▲কেন রক্ত দেবেন ?
জীবনের জন্যে প্রয়োজন রক্ত। রক্তের বিকল্প শুধু রক্ত। অপারেশনের জন্যে, হিমোফেলিয়া, থ্যালাসেমিয়া বা দুর্ঘটনার কারণে রক্তক্ষরণ হলে শরীরে রক্ত সঞ্চালন প্রয়োজন হয়। শুধু রক্ত হলেই হবে না, জীবনের জন্যে চাই বিশুদ্ধ রক্ত। স্বেচ্ছা রক্তদাতাদের পরীক্ষিত রক্তই হতে পারে এর একমাত্র সমাধান। বাংলাদেশে প্রতিবছর প্রায় সাড়ে ৪ লক্ষ ব্যাগ রক্তের প্রয়োজন। একসময় বেশিরভাগ রক্তই আসতো পেশাদার রক্ত বিক্রেতা ও আত্মীয়স্বজনের কাছ থেকে। আর পেশাদার রক্ত বিক্রেতাদের অধিকাংশই সিফিলিস, ম্যালেরিয়া, হেপাটাইটিস-বি বা এইডসে আক্রান্ত। ফলে এই দূষিত রক্ত পরিসঞ্চালিত হয়ে রক্তগ্রহীতা প্রায়শই আক্রান্ত হন দুরারোগ্য ব্যাধিতে। প্রয়োজনের সময়ে রক্ত পাওয়া এবং দূষিত রক্তের অভিশাপ থেকে মুমূর্ষু মানুষকে রক্ষা করার জন্যেই প্রয়োজন নিরাপদ ও সুস্থ রক্তের, প্রয়োজন সচেতন মানুষের স্বেচ্ছা রক্তদান। কারণ স্বেচ্ছায় রক্তদানের মাধ্যমে যেকোনো সুস্থ মানুষ নিজের কেনো ক্ষতি না করেই মুমূর্ষু মানুষকে বাঁচাতে পারে।
▲রক্তদানঃ দান নয়, হোক আনন্দিতচিত্তে দেয়া উপহার
সাধারণভাবে অনেকেই রক্তদান থেকে দূরে থাকেন মূলত এক ধরনের অমূলক ভয়ের কারণে। এক ভদ্রলোক, তার রক্তদানের প্রথম অভিজ্ঞতা ছিলো এরকম- শরীরে সুঁচ ফোটানোর ভয়ে তিনি রক্ত দিতেন না। এক সহপাঠীর কাছে শুনে প্রথমবারের মতো রক্ত দিলেন। এরপর থেকেই নিয়মিত রক্ত দিচ্ছেন। এখন তার অনুভূতি হচ্ছে- রক্তদান এখন আমার জন্যে ভিন্নতর এক আনন্দের উৎস। মনে হয় জীবনে অন্তত একটি ভালো কাজ করার তৃপ্তি তো পাচ্ছি।
▲কোনো দুঃসাহস বা ভয় পাওয়ার কিছু নেই, প্রয়োজন একটু সদিচ্ছা-
স্বেচ্ছা রক্তদাতারা হলেন মানুষের জীবন বাঁচানোর আন্দোলনের দূত। ভালো কাজে মানুষ সবসময় অন্যকে দেখে উদ্বুদ্ধ হয়। বন্ধু রক্ত দিচ্ছে দেখে তার আরো বন্ধুও রক্ত দিতে উদ্বুদ্ধ হয়। রক্তদান একটি মানবিক দায়বদ্ধতা, সামাজিক অঙ্গীকার। যিনি যে পেশায়ই থাকুন না কেন, সমাজের জন্যে তার কিছু না কিছু করার আছে। এক ব্যাগ রক্তদানের মাধ্যমেও তিনি পালন করতে পারেন তার সামাজিক অঙ্গীকার।
▲রক্তদানের উপকারিতাঃ
▲ মানসিক তৃপ্তিঃ একবার অন্তত ভাবুন, আপনার রক্তে বেঁচে উঠছে একটি অসহায় শিশু, একজন মৃত্যুপথযাত্রী মানুষ। সে মুহূর্তে আপনার যে মানসিক তৃপ্তি তাকে কখনোই অন্য কোনোকিছুর সঙ্গে তুলনা করা সম্ভব নয়।
▲ শারীরিক দিক থেকেঃ রক্তদান স্বাস্থ্যের জন্যে অত্যন্ত উপকারী। রক্তদান করার সাথে সাথে আমাদের শরীরের মধ্যে অবস্থিত ‘বোন ম্যারো’ নতুন কণিকা তৈরির জন্যে উদ্দীপ্ত হয়। দান করার ২ সপ্তাহের মধ্যেই নতুন রক্ত কণিকা জন্ম হয়ে এই ঘাটতি পূরণ করে। আর প্রাকৃতিক নিয়মেই যেহেতু প্রতি ৩ মাস পর পর আমাদের শরীরের রেড সেল বদলায়, তাই বছরে ৪ বার রক্ত দিলে শরীরের লোহিত কণিকাগুলোর প্রাণবন্ততা আরো বেড়ে যায়।
