ইদানিং ভারতের কিছু মানুষ এবং মিডিয়া প্রচার করে যাচ্ছে যে ভারতীয় পণ্য এবং সেবা বন্ধ হলে বাংলাদেশের মানুষ কঠিন বিপদে পড়বে। না খেয়ে মরবে এমন কথাও বলছে অনেকে। তাদের অনেকেই ঘুড়িয়ে ফিরিয়ে বলতে চাচ্ছে যে বাংলাদেশের মানুষের তুলনায় তারা অনেক বেশী আয় করে এবং সুখে শান্তিতে আছে। আসুন দেখা যাক এই কথাগুলি কতটা সত্য।
আন্তর্জাতিক মানদণ্ডে প্রতিদিন ২ ডলার ১৫ সেন্টের কম যারা আয় করে তাদেরকে চরম দরিদ্র মানুষ বলা হয়। সেই হিসাবে ভারতের ১২.৯০% মানুষ চরম দরিদ্র (২০২১ সালের হিসাব)। একই মানদণ্ডে বাংলাদেশের ৫% মানুষ চরম দরিদ্র (২০২২ সালের হিসাব)। (সুত্র – বিশ্বব্যাংক)
২০২৩ সালের আইএমএফের হিসাব অনুযায়ী গত চার বছরে বাংলাদেশের মাথাপিছু আয় ভারতের চেয়ে বেশী ছিল। ২০২৩ সালে বাংলাদেশের মাথাপিছু আয় ছিল ২৬২১ ডলার আর ভারতের ছিল ২৬১২ ডলার।
বাংলাদেশের মানুষ ভারতের চেয়ে সামান্য বেশী পরিমান ডায়েটারি এনার্জি গ্রহণ করে থাকে খাদ্যের মাধ্যমে। বাংলাদেশের মানুষ গড়ে প্রতিদিন ১০,৭২০ কিলোজুল ডায়েটারি এনার্জি গ্রহণ করে থাকে আর ভারতের মানুষ গ্রহণ করে ১০,৬০০ কিলোজুল। (সূত্র – এফ এ ও)।
ওয়ার্ল্ড হ্যাপিনেস ইনডেক্সের ২০২৩ সালের হিসাব অনুযায়ী ভারতের চেয়ে বাংলাদেশের মানুষ বেশী সুখী (সূত্র - ওয়ার্ল্ড হ্যাপিনেস রিপোর্ট ২০২৩) । এই তালিকায় ভারত ১২৬ তম আর বাংলাদেশ ১১৮ তম।
২০২৩ সালের গ্লোবাল অরগানাইজড ক্রাইম ইনডেক্সের রিপোর্ট অনুযায়ী ভারতের অবস্থান ৬১ তম (স্কোর ১০ এর মধ্যে ৫.৭৫ ) আর বাংলাদেশের অবস্থান ৮৯ তম (স্কোর ৫.১২)। সুবিধার জন্য বলছি যে, অবস্থান যত আগে ক্রাইম তত বেশী।
পিইউ রিসার্চের ২০২১ সালের তথ্য অনুযায়ী পৃথিবীতে যে ৮ টি দেশে অত্যধিক বেশী (ভেরী হাই) মাত্রায় ধর্মীয় শত্রুতা বিরাজমান তার মধ্যে ভারতের অবস্থান দ্বিতীয় (বাকি দেশগুলি হল নাইজেরিয়া, সিরিয়া, ইসরাইল, মিশর, আফগানিস্তান এবং পাকিস্তান)। এই তালিকায় যুক্তরাজ্য এবং বাংলাদেশ আছে বেশী মাত্রার (হাই গ্রুপ) গ্রুপে। এই হাই গ্রুপে আরও আছে ফ্রান্স, মেক্সিকো, ফিনল্যান্ড, ফিলিপাইন, বেলজিয়াম, জার্মানি, রাশিয়া, ব্রাজিল, ইন্দোনেশিয়া, শ্রীলঙ্কা সহ আরও কিছু দেশ। ।
প্রতি লক্ষ জনসংখ্যায় হত্যার পরিমান হিসাব করলে ভারত বাংলাদেশ থেকে পিছিয়ে আছে। ভারতে প্রতি লাখে ২.৮৩ জন মানুষ হত্যা হয় আর বাংলাদেশে লাখে হত্যা হয় ২.৩৪ জন (সূত্র - UNODC)।
স্বাস্থ্যকর খাবার পানি, টয়লেট, নর্দমা, বর্জ্য ইত্যাদি জনস্বাস্থ্য সংক্রান্ত সুবিধা বিবেচনায় নিলে ভারতের চেয়ে বাংলাদেশের অবস্থান ভালো। বিশ্বের সব দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ১৩৩ তম আর ভারতের অবস্থান ১৪৩ তম। (সুত্র - https://epi.yale.edu/measure/2024/H2O)
