যুক্তরাষ্ট্রের যুদ্ধাপরাধ বিষয়ক রাষ্ট্রদূত স্টিফেন জে র্যাপ আন্তর্জাতিক অপরাধ আইনে তার ইতঃপূর্বে দেয়া সুপারিশ পুরোপুরি গ্রহণ না করায় দুঃখ প্রকাশ করেছেন। তিনি বলেন, ১০টি সুপারিশের ৫টি আংশিক গ্রহণ করা হয়েছে। আমি দুঃখের সাথে বলতে চাই যে, গত জুন মাসে বিচার কাজের ধারাসমূহে যেসব সংশোধনী আনা হয়েছে তাতে আরও অনেক বিষয় অন্তর্ভুক্ত করা সম্ভব ছিল। বাংলাদেশে মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ কি তার সঠিক সংজ্ঞায়নও হয়নি বলে অভিযোগ করেন তিনি। ট্রাইব্যুনালের অন্তর্বর্তীকালীন আদেশের বিরুদ্ধে আপীলের সুযোগ থাকা উচিত। বিচারের স্বচ্ছতা ও নিরপেক্ষতা নিশ্চিত হয়েছে এমনটি দেখতে চায় যুক্তরাষ্ট্র। বিচারিক সব কার্যক্রম সরাসির টেলিভিশনে প্রচারের পক্ষেও যুক্তি দেন তিনি। যারা নিরপরাধ তাদের নিরপরাধিতা প্রমাণের সুযোগ নিশ্চিত করা এবং মুক্তি দেয়া উচিত। বাদী-বিবাদী উভয়পক্ষের জন্যই বিদেশী আইনজীবী নিয়োগের বিধান রাখার পক্ষে মত দেন র্যাপ।
দু'দিনের বাংলাদেশ সফরের শেষ পর্যায়ে গতকাল সোমবার ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটিতে আয়োজিত এক সাংবাদিক সম্মেলনে স্টিফেন জে র্যাপ বক্তব্য রাখছিলেন। ঢাকাস্থ মার্কিন দূতাবাসের কর্মকর্তারা এ সময় উপস্থিত ছিলেন।
স্টিফেন জে র্যাপ গত রোববার সকালে ঢাকায় এসে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের বিচারক ও প্রসিকিউটদের সাথে বৈঠক করেন। গতকাল তিনি অভিযুক্ত পক্ষের আইনজীবী ও আইনমন্ত্রীর সাথে সাক্ষাৎ করেন। পরে বিকেলে সাংবাদিক সম্মেলনে বক্তব্য রাখেন। রাষ্ট্রদূত র্যাপ এ নিয়ে তৃতীয় বারের মত বাংলাদেশ সফর করছেন। তিনি কার আমন্ত্রণে এই তিনবার বাংলাদেশ সফর করলেন এবং খরচ কে বহন করছেন এমন প্রশ্নের জবাবে বলেন, আমি বাংলাদেশ সরকারের আমন্ত্রণেই এসেছি। যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশ মানবতার বিরুদ্ধে বিচারে স্বচ্ছতা ও নিরপেক্ষতা দেখতে চায়। যুক্তরাষ্ট্রের স্টেট ডিপার্টমেন্টে আমি রিপোর্ট করব।
যুক্তরাষ্ট্র ১৯৭১ সালে পাকিস্তান ও তার সহযোগীদের পক্ষে ছিল। তাদের অপরাধের বিচার হচ্ছে। এই প্রক্রিয়ায় যুক্তরাষ্ট্র কি এখনো তার আগের অবস্থানেই আছে কিনা। এমন প্রশ্নের জবাবে র্যাপ বলেন, আমি কেনেডির লোক। কাজেই আপনাদের জাতি রক্তের গন্ধের সাথেই আছি। তাছাড়া ১৯৭১ সাল আর ২০১১ সাল এক নয়। সাংবাদিক সম্মেলনে স্টিফেন জে র্যাপ বলেন, আপনাদের আন্তর্জাতিক যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনাল সম্পর্কে জানতে এবং যে বিচারকাজ শুরু হয়েছে তার নিরপেক্ষতা ও স্বচ্ছতা নিশ্চিত করতে করণীয় বিষয়ে মতামত জানাতে বাংলাদেশে এটি এ বছরে আমার তৃতীয় সফর।
