কেউ কি কোথাও আছ, যে আমার কথাগুলি শুনবে। আমার পুরাতন কথা যদি শুনতে চাও , তবে চলে এসো এই বুড়িগঙ্গা নদীর পাড়ে, আর মনোযোগ দিয়ে জলকল্লোলে কান পেতে থাকো, বহুদিনকার আমার কত বিস্মৃত কথা শুনতে পাবে।
আমার আর-একদিনের কথা মনে পড়ছে। সেও ঠিক এইরূপ দিন। আশ্বিন মাস পড়িতে আর দুই-চারি দিন বাকি আছে। ভোরের বেলায় অতি ঈষৎ মধুর নবীন শীতের বাতাস নিদ্রোত্থিতের দেহে যেন নূতন প্রাণ এনে দিয়েছে। তরু-পল্লব অমনি একটু একটু শিহরিয়া উঠিছে। ভরা বুড়িগঙ্গার উপরে শরৎ প্রভাতের যে রৌদ্র পড়েছে, তা যেন কাঁচা সোনার মতো রঙ, কিংবা চাঁপা ফুলের মতো রঙ। রৌদ্রের এমন রঙ আর কোনো সময়ে দেখা যায় না। চড়ার উপরে কাশবনের উপরে রৌদ্র পড়েছে। এখনো কাশফুল সব ফুটে নাই, ফুটতে আরম্ভ করেছে মাত্র।
পাখিরা যেমন আলোতে পাখা মেলে আনন্দে নীল আকাশে ওড়ে, আমার কাছে মনে হত ছোটো ছোটো নৌকাগুলি তেমনি ছোটো ছোটো পাল ফুলিয়ে সূর্যকিরণে যেন উড়ছে। আমার কাছে নৌকাগুলিকে পাখি বলে মনে হতো; তারা যেন রাজহাঁসের মতো জলে ভাসছে, কিন্তু আনন্দে পাখা দুটি আকাশে ছড়িয়ে দিয়াছে। যতবার এই বুড়িগঙ্গার পাড়ে এসে বসেছি, সবসময় আমার পাশে সুমনা থাকত। আজ শুধু রয়ে গেছে সুখময় কিছু কল্পনা ।
-চল উঠি সুমনা ।
-না ,উঠব না। সারারাত এখানেই থাকব । সারারাত নদীর পাড়ে বসে জোছনা দেখে, কাল সকালে আমরা বিয়ে করব ।
- কি বলছ, তোমার বাবা তো আমাকে খুন করে ফেলবে ।
- সুমনা আমার কথা শুনে খিল খিল করে হাসছে। হাসতে হাসতে তার চোখে পানি এসে গেল। তবু সে হাসছে। এমন অসাধারন দৃশ্য আমার জীবনে অভিনীত হয়েছে, এই কথাটা আজ কিছুতেই বিশ্বাস হতে চায় না। আজ মনে হয় ‘সুমনা’ নামে কোন তরুনীর সঙ্গে আমার কোনদিন পরিচয় ছিল না। সবই কল্পনা ।
হটাৎ কিছু পড়ার শব্দে চমকে তাকালাম---- হ্যাঁ ধ্বংস প্রায় বুড়িগঙ্গা সেতুর উপর থেকে কিছু একটা পড়ল। যাই দুপুরের খাবারের আয়োজন করা দরকার।
২০৭০ সন তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলছে-----
ছোট একটা কনফারেন্স রুমে জাতিসংঘের গোপন একটা মিটিং এ ৩২ দেশের প্রতিনিধি হাজির। কথা হবে গোপন একটি প্রজেক্ট নিয়ে। প্রজেক্ট ফ্যাক্ট ফাইল ইতিমধ্যে সবার টেবিলে রাখা আছে। স্পিচ দেবেন, প্রজেক্ট কোর্ডিনেটর। কিছু ক্ষনের মধ্যেই শুরু হয়ে যাবে ওরাল সেসন। ধীরে ধীরে রুমের আলো কমতে থাকে। সদস্যরা নীরবে শুনতে থাকে...
জেনেটিক্স ইন্জিনিয়ার্ড ভাইরাস বা জীবানু অস্ত্রের প্রয়োগের ফলে পৃথীবী আজ বিপর্যস্ত। বিশেষ একটি ভাইরাস ছরিয়ে পরেছে, যার সক্রমনের কয়েক মিনিটের মধ্যেই আক্রান্তের মৃত্যু হয়। ভাইরাসটি পরাজিত হবে ভাবা হয়েছিল, সেই রকমটি হয়নি। ভাইরাসটির প্রতিরোধ ব্যবস্থার পরবর্তি সংস্করনের দিকে নজর দেয়া প্রয়োজন। অন্যান্য প্রজাতিতে ছড়িয়ে পড়ার কোন ধরনের ডেটা পাওয়া যায়নি।
দীর্ঘদিন পারমানবিক গবেষনাগারে কাজ করায় আমার দেহে মাত্রাতিরিক্ত রেডিয়েশন ছড়িয়ে পড়েছে। হয়তো সে কারনেই আমার দেহে জেনেটিক্স ইন্জিনিয়ার্ড ভাইরাসটির মিউটেশান ঘটেছে। আক্রান্ত হবার পরও আমি বেচে আছি। আমি চিরদিন স্থির অবিচল, চিরদিন একই ভাবে আছি, কিন্তু তবুও আমার এক মুহূর্তের জন্যও বিশ্রাম নাই। এতটুকু বিশ্রাম নাই। আমার এতুটুকু সময় নাই যে, আমার শিয়রের কাছে অতি ক্ষুদ্র যে একটি নীলবর্ণের বনফুল ফুটিছে তাকে দেখতে পারি।
সুমনার কথামত সেদিন আমরা সত্যিই বিয়ে করেছিলাম। স্বাতী নামের আমাদের ফুটফুটে একটা মেয়ে ছিল। স্বাতী তার ছোটো ছোটো হাতগুলি দিয়ে আমাকে মৃদু মৃদু আঘাত করিত। যেন সে পরম স্নেহে আমাকে ঘুম পাড়াইতে চায়। যেন তার অবচেতন বিমল হৃদয় আমার সাথে কথা কয়। হায় !!! এত স্নেহ পাইয়াও আমি তার কোন উত্তর দিতে পারি নাই ।
বিদায়কালে আমি সুমনা-কে কথা দিয়েছিলাম, আবার দেখা হবে। সে কথা কোন্খানে রক্ষা হয়েছে জানি না। শুধু রাতের আকাশে যখন তাকিয়ে থাকি, তখন তারাগুলোকে জিজ্ঞাসা করি, - কোটি কোটি যোজন দূরে থেকে তোমরা কি সত্যই মানুষের জীবনের সমস্ত কর্মসূত্র ও সম্বদ্ধসূত্র নিঃশব্দে বসে বসে বুনছ ........।
ছবি সুত্র : নেট
২৩.০৬.২০১৭
সর্বশেষ এডিট : ২৪ শে জুন, ২০১৭ রাত ১১:০০