পৃথিবীর সব দেশেই স্ব-স্ব দেশের নববর্ষ পালিত হয়। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে অনেক দেশেরই নিজস্ব কোন নববর্ষ নেই। কোন না কোন ঘটনার প্রেক্ষিতেই প্রচলিত প্রত্যেকটি সন গণনা শুরু হয়। যেমন- যীশু খৃস্টের জন্মদিন থেকে গণনা শুরু হয় খৃস্টাব্দ, মুসলমানদের নবী হযরত মুহাম্মদ (সা.) এর হিজরতের দিন থেকে গণনা শুরু হয় হিজরী সন, খৃস্টপূর্ব ৭৫ অব্দে ভারতে শক সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠার লগ্ন থেকে গণনা শুরু হয় শকাব্দ ইত্যাদি। একটা দেশে বসবাসরত সংখ্যাগুরু কিংবা সংখ্যালঘু প্রতিটি জাতিগোষ্ঠীর ধর্মীয় বা ঐতিহ্যগত যে সন তার শুরুতেই অর্থাৎ প্রথম দিনেই এই নববর্ষের উদযাপন হয়ে থাকে। যেমন- মুসলমানগণ তাদের নবী হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর মক্কা থেকে মদীনাতে হিজরত উপলক্ষে প্রবর্তিত হিজরী সনকে ধর্মীয় সন হিসাবে ধর্মীয় ভাবগাম্ভীর্যের সাথে পালন করে থাকেন। তবে সে নববর্ষ পালনে সাড়ম্বর নেই। আবার খৃস্টান সম্প্রদায় অত্যন্ত জাঁকজমকপূর্ণভাবে এবং সাড়ম্বরে পালন করে থাকে তাদের-নিউইয়ার। এই সনও তাদের ধর্মীয় নবী ঈসা (আঃ) বা যীশু খৃস্টের জন্মদিন থেকেই প্রবর্তিত বলে একে ঈসায়ী সনও বলা হয়। পৃথিবীর এক মাত্র প্রাচীনতম এবং দীর্ঘ সাতদিন যাবৎ উৎযাপিত নববর্ষ হলো পারস্যের (বর্তমান ইরানের) নওরোজ। তবে অধিকাংশ নববর্ষের উদযাপন ধর্মীয় বিধি-বিধান এবং স্ব-স্ব জাতির শুদ্ধতম কৃষ্টি কালচারকে অনুসরণ করেই পালন করা হতো। কিন্তু বর্তমানে কোন কোন নববর্ষ পালনে নৈতিক বিপর্যয় এবং উশৃংখলতা পরিলক্ষিত হয়।
বাংলাদেশে সাধারণত তিনটি নববর্ষ বিশেষভাবে পালন করা হয়। যথা- বাংলা নববর্ষ বা ১লা বৈশাখ, ইংরেজি নববর্ষ বা ১লা জানুয়ারি এবং হিজরী নববর্ষ বা ১লা মহররম। এর মধ্যে হিজরী নববর্ষ অত্যন্ত অনাড়ম্বরভাবে এবং ধর্মীয় ভাবগাম্ভীর্যের সাথে দোয়া ও মুনাজাত, মিলাদ মাহফিল ইত্যাদির মাধ্যমে পালন করা হয়। মসজিদে শিরনী দান, গরীব মিসকিনকে খাওয়ানো ইত্যাদির মধ্যেই এই নববর্ষ পালন সীমাবদ্ধ থাকে। কোন কোন ক্ষেত্রে রোজা পালনও করা হয়। ইসলামের দ্বিতীয় খলীফা হযরত উমর (রা.) এর খেলাফত আমলে হযরত আলী (রা.) এর প্রস্তাবের মাধ্যমেই মহানবী (সা.) এর হিজরতের দিন থেকেই হিজরী সন গণনা শুরু করা হয়। যতদূর জানা যায় উৎপত্তি কাল থেকেই হিজরী নববর্ষ উপরোক্ত রূপেই পালিত হয়ে আসছে। হিজরী নববর্ষ পালন নিয়েই প্রথমে আলোকপাত করলাম এজন্য যে, হিজরী নববর্ষ পালন সম্বন্ধে মোটামুটিভাবে কথা এটুকুই।