▲ চিকিৎসাবিজ্ঞানের আলোকেঃ ইংল্যান্ডে মেডিকেল পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, নিয়মিত স্বেচ্ছা রক্তদাতারা দুরারোগ্য রোগ-ব্যাধি থেকে প্রায়ই মুক্ত থাকেন। রক্তদাতার হৃদরোগ ও হার্ট এটাকের ঝুঁকিও অনেক কম।
▲ ধর্মীয় দৃষ্টিতেঃ রক্তদান ধর্মীয় দিক থেকেও অত্যন্ত পুণ্য বা সওয়াবের কাজ। এটি এমন একটি দান যার তাৎপর্য সম্পর্কে পবিত্র কোরআনের সূরা মায়েদার ৩২নং আয়াতে বলা হয়েছে, ‘একজন মানুষের জীবন রক্ষা করা সমগ্র মানবজাতির জীবন রক্ষা করার মতো মহান কাজ।’ ঋগবেদে বলা হয়েছে ‘নিঃশর্ত দানের জন্যে রয়েছে চমৎকার পুরস্কার। তারা লাভ করে আশীর্বাদধন্য দীর্ঘজীবন ও অমরত্ব।’ আসলে সব ধর্মেই রক্তদানকে উৎসাহিত করা হয়েছে। নিঃসন্দেহে এটি একটি বড় ইবাদত।
▲কিভাবে এবং কোথায় রক্ত দান করবেন ?
১. আপনার এলাকার সব হাসপাতাল এবং ক্লিনিকে আপনার ফোন নাম্বার এবং আপনার রক্তের গ্রুপ জানিয়ে রাখুন। প্রয়োজন হলে রক্তদানের জন্য প্রস্তুত থাকুন।
২. বন্ধু, আত্মীয় সবার রক্তের গ্রুপ জেনে নিন। একটি ডাইরীতে লিখে রাখুন। দেখবেন, প্রয়োজনের সময় এই ডাইরীটিই একজনের জীবন বাঁচাতে সাহায্য করছে।
৩. সন্ধানী, রেড ক্রিসেন্ট বা কোয়ান্টাম ফাউন্ডেশনের মত সেবামূলক প্রতিষ্ঠানগুলোতে নিয়মিত রক্ত দান করতে পারেন।
▲রক্তদানে প্রকৃতির প্রতিদান
এক তরুণ। তার এক ভাইকে সঙ্গে করে চট্টগ্রামের কালুরঘাট বিসিক শিল্প নগরীর একটি রাস্তা দিয়ে রিকশায় যাচ্ছিলেন। হঠাৎ এক দ্রুতগামী ট্রাক তাদের রিকশায় প্রচণ্ড ধাক্কা দিয়ে পাশ কাটিয়ে চলে গেল। তারা তিনজনই ছিটকে পড়লেন রাস্তায়। আর তখনই ঠিক তার পাশ দিয়ে চলে গেল আরেকটি বিশাল ট্রাক। খুবই অল্প ব্যবধানে বেঁচে গেলেন তিনি। উঠে দেখেন, তার তেমন কিছু হয় নি, সামান্য চামড়া উঠে গেছে মাত্র। তখন তার মনে হলো, যেহেতু আগেই রক্তদান করেছিলেন, তাই পরম করুণাময় হয়তো নতুন করে রক্তপাত করাতে চান নি।
▲ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের প্রবীণ অধ্যাপক মো. হাফিজুল ইসলাম। তিনি ১৯ বছর বয়সে সম্পূর্ণ স্বেচ্ছা প্রণোদিত হয়ে প্রথম রক্তদান করেন। তারপর থেকে ৬০ বছর পর্যন্ত ৬৩ বার রক্ত দেয়ার বিরল কৃতিত্ব তিনি লাভ করেন। নিজে রক্তদানের পাশাপাশি প্রায় ৪০০ রক্তদাতাকে তিনি একাই উদ্বুদ্ধ করেছেন রক্তদানের এ মহতী কাজে। প্রফেসর এম হাফিজুল ইসলাম তার বক্তব্যে বলেন, আমি প্রথম রক্ত দেই ৬০ এর দশকে- তখন আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। আমার এক রুমমেটের বোনের অপারেশন হয়েছিলো। রক্তের জোগাড় কীভাবে হবে এই ভেবে সে ব্যাকুল হয়ে কাঁদছিলো। আমি তাকে রক্ত দিলাম। শুনে পুরো হলে তোলপাড় শুরু হয়ে গেল। আমাদের হলের হাউজ টিউটর দৌড়ে এলেন, আমি সুস্থ আছি কি না। মাথা নেড়ে তিনি বলতে লাগলেন, রক্ত দেয়ার আগে বাবা-মায়ের অনুমতি নেয়া উচিত। অর্থাৎ রক্তদান সম্পর্কে অনেক ভুল ধারণা সে সময় ছিলো। রক্ত দিলে কোনো শারীরিক সমস্যা হয় না- এ কথা তখন কেউ বুঝতো না।
