মানুষ অভাবে পড়লে সাহায্য চাইতেই পারে। সাময়িকভাবে রাস্তায় দাড়িয়ে ভিক্ষাও করতে পারে। কিন্তু এক শ্রেণীর মানুষ যখন বছরের পর বছর এই ভিক্ষা করাকে পেশা হিসাবে বেছে নেয় তখন সেটা একটা সামাজিক সমস্যায় পরিনত হয় এবং এই পরিস্থিতির জন্য দায়ী হলও এই সমস্ত পেশাদার ভিক্ষুকেরা। অনেকে শারীরিক ভাবে পঙ্গু থাকে বা অনেকের মানসিক ভারসাম্য নষ্ট হয়ে গেছে অথবা অনেকে আছে বয়োবৃদ্ধ যাদের কাজ করার শক্তি নাই। এদের কথা আলাদা। কিন্তু একটু খেয়াল করলেই দেখবেন যে অধিকাংশ ভিক্ষুক শারীরিকভাবে সক্ষম এবং ভিক্ষা করা এদের নেশা বা পেশা। এই ধরনের ভিক্ষাকে কখনও উৎসাহিত করা উচিত না।
রাস্তায় ভিক্ষা করাও অনেক পরিশ্রম সাধ্য কাজ। দিনের মধ্যে ১০ থেকে ১২ ঘণ্টা তপ্ত রাস্তায় শুয়ে, বসে বা দাড়িয়ে ভিক্ষা করা সহজ কথা না। অনেক শারীরিক সক্ষমতার প্রয়োজন আছে। যারা এতো কঠিন শারীরিক কষ্ট সহ্য করতে পারে তারা চেষ্টা করলে যে কোন ছোট কাজে ঢুকে যেতে পারে। সেটা হতে পারে রিকসা চালানো, বিড়ি সিগারেট বিক্রি, চা বিক্রি, রাস্তার পাশে ফল কেটে রস বিক্রি, বাদাম বিক্রি, পিঠা বিক্রি, চটপটি বিক্রি, ভ্যানে সবজি বিক্রি, ঝালমুড়ি বিক্রি, রাস্তার সিগনালে ছোটখাটো জিনিস বিক্রি (যেমন বাচ্চাদের ছবির বই, রুমাল, ইয়ার ফোন ইত্যাদি), গৃহকর্মী হিসাবে কাজ ইত্যাদি। ইচ্ছা থাকলে এই ধরণের অনেক পেশা আছে যে পেশাতে পুজি লাগে না বললেই চলে। এই কাজ আপনি আমি না করতে পারলেও একজন ভিক্ষুকের জন্য কোন ব্যাপার না। রাস্তায় অনেক সময় দেখা যায় রিকসা চালাচ্ছে কিন্তু তার একটা হাত নাই। অথবা খুড়িয়ে খুড়িয়ে হেটে জিনিস ফেরি করে বিক্রি করছে বা অন্য কোন কাজ করছে।
আসল কথা হলও যার আত্মসম্মান বোধ নাই সে ভিক্ষা করাকে স্থায়ীভাবে বেছে নেয়। অনেক ছোট বাচ্চাকে ভিক্ষা করা শেখানো হচ্ছে। কিন্তু তার পাশাপাশিই দেখা যায় ১০/১২ বছরের ছেলে বা মেয়ে কুলির কাজ করছে, পেপার বিক্রি করছে, চা বিক্রি করছে, মটর গ্যারাজে কাজ করছে, রেস্টুরেন্টে কাজ করছে, বাসে চকলেট বিক্রি করছে।
আরেকটা ব্যাপার হল ভিক্ষুকরা আমাদের দেশে আল্লাহর কথা বলে ভিক্ষা করা শুরু করে। আমি বাংলাদেশে কোন ভিক্ষুকের মুখে শুনি নাই যে বলছে বাবা ভগবান তোমার ভালো করবে আমাকে একটু সাহায্য কর। আমার ধারণা বাংলাদেশের ভিক্ষুকদের ৯৯.৯৯% হল মুসলমান। কিন্তু হওয়া উচিত ছিল ৯০% মুসলমান। আমি কখনও বাংলাদেশে কোন হিন্দু ভিক্ষুক দেখি নি। থাকলেও খুব কম আছে। ভারতে ভিক্ষুক হিন্দু ভিক্ষুক দেখেছি কিন্তু কম।
আল্লাহকে ডেকে যারা এভাবে সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও ভিক্ষা করে এরা আসলে সমাজকে কলুষিত করছে। জাতির একটা উল্লেখযোগ্য অংশ যার তার কাছে হাত পাতাকে পেশা হিসাবে নিতে দ্বিধা বোধ করছে না। এটা একটা জাতির জন্য কখনও সম্মানজনক হতে পারে না। আবার মৌসুমি ভিক্ষুক আছে যারা ঈদ বা বিভিন্ন উৎসবের সময়ে মাস খানেকের জন্য ঢাকায় আসে ভিক্ষা করতে। এরা একটা ভালো অংক আয় করে দেশে চলে যায়।
