স্বাধীনতা যুদ্ধের গৌরবময় অধ্যায়ের সাথে মিশে আছে ভিনদেশী কিছু মানুষের নাম। একাত্তরের মুক্তিসংগ্রামে কোটি মুক্তিকামী বাঙালির পাশাপাশি তাঁরা লড়েছেন, নিছক সহযোগিতা বা কর্তব্যের খাতিরে নয়, তাঁরা লড়েছেন মানবতার জন্য। আর সেইসব ভিনদেশী বীরদের অবদান স্মরণে ধারাবাহিক এই আয়োজন -
(গত পর্বের পর থেকে)
আন্দ্রেই আন্দ্রেভিচ গ্রোমিকো
জন্মঃ ১৮ জুলাই, ১৯০৯
মৃত্যুঃ ০২ জুলাই, ১৯৮৯
১৯৭১ সালের পূর্ব পাকিস্তান ইস্যুতে বিশ্বের দুই পরাশক্তি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও সোভিয়েত ইউনিয়ন যখন দুই শিবিরে বিভক্ত, তখন সোভিয়েত ইউনিয়ন বাংলাদেশের মুক্তিকামী মানুষের পাশে অকুন্ঠ সমর্থন নিয়ে এগিয়ে এসেছিল। রাশিয়ান কূটনীতিবিদ আন্দ্রেই আন্দ্রেভিচ গ্রোমিকো ১৯৬৫ সালের তাসখন্দ চুক্তির মাধ্যমে ভারত-পাকিস্তান সম্পর্কের মধ্যে স্থিতিশীলতা আনার চেষ্টা করেন। মুক্তিযুদ্ধের সময় সোভিয়েত পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিসেবে আন্দ্রেই আন্দ্রেভিচ গ্রোমিকো বাংলাদেশ সংকট সমাধানের জন্য ভারত-পাকিস্তান দুদেশের সাথে কূটনৈতিক প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখেন। আন্দ্রেই আন্দ্রেভিচ গ্রোমিকো যিনি ছিলেন একজন পেশাদার কূটনৈতিক, জাতিসংঘ সহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক ফোরামে পূর্ব পাকিস্তান তথা বাংলাদেশের স্বাধীনতার পক্ষে জোরালো সমর্থন আদায়ে জোর তৎপর ছিলেন। তাঁর কূটনৈতিক প্রচেষ্টায় জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র কর্তৃক উত্থাপিত যুদ্ধবিরতি প্রস্তাবে সোভিয়েত ইউনিয়ন 'ভেটো' প্রদান করে। এর ফলে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ আরও সফলতার দ্বারপ্রান্তে পৌছে যায়। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়া পর্যন্ত ভারতীয় কূটনীতিকদের পরামর্শে আন্দ্রেই আন্দ্রেভিচ আন্তর্জাতিক পরিমন্ডলে পাকিস্তানের বিপক্ষে জনমত গঠনে প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারকে সবধরনের কূটনৈতিক সহযোগিতা প্রদান করেন। বাংলাদেশের এই অকৃত্রিম বন্ধুকে আমরা শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করি।
সাইমন ড্রিং
জন্মঃ ১১ জানুয়ারি, ১৯৪৫
১৯৭১ সালে ২৫ মার্চ কালরাতে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী গণহত্যা শুরু করবার আগে ঢাকায় অবস্থানকারী সব বিদেশী সাংবাদিককে হোটেল ঢাকা ইন্টার-কন্টিনেন্টালে (ভূতপূর্ব শেরাটন, বর্তমান রুপসী বাংলা) আটকে ফেলে। পরদিন তাদেরকে বিমানে তুলে দেওয়া হয় ঢাকাকে বাকি বিশ্বের চোখের আড়াল করতে- যাতে পূর্ব পরিকল্পিত পাকিস্তানিদের বাঙালি নিধনযজ্ঞের খবর বাইরের পৃথিবীতে না পৌঁছায়। কিন্তু পাকিস্তানিদের এই পরিকল্পনায় বাধ সাধেন ২৫ বছরের এক বৃটিশ তরুণ - সাইমন ড্রিং। সামরিক আইন অমান্য করে, প্রাণের ঝুঁকি নিয়ে ২৭ মার্চ পর্যন্ত তিনি লুকিয়ে থাকেন হোটেলে। এরপর