আমাদের জেনারেশনকে আমার বরাবরই কনফিউজড লাগে । বিভিন্ন ব্যাপারে আমাদের যেন কোন সুস্পষ্ট মতামত নেই । এত ভিন্ন ভিন্ন রকমের চিন্তাভাবনা চারিদিক থেকে আমাদের ঘিরে ধরে যে তাদের মধ্যে কোনটি গ্রহণযোগ্য সেটা কিছুতেই বুঝে উঠতে পারি না । কখনও মনে হয় একপক্ষ ঠিক কখনও বা মনে হয় অপরপক্ষ । আবার বেশিরভাগ সময়েই মনে হয় উভয়পক্ষের কথাতেই যেন যুক্তি আছে । কাউকেই যেন উড়িয়ে দেওয়া যাচ্ছে না । ঈশ্বরের অস্তিত্বের ব্যাপারে ঠিক একই কথা মনে হয় । যারা বলেন যে ঈশ্বর আছেন আর যারা বলেন যে ঈশ্বর নেই তাঁদের উভয়ের কথার মধ্যেই অনেক যুক্তি রয়েছে । কারোর যুক্তিই পুরোপুরি ফেলে দেওয়া যায় না ।
তবে ঈশ্বরের অস্তিত্বের প্রমাণে যে কথাগুলি প্রচলিত সেগুলি হল । আমরাই হচ্ছি ঈশ্বরের অস্তিত্বের সবচেয়ে বড় প্রমাণ । ঈশ্বর আমাদের সৃষ্টি করেছিলেন বলেই আমরা আছি । না হলে আমাদের কোন অস্তিত্ব থাকত না । ঈশ্বর সর্বদা আমাদের অন্তরে অধিষ্ঠান করেন । তাই ঈশ্বরকে পেতে গেলে মন্দির মসজিদ বা গির্জায় গিয়ে কিছু হবে না । নিজের অন্তরের মধ্যেই ঈশ্বরকে খুঁজতে হবে ।
কিন্তু এই ধরনের কথায় ঠিক যেন মন ভরে না । আমরা শিক্ষিত বা অর্ধশিক্ষিত মানুষ আমাদের চাই যুক্তি । কোন ধর্মগুরু কি কথা বলল বা কি ধর্মগ্রন্থে কি কথা লেখা আছে সেটা কখনও প্রমাণ হতে পারে না । পৃথিবীর বেশিরভাগ ধর্মগ্রন্থেই যা লেখা আছে সেগুলি যে ঠিক তারই বা প্রমাণ কি ? বা সেগুলি যখন লেখা হয়েছিল তার পরে সেগুলিকে কোন বদল করা হয় নি তারই বা নিশ্চয়তা কোথায় ? আর ধর্মগ্রন্থগুলিকে বিনা বিচারে মেনে নেওয়াটাও কি একধরনের গোঁড়ামি নয় ।
ধর্মগ্রন্থগুলি হল অনেকটা জ্যামিতির স্বতঃসিদ্ধের মত । প্রথমেই মেনে নিতে হবে কোন প্রমাণ ছাড়াই যে এইগুলি ঠিক । না হলে কোন অঙ্কই কষা যাবে না । বেশিরভাগ ধর্মেই আছে যে কোন অবস্থাতেই ধর্মগ্রন্থগুলির বিরুদ্ধে কোন প্রশ্ন তোলা যাবে না । বিনা বিচারে মেনে নিতে হবে সব কিছু । এই ব্যাপারটাই আমার আশ্চর্য লাগে । যারা ঈশ্বরে বিশ্বাস করেন তাঁরা তো এটাও তো বিশ্বাস করবেন যে মানুষের এই সভ্যতা মানুষের বিচার বিবেচনা বুদ্ধি সবই ঈশ্বরের দান । তাহলে মানুষ যদি তার বুদ্ধি বিবেচনা খাটিয়ে ধর্মের মূল বক্তব্যগুলি সম্পর্কে কিছু প্রশ্ন তোলে তবে তা কেন গ্রহণযোগ্য হবে না ।
অনেক সাধুসন্ত আর ধর্মগুরু কিন্তু প্রত্যক্ষ প্রমাণ দিয়েই মানুষের মনে বিশ্বাস আনেন । অর্থাৎ তাঁরা নানা রকমের ম্যাজিক দেখিয়ে সাধারণ মানুষকে প্রভাবিত করার চেষ্টা করেন ।
পৃথিবীর ইতিহাস ঘাঁটলে কিন্তু দেখা যায় ঈশ্বরের নাম করেই বিভিন্ন দেশের শাসকেরা তাঁদের শাসন চালিয়ে গেছেন । ঈশ্বরের নামে শাসন করে তাঁরা দুর্বলদের উপর আধিপত্য চালিয়েছেন । দেশ শাসন করেছেন । রাজ্যজয় করেছেন । তাঁরা প্রচার করেছেন যে রাজা বা সম্রাট হচ্ছেন স্বয়ং ঈশ্বরের অবতার বা তাঁর প্রতিনিধি । চার হাজার বছর আগেকার মিশরীয় রাজা থেকে আরম্ভ করে মাত্র কয়েকদিন আগে পতন হওয়া নেপালের রাজা সবাই একই পথের পথিক।
আবার মেয়েদের দমিয়ে রাখার জন্যও ঈশ্বরকে টেনে আনা হয় । তাঁদের বলা হয় তাঁদের স্বামীই হচ্ছেন তাঁর কাছে ঈশ্বর সমতুল্য । অর্থাৎ পতি পরম গুরু । আবার হিন্দু বা মুসলিম সব ধর্মেই আছে কোন পুরুষ যদি ভাল কাজ করে তাহলে সে মৃত্যুর পরে সে স্বর্গে বা বেহেস্তে যাবে । কিন্তু কোন মহিলা সম্পর্কে এটা বলা নেই যে তারা যদি ভাল কাজ করে তাহলে মৃত্যুর পর স্বর্গে গিয়ে সে কয়টি পুরুষকে উপভোগ করতে পারবে ।
তা যাই হোক যার বিশ্বাস আছে সে ঈশ্বরে বিশ্বাস করবে আর যার নেই সে করবে না । কিন্তু কোন কোন সময় সত্যিই মানুষের ঈশ্বরের উপর থেকে বিশ্বাস উঠে যায় যখন তারা চরম বিপর্যয়ের সম্মুখীন হয় । সম্প্রতি ইজরায়েলে পোল্যান্ডের একটি ইহুদি মেয়ের দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়কার ডায়েরি প্রকাশিত হয়েছে । সেখানে সে লিখেছে – যখন দেখি মানুষদের জীবন্ত অবস্থায় ফার্নেসে ফেলে দেওয়া হচ্ছে । বাচ্চাদের জার্মান সৈন্যরা কেবল খালি হাতে মেরে ফেলেছে তখন ঈশ্বরের উপরে আর কোন বিশ্বাস থাকে না । যদি সত্যিই ঈশ্বর থাকতেন তাহলে কিছুতেই তিনি তাঁর পথ অনুসারীদের এভাবে মরতে দিতেন না ।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ে জার্মানে প্রায় নব্বই লক্ষ মানুষকে কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্পে মেরে ফেলেছিল । যাদের মধ্যে বহু শিশুও ছিল । যারা ঈশ্বর বিশ্বাসী তাঁদের মনে প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক যদি ঈশ্বর থেকে থাকেন তাহলে তিনি কিভাবে এই অনাচার মেনে নিলেন । নাকি হয়ত ঈশ্বর আছেন কিন্তু মানুষের ভালমন্দে তাঁর কিছুই যায়-আসে না । ঈশ্বরবিশ্বাসরা প্রায়ই একটা কথা বলেন যে আল্লাহ যা করেন মঙ্গলের জন্যই করেন । আমার জানতে ইচ্ছা হয় যে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে যে ছয় কোটি মানুষ মারা গিয়েছিল তাতে কার মঙ্গল হয়েছিল । টিবিতে মাঝেমধ্যেই দেখায় সোমালিয়ার দুর্ভিক্ষের ছবি । হাজার হাজার মানুষ খেতে না পেয়ে যাদের হাত পা কাঠি হয়ে গেছে । বাচ্চাদের প্রত্যেকটি পাঁজরা গোনা যাচ্ছে । যেকোনো মূহুর্তে তারা মারা যেতে পারে সুধু না খেয়ে । তাদের এই অবস্থা তাও কি ঈশ্বরের করুণার দান । অথবা কয়েকবছর আগে সুনামিতে ইন্দোনেশিয়া, ভারত, শ্রীলঙ্কা সহ আরও বহু দেশে যে হাজার হাজার মানুষ মারা গেল তাও কি ঈশ্বরের ইচ্ছায় হয়েছে ।