১৯৭১ সালে কী ধরনের জঘন্য অপরাধ এখানে সংঘটিত হয়েছিল সে বিষয়ে আমার ধারণা রয়েছে। আমি জানি, সে সময় হাজার হাজার ভুক্তভোগীকে হত্যা করা হয়েছে কিংবা তারা ধর্ষিত হয়েছেন, কী যন্ত্রণার ভিতর দিয়ে তারা দিনাতিপাত করেছেন এবং কত বাড়িঘর ও সম্পত্তি ধ্বংস হয়েছে। এ ধরনের অপরাধের ভুক্তভোগীদের বিচার পাওয়ার অধিকার রয়েছে এবং যারা এ ধরনের অপরাধের জন্য অভিযুক্ত হয়েছেন তাদেরও অধিকার রয়েছে তাদের বিরুদ্ধে প্রমাণাদির যথার্থতা যাচাই করার এবং নিজেদের পক্ষে সাক্ষ্য-প্রমাণ হাজির করবার। যারা নির্দোষ, এ প্রক্রিয়ায় তাদের নিরাপরধতা প্রমাণিত হওয়া উচিত এবং তাদেরকে মুক্তি দেয়া উচিত। আর যারা এ ধরনের অপরাধের জন্য দায়ী তাদেরকে দোষী সাব্যস্ত করে শাস্তি প্রদান করা উচিত। বাংলাদেশে, এ অঞ্চল এবং বিশ্বব্যাপী এই বিচারের ঐতিহাসিক গুরুত্ব বিবেচনায় এমনভাবে এই বিচারকার্য পরিচালনা করা উচিত, যাতে তা স্বচ্ছ হয় এবং সবার জন্য উন্মুক্ত থাকে।
তিনি বলেন, এই বিচার প্রক্রিয়ার নিরপেক্ষতা ও স্বচ্ছতা নিশ্চিত করতে গত মার্চ মাসে আমি এই বিচারকাজের ধারাসমূহের সংশোধনীর জন্য কিছু প্রস্তাব রেখেছিলাম। এসব প্রস্তাবনার কিছু জুন মাসে গৃহীত সংশোধনীতে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। তবে আমি দুঃখের সাথে বলতে চাই যে, এগুলোর মধ্য থেকে আরো অনেকগুলো বিষয় যোগ করা সম্ভব ছিল। স্টিফেন জে. র্যাপ বলেন, আমার বর্তমান সফরের মূল উদ্দেশ্য হলো, আন্তর্জাতিক যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনাল কিভাবে এই বিচারকাজ পরিচালনা করবে তা জানা। সংবিধি ও ধারাগুলো তৈরি করা আছে; এখন প্রশ্ন হচ্ছে, কীভাবে ওগুলো বাস্তবে প্রয়োগ করা হবে। এই ঐতিহাসিক বিচার প্রক্রিয়ার জন্য ন্যায়বিচার নিশ্চিত করা এবং তা করতে দেখার এখনো অনেক কিছুই করার বাকি রয়েছে।
তিনি বলেন, প্রথমত, এটা গুরুত্বপূর্ণ যে বিচারকদের প্রথম সুযোগেই ‘মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ' বিষয়টি সংজ্ঞায়িত করা উচিত। ‘মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ' বিষয়টি আন্তর্জাতিক আদালতের সংবিধি ও বিভিন্ন মামলার মাধ্যমে সংজ্ঞায়িত করা হয়েছে। কিন্তু বাংলাদেশে এ বিষয়টি এখনো কোনো সংজ্ঞায় ফেলা হয়নি। প্রথম মামলার অভিযোগ গঠন প্রক্রিয়ায় বিচারকরা বলেছিলেন যে, তারা বাংলাদেশের আইন অনুযায়ী এই সংবিধি প্রয়োগ করবেন এবং আন্তর্জাতিক ট্রাইব্যুনালের বিভিন্ন সিদ্ধান্তের মধ্য দিয়ে তারা দিক নির্দেশনা খোঁজার চেষ্টা করবেন। তবে, অভিযুক্ত হত্যা ও ধর্ষণগুলো কি একটি নাগরিক গোষ্ঠীর বিস্তৃত ও প্রক্রিয়াগত আক্রমণের অংশ হিসেবে করা হয়েছিলো, নাকি সেগুলো কোনো বর্ণবাদ, ধর্মবাদ কিংবা রাজনৈতিক উদ্দেশ্যের কারণে করা হয়েছিলো, নাকি আবার অভিযুক্ত আসামীদের এই বিশাল আক্রমণ সম্বন্ধে কোনো তথ্য বা জ্ঞান থাকার প্রয়োজন ছিলো কি না, এগুলোর মধ্যে কোন বিষয়টি বিচার প্রক্রিয়ায় প্রমাণ করতে হবে সে বিষয়টিও পরিষ্কার নয়।