এবার বাংলা নববর্ষ সম্বন্ধে আলোচনা পর্যালোচনার পূর্বেই ইংরেজি নববর্ষ নিয়ে কথা বলা প্রয়োজন। কেননা বাংলাদেশী বাঙালি হিসেবে বাংলা নববর্ষ নিয়ে বিস্তর কথা বলার ইচ্ছে। তাই তুলনামূলক ছোট খাটো কথাগুলো আগেই শেষ করতে চাই। বর্তমান বিশ্বের সবচে' জনপ্রিয় ও বহুল প্রচলিত সনের নাম ইংরেজি সন বা খৃস্টাব্দ। নবী হযরত ঈসা (আঃ) যিনি খৃস্টানদের নিকট যীশু খৃস্ট নামে পরিচিত তাঁর নামে খৃস্টাব্দ বা ঈসায়ী সনের প্রবর্তন। তবে তাঁর জন্মের ৭৫০ বছর পর রোমের খৃস্টান পাদ্রীগণ এই বর্ষ গণনা শুরু করেন। পরবর্তীতে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে এই খৃস্টাব্দ জনপ্রিয়তা অর্জন করে এবং পালিত হচ্ছে। যা হোক, ইংরেজি নববর্ষ বা ১লা জানুয়ারি আসার পূর্বেই শুরু হয় প্রস্তুতি পর্ব। বর্তমানে ৩১শে ডিসেম্বর অত্যন্ত ধূম ধামের সাথে পালন করা হয় থার্টি ফার্স্ট নাইট। ইউরোপ আমেরিকার আদলেই আমাদের দেশেও পালিত হয় থার্টি ফার্স্ট নাইট। তবে এই রাতের আচার অনুষ্ঠানে শ্লীলতার চাইতে অশ্লীলতাই বেশি বলে দৃশ্যমান। শহরের ফোর স্টার কিংবা ফাইভ স্টার হোটেলগুলোতে মজমা বসে, মদের বন্যা বয়। লোকেরা বেহুস হয়। বাইজীর পসরা বসে। আর দেদারসে উলঙ্গ নাচ গান হয়। এমনকি কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-ছাত্রীরাও গড্ডালিকায় গা ভাসায়।
১লা জানুয়ারিতে নানা রকম আয়োজনের মধ্য দিয়ে পালিত হয় ইংরেজি নববর্ষ। তবে নববই দশকের পূর্বে কিন্তু থার্টিফার্স্ট নাইট নিয়ে এমন কোন তাল মাতাল কোন কার্যক্রম পরিলক্ষিত হয়নি। ১লা জানুয়ারিতে শুধুমাত্র শিক্ষিত জনগণের মধ্যে নববর্ষে কুশল বিনিময়ের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল বাংলাদেশে ইংরেজি নববর্ষ পালন। অবশ্য অফিস আদালতে নতুন ডায়রী রেজিস্টার বা হিসাবের খাতা খোলার রেওয়াজ পূর্ব থেকেই ছিল। অর্থাৎ ইংরেজি নববর্ষ পালন কেবল শহুরে বা শিক্ষিত সমাজের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল এবং এখনও আছে। তবে সাধারণ মানুষ তথা বাংলাদেশের ৮০% গ্রাম বাংলার খেটে খাওয়া মানুষের মধ্যে কিন্তু ইংরেজি নববর্ষ পালন নিয়ে কোন হৈ চৈ লক্ষ্য করা যায় না।
মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সা.) এর তিরোধানের পর ইসলামের দ্বিতীয় খলীফা হযরত উমর (রা.) এর সময়কালে হযরত আলী (রা.) এর প্রস্তাবে মহানবী (সা.) এর হিজরতের দিন থেকে হিজরী সন গণনা শুরু হয়। সেটা ছিল ৬২২ খৃস্টাব্দের ১৬ জুলাই।৬০০ হিজরীতে ইখতিয়ার উদ্দিন মুহাম্মদ বিন বখতিয়ার খিলজি বঙ্গ বিজয় করেন। তখন থেকেই এই বঙ্গ দেশে হিজরী সন গণনার প্রচলন হয়। প্রায় ৩৬৩ বছর এই আরবী সন গণনা চলে এই বাংলা বিহার উড়িষ্যায়। তৎকালীন সম্রাটদের নিয়মানুযায়ী বছরের শুরুতেই প্রজাদের নিকট থেকে খাজনা বা রাজস্ব আদায় করা হত। আর সেটা ছিল হিজরী সনের প্রথম মাস মহররম। আরবী সনের ভিত্তি হলো চন্দ্র উদয়, অর্থাৎ চন্দ্র উদয়ের সাথে সাথেই হিজরী সন বা চন্দ্রবর্ষের মাত্রা শুরু হয় এবং চন্দ্র বর্ষকে বারোটি চন্দ্রমাসে ভাগ করা হয়। এক্ষেত্রে একটা সমস্যা হলো যে চন্দ্রবর্ষ প্রতিবছরে ১১ দিন করে অগ্রগামী হয় । অর্থাৎ এগারো দিন আগেই বছর শুরু হয়। ফলে চন্দ্রবর্ষ হয় ৩৫৪ দিনে; যার ফলে আরবী বছর শুরু হলেও অর্থাৎ মহররম মাস শুরু হলেও তখন দেখা যেত ফসল কাটার সময় হতো না। যার কারনে কৃষি প্রধান এই বঙ্গ দেশের মানুষ খাজনা দিতে ব্যর্থ হতো। ফলে খাজনা আদায় এবং সরকারী হিসাব সংরক্ষনের ক্ষেত্রে গুরুতর সমস্যা দেখা দিত। এই সমস্যা সমাধানের জন্য ফসল কাটার সময়কে বিবেচনা করে একটি সৌরবর্ষ প্রবর্তন করা হয় মোঘল সম্রাট আকবরের সময়। এই বর্ষ শুরু হতো সূর্যোদয়ের সাথে সাথে, এবং এর নাম দেয়া হলো তখন ফসলী সন। এ কাজটি করা হলো মোঘল সম্রাজ্যের একজন প্রভাবশালী সম্রাট আকবরের সময় যাকে ইতিহাসবেত্তাগণ আকবর দ্যা গ্রেট বলে অভিহিত করেন এবং তিনি ছিলেন একজন মুসলমান সম্রাট। সম্রাট আকবর ছিলেন একজন মুর্খ ব্যক্তি এবং তার নয় সদস্য বিশিষ্ট একটি উপদেষ্টা পরিষদ ছিল যাদেরকে ইতিহাসবেত্তাগণ নবরত্ন বলে অভিহিত করেন। তাঁদের মধ্যে আমির ফতেহ উল্লাহ সিরাজি নামে একজন মুসলিম জ্যোতির্বিদ ছিলেন, তাঁর উপরই সন জনিত জটিলতা এড়ানো এবং ফসলী সন প্রবর্তনের দায়িত্ব দেন মুসলিম বীর চেঙ্গিসখান এবং তৈমুর লং এর বংশধর বাদশাহ বাবরের নাতি আর সম্রাট হুমায়নের ছেলে আকবর দ্যা