বাঙালি বাবু হৃষীকেশ মুখোপাধ্যায় বা মুখারজি (১৯২২ - ২০০৬) হলেন সেই চিত্রপরিচালক যার তৈরি যে কোন হিন্দি সিনেমা আপনি আগে থেকে খবর না নিয়েই দেখতে পারেন। ছবি দেখে যে আপনি বিমলানন্দ পাবেন এই ব্যাপারে নিশ্চিত থাকতে পারেন। হিন্দি সিনেমার একজন কিংবদন্তি চিত্র পরিচালক হিসাবে ওনাকে গণ্য করা হয়। উনি একাধারে একজন চিত্র পরিচালক, ফিল্ম এডিটর এবং কাহিনী লেখক। উনি মোট ৪২ টি ছবি পরিচালনা করেছেন। শেষ ছবি ছিল ‘ঝুট বোলে কাউয়া কাটে’। ইহাতে অভিনয় করেছেন জুহি চাওলা এবং অনিল কাপুর। এই চিত্রপরিচালকের বেশীর ভাগ সিনেমাই রোমান্টিক কমেডি এবং মধ্যবিত্ত পরিবার কেন্দ্রিক। ওনার সম্পর্কে আরও জানতে এই লিঙ্কটি দেখুন
আমার দেখা ওনার পরিচালিত কয়েকটি হিন্দি সিনেমা যেগুলি বহুবার দেখেছি –
১। ঝুট বোলে কাউয়া কাটে ( ১৯৯৮, অনিল কাপুর, জুহি চাওলা। রোমান্টিক কমেডি)
জুহি চাওলার বাবা অমরেশ পুরি একজন অবসরপ্রাপ্ত পুলিশ কর্মকর্তা যার মধ্যে ধর্মীয় ও সামাজিক গোঁড়ামি আছে। তিনি চান তার মেয়েও এই পুরনো গোঁড়ামিগুলি মেনে চলবে। ফলে জুহি চাওলা তার প্রেমিক অনিল কাপুরকে তার বাবার সাথে পরিচয় করিয়ে দিতে পারছে না। ফলে তারা কিছু মজার কৌশল প্রয়োগ করে বাবাকে রাজি করার জন্য। এইসব নিয়েই কিছু মজার ঘটনা আছে এই সিনেমায়।
২। ঝুটি (১৯৮৫, রেখা, রাজ বাব্বর, সুপ্রিয়া পাঠক, অমল পালেকার। সামাজিক এবং রোমান্টিক কমেডি)
রেখার অভ্যাস হোল মানুষের সাথে মিথ্যে কথা বলে মজা করা। এভাবে সে মানুষের উপকার করার চেষ্টাও করতো অনেক সময়। তার ভাই পুলিশ পরিদর্শক অমল পালেকার তাকে বারবার নিষেধ করা সত্ত্বেও সে কথা শুনত না। অমল পালেকারের সাথে আবার পাশের বাড়ির মেয়ের প্রেম ছিল। রেখার বোন আল্পনার সাথে রাজ বাব্বরের ( ডঃ অনিল গুপ্তা) বিয়ে ঠিক হয়। কিন্তু আলপনা আবার আরেকজনকে ভালোবাসে। এই বিয়ে ঠেকানোর জন্য রেখা তার মিথ্যা বলার প্রতিভাকে কাজে লাগায়। সে তার মাকে বলে যে রাজ বাব্বর একজন চরিত্রহীন মানুষ। ফলে বিয়ে ভেঙে যায়। কিন্তু ঘটনাচক্রে রেখা রাজ বাব্বরের প্রেমে পড়ে যায়। রেখার এই মিথ্যা বলার প্রতিভা নিয়েই এই মজার সিনেমা। মিথ্যা বলতে গিয়ে অনেক মজার এবং বিব্রতকর পরিস্থিতি তৈরি হয়।
৩। কিসিসে না কেহ না ( ১৯৮৩, দিপ্তি নাভাল, ফারুক শেখ, উৎপল দত্ত)
ফারুখ শেখের বাবা উৎপল দত্ত একজন বিপত্নীক এবং অবসরপ্রাপ্ত মানুষ। সে সব সময় নতুন প্রজন্মের ইংরেজি প্রীতি এবং আধুনিকতার সমালোচনা করে। সে তার ছেলে ফারুক শেখকে বিয়ে দিতে চায় সাদাসিদা একটা মেয়ের সাথে। কিন্তু ছেলের জন্য মেয়ে দেখতে গিয়ে কয়েকটা মেয়ের পশ্চিমা আচরণ এবং ইংরেজি কথা শুনে সে ধাক্কা খায়। সে ঠিক করে কোন শহুরে মেয়ের সাথে ছেলের বিয়ে দেবেন না। বরং গ্রামের একটা সহজ সরল এবং সনাতনী চিন্তা ধারার মেয়ের সাথে বিয়ে দিবেন যে মেয়ে ইংরেজি জানে না। এদিকে ফারুক শেখের সাথে প্রেম চলছে দিপ্তি নাভালের। দিপ্তি নাভাল সুশিক্ষিত এবং একজন ডাক্তার। এই ধরণের ইংরেজি জানা মেয়েকে তার বাবা পছন্দ করবে না। ফলে সে তার বাবার বন্ধু লালাজির পরামর্শ চায়। লালাজি বলেন যে দিপ্তি নাভালকে একটা গ্রামের পণ্ডিতের মেয়ে হিসাবে সাজাতে যাকে অভিনয় করতে হবে একটা