সংঘটিত অপরাধ সংশ্লিষ্ট যেসব বিষয়গুলো প্রমাণ করতে হবে সেগুলো অন্যান্য আদালতে বিচারকরা পূর্ববর্তী রায়ের মাধ্যমে নির্ধারণ করেছেন। এখানেও একইভাবে কাজটি করা যেতে পারে। দ্বিতীয়ত, অন্যান্য মারাত্মক অপরাধে আরোপিত বাংলাদেশী নাগরিকগণ যেসব অধিকার নিশ্চিতভাবে উপভোগ করবে, এই অভিযুক্তদেরও সেই অধিকারগুলো চর্চার সুযোগ দেয়াটা গুরুত্বপূর্ণ। বাংলাদেশের সংবিধান ও আইন এ বিষয়ে সম্মতি জানায় যে, এটা একটি বিশেষ আদালত যা নিজস্ব ধারা ও প্রক্রিয়াসমূহের জন্য নিজেই দায়ী। বিচারকরা ধারাগুলোর সংস্কার করে ‘অভিযুক্তদের দোষী সাব্যস্ত হওয়ার আগে নির্দোষ হিসেবে বিবেচিত হওয়া' এবং ‘যুক্তিসঙ্গত দ্বিধা-সন্দেহের ঊর্ধ্বে প্রমাণ' ধারণাগুলো সংযোজন করেছেন। একইসঙ্গে, এই বিচারকাজ যেন এমনভাবে পরিচালিত হয় যাতে অভিযুক্তরা তাদের আইনজীবীদের সঙ্গে পরামর্শ করার সমঅধিকার, নিজের রক্ষার্থে মামলা প্রস্তুতির জন্য সমপরিমাণ সময় ও দক্ষতা এবং অন্যান্য মামলার ক্ষেত্রে যেমন হতো ঠিক তেমনিভাবে এই প্রক্রিয়াকেও চ্যালেঞ্জ করার মতো সময় ও দক্ষতা উপভোগ ও ব্যবহারের সুযোগ পায় সে বিষয়টাও নিশ্চিত করাটা গুরুত্বপূর্ণ।
তৃতীয়ত, ধারাসমূহ সংস্কারের মাধ্যমে সাক্ষীদের নিরাপত্তার সুযোগ হলেও এটা গুরুত্বপূর্ণ যে, এমন একটি সাক্ষী নিরাপত্তা প্রক্রিয়া গড়ে তুলতে হবে যা উভয়পক্ষ ব্যবহারের সুযোগ পায়। প্রথম বিচার প্রক্রিয়ায় সাক্ষীদের নামের তালিকা ইতোমধ্যে লিপিবদ্ধ করা হয়েছে। বিবাদীকেও ৭ ডিসেম্বরের মধ্যে সাক্ষীদের একটি তালিকা অবশ্যই জমা দিতে হবে। সাক্ষী নিরাপত্তা ব্যবস্থায় গৃহীত পদক্ষেপগুলো এমনভাবে কার্যকর করতে হবে যাতে যারা এগিয়ে এসে সত্য কথা বলতে চায় তারা যেন কোনো হুমকি ও ভয়-ভীতির শিকার না হয়।
র্যাপ বলেন, সর্বশেষ এবং সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ যে বিষয় তা হলো- এই বিচার প্রক্রিয়ায় কি ঘটছে তা সবাইকে জানাতে হবে। সাধারণ জনগণের পক্ষে এই আদালতের অধিবেশনে যোগ দেয়া সহজ ও সম্ভব নয়। আদর্শতগভাবে, সবচাইতে ভালো হতো যদি এই বিচার প্রক্রিয়ার অধিবেশনসমূহ টেলিভিশন বা রেডিওতে সরাসরি সম্প্রচার করা হতো। অথবা সপ্তাহিক প্রতিবেদন প্রচার করা হতো যেখানে মূল সাক্ষ্য, যুক্ততর্ক, এবং রুলিং দেখানো হতো। ১৯৭০-এর দশকে কম্বোডিয়ায় যুদ্ধ চলাকালে