বাংলাদেশ সরকারের সংশ্লিষ্ট বিভাগ ভিক্ষুক নির্মূলের চেষ্টা করছে নাম কা ওয়াস্তে। ঢাকার কিছু কিছু গুরুত্বপূর্ণ রাস্তায় সাইনবোর্ডে লেখা থাকে যে ভিক্ষুক প্রবেশ নিষেধ। সরকারকেও পুরোপুরি দোষ দিয়ে লাভ নেই। কারণ আমাদের সমাজের মানুষ ভিক্ষাবৃত্তিকে উৎসাহিত করছে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে। একটা জাতির একটা শ্রেণীর আত্মসম্মান বোধ কমে গেলে এগুলি হয়। এটা জাতির জন্য ভালো কিছু না।
এই লেখাটা মুলত পেশাদার ভিক্ষুকদের নিয়ে লেখা যারা ভিক্ষা করে বাণিজ্যিক লাভের জন্য। দশ জনের কাছে চাইলে একজন দেবেই। আবার শোনা যায় কিছু ক্রিমিনাল নাকি মানুষকে পঙ্গু করে দেয় এবং ভিক্ষাবৃত্তিতে নিয়ে আসে। এগুলি দেখার কোন কর্তৃপক্ষ এই দেশে আছে বলে মনে হয় না। জাতি যদি নেশায় বুদ হয়ে থাকে, অলস ভাবে সময় কাটায়, টিকটক নিয়ে ব্যস্ত থাকে আর একটা অংশ হাত পাতাকে বাণিজ্য বানিয়ে ফেলে তাহলে বোঝা যায় যে এই জাতির রন্ধ্রে রন্ধ্রে কঠিন ক্যানসার ঢুকে গেছে। আর মধ্যবিত্ত আর ধনীদের একটা শ্রেণী ডুবে আছে রাজনৈতিক লুটপাট, দুর্নীতি, সন্ত্রাস, জমি ডাকাতি, প্রতারনা আর ব্যাংক ডাকাতিতে। বাংলাদেশে বড় কোন সৎ ব্যবসায়ী আদৌ আছে কি না সন্দেহ আছে আমার । কোন সৎ লোকের পক্ষে এই দেশে বড় কোন ব্যবসা করা সম্ভব না।
আমি প্রকৃত নিরুপায় ভিক্ষুকের বিরুদ্ধে বলছি না। কিন্তু বিভিন্ন সুত্রে জানা যায় যে আমাদের দেশে ভিক্ষা একটা বড় পেশা। মাদ্রাসা আর এতিম খানার নামে কমিশন ভিত্তিতে টাকা তোলাও এক ধরণের ভিক্ষাবৃত্তি। কোন জাতির একটা উল্লেখযোগ্য অংশের মন মানসিকতা এত নিচু হলে এটা জাতির জন্য অশনি সংকেত। এই ধরণের কাজ অলস, ভবঘুরে এবং কাপুরুষেরা করে থাকে।
যে ব্যক্তির হাত পাততে বাধে না সে আসলে সমস্যায় নাই। সমস্যায় আছে নিম্নবিত্ত আর মধ্যবিত্ত মানুষ। কারণ তারা মরে গেলেও কারও কাছে হাত পাততে চায় না। আমাদের উচিত এই ধরণের প্রকৃত অভাবী লোকদের খুঁজে বের করে তাদেরকে সাহায্য করা। এদেরকে খোঁজা খুব সহজ। আপনার আসে পাশে যারা থাকে যেমন গৃহকর্মী, অফিসের পিয়ন, ড্রাইভার, দারোয়ান এরাই আসলে অনেক কষ্টে আছে। কিন্তু তারা ভিক্ষা করবে না যত কষ্টেই থাকুক না কেন।
পৃথিবীর অনেক উন্নত দেশেও হয়তো ভিক্ষুক আছে। কিন্তু তারা এটাকে স্থায়ীভাবে পেশা হিসাবে বেছে নেয় না। আমার মতে এই ভিক্ষা বাণিজ্যের মূল কারণ আমাদের জনগণের প্রতারিত হওয়ার মন মানসিকতা। আমরা জানি যে মসজিদের টাকা লুটপাট হচ্ছে তারপরেও দান করি। ভিক্ষুকের চেহারা দেখে আমাদের মায়া লাগে আমরা টাকা দেই। কিন্তু কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া পেশাদার ভিক্ষুকরা ভালো অভিনয় করতে জানে। সমাজের ভিতর থেকে এই সমস্যাগুলির সমাধান আসতে হবে। সব কিছু রাষ্ট্র করে দিতে পারবে না। আমাদের হীন এবং নিচু মন মানসিকতা থেকে বেড়িয়ে আসতে হবে। ভিক্ষা দেয়া বন্ধ করতে আমি বলছি না। আমিও অনেক সময় ভিক্ষা দেই। কিন্তু বুঝে শুনে দেয়ার চেষ্টা করি। প্রকৃত অভাবী ভিক্ষুককে ভিক্ষা দেয়ার চেষ্টা করা উচিত। যদিও এটা নির্ণয় করা অনেক সময় কঠিন। আমি শারীরিক এবং মানসিক প্রতিবন্ধিদের ভিক্ষা দেই আর অতি বৃদ্ধ এবং দুর্বল মানুষকে ভিক্ষা দেই।
ছবি - যুগান্তর
সর্বশেষ এডিট : ১৭ ই সেপ্টেম্বর, ২০২৩ রাত ১:২৭