গৃহকর্মীকে সোফায় বসানোর মত মন মানসিকতা আমাদের মধ্যে খুব কম মানুষের মধ্যেই আছে বলে মনে হয়। ছোট বেলায় আমাদের বাসাতেও কাজের লোক সোফায় বসতো না। তবে আমার পরিবারের ক্ষেত্রে পরবর্তীতে কিছুটা উন্নতি হয়েছে বলে মনে হয়। এখন আমার বাসায় একটা বাচ্চা মেয়ে থাকে। বয়স হবে ৮/৯ বছর। সে আমাদের সোফায় বসে টিভির কার্টুন দেখে। আমাদের বিছানায় বসে। বেশ কয়েক বছর আগে একটা কিশোরী মেয়ে অনেক বছর ছিল আমাদের বাসায়। সে মাঝখানে চলে গিয়েছিল এবং দ্বিতীয় বার আবার এসেছিল। প্রথম বার সে সোফায় বসতো না। দ্বিতীয় বার আসার পরে সে আমাদের খাবার টেবিলে বসে খেত, সোফায় বসত। আমরা মেনে নিয়েছিলাম এবং কিছুই বলতাম না। বিয়ে না হওয়া পর্যন্ত সে আমাদের বাসায় ছিল। তখন আমার বাবা মা ছিল এবং যৌথ পরিবারে ছিলাম আমরা। মাঝখানে স্থায়ী কাজের লোক ছিল না। ছুটা কাজ করতো অনেকেই। এদের বসার সময় নাই। কাজ করে দিয়ে কত আগে চলে যাবে সেই চিন্তায় ব্যস্ত থাকতো তারা। যাদের কথা বললাম তারা ছাড়া অন্য কোন গৃহকর্মীকে আমরা সোফায় বা চেয়ারে বসতে দিব কি না সেটাও আমি সঠিক বলতে পারবো না। কারণ সামাজিক নিয়মের বাইরে আমরাও না।
সাধারণত আমাদের সমাজে কাজের লোককে আমরা ড্রইং রুমের সোফায় বা খাবার ঘরের চেয়ারে বসতে দেই না। ব্যতিক্রম সম্ভবত খুব কমই আছে। আমার স্ত্রীও ছুটা কাজের লোককে চেয়ারে বসতে দেবে কি না আমি জানি না। এই সামাজিক বৈষম্য পৃথিবীর আর কোথায় আছে জানি না। এটা কি এক ধরণের বর্ণবাদ? একটা সমাজে এই ধরণের বৈষম্য থাকলে সেই সমাজের সুষম উন্নয়ন কিভাবে সম্ভব।
আরেকটা বিষয় বলি। আমাদের সমাজে শিক্ষিত ছেলে মেয়েরা সব পেশায় যেতে চায় না। যদিও আগের চেয়ে অবস্থার কিছু উন্নতি হয়েছে। এখন অনেক রেস্টুরেন্টে দেখি শিক্ষিত ছেলে মেয়েরা কাজ করছে ওয়েটার হিসাবে। দূর পাল্লার বাসে সেবক হিসাবে কাজ করছে ডিগ্রি বা মাস্টারস পাস করা ছেলেরা। হোম ডেলিভারি দিচ্ছে শিক্ষিত ছেলেরা। তবে এখনও অনেক শিক্ষিত তরুণ আছে যারা এই পেশাগুলিতে যাবে না বছরের পর বছর বেকার থাকা সত্ত্বেও। আমার একটা গ্রাম সম্পর্কের ভাগ্নে আছে। গরীব ঘরের ছেলে। অনেক কষ্টে সে বিবিএ পাস করেছে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। বছর খানেক বেকার থাকার পরে আমাকে মোবাইলে মেসেজ পাঠিয়েছে যে মামা একটা চাকরী দেয়া যাবে। আমি তার জন্য কর্পোরেট জব আগেও চেষ্টা করেছি। কিন্তু সে বিবিএ পাস হলেও যোগ্যতার মাপকাঠিতে পিছিয়ে। কম্পিউটার চালাতে পারে না বললেই চলে। ইংরেজিতে দুর্বল। ই-মেইলে যোগাযোগ সে কখনও করেনি। এই সব কারণে চেষ্টা সত্ত্বেও তার চাকরীর ব্যবস্থা করতে পারিনি। তার মেসেজ পেয়ে আমি তাই তাকে লিখলাম যে সিকিউরিটি গার্ডের চাকরী করবে কি না। সে রাজী হলে একটা কোম্পানির সিকিউরিটি বিভাগে চাকরী দেয়া সম্ভব হতো। কিন্তু সে আমার মেসেজের উত্তর দেয় নি। সম্ভবত এই চাকরীকে সে সম্মানজনক মনে করেনি। আমি তাকে বেশ কয়েকবার বলেছি গাড়ি চালানো শিখতে কিন্তু সে এটাকেও সম্মান জনক পেশা হিসাবে মনে করেনি।
আমাদের সমাজে কিছু সামাজিক বৈষম্য আছে যেটা এই যুগে থাকা উচিত না। যেমন আমরা পিয়ন, দারোয়ান, গৃহকর্মী, গাড়ি চালক ইত্যাদি পেশার লোকদেরকে একটু ভিন্ন দৃষ্টিতে দেখি এবং আমাদের সাথে এক সাথে চলার যোগ্য মনে করি না। এই পেশাগুলিতে ডিগ্রি বা মাস্টারস পাস খুব কম ছেলেই আসে। এটার মূল কারণ এই পেশাগুলিকে আমরা নিচু শ্রেণীর পেশা মনে করি এবং এই পেশা নিলে আমাদের সামাজিক মান মর্যাদা ক্ষুণ্ণ হবে বলে আমরা মনে করি। আবার এই পেশার লোকদের সাথেও আমরা অনেকে খুব অমানবিক ব্যবহার করি। আমরা আরবদের দোষ দেই গৃহকর্মীর উপর যৌন এবং শারীরিক নির্যাতনের জন্য। কিন্তু আমাদের দেশেও গৃহকর্মীরা চরম নিগৃহীত। আমরা মনে করি এরা নিচু জাত। আমাদের এই দীনতা দূর করতে হবে নিজেদেরকে সভ্য দাবী করতে হলে। অতীতের সামাজিক বৈষম্য এই যুগেও বজায় রাখা মানে আমাদের সমাজের বাহ্যিক জৌলুস বৃদ্ধি পেলেও আমাদের মন মানসিকতার মধ্যেও এখনও এক ধরনের বর্ণবাদ আছে। ধনী আর দরিদ্র শ্রেণীর মাঝে একটা অদৃশ্য দেয়াল আমরা এখনও রেখে দিয়েছি। এই দেয়াল ভেঙ্গে ফেলতে আমরা কি পারবো? সম্ভবনা খুব কম মনে হচ্ছে আমার কাছে। ব্লগাররা কি মনে করেন?