাগ করে।
- এতো রাতে একটা মেয়ে কখনই বাহিরে বের হবে না। তাছাড়া ওর কিছু সমস্যাও ছিল। ভয়েও ওর বের হবার কথা না।
- কি ধরণের সমস্যা?
- মানে, ওর উপর খারাপ আত্মার ভর ছিল।

রাদিব সূক্ষ্ম চোখে তাকাল মুহিবের দিকে। কথাটা বোধহয় রাদিবের খুব একটা পছন্দ হল না।
- এই যুগে এসেও তুই এসবে বিশ্বাস করিস?
- আমি করি না। কিন্তু যেসব ঘটনা ঘটেছে, এরপর অবিশ্বাসের কিছু থাকে না। তুই থাকলেও একই কাজ করতি। এ জন্যই তোকে আমি কল করেছি রাতে। জানি তুই কিছু একটা করতে পারবি।
- হাহা, আমি? বাহ বেশ ভাল বললি। আচ্ছা আমাকে সব বল। কিছু লুকাবি না।

ছাদের উপর রোদ পড়েছে। চকচকে সে রোদে, মুহিব বলে যাচ্ছে সব ঘটনা। রাদিব শুনছে সব। খুব মনোযোগ সহকারে। মুহিব বলা শেষ সব তাকাল রাদিবের দিকে। রাদিব কিছুই না বলে, ছাদের কোণাটায় গেল। সব গুলো কোণা থেকে এদিক ওদিক তাকাল। এমন করছে কেন রাদিব জানে না মুহিব। ছাদের যে পাশটায় ডোবা, ছোট ছোট কচুরি পানায় ভরা, সে পাশটায় এসে থামল রাদিব। মুহিব এসে পাশে দাড়িয়ে রাদিবের মুখের দিকে তাকাল। রাদিব আঙুল দিয়ে নিচের দিকে কিছু দেখাল। মুহিব সেদিকে তাকাতেই চমকে উঠল। নিলির ওড়না কচুরি পানার উপর। মুহিবের মাথার ভিতর ঝিম ঝিম করছে। ফাঁকা লাগছে।

লোক এনে নিলির লাশ তোলা হল। ছাদ থেকে পানিতে পড়ে নিলির মৃত্যু হয়েছে। বাড়ির সামনে মানুষ জনে ভরে গেছে। বাড়িওয়ালা বাড়িতে কাউকে ঢুকতে দিচ্ছে না। তিনি শোকের চেয়ে, বেশী বেশী বকবক করে বলছেন, কেন যে এসব ঝামেলা ভাড়া দেই।

নিলির মা কাঁদছেন, কাঁদছেন বাবা, কাঁদছেন মুহিবের মা, মুহিবের বাবার পাশে বসে চোখ মুছছে মনির। স্বাভাবিক কাঁদাটা। মুহিবের মা কেঁদে কেঁদে বলছেন, সব ঐ খারাপ আত্মাটার কাজ। মেয়েটাকে শেষ পর্যন্ত ছাদ থেকে ফেলে.........।

মুহিব চুপচাপ দাড়িয়ে আছে রাদিবের পাশে। কাঁদছে না। তবে বুকের ভিতর কষ্টে ফেটে যাচ্ছে। প্রথম বারের জন্য মনে হচ্ছে, নিলিকে হয়ত ভালবেসে ফেলেছিল। নিলি ভাল মেয়ে ছিল। যতটা খারাপ ব্যবহার করেছে, তার কোনটাই উচিৎ হয় নি। সবার সাথে কাঁদতে ইচ্ছা করছে মুহিবের। কিন্তু মুহিবের যে কাঁদতে নেই। মুহিব বড় শক্ত ছেলে। রাদিব মুহিবের হাত ধরে, আবার ছাদে নিয়ে গেল। মুহিবকে সামনে দাড় করিয়ে বলল, জানি তোর কষ্ট হচ্ছে। অবহেলা করতে করতেই তুই একসময়য় ভাবীকে ভালবেসেছিল। হয়ত বুঝতে পারিস নাই। যাই হোক, আমি চলে যাব। কাজ আছে।