বেকারত্বের হার বাংলাদেশের চেয়ে ভারতে বেশী। আইএলওর রিপোর্ট অনুযায়ী ভারতে বেকারত্বের হার ৭.৮০% আর বাংলাদেশে বেকারত্বের হার ৫.২০%।
ভারতে প্রতি লাখে আত্মহত্যার হার বাংলাদেশের চেয়ে অনেক বেশী। ভারতে প্রতি লাখে ১৯ জন আত্মহত্যা করে আর বাংলাদেশে করে ৭ জন।
জনগণের গড় আয়ু বাংলাদেশের ৭৩.১০ বছর ( ২০২১ সালের উপাত্ত , ওয়ার্ল্ড হেলথ অর্গানাইজেশন রিপোর্ট) আর ভারতের ৬৭.৩০ বছর।
২০২৪ সালে তৈরি করা শান্তির দেশের তালিকায় বাংলাদেশের অবস্থান ভারতের চেয়ে ভালো। বাংলাদেশের অবস্থান ৯৩ তম আর ভারতের অবস্থান ১১৬ তম (সুত্র - https://gfmag.com/data/most-peaceful-countries/)।
নারীর সমতার ক্ষেত্রে ভারতের চেয়ে বাংলাদেশ এগিয়ে। ওয়ার্ল্ড ইকনমিক ফোরামের ২০১৮ সালের রিপোর্ট অনুযায়ী বাংলাদেশের অবস্থান ৪৮ তম আর ভারতের অবস্থান ১০৮ তম। নারীর সমতার ক্ষেত্রে দক্ষিণ এশিয়ায় বাংলাদেশ এগিয়ে আছে।
শিশু মৃত্যু এবং পুষ্টির হার বিবেচনায় নিলে বাংলাদেশের অবস্থান ভারতের চেয়ে ভালো।
ধর্মীয় শত্রুতার বিচারে সারা বিশ্বে ভারতের অবস্থান খারাপের দিক থেকে ৪র্থ (পিউ রিসার্চের রিপোর্ট ২০১৫) । ভারত শুধু মাত্র সিরিয়া, নাইজেরিয়া এবং ইরাকের চেয়ে ভালো অবস্থানে ছিল।
বায়ু দূষণে দিল্লির অবস্থা ঢাকার চেয়েও খারাপ।
তবে সব সূচকেই যে বাংলাদেশ ভারতের চেয়ে এগিয়ে এই কথা বলা যাবে না। উপরে ব্যক্তি পর্যায়ের অর্থনৈতিক, মনস্তাত্ত্বিক এবং সামাজিক স্বস্তি এবং সামর্থ্যকে বিবেচনায় নিয়ে দেখানো হয়েছে যে আর্থিক, সামাজিক, ধর্মীয় এবং মনস্তাত্ত্বিক বিচারে গড়ে ভারতের একজন মানুষের চেয়ে বাংলাদেশের মানুষ ভালো আছে। কিছু কিছু সুচকে ভারতের অবস্থান বাংলাদেশের চেয়ে ভালো কিন্তু খুব ভালো বলা যাবে না। যেমন রাজনৈতিক পরিবেশের স্থিতিশীলতায় ভারতের স্কোর ৫৯ আর বাংলাদেশের ৫০। জীবন যাত্রার ব্যয় ভারতে কম ( বাংলাদেশের স্কোর ৫৮ আর ভারতের ৪৯)। ভারতের মুদ্রাস্ফীতি বাংলাদেশের চেয়ে কম (বাংলাদেশ ৯.৮৮% ভারত ৫.৬৫%)। দুর্নীতিতে ভারতের চেয়ে বাংলাদেশ এগিয়ে ( বাংলাদেশের স্কোর ৭৬ আর ভারতের ৬১)। প্রতি হাজারে ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর সংখ্যা ভারতে ৪৬৩ জন আর বাংলাদেশে ৪৪৫ জন (কিন্তু ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট ব্যবহারকারী বাংলাদেশে হাজারে ৭৫ জন আর ভারতে ২৮ জন)। ভারতে প্রতি হাজারে ১.৬৩ টা হাসপাতাল বেড আছে। বাংলাদেশে আছে ০.৮৮ টা। ভারতে প্রতি হাজারে ০.৭৩ জন ডাক্তার আছে আর বাংলাদেশে আছে ০.৬৭ জন। ডায়াবেটিস রোগী ভারতের চেয়ে বাংলাদেশে বেশী (ভারত ৯.৬০%, বাংলাদেশ ১৪.২০%)। ধূমপায়ীর সংখ্যা বাংলাদেশে অনেক বেশী (ভারত ৮% আর বাংলাদেশ ৩৪.৭০%) (এই প্যারাগ্রাফে দেয়া উপাত্তের সূত্র হল Click This Link)