সংঘটিত নিষ্ঠুরতার জন্য যারা দায়ী বলে যারা অভিযুক্ত হয়েছেন, বর্তমানে সে দেশটিতে যুদ্ধাপরাধী বিচারকাজে এই প্রক্রিয়া অবলম্বন করা হচ্ছে। বাংলাদেশে যদি তা সম্ভব না হয়, তাহলে নিরপেক্ষ পর্যবেক্ষকদেরকে এই বিচার প্রক্রিয়া অনুসরণ করার অনুমোদন দেয়া উচিত যাতে করে তারা প্রাত্যহিক ও সাপ্তাহিক প্রতিবেদন তৈরি করতে পারেন যা ইন্টারনেট ও অন্যান্য সংবাদ মাধ্যম দ্বারা সবার কাছে পৌঁছাতে পারে।
তিনি বলেন, এই নৃশংস অপরাধের যারা শিকার হয়েছিলেন, তাদের কাছে এই বিচার প্রক্রিয়া অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এইখানে যা ঘটবে, বিশ্বের সর্বত্র যারা এ ধরনের অপরাধের সাথে জড়িত তাদের জন্য এটি এই বার্তা পৌঁছে দেবে যে এ ধরনের অপরাধের জন্য যারা দায়ী, একটি রাষ্ট্রব্যবস্থার পক্ষে সম্ভব তাদের বিচারের ব্যবস্থা করা। আমি এখানে এসেছি কারণ, যুক্তরাষ্ট্রের জনগণ এটা নিশ্চিত করতে চায় যে, এই বিচার প্রক্রিয়াটি স্বচ্ছ ও নিশ্চিত হচ্ছে। এই ঐতিহাসিক বিচার প্রক্রিয়া ন্যায়বিচার অর্জনের জন্য এই প্রক্রিয়ার সঙ্গে যারা জড়িত তাদের সকলের সাথেই আমরা কাজ করা অব্যাহত রাখবো।
বিদেশী আইনজীবী নিয়োগ করতে না দেয়া প্রসঙ্গে এক প্রশ্নের জবাবে যুক্তরাষ্ট্রের যুদ্ধাপরাধ বিষয়ক রাষ্ট্রদূত বলেন, বাংলাদেশের বার কাউন্সিল আইনে উল্লেখ আছে যে শুধু মাত্র বাংলাদেশের নাগরিকরাই এদেশের কোর্টে আইনী কার্যক্রম করতে পারবে। কিন্তু এটা যেহেতু বিশেষায়িত আদালত এবং আন্তর্জাতিক মানের বিচার নিশ্চিত করতে সরকার ওয়াদা করেছে তাই আমি মনে করি যে এক্ষেত্রে উভয় পক্ষের জন্যই বিদেশী আইনজীবীর প্রভিশন থাকতে পারে।
ট্রাইব্যুনালের চেয়ারম্যান গণতদন্ত কমিশনের সদস্য ছিলেন, তিনিই এই ট্রাইব্যুনালের চেয়ারম্যান। তার কাছ থেকে ন্যয়বিচার পাওয়া সম্ভব নয় বলে অভিযুক্তরা অভিযোগ করেছেন। যুক্তরাষ্ট্র কি মনে করে এ প্রসঙ্গে। এমন প্রশ্নের জবাবে স্টিফেন র্যাপ বলেন, একক কোর্ট হওয়া উচিত নয়। এ ধরনের অভিযোগ আসতেই পারে। অভিযুক্তরা ন্যায়বিচার পাবে না, এমন অভিযোগ করতে পারে। সেক্ষেত্রে বিকল্প ব্যবস্থা থাকা দরকার। ন্যায়বিচার নিশ্চিত করা এবং স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতার জন্যই এটা প্রয়োজন। আরেক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ১৯৭৩ সালের আইনের ২০১০ সালে সংশোধনী আনা হয়েছে। পরে কিছু বিধি প্রণয়ন করা হয়েছে। সব মিলিয়ে এখন ট্রাইব্যুনালের আইন ও বিধিতে যা দাঁড়িয়েছে তা আন্তর্জাতিক অপরাধ আইনের সাথে পুরোপুরি সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। অনেক কিছুই আছে যা আইসিসির সাথে সাংঘর্ষিক।
কপি পেস্ট