মুহিব মুখ উঁচু করে বলল, নিলির কি হয়েছিল?
- হ্যাঁ বলব। একটা সিগারেট খাওয়াতে পারবি?
- তুই ডাক্তার হয়ে সিগারেট খাবি?
- না খাবা না ঠিক। আসলে মাঝে মাঝে খুব সিগারেটের তৃষ্ণা পায়। খাই নি কখনও, তবুও পায়। সিগারেট হাতে নিলেই সে তৃষ্ণা চলে যায়। মনে হয় বড় শান্তি লাগছে।
- অদ্ভুত তুই।
- হাহা, পৃথিবীতে অদ্ভুত কিছু নেই, নেই ভূত বলতেও কিছু। যে সবের ব্যাখ্যা আমরা না পাই, সেসবের সামনে একটা নাম অদ্ভুত লাগিয়ে দেই। যেসবকে অদ্ভুত ঘটনা বলি, সেসবের পিছনে ভূত কিংবা অলৌকিক কিছুর কারসাজি বলে আমরা চালিয়ে দেই।
- মানে?
- মানে সহজ। তোর বউ এর সাথে ঘটা ঘটনা গুলোর ব্যাখ্যা না পেয়েই বলে দিল, নিলির উপর খারাপ আত্মার ভর আছে। তুই ও পাচ্ছিলি না, তাই অবিশ্বাসী মনে বিশ্বাস করলি সেসব। একটা ব্যাখ্যা দাড় করিয়ে দিলি, নিলির সাথে ভূত আছে। নিলিকে ভূতে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিল।
- তাহলে নিলির সমস্যা কি ছিল?
- তেমন কিছুই না। তোর বউ মানে নিলির সাথে যে যে ঘটনা ঘটেছে সব গুলো স্বাভাবিক ঘটনা ছিল।
- কিভাবে? নিলির পর পর দুইবার এমন করা। হুট করে মারা যাওয়া, সব স্বাভাবিক? বাড়ি কেঁপে ওঠা, আলখাল্লা পরা লোক দেখা সেটাও স্বাভাবিক? স্বাভাবিক, অস্বাভাবিক শক্তি নিয়ে আমাকে ছুঁড়ে ফেলে দেওয়া? আগুন দেখে ভয়ে কুঁচকে যাওয়া? শরীর বেকে, শক্ত হয়ে যাওয়া, অজ্ঞান হওয়া, সাথে পোড়া গন্ধটা?
- হ্যাঁ। নিলি ছোট বেলা থেকেই এপিলেপসি রুগী ছিল। সোজা বাংলায় বললে, মৃগী রুগী। এই রোগে আক্রান্তরা, হঠাৎ করেই শরীর খিঁচুনি দিয়ে অজ্ঞান হয়ে যায়। সে অবস্থায় তুই ওকে ধরলে মনেই হবে শরীরে অনেক শক্তি। এই রোগে আক্রান্তরা আগুন দেখে ভয় পাবে, স্বাভাবিক। তোর হাতে মোম দেখে যেমন পেয়েছিল। কারণ তখন নিলির শরীর খিঁচুনি দিচ্ছিল। বাথরুমের দরজা বন্ধ করার পরও ভয় থেকে, সামনে পানি দেখে খিঁচুনি দিয়ে সমস্যাটা হল। এপিলেপসি রুগীরা পানি দেখেও ভয় পায়। এরা বিপদজনক যন্ত্রপাতিও ব্যবহার করতে পারে না। আর তোর পিছনে কাউকে দেখাটা ছিল, সিজোফ্রিনিয়া থেকে। এপিলেপসি রুগীরা অনেক দিন ভুগতে ভুগতে সিজোফ্রিনিয়া আক্রান্ত হয়ে যায়। আর পোড়া গন্ধটা তোর ডিম ভাজির তেলের।

