ভূ-রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন ভূগোলবিদ প্রফেসর ড. আব্দুর রব বাংলাদেশ-মিয়ানমারের মধ্যকার বঙ্গোপসাগরের সমুদ্রসীমা সংক্রান্ত আন্তর্জাতিক সমুদ্রআইন ট্রাইব্যুনাল (ইটলস) এর রায়কে ত্র“টিপূর্ণ অভিহিত করে বলেছেন, মিয়ানমার-বাংলাদেশের রায়ের প্রিসিডেন্ট অনুযায়ী ভারত রায় পেলে বাংলাদেশ সমুদ্রে লকড-জোন হয়ে যাবে এবং বাংলাদেশ নৌ-শক্তিতে তাদের উপর নির্ভরশীল হয়ে পড়বে। সমুদ্রে বাংলাদেশ জোন-লকড বা অবরুদ্ধ হয়ে গেলে বিদেশি জাহাজ চলাচলে ও বাণিজ্যে মিয়ানমার এবং ভারতের কাছ থেকে আমাদের সমুদ্রে ট্রানজিট নিতে হবে। রায়ে বাংলাদেশ বঞ্চিত হবে এ জন্য রায়ের আগেই হামবুর্গ ইটলস আরবিট্রেশন কোর্টের একজন বিচারক বর্তমান রায়ের সম্পূর্ণ ভিন্নমত সম্পন্ন ৬১ পৃষ্ঠার মত দিয়ে নিজেকে উইথ্ড্র তথা প্রত্যাহার করে নিয়েছেন। মিয়ানমার মহিসোপানের হাইড্রোকার্বন সমৃদ্ধ (গ্যাস ও খনিজ তৈল) বেশিরভাগ ব্লক পেয়েছে। কম অভিজ্ঞতাসম্পন্ন লোকদের দিয়ে মামলা পরিচালনা করায় বাংলাদেশের পরাজয় হয়েছে। সমুদ্রে ভারতের সাথে জিততে হলে এই বিষয়ে বিশেষজ্ঞদের নিয়ে জাতীয় কমিটি গঠন করতে হবে। সমুদ্র সংক্রান্ত এই রায়ের বিভিন্ন বিষয় নিয়ে সাপ্তাহিক সোনার বাংলার সাথে দীর্ঘ সাাৎকারে ভূগোল বিশেষজ্ঞ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর ড. আব্দুর রব উপরোক্ত অভিমত ব্যক্ত করেন। সাপ্তাহিক সোনার বাংলার পক্ষ হতে এ সাক্ষাৎকারটি গ্রহণ করেছেন শেখ আবু তালেব। নিম্নে সাক্ষাৎকারের পূর্ণ বিবরণ তুলে ধরা হলো :
সোনার বাংলা : সমুদ্রসীমা নিয়ে ইটলসের রায়ের ব্যাপারে আপনার পর্যালোচনা ও মন্তব্য কি?
প্রফেসর ড. আব্দুর রব : মিয়ানমারের সঙ্গে সমুদ্রসীমা মামলার রায়ে বাংলাদেশ হেরেছে। সমুদ্রসীমা নির্ধারণ ও বিরোধ নিষ্পত্তি হওয়া ছাড়া সবেেত্রই হেরেছে দেশটি। নীতিগত ও অধিকারগত হার হয়েছে। মিয়ানমারের সব দাবিকেই প্রাধান্য দিয়েছে আন্তর্জাতিক আদালত। এক্সকুসিভ ইকোনমিক জোনের একটি বড় অংশ হারিয়েছে বাংলাদেশ। সমুদ্রে তেল-গ্যাস অনুসন্ধানে নির্মিত ছয়টি ব্লক পুরোপুরি এবং চারটি ব্লকের আংশিক পেয়ে গেছে মিয়ানমার। এতে সমুদ্রে সম্ভাব্য হাইড্রো-কার্বন বা তেল-গ্যাসের বৃহদাংশই হারাল বাংলাদেশ। ২০০ নটিক্যাল মাইল সমুদ্রসীমা প্রাপ্তির মাঝেও রয়েছে শুভঙ্করের ফাঁকি। সেন্টমার্টিন দ্বীপকে আমাদের ভূখণ্ডের মূল সীমানার বাইরে ধরেই সমুদ্রসীমার হিসাব করা হয়েছে। টেকনাফকে সর্বশেষ সীমানা ধরে ২০০ নটিক্যাল মাইল সমুদ্রসীমা দেয়া হয়েছে বাংলাদেশকে। কিন্তু আমার বিবেচনায় বিষয়টা এখনো খুবই অস্পষ্ট এবং দারুণভাবে প্রশ্নসাপে। এই ট্রাইব্যুনাল বা সালিশি আদালতে আমাদের জয় অবশ্যই কাম্য ছিল, কিন্তু এই রায়ের ফলে প্রতিপ মিয়ানমারের পরাজয় হয়েছে কি বলা যায়? অবশ্যই নয়। কোনো সালিশি আদালতের রায়ে একপরে জয় এবং অন্যপরে পরাজয় হবে এমন হতে পারে না। উভয়ের সম্মতিতে গঠিত সালিশি আদালত সেই সমাধানই দেবেন, যা দুই পরে মধ্যে আপসে সম্ভব ছিল না। এ েেত্র তা মানা হয়নি।