তাহলে আমাদের এই জগতে ঈশ্বরের কাজটা কি ! তিনি কি একটা বাচ্চার মত যে নিজের খেলনা গুলো নিয়ে খেলে ছড়ায় ভাঙে আবার গুছিয়ে রাখে । যখন যা ইচ্ছা তখন তা করে । আর এই সমস্ত কাজের মধ্যে কোন যুক্তিবোধ কাজ করে না । নাকি আমাদের এই দুঃখ দুর্দশা আনন্দ সবই আসলে একটা ভ্রম । আমরা মনে করছি যে আমরা ভাল আছি বা খারাপ আছি । কিন্তু আমরা আসলে যা দেখছি বা শুনছি তা সবই মায়া । এই অনুভূতিগুলির বাস্তবে কোন অস্তিত্ব নেই । কেন যুক্তি দিয়েই পৃথিবীতে অনাচারগুলির কোন ব্যাখ্যা পাওয়া যায় না । কেনই বা মানুষে মানুষে এত বৈষম্য আর কেনই বা খুব অল্পসংখ্যক কিছু মানুষ পৃথিবীর সব সম্পদ ভোগ করে তার কোন ব্যাখ্যা মেলে না । কেন কিছু মানুষ সারাজীবন ধরে সুখভোগ করে আর কিছু মানুষের সারাজীবন কাটে দুঃখে যেখানে সব মানুষেরই ঈশ্বর কৃপা সমানভাবে পাওয়া উচিত ছিল ।
কেউ কেউ বলেন যে ঈশ্বর মানুষকে দুঃখ কষ্টে ফেলে পরীক্ষা করেন যে তারা কতটা সহনশীল হয়েছে । কিন্তু ঈশ্বর এরকম খামখেয়ালিপনায় কি লাভ হয় সেটা কেউ স্পষ্ট করে বুঝিয়ে বলতে পারে না । একজন মানুষ সে হয়ত জীবনে চরম কষ্ট পেয়েছে যা নরকযন্ত্রণাই সামিল সে তো বলতেই পারে যে হয়ত ঈশ্বর আছেন কিন্তু তাতে আমার কি । ঈশ্বর থেকেও তো আমার কোন উপকার হয়নি । তাহলে ঈশ্বর থাকুন তাঁর মতো । আর আমি থাকব আমার মত ।
তবে শেষ অবধি আমার যেটা মনে হয় সেটা হল ঈশ্বর হয়ত আছেন কিন্তু তিনি সর্বশক্তিমান নন । অর্থাৎ তিনি চাইলেই কোন মানুষের ভাল বা মন্দ করতে পারেন না । হয়ত লড়াই করার জন্য কিছুটা শক্তি যোগাতে পারেন । যেমন কেউ যদি একটুও পড়াশোনা না করে তাহলে কি কেবল ঈশ্বরকে ডেকে পরীক্ষায় পাস করতে পারে । না তা কোনমতেই সম্ভব নয় । ঈশ্বর কেবল তাকে ভাল পরীক্ষা দেবার জন্য কিছুটা মানসিক শক্তি যোগাতে পারেন । কিন্তু তাকে পাস করিয়ে দেবার ক্ষমতা তাঁরও নেই ।
তাই মনে হয় ঈশ্বরের প্রতি আস্থার থেকেও যেটা দরকার বেশি সেটা হল নিজের প্রতি আস্থা । আর নিজের প্রতি আস্থার অভাব থাকলেই মানুষ যখন পরাস্ত হয় তখন সে ঈশ্বরকে দোষারোপ করে । অথচ প্রত্যেক মানুষের ভিতরেই যদি ঈশ্বরের প্রকাশ থাকে তাহলে নিজের প্রতি আস্থাই ঈশ্বরের প্রতি আস্থায় রূপান্তরিত হয় ।
সর্বশেষ এডিট : ২৪ শে ডিসেম্বর, ২০১৫ রাত ৯:৩৩