মুহিবের হাত ধরে ছাদের পাশটায় আসল রাদিব। বাড়ির সামনে এখনও অনেক লোক। বাড়িওয়ালা লোকটা রোবটের মত, একই জায়গায় দাড়িয়ে লোকগুলোকে তাড়াচ্ছে। রাদিব সেদিকে তাকিয়েই বলল, এপিলেপসি রুগীদের একা একা রাস্তা পাড়ানোর বড় বাড়ন। বাড়ন ছাদে ওঠার। নিলি তোর উপর রাগ করেই ছাদে উঠেছিল হয়ত। আর তখনি ছাদ থেকে পড়ে......।

রাদিব থামল একটু। মুহিবের দিকে তাকাল। মুহিবের চোখ ভেজা। বুকের ভিতরের শূন্যতা গুলো সাই সাই করে বাড়ছে। নিজেকে বড় অপরাধী লাগছে। মনে হচ্ছে, নিলির মৃত্যুর জন্য মুহিবই দায়ী। রাদিব অবস্থা একটু স্বাভাবিক করার জন্য বলল, তোদের বাড়িওয়ালার ছেলে মেয়ে কয়টা?
- উনি বিয়ে করেন নি।
- ওওও। এটাও কিন্তু অদ্ভুত কিছু না। তোর সব গুলো প্রশ্নের উত্তর পেলি?
- হ্যাঁ। কিন্তু বাড়ি কেঁপে ওঠার ব্যাপারটা? আমার ছোট ভাইয়ের ছাদ সিঁড়ি বেয়ে কারও নামার শব্দের ব্যাপারটা?
- সেটা মনের ভুল হয়ত।

মুহিব রাদিবের হাতটা ধরল। শক্ত করে জড়িয়ে বলল, বন্ধু নিলি আমার জন্যই মারা গেল। আমি ওকে ভালবাসতাম সত্যি।
- কাঁদিস না পাগল। জানি ভালবাসতি। ভালবাসা হারিয়ে যায় নি। নিলিকে সব সময় মনে করবি, থাকবে সবসময় ভালবাসা।

রাদিব চলে যাচ্ছে। মুহিবদের বাসা থেকে বের হবার আগে, সবার কাছ থেকে বিদায় নিল। মুহিবের মা বা, নিলির মা বাবা। মুহিব আর মনির সাথেই আসছে। যাবার আগে, বাড়িওয়ালা লোকটার সাথে হ্যান্ডশেক করল। রাদিব জানতে চাইল, আপনার পায়ে কি সমস্যা?
- জ্বি না বাবা।
- এক পা নাড়াচ্ছেন, অন্যটা স্থির যে?
- এমনিই। একটু পা নাড়ান তো, আপনার পা নাড়ানো না দেখা পর্যন্ত বড় অস্বস্তি লাগবে।

লোকটা অনিচ্ছা সত্ত্বেও দুই পা তুলে নাড়ানো। রাদিব একটু হেসে উঠল। হেসেই চলে যাচ্ছিল। হঠাৎ কি মনে করে ফিরে আসল। বাড়িওয়ালার দিকে তাকিয়ে বলল, আপনি একটু এইদিকে আসেন তো।
- কেন?
- আসেন একটু।