এ রায়ের নানাবিধ ত্র“টি ও সীমাবদ্ধতা এবং বাংলাদেশকে বঞ্চিত করার কথা বিধৃত করে হামবুর্গ ইটলস আরবিট্রেশন কোর্টের একজন বিচারক বর্তমান রায়ের সম্পূর্ণ ভিন্নমত সম্পন্ন ৬১ পৃষ্ঠার মত দিয়ে নিজেকে উইথ্ড্র তথা প্রত্যাহার করে নিয়েছেন। এ কথা সরকার কিংবা কোন মহল জাতিকে জানাচ্ছে না। জাতীয় স্বার্থ রক্ষার্থে সরকারের উচিত ঐ বিচারকের মতটি সংগ্রহ করা এবং তা খতিয়ে দেখা। এ মতটি বংলাদেশের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
সোনার বাংলা : মায়ানমারের সাথে বাংলাদেশের সমুদ্রসীমা নির্ধারণে ইটলসের রায়ের ব্যাপারে সরকার এবং বিশেষজ্ঞদের চিন্তা ও ধারণার মধ্যে মৌলিক পার্থক্য কোথায় দেখছেন ?
ড. আব্দুর রব : জার্মানীর হামবুর্গে ‘ইটলস’ (ওঞখঙঝ) রায়ের ফলে বাংলাদেশ বঙ্গোপসাগরের ১২ নটিক্যাল মাইল আঞ্চলিক সমুদ্রাঞ্চল এবং এ থেকে বেইসলাইন ধরে সোজা দেিণ আরো ২০০ ন.মা.পর্যন্ত একান্ত আর্থনীতিক জোন লাভ করতে সম হয়েছে। বাংলাদেশ উপকূল ১ লাখ ৭ হাজার বর্গ কি.মি. এর চেয়ে বেশি ১ লাখ ১১ হাজার ৬৩১ বর্গ কি.মি. সমুদ্রসীমা প্রাপ্তির গল্পও সঠিক নয়। এখনতো শুধু মিয়ানমারের সাথে রায়ের ফলে একটি মাত্র রেখা টানা হয়েছে। পশ্চিমের রেখা তো ২০১৪ সালে টানা হবে। ভারতের সঙ্গে সমুদ্রসীমা বিরোধ নিষ্পত্তির পরই বোঝা যাবে কি পরিমাণ সমুদ্রসীমা বাংলাদেশের অধিকারে আসবে। মহিসোপানেও বাংলাদেশের কি অধিকার প্রতিষ্ঠিত হবে তা বুঝা যাবে।
ভারত ও মিয়ানমার দেশ দুটির বঙ্গোপসাগরে ‘সমদূরত্ব পদ্ধতি’র দাবি উপস্থাপনের ফলে বাংলাদেশের দাবিকৃত সমুদ্রাঞ্চল তীর্যকভাবে এসে এক বিন্দুতে কৌণিকভাবে মিশে যাবে। মিয়ানমার তার দাবিতে অনেকদূর এগিয়ে গেছে। মামলার রায়ের পর্যবেক্ষণে যে কয়েকটি সীমারেখা পূর্ব-পশ্চিমে টানা হয়েছে তাতে এ বিষয়টি পরিষ্কার। ভারত তাদের যুক্তিতে এ বিষয়টি আদালতে তুলে ধরবে। এবং বাংলাদেশের বিপক্ষে মিয়ানমারের পক্ষে যে আইনজীবী লড়েছেন একই আইনজীবী ভারতের হয়ে বাংলাদেশের বিপক্ষে লড়বেন। এখন যদি ভারত তাদের মতো রায় পায় অর্থাৎ মিয়ানমার-বাংলাদেশের রায়ের প্রিসিডেন্ট অনুযায়ী তাহলে বাংলাদেশের পূর্বদিকের এবং পশ্চিমদিকের উপকূলীয় সীমানা বরাবর যে কৌণিক রেখা হবে তা আমাদের মহিসোপানে যেতে বাধা দেবে। এখানেই আমাদের মূল কথা। তখন সমুদ্রে আমরা লকড-জোন বা অবরুদ্ধ হয়ে যাব।
সোনার বাংলা : যদি বাংলার দেিণ চর জাগে তাহলে ইটলস-এর আইনের আলোকে বাংলাদেশের সার্বভৌম সমুদ্রসীমার পরিবর্তন হবে কি না ?