হোটেল কর্মচারীদের সহযোগিতায় ছোট্ট একটি মোটরভ্যানে ঘুরে ঘুরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইকবাল হল (বর্তমান জহুরুল হক হল), রাজারবাগ পুলিশ ব্যারাক ও পুরান ঢাকার বিভিন্ন এলাকা দেখে লেখেন, 'ট্যাংকস ক্র্যাশ রিভোল্ট ইন পাকিস্তান' নামের সেই বিখ্যাত প্রতিবেদনটি, যা ৩০ মার্চ ডেইলি টেলিগ্রাফে ছাপা হয়। তৎকালীন পাকিস্তানি সরকার তাঁকে জোরপূর্বক দেশ থেকে বের করে দিলে, ইংল্যান্ড হয়ে পুনরায় নভেম্বরে তিনি কলকাতায় আসেন। সেখান থেকে তিনি বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের যাবতীয় খবরাখবর নিরপেক্ষভাবে ঐ দৈনিকে প্রেরণ করতেন। ১৬ ডিসেম্বর মিত্রবাহিনীর সঙ্গে ট্যাংকে চড়ে ময়মনসিংহ হয়ে প্রবেশ করেন মুক্ত বাংলার রাজধানী ঢাকায়, যেন তিনিও বিজয়ী মুক্তিযোদ্ধাদের একজন।
জর্জ হ্যারিসন
জন্মঃ ২৫ ফেব্রুয়ারী, ১৯৪৩
মৃত্যুঃ ২৯ নভেম্বর, ২০০১
১ আগষ্ট, ১৯৭১। নিউইয়র্কের ম্যাডিসন স্কয়ার গার্ডেনে যুদ্ধপীড়িত বাংলাদেশী শরণার্থীদের সাহায্য করার জন্য জর্জ হ্যারিসনের উদ্যোগে আয়োজিত হয়েছিল দুটো কনসার্ট। দুর্গত মানবতার পক্ষে এমন আয়োজন ইতিহাসে সেটাই প্রথম (তারকা উপস্থিতির বিচারে)। প্রতিটি চার ঘন্টা দৈর্ঘ্যের দুপুর ও সন্ধ্যায় আয়োজিত এই 'কনসার্ট ফর বাংলাদেশ' এ সমবেত হয়েছিল প্রায় ৪০,০০০ মানুষ, প্রাণের তাগিদে মানবতার আহবানে। বন্ধু পণ্ডিত রবি শংকরের আহবানে সাড়া দিয়ে আয়োজিত এই কনসার্ট সম্পর্কে এক সংবাদ সম্মেলনে বিটলস ব্যান্ডের এই কিংবদন্তির কাছে জানতে চাওয়া হয়েছিল যে, দুনিয়াতে এত সমস্যা থাকতে হঠাৎ বাংলাদেশ প্রসঙ্গ তাঁর কাছে এতোটা গুরুত্ব পাচ্ছে কেন? হ্যারিসনের সোজাসাপ্টা উত্তর ছিল তাঁর রচিত ঐতিহাসিক 'বাংলাদেশ' গানটার কথাগুলোর মতোই সাবলীল, "আমার বন্ধু আমার কাছে সাহায্য চেয়েছে, আমার মনে হয়েছে তাঁর পাশে দাঁড়ানো উচিত।"
পণ্ডিত রবি শংকর
জন্মঃ ৭ এপ্রিল, ১৯২০
মৃত্যুঃ ১১ ডিসেম্বর, ২০১২
'রবি শংকর হচ্ছেন বিশ্ব সঙ্গীতের দেবপিতা' - জর্জ হ্যারিসন।
১৯৭০ সালে ভোলায় প্রলয়ঙ্করী সাইক্লোনটির পরপরই বাংলাদেশের বন্যাদুর্গতদের জন্য কিছু করবার কথা ভাবছিলেন বিশিষ্ট ভারতীয় সেতারবাদক ও সঙ্গীতজ্ঞ পণ্ডিত রবি শংকর। ব্যাপারটি নিয়ে আলোচনা করেন তাঁর বাল্যবন্ধু ও বিটলস ব্যান্ডের উজ্জ্বল নক্ষত্র জর্জ হ্যারিসনের সাথে। এরপর বিটলসের নিজস্ব কোম্পানি অ্যাপেল রেকর্ডস্ এ রবি শংকর রেকর্ড করেন 'জয় বাংলা' আর হ্যারিসন তাঁর 'বাংলাদেশ' জিঙ্গেলসটি। উদ্দেশ্য ছিল গানের বিক্রি আর রয়ালটি বাবদ প্রাপ্ত অর্থ দিয়ে ততদিনে যুদ্ধ শুরু হয়ে যাওয়া বাংলাদেশীদের সাহায্য করা। তবে মানবতার পাশে দাঁড়াতে আরো বড় পদক্ষেপ নিলেন তিনি। ১৯৭১ এ মুক্তিযুদ্ধের ভয়াবহতা আন্তর্জাতিক পরিমন্ডলের নজরে নিয়ে আসে রবি শংকর ও হ্যারিসনের উদ্যোগে 'নিউইয়র্কের ম্যাডিসন স্কয়ার গার্ডেনে' আয়োজিত 'কনসার্ট ফর বাংলাদেশ' অনুষ্ঠানটি।
. . . .(চলবে)