লোকটা এদিকে সরে আসতেই, রাদিব লোকটার দাড়ান জায়গাটায় মাটি সরাতে লাগলো। কি সব পাগলের মত কাজ করছে। মাটি সরাতেই দুইটা কারেন্টের তারের মাথা দেখল। সে দুটো এক করতেই পুরো বাড়ি শব্দ করে কেঁপে উঠল। ভুমিকম্প হলে যেভাবে কাঁপে ঠিক সেভাবে। রাদিব বাড়িওয়ালার মুখের দিকে তাকাল। মুখ একদম রক্ত শূন্য সাদা হয়ে গিয়েছে। বাড়ি থেকে সব লোকজন ভয়ে বের হয়ে এসেছে।
রাদিব বলল, আলখাল্লা পরে আপনিই এসে এই কাজ করেছিলেন তাই তো?
লোকটা বিষণ্ণ চোখে তাকিয়ে বলল, না মানে।
- নিলিকে ছাদ থেকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে, আপনিই দৌড়ে পালিয়ে গিয়েছিলেন, তাই তো?
- আপনি এসব কি বলছেন? আমি কেন এসব করব?
- কেন করবেন সেটা আপনিও জানেন , আমিও জানি। আপনার মানুষকে ভয় দেখাতে ভাল লাগে। তাই বাড়ি বানানোর সাথে সাথে, কিছু একটা যন্ত্র বাড়ির ঠিক পাশেই মাটির নিচে গেথে রেখেছেন। এই সুইচ এক করলেই সেই যন্ত্র কেঁপে উঠে, কেঁপে উঠে পুরো বাড়ি। এতো বয়সেও বিয়ে করেন নি। বউ, সন্তান নেই। নিশ্চিত তেমন কোন আত্মীয় স্বজনও নেই। তাই একাকীত্ব থেকে যে বিষণ্ণতার সৃষ্টি হয়েছিল, তা থেকেই আলখাল্লা পরে এসে নিলিকে ভয় দেখাতেন। আপনি এটা উপভোগ করতেন। সেদিন মুহিব বাহিরে যাবার পর একবার করলেন এটা। আর একবার যখন মুহিব বাহিরে গেল, আপনি আশেপাশেই ছিলেন বাড়ির। কোন ভাবে টের পেলেন, নিলি ছাদে গিয়েছে। নিলি যদিও আত্মহত্যা করতেই গিয়েছিল ছাদে, বা অন্য কোন কারণে। আপনি পিছন থেকে নিলিকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে, সে কাজটা সোজা করে দিলেন। কাজটা করে দৌড়ে সিঁড়ি বেয়ে নেমে গেলেন। সেই শব্দই শুনেছে মনির। মনের মধ্যে ভয়, এতো লোকের মধ্যে যদি কেউ আপনাকে ধরে ফেলল। তাই ভয়ে আপনার যন্ত্রের সুইচের উপর সেই কখন থেকে রোবটের মত দাড়িয়ে আছেন। কথা কি একটাও মিথ্যা বলেছি?

আশেপাশের সবাই রাদিব আর বাড়িওয়ালা লোকটার দিকে তাকিয়ে। বাড়িওয়ালা লোকটা ঘনঘন ঘাম মুছছেন। অস্বীকার করার মত কিছু বলতে চাচ্ছেন, তবে পারছেন না। সত্যিটা মেনে নেয়াটাই মনে হচ্ছে উচিৎ। পুলিশে খবর গেল, এসে ধরে নিয়ে গেল বাড়ির বাড়িওয়ালাকে।

রাদিব বাসের জানালাটার পাশে বসে আছে। জানালা খুলে দেয়া। হাতে একটা সিগারেট। বড় সিগারেটের তৃষ্ণা পেয়েছে। সিগারেট দেখে সে তৃষ্ণা চলে গেছে। এবার জানালা দিয়ে ছুড়ে, দূরে ফেলে দিল সিগারেটটা। কেউ সিগারেট খেয়ে তৃষ্ণা মেটায়, রাদিবের মত কেউ শুধু দেখে। সব কিছুর জন্য একই যুক্তি দাড় করালে হয় না। একটা খেলায় দুইটা পক্ষ, সেই খেলায় যে জিতবে সে হাসবে, যে হারবে সে মন খারাপ করবে। তার মানে খেলা মানেই শুধু হাসির জিনিস না, বা মন খারাপের কিছু না। একটা জিনিসের জন্য সবসময় এক যুক্তি খাটে না। ভাবনায় কিংবা দৃষ্টির পরিবর্তনে, যে জিনিস খারাপ, তাই ভাল হতে পারে। যা ভাল তাই খারাপ হতে পারে। পারে নিজের ভাবনার জায়গায় একটু পরিবর্তন আসতে। সহজ সরল জিনিস গুলো সমাধান বড় কঠিন, আবার খুব জটিল জিনিসের সমাধান খুব সহজ, হতেই পারে। কালো মানেই শুধু ব্যথার রঙ নয়। শোকের রঙ নয়। কালো শাড়ি পরে একটা মেয়ে হাসতেই পারে, অপরূপ লাগতেই পারে। সব কালো যেমন শুধু ব্যাথার নয়, তেমনি সব নীল স্বপ্নিল নয়। একটু ভেবে দেখার হেরফের। একটু অনুভূতি বা অনুভবের জায়গার পরিবর্তন।
৬টি মন্তব্য ৬টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