সাদাসিদা গ্রাম্য মেয়ের মত। এইভাবে মিথ্যা নাটক করে এবং উৎপল দত্তকে ফাঁকি দিয়ে উভয়ের বিয়ে হয়। বিয়ের পরে দিপ্তি নাভালের সেবা পেয়ে উৎপল দত্ত ভাবেন যে গ্রামের মেয়ে এনেছি বলেই এই সেবা পাচ্ছি। কিন্তু একদিন শ্বশুর উৎপল দত্ত অসুস্থ হয়ে পড়লে দিপ্তি নাভাল তাকে চিকিৎসা দিতে বাধ্য হন। ফলে তার পরিচয় প্রকাশ হয়ে পড়ে। এতে উৎপল দত্ত মনে কষ্ট পান এবং দিপ্তি নাভালও বাড়ি ছেড়ে চলে যেতে বাধ্য হন। বাকি ঘটনা ছবি দেখলেই বুঝতে পারবেন।
মধ্যবিত্তের প্রেম কাহিনী হিসাবে চমৎকার সিনেমা এটা। হৃষীকেশ মুখারজির কাহিনীগুলি মুলত মদ্ধবিত্ত শ্রেণীকে নিয়ে।
৪। আনারি (১৯৫৯, রাজ কাপুর, নুতন )
কাহিনী সংক্ষেপ – রাজ ( রাজকাপুর) একজন সৎ এবং সুদর্শন তরুণ। পেইন্টিংএর দোকান আছে তার। কিন্তু অর্থ কষ্টে আছেন। একদিন সে একটা মানিব্যাগ পায় এবং পাওয়ার পর এটার মালিক রামনাথকে খুঁজে মানিব্যাগটা তাকে ফেরত দেয়। খুশি হয়ে রামনাথ তাকে তার ব্যবসায় ক্লার্ক হিসাবে চাকরী দেয়। রামনাথ সাহেবের ভাতিজী আরতির (নুতন) সাথে তার পরিচয় এবং প্রেম হয়। প্রেমনাথের তৈরি করা ওষুধ খেয়ে রাজের বাড়িওয়ালী মিসেস ডি’সার মৃত্যু হয়। পুলিশ সন্দেহ করে যে রাজ তাকে বিষ প্রয়োগ করেছে। রাজকে গ্রেফতার করা হয় এবং মামলা চলতে থাকে। বিচারে রামনাথ তার দোষ স্বীকার করে নেয়। আরতি রাজকে জানায় সে মিসেস ডি’সাকে কথা দিয়েছিল যে সে রাজের দেখাশুনা করবে। কারণ মিসেস ডি’সা এবং আরতি মনে করতো যে রাজ হোল এই দুনিয়ার চালাক লোকদের তুলনায় একটু বোকা প্রকৃতির। এই দেখাশুনার দায়িত্ব বলতে ওদের মধুর মিলন বোঝানো হয়েছে।
এই চিত্র পরিচালকের আরও কিছু ছবি আমি এককালে দেখেছি যেমন;
১। গোলমাল ( অমল পালেকার, উৎপল দত্ত, বিন্দিয়া গোস্বামী)
২। চুপকে চুপকে ( অভিতাভ, ধরমেন্দ্র, শরমিলা ঠাকুর, জয়া ভাদুরি)
৩। আচ্ছা বুরা ( অনিতা রাজ, রাজ বাব্বর )
৪। রাঙ বিরাঙগী ( দিপ্তি নাভাল, ফারুক শেখ, উৎপল দত্ত)
৫। বেমিসাল ( অমিতাভ, রাখি, ভিনোদ মেহরা )
৬। নারাম গারাম ( অমল পালেকার, উৎপল দত্ত, শত্রুঘ্ন সিনহা, সোয়ারূপ সমপাদ)
৭। খুব সুরাত ( রেখা , রাকেশ রশান, অশোক কুমার )
৮। মিলি ( অমিতাভ, জয়া ভাদুরি)
৯। নেমক হারাম ( রাজেশ খান্না, অমিতাভ, রেখা )
১০। অভিমান ( অমিতাভ, জয়া ভাদুরি, আসরানি)
১১। বাবুর্চি ( রাজেশ খান্না, জয়া ভাদুরি)
১২। বুদ্দা মিল গায়া ( দেভেন ভারমা, ওম প্রকাশ, নভিন নিশ্ছল)
১৩। গুড্ডি ( ধরমেন্দ্র, জয়া ভাদুরি, উৎপল দত্ত)
১৪। আনান্দ ( রাজেশ খান্না, অমিতাভ )
ঋষিকেশ মুখারজির প্রত্যেকটা সিনেমাই ভালো (যেগুলি দেখেছি সেগুলির ভিত্তিতে অনুমান করছি )। এগুলি সস্তা হিন্দি বাণিজ্যিক ছবি না। ওনার ছবির মূল কেন্দ্রবিন্দু হোল মধ্যবিত্ত পরিবারের মূল্যবোধ ও সুখ-দুঃখ, রোমান্টিক প্রেম এবং সর্বোপরি পরিবার কেন্দ্রিক কমেডি। ছবিগুলি দেখে অবশ্যই আনন্দ এবং মজা পাবেন। এই ব্যাপারে আমি পুরোপুরি নিশ্চিত। বিফলে মূল্য ফেরত। ওনার অধিকাংশ ছবি অনেক পুরস্কার পেয়েছে। যেগুলি দেখিনি এবং উপরে নাম লিখিনি সেগুলিও অনেক ভালো বলে শুনেছি। তাই সময় নষ্ট না করে এখুনি ওনার পরিচালিত সিনেমাগুলি দেখে ফেলুন।
সুত্র – উইকিপিডিয়া
ছবি- Indiatvnews