তিনি বলেন, আমার পর্যবেক্ষণ থেকে দেখেছি যারা নিয়মিত রক্ত দেন তারা অনেক সুস্থ থাকেন, দীর্ঘজীবী হন। শুধু তা-ই নয় মানসিকভাবেও তারা সুখী জীবনের অধিকারী হন। আমি ৬৩ বার রক্ত দিয়েছি, এটা আমার কোনো গর্বের বিষয় নয়, বরং আমি মনে করি এর মাধ্যমে ৬৩ জন মানুষের খেদমত করতে পেরেছি আমার দেহের সামান্য অংশ দিয়ে। আর এই দেয়ায় আমার তো কোনো ক্ষতি হয়ই নি, বরং সুস্থ, সুখী ও পরিতৃপ্ত জীবন পেয়েছি। ষাটোর্ধ্ব বছর বয়সে এসেও আমার ডায়াবেটিস নেই। ব্লাড প্রেশার কিংবা হার্টের কোনো সমস্যা নেই। দিনে ১৭/১৮ ঘণ্টা কাজ করেও আমি কোনো ক্লান্তি অনুভব করি না। আমার বিশ্বাস, নিয়মিত রক্তদানের ফলে সুস্থতার এই নেয়ামত আমি অর্জন করেছি। কেননা রক্তদানের মাধ্যমে আমি কিছু মানুষের জীবন বাঁচানোর চেষ্টা করেছি। সৃষ্টির সেবার এই অনন্য সুযোগ পাওয়ার ফলে প্রাকৃতিক নিয়মেই আমি ভালো থাকছি, সুস্থ থাকছি। অর্থাৎ স্বেচ্ছায় রক্তদানে রক্তদাতার শারীরিক ক্ষতির কোনো সম্ভাবনা নেই বরং তা রক্তদাতার শারীরিক সুস্থতাকে অনেকাংশে বাড়িয়ে দেয়। রক্তদান দেয় রোগমুক্ত জীবনযাপন করার সুযোগ।
▲সাধ্যমতো করুন মানবকল্যাণ
এটি টমাস মানের একটি গল্প। গল্পে একজন বৃদ্ধ সমুদ্রের বেলাভূমি দিয়ে হাঁটছেন আর কিছুক্ষণ পরপর আপন মনে বালুর ওপর ঝুঁকে কিছু একটা তুলে সমুদ্রে ছুঁড়ে মারছেন। এই দেখে এক যুবক কৌতূহলী হলো। কাছে এসে সে দেখলো বৃদ্ধ আসলে সমুদ্রের ঢেউয়ের সাথে ভেসে আসা স্টারফিশগুলোর একটি/ দুটিকে এভাবে বালি থেকে তুলে সমুদ্রে ফিরিয়ে দিচ্ছেন। দেখে সে বিস্মিত হলো। বৃদ্ধের বোকামি দেখে মজাও পেলো। জিজ্ঞেস করলো, ‘সমুদ্রের একেকটা ঢেউয়ের সাথে লাখ লাখ স্টারফিশ ভেসে এসে বালিতে আটকে যায়। কিন্তু আপনি তো এভাবে ছুঁড়ে ছুঁড়ে তাদের কয়েকটি মাত্র বাঁচাতে পারেন। বাকিদের কী হবে?’ শুনে বৃদ্ধ বললেন, ‘দেখ, সবাইকে আমি বাঁচাতে পারবো না। আমার সাধ্য এটুকুই। কিন্তু তারপরও যে কয়টিকে আমি বাঁচাতে পেরেছি তাদের কাছে এটাই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। কারণ আমার সাহায্যটুকুই তার জীবন এবং মরণের মধ্যে পার্থক্য সৃষ্টির কারণ। অতএব এটার গুরুত্ব অনেক বেশি।’
এ গল্পটির শিক্ষা ছিলো যে- পৃথিবীর সব লোকের সব সমস্যা সমাধান করার সাধ্য আমাদের নেই। কিন্তু তারপরও যতটুকু সাধ্য আছে তা নিয়েই আমাদেরকে এগিয়ে আসতে হবে মানবতার কল্যাণে। তাহলেই সে ক্ষুদ্র প্রয়াস সার্থক হবে। আর সে কাজটাই রক্তদাতারা করছেন নিজ রক্তের বিনিময়ে লক্ষ প্রাণ বাঁচানোর উদ্যোগ নিয়ে।

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।