শ্রমিক সংঘ অটুট থাকুক

লিখেছেন হীসান হক, ০১ লা মে, ২০২৪ সকাল ৯:৪৮

আপনারা যখন কাব্য চর্চায় ব্যস্ত
অধিক নিরস একটি বিষয় শান্তি ও যুদ্ধ নিয়ে
আমি তখন নিরেট অলস ব্যক্তি মেধাহীনতা নিয়ে
মে দিবসের কবিতা লিখি।

“শ্রমিকের জয় হোক, শ্রমিক ঐক্য অটুট থাকুক
দুনিয়ার মজদুর, এক হও,... ...বাকিটুকু পড়ুন

কিভাবে বুঝবেন ভুল নারীর পিছনে জীবন নষ্ট করছেন? - ফ্রি এটেনশন ও বেটা অরবিটাল এর আসল রহস্য

লিখেছেন সাজ্জাদ হোসেন বাংলাদেশ, ০১ লা মে, ২০২৪ দুপুর ১২:৩৪

ফ্রি এটেনশন না দেয়া এবং বেটা অরবিটার


(ভার্সিটির দ্বিতীয়-চতুর্থ বর্ষের ছেলেরা যেসব প্রবলেম নিয়ে টেক্সট দেয়, তার মধ্যে এই সমস্যা খুব বেশী থাকে। গত বছর থেকে এখন পর্যন্ত কমসে কম... ...বাকিটুকু পড়ুন

প্রতিদিন একটি করে গল্প তৈরি হয়-৩৭

লিখেছেন মোঃ মাইদুল সরকার, ০১ লা মে, ২০২৪ দুপুর ১২:৫১




ছবি-মেয়ে ও পাশের জন আমার ভাই এর ছোট ছেলে। আমার মেয়ে যেখাবে যাবে যা করবে ভাইপোরও তাই করতে হবে।


এখন সবখানে শুধু গাছ নিয়ে আলোচনা। ট্রেনিং আসছি... ...বাকিটুকু পড়ুন

একাত্তরের এই দিনে

লিখেছেন প্রামানিক, ০১ লা মে, ২০২৪ বিকাল ৫:৩৬


শহীদুল ইসলাম প্রামানিক

আজ মে মাসের এক তারিখ অর্থাৎ মে দিবস। ১৯৭১ সালের মে মাসের এই দিনটির কথা মনে পড়লে এখনো গা শিউরে উঠে। এই দিনে আমার গ্রামের... ...বাকিটুকু পড়ুন

হুজুররা প্রেমিক হলে বাংলাদেশ বদলে যাবে

লিখেছেন মিশু মিলন, ০১ লা মে, ২০২৪ রাত ৯:২০



তখন প্রথম বর্ষের ছাত্র। আমরা কয়েকজন বন্ধু মিলে আমাদের আরেক বন্ধুর জন্মদিনের উপহার কিনতে গেছি মৌচাক মার্কেটের পিছনে, আনারকলি মার্কেটের সামনের ক্রাফটের দোকানগুলোতে। একটা নারীর ভাস্কর্য দেখে আমার... ...বাকিটুকু পড়ুন

×