গ্রেট। কাজ শুরু করেন আমীর ফতেহ্ উল্লাহ্ সিরাজী। সম্রাট আকবরের নির্দেশে ৯৯৮ হিজরী মোতাবেক ১৫৮৫ খৃস্টাব্দে ফসলী সনের প্রবর্তন করেন তিনি। যেহেতু বঙ্গ অঞ্চলের জন্যই এই ফসলী সনের প্রবর্তন, সেহেতু পরবর্তীতে এর নাম দেয়া হয় বঙ্গাব্দ বা বাংলা সন। আর এই বঙ্গাব্দের গণনা শুরু হয় সম্রাট আকবরের সিংহাসনে আরোহনের বছরকে বেজ বা ভিত্তি ধরে। সেটা ছিল ৯৬৩ হিজরী মোতাবেক ১৫৫৬ সালে (১৪ ফেব্রুয়ারী)। অর্থাৎ জন্ম গ্রহনের দিনই বাংলা সন বা বঙ্গাব্দের বয়স ছিল ৯৬৩ বছর। বাংলা সনের ১,২,৩ এমনিভাবে হিসাব শুরু হয়নি। হিজরী সন যে দিন থেকে গণনা শুরু হয়, সেই দিনই মূলতঃ বাংলা সনের জন্ম তারিখ।
সুদূর অতীতে রাজা বাদশাহর খাজনা আদায় এবং মহাজনী পাওনা আদায়ের ঘটনা ছাড়া পহেলা বৈশাখের আর কিছু জানা না গেলেও নিকটতম অতীতে নববর্ষ পালনটা বেশ সাদা সিধেই ছিল। শহর কিংবা গ্রামে সবখানেই বাংলা নববর্ষের প্রধান আকর্ষণ ছিল হাল খাতা। বিশেষ করে যে সমস্ত মহাজনরা সুদে টাকা খাটাতো বা যে সমন্ত দোকানদার বাঁকীতে মালামাল বিক্রি করত তাদের সৌজনে তারা হাল খাতা করত। খরিদ্দারদের দাওয়াত করে মিষ্টি পুরি খাওয়াতো আর খরিদ্দাররাও ১লা বৈশাখের দিন দোকান্দারদের পাওনা মিটিয়ে দেয়ার জন্য সচেষ্ট থাকত। এতো গেল ব্যবসা বাণিজ্যের কথা।
পারিবারিক ভাবেও পহেলা বৈখাখ পালনের ঐতিহ্য বাংলাদেশে ছিল। দুধ-চিনি কিংবা গুড়ের সাথে আতপ চাল মিশিয়ে পায়েশ বানিয়ে পরিবারের লোকজন যেমন খেতো তেমনি পাড়া প্রতিবেশিরাও সেই পায়েশের ভাগ পেতো। গ্রামের কৃষকেরা শুভদিন মনে করে ১লা বৈশাখে নতুন লাঙ্গল বাঁধতো। গরুকে গোসল করাতো। শুভকামনা করে মসজিদে শিরনী দেয়ার কাজটি বেশি হতো বৈশাখ মাসের ১ম শুক্রবারে। কোন কোন ক্ষেত্রে কৃষক মাঠের মধ্যে তার জমিতে গিয়ে গরুর কাঁধে লাঙ্গল বেঁধে দু'পাক ঘুরে নিত এই ভেবে যে - সারা বছর তার চাষবাদ যেন ভাল হয়। আর বাড়ির গৃহিনীরা আল্লাহর নাম করে বিস্মিল্লাহ বলে এক মুঠো ধান নেকড়ায় বেঁধে রাখতো এই শুভ কামনায় যে সারাবছর তার ঘরে যেন ধান চাল থাকে এবং অভাব না হয়। খেজুরের গুড় দিয়ে ক্ষির রান্না করে ছেলে মেয়ে বৌ-ঝিদের খাওয়ানো হত যাতে সারাবছর সকলেই মিষ্টি মুখে এবং হাসিমুখে থাকে।