পশ্চিম বঙ্গের দাদারা লাফালাফি বেশী করছে। আমি উপরে যে উপাত্ত দিয়েছি সেগুলি সমগ্র ভারতের গড় হিসাব। আসুন দেখি পশ্চিমবঙ্গের কি অবস্থা। বাংলাদেশের মাথা পিছু আয় হল ২৬২১ ডলার (২০২৩ সাল) তার বিপরীতে পশ্চিম বঙ্গের মাথা পিছু আয় হল ২১০০ ডলার (সূত্র - "GSVA/NSVA by Economic Activities")। অর্থাৎ বাংলাদেশের চেয়ে প্রায় ২০% কম এবং ভারতের গড় মাথাপিছু আয়ের চেয়েও প্রায় ২০% কম ( ভারতের গড় মাথাপিছু আয় ২৬১২ ডলার)। মাথাপিছু আয়ের হিসাবে ভারতের ২৮ টা রাজ্যের মধ্যে পশ্চিম বঙ্গের অবস্থান হল ২১ তম। অর্থাৎ তাদের চেয়ে আরও ২০ টা রাজ্যের মানুষের মাথাপিছু আয় তাদের চেয়ে বেশী। বলা যেতে পারে যে আয়ের দিক থেকে পশ্চিমবঙ্গ ভারতের একটা পিছিয়ে পড়া রাজ্য। তবে স্বীকার করতে হয় যে তাদের মুদ্রাস্ফীতির হার বাংলাদেশের চেয়ে অনেক কম (৩.৬৩%)।
তারপরেও পশ্চিমবঙ্গের মানুষের কৃপণতা নিয়ে কিছু কথা প্রচলিত আছে। যেমন ‘দাদা খেয়ে এসেছেন নাকি গিয়ে খাবেন’। কিংবা ‘আধেক ডিম পুরোটাই খেলুম’। অথবা ‘আধেক মিষ্টি পুরোটাই খাবেন কিন্তু’। এমনও শোনা যায় যে পশ্চিমবঙ্গের দাদা বউদিরা নাকি একই কনডম ধুয়ে রোদে শুকিয়ে পুনরায় ব্যবহার করে থাকেন (আমাদের একজন সুপরিচিত ব্লগার এই ধরণের অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হয়েছিলেন)।
আমার এই পোস্টে সামষ্টিক সুবিধার চেয়ে ব্যক্তিগত সুযোগ, সুবিধা, সুখ, স্বস্তিকে প্রাধান্য দেয়া হয়েছে। ভারত মহাকাশে রকেট বা উপগ্রহ পাঠাতে পারে কিংবা পারমানবিক বোমা বানাতে পারে কিংবা তাদের অস্ত্র, সৈন্য, গোলাবারুদ বেশী এই বিষয়গুলি ভারতের একজন দরিদ্র সাধারণ মানুষের কোন উপকারে আসে না। এগুলি নিয়ে তারা যদি বড়াই করেও থাকে, নিজের আয় রোজগারের ক্ষেত্রে বা ব্যক্তিগত সুখ, স্বাচ্ছন্দ্যের ক্ষেত্রে এগুলির কোন ভুমিকা নাই।
ভারতবাসীদের প্রতি, বিশেষ করে পশ্চিমবঙ্গের দাদা দিদিদের প্রতি পরামর্শ রইল দয়া করে নিজের চরকায় তেল দেন। আর শেখ হাসিনাকে দেখে শুনে রাখিয়েন। উহা আপনাদের জন্য অমূল্য সম্পদ। আশা করা যায় উহার কারণে অচিরেই আপনাদের অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক এবং সামাজিক উন্নতি সংঘটিত হইবে।
সূত্র-
https://ocindex.net/rankings?f=rankings&view=List
https://www.pewresearch.org/religion/wp-content/uploads/sites/7/2024/02/PR_2024.3.5_religious-restrictions_B.pdf
https://data.who.int/countries/356
https://www.huffpost.com/archive/in/entry/on-religious-hostilities-india-ranked-just-slightly-better-than_in_5c11edf1e4b0295df1fa0e65
সর্বশেষ এডিট : ১৪ ই ডিসেম্বর, ২০২৪ দুপুর ১২:৪১