গ্রামের বড় কোন বটগাছ তলায় কিংবা বড় পুকুর পাড়ে বৈশাখী মেলা বসতো। জামাই-ঝিরা শ্বশুর বাড়ীতে দাওয়াত পেত। মন্ডা-মিঠাই, মুড়ির মোয়া, দেশীয় মিষ্টির পসরা বসত মেলায়। সেই সাথে থাকতো নাগরদোলা। তাল পাতার হাত পাখা, বাঁশ ও কাঠের তৈরি নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিস পাতি যেমন- পাওয়া যেত মেলায়, তেমনি বাচ্চাদের জন্য কাঠের ঘোড়া, মাটির খেলনা পাতি, কাগজের তৈরী গুড্ডি-ঘুড়ি, শলার তৈরী বিভিন্ন পাখি, বেতের বাঁশি ইত্যাদি মেলার আনন্দকে বাড়িয়ে দিত আরও এক ধাপ। আম, লিচু, তরমুজ, বাঙ্গি, ক্ষিরা প্রভৃতি ফল ফলাদি বৈশাখের আনন্দকে আরও রসময় করে তুলত। লাঠি খেলা যেন সব বয়সী মানুষের কাছে ছিল এক মজার ব্যপার। ছেলে বুড়ো সবাই যেন লাঠি খেলার যাদুতে হত বিমোহিত।
বর্তমানে দুইশ' আড়াইশ‘ টাকা দিয়ে রমনার বটমূলে মাটির সানকিতে একটু পান্তা কিনে খাওয়ার যে রেওয়াজ লক্ষ্য করা যায় অতীতে তার কিন্তু কোন নজির পাওয়া যায় না। এমন কি ১লা বৈশাখ উদযাপনের জন্য বর্তমানে যে একজোড়া ইলিশ ১৪/১৫শ টাকায় কিনে বাসায় পান্তার আয়োজন করা হয়, তারও কোন নজির নেই। শুধুমাত্র নদীর পাড়ের মাঝি যারা নদীতে ইলিশ মাছ ধরতো এবং তা বিক্রি করে জীরন যাপন করত, তারাই ইলিশ মাছ দিয়ে পান্তা খেতো এবং সেটা ১লা বৈশাখে নয়, সারা বছরই খেতো। তাছাড়া সারা বাংলাদেশের গ্রাম বাংলার মানুষেরা আলু ভর্তা কিংবা শুকনা মরিচ ভাজি ও পিঁয়াজ দিয়ে পান্তা খেতো। সেটা সারা বছরই খায়। কোন বিশেষ দিনে নয়। আর যে সময়ে সাধারণ মানুষের জীবন ধারণ করাটাই দুর্বিসহ হয়ে উঠেছে, সে সময়ে শহরে একটা মধ্যবিত্ত পরিবারে পাঁচ থেকে সাত হাজার টাকা খরচ করে পান্তা ইলিশ খাওয়া, কিংবা একদিনের বাঙালী সাজার জন্য দামী দামী বাহারী সাদা শাড়ি বা পায়জামা কিংবা ধূতি পাঞ্জাবী কিনে ঘটা করে পড়ে নাচ গানে মত্ত হওয়া কোন কালেই বাংলাদেশী বাঙালীদের সংস্কৃতি ছিল না। ইদানীং তো শহরের মোড়ে মোড়ে বিশাল সাউন্ড বক্স বসিয়ে ধূম ধারাক্কা হিন্দি কিংবা ইংরেজি গান বা ওয়েস্টার্ন ধাঁচের ব্যান্ড সঙ্গীত বাজানো হয়। কানে দুল এবং হাতে চুড়ি পরে ছেলেরা হিজরাদের মত নাচে। অতি সম্প্রতি শহরে জীব-জন্ত জানোয়ারের মুখোশ পরে র্যালী করা হয়। র্যালীতে অংশ গ্রহণকারীরা বলে - পশুত্বকে বধ করতে চাই। আর সমালোচকরা বলে- মানুষেরা আজকাল পশুর মত আচরণ করলেও পশুর আকৃতি ধারণ করতে পারে না। তাই তারা পশুর মুখোশ পরে বছরের প্রথম দিনে পশু সাজতে চায়। সে যাই হোক, ইদানীং ঘটা করে কিছু কিছু মুসলমান ছেলেরা ধূতি পরে আর মেয়েরা মাথায় সিঁদুর পরে র্যালীতে অংশ গ্রহণ করে বা আড্ডায় মেতে ওঠে। খুব সম্ভবত তারা বুঝাতে চায় যে পহেলা বৈশাখ মানেই বাঙালী সংস্কৃুতি, আর বাঙালী সংস্কৃতি মানেই হিন্দুয়ানী সংস্কৃতি; এতে মুসলমানদের কিছূ নেই। যাই হোক, আমি, ধূতি, শাড়ি, সিঁদুর, টুপি ইত্যাদি পরতে নিষেধ করছি না। শুধু এইটুকু বলছি যে- হিন্দু ধর্মাবলম্বীরা ধুতি কিংবা সিঁদুর পরলে কিছু যায় আসে না। আবার মুসলমানরাও যদি জুববা টুপি পরে তাতেও কোন ক্ষতি নেই। কিন্তু বিপত্তি ঘটে তখন যখন এক ধর্মের মানুষেরা অন্য ধর্মের মানুষের পোশাকাদি পরে বেহায়াপনা করে। নিজেদের সংস্কৃতির নিজস্বতা হারিয়ে বিদেশী সংস্কৃতির ভাঁড় সাজে। অপর পক্ষে শহরের কিছু গোঁড়া মুসলমানও মনে করেন যে পহেলা বৈশাখ মানেই কেবল মাত্র হিন্দু সস্প্রদায়ের সংস্কৃতি।
ব্যাপারটা কিন্তু তা নয়। বাংলা সনের উৎপত্তির ইতিহাস কিন্তু তা বলে না। মোঘল সম্রাট আকবর যিনি মুসলিম সম্ভ্রান্ত ঘরে জন্ম গ্রহণ করেছেন এবং যাঁর নিজের নামও মুসলিম ঐতিহ্যের ধারক, তাঁর আমলেই এই বাংলায় হিন্দু মুসলমান বৌদ্ধ, খী্রষ্টান নির্বিশেষে সকল সম্প্রদায়ের কাছে খাজনা আদায় করার জন্য বাংলা সনের প্রবর্তন করেন। আরও মজার ব্যাপার হলো যে ‘সন' এবং ‘তারিখ' শব্দ দুটি‘ও মুসলিম ঐতিহ্যের আরবী ভাষা থেকে নেয়া। আবার সম্রাটের নির্দেশে যেই জ্যোতির্বিদ বাংলা সনের প্রবর্তন করেন সেই আমির ফতেউল্লাহ্ সিরাজীও একজন বিখ্যাত মুসলিম পন্ডিত বলেই খ্যাত। পূর্বেই উল্লেখ কার হয়েছে যে, মোহাম্মাদীয় হিজরী সনকে বেজ ধরেই মূলত বাংলা সন বা বঙ্গাব্দের গণনা শুরু হয়। প্রকৃতপক্ষে, বাংলা নববর্ষ মুসলিম ঐতিহ্যের হিজরী সনেরই অন্য সংস্করণ। তবে, সকল ধর্মাবলম্বী মানুষের কাছে বাৎসরিক খাজনা আদায়ের জন্যই যেহেতু বাংলা সনের উৎপত্তি সেহেতু মুসলিম, হিন্দু, বৌদ্ধ, খৃস্টান সকল সপ্রদায়ের কাছেই বাংলা সন সমান গুরুত্বপূর্ণ। ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে সকল মানুষই পহেলা বৈশাখ বা বাংলা নববর্ষ পালন করবে এটাই স্বাভাবিক। তবে বাংলা নববর্ষ পালনের নামে বিশেষ কোন জাতি বা গোষ্ঠির নিজস্ব কালচারকে আমদানী করা বা বাংলাদেশের ইতিহাস, ঐতিহ্য, ধর্মানুভূতি, এবং সংস্কৃতিকে বিপন্নকারী কোন অনুষ্ঠানাদি পালন করাও বোধ হয় সমীচীন হবে না। এক্ষেত্রে অবশ্য বাংলাদেশী মুসলমানদের দুর্ভাগ্য যে, তারা তাদের নিজস্ব ইতিহাস-ঐতিহ্য সম্বন্ধে বড় বেখেয়াল। আর ভষ্যিৎ প্রজন্মকে এসব জানানোর যে তাকিদ এবং কর্মতৎপরতা তাও লক্ষ্য করা যায় না। ব্রিটিশদের তৈরী করা শিক্ষাক্রম এবং ব্রিটিশ আনুকূল্য প্রাপ্ত বিশেষ এক শ্রেনীর মানুষের তৈরী করা শিক্ষা ব্যবস্থাই আজও বাংলাদেশে বর্তমান। যার কারণে বাংলা নববর্ষের সাথে মুসলমানেদের যে গৌরবময় ইতিহাস জড়িয়ে আছে সে সম্বন্ধে তারা পুরোদস্তুর বেখবর। এমনকি নিজস্ব আঙ্গিকে ও সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের আলোকে বাংলা নববর্ষ পালন করার জন্য প্রয়োজনীয় যে কার্যক্রম তাও তারা পালন করতে পারছে না। প্রকারান্তরে তারা ভিনদেশীয় সংস্কৃতিকে ছেড়ে দিচ্ছে তাদের স্থান। ফলে যা হবার তাই হচ্ছে; অপসংস্কৃতি দখল করে নিচ্ছে নববর্ষের সকল আয়োজন।
পরিশেষে এ কথায় উপনীত হওয়া যায় যে, অতীতে বিভিন্ন নববর্ষ পালনে নিজ দেশীয় সংস্কৃতির প্রতি যেমন শ্রদ্ধাশীল থাকা হতো, তেমনি সকল সপ্রদায়ও তাদের স্ব-স্ব ধর্মীয় সুনীতি অনুসরন করতো। ফলে অশ্লীল এবং অশালীন কিছু পরিলক্ষিত হত না। কিন্তু বর্তমানে চরম সাংস্কৃতিক আগ্রাসনের শিকার এদেশীয় সংস্কৃতি। বস্তুত সে কারনেই নববর্ষ পালনে নানা বিকৃতি লক্ষ্য করা যায়, যা আমাদেরকে নৈতিক অবক্ষয়ের দিকে নিয়ে চলেছে; সামাজিক অবক্ষয়ের দিকে ঠেলতে শুরু করেছে। ফলে সমাজে বা রাস্ট্রে বিশৃংখলা দেখা দিয়েছে। অতীতে নববর্ষ পালন যেমন নির্মল আনন্দের ছিল, এখন আর তা নেই। এখন কেউ উপভোগ করছে আর কেউ সম্ভ্রম হারা হচ্ছে, লজ্জিত হচ্ছে। কেউ হাসছে, কেউ ছি ছি করছে। সুতরাং নববর্ষ পালনে সকলকেই নিজ দেশীয় কৃষ্টি কালচারের প্রতি যেমন সচেতন থাকতে হবে, স্ব-স্ব সপ্রদায়ের ধর্মীয় বিধি বিধানের প্রতিও তেমন সচেতন থাকতে হবে। তাহলেই কেবল নববর্ষ পালন হবে সুনির্মল আনন্দের এবং সকলের কাছে সুখকর। বিদেশীয় কোন কালচারকে আমরা যদি গ্রহণ করতে চাই, তাহলেও নিজেদের ইতিহাস ও ঐতিহ্যের ছাঁকনি দিয়ে ছেঁকে নিয়ে তারপরে তা গ্রহণ করতে হবে যাতে, আমাদের নিজস্ব সংস্কৃতির কোন অপ্রীতিকর বিকৃতি না ঘটে।
এ কে আজাদ