ড. আব্দুর রব : বাংলাদেশ যেহেতু মূলত বঙ্গোপসাগর থেকে জেগে ওঠা একটি বর্ধিষ্ণুপ্রধান ব-দ্বীপ রাষ্ট্র । বাংলাদেশের উপকূলীয় ভূ-ভাগের ভূ-রূপতাত্ত্বিক গঠন, উপকুলীয় সমুদ্রাঞ্চলের দ্বীপময় অগভীর বঙ্গোপসাগরের তলদেশের অবস্থা এবং বাংলাদেশের সমুদ্র-শরিকদের উপকূলীয় কাঠামো বাংলাদেশকে বিশেষ অসুবিধাময় পরিস্থিতিতে নিপতিত করেছে। বাংলাদেশের উপকূলীয় দ্বীপমালাসমূহ মূলত ব-দ্বীপিয় নব-পলল গঠিত দ্বীপঞ্চল। এগুলো মূল ব-দ্বীপিয় ভূ-ভাগের সাথে মিলে প্লাবন সমভূমি দেশের মূলভাগের দণিাঞ্চলকে প্রবর্ধিত করে আরো দেিণ ক্রমান্বয়ে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। পদ্মা, মেঘনা, যমুনাসহ বেশ কয়েকটি নদীর পলি সমুদ্রে পড়ে অদূর ভবিষ্যতে বাংলাদেশের দণিাঞ্চলে ২০-৩০ মাইল কিংবা তার চেয়ে দূরে পলি জমে নতুন ভূমি জেগে উঠতে পারে। দেিণর উপকূলের আরো দেিণ ব-দ্বীপ গঠনের সাধারণ প্রক্রিয়ায় অগভীর মহিসোপানে ভূমি দেিণ সম্প্রসারিত হয়ে বাংলাদেশের আঞ্চলিক সমুদ্রাঞ্চল, কন্টিগুয়াস জোন বহুদূর দেিণ সম্প্রসারিত হবে। দণিাঞ্চলে সমুদ্রে পলি জমে ভূমি জেগে উঠলে আঞ্চলিক সমুদ্রাঞ্চল, কন্টিগুয়াস জোন বাড়বে। তখন ‘বেইস লাইন’ বাস্তবে ক্রম পরিবর্তনশীল থাকবে। তার ফলে বাংলাদেশের সমুদ্রসীমা নির্ধারণের বেইসলাইনও আরো দেিণ যাবে। তখন তো বর্তমানের ইটলসের রায়ে নির্ধারিত বেইস লাইন, আর্থনীতিক জোন ও মহিসোপানের নির্ধারিত সীমানাও বদলে যেতে বাধ্য। জানিনা, এ রায়ে এ বিষয়ে এর কীরূপ প্রতিবিধান বিধৃত হয়েছে।
সোনার বাংলা : বাংলাদেশের দণি-পশ্চিমে ২১৫ ডিগ্রি কৌণিকভাবে সমুদ্র রেখা টানায় বাংলাদেশ কিভাবে তিগ্রস্ত হয়েছে ?
ড. আব্দুর রব : আদতে বংলাদেশের উপকূলাঞ্চাল অবতল আকৃতির ভূ-কাঠামোর হওয়ার ফলে এবং ভারত-মিয়ানমারের উপকূলীয় ভূ-গঠন উত্তল হওয়ায় বাংলাদেশের আঞ্চলিক সমুদ্রাঞ্চল নির্ধারণের মূল ভিত্তিরেখা বা বেইস লাইন যা নির্ধারণ খুবই জটিল হয়ে যায়। এর ফলে এদেশের বঙ্গোপসাগরেও আঞ্চলিক সমুদ্রাঞ্চল এবং ‘কন্টিগুয়াস জোন’ চিহ্নিতকরণ প্রক্রিয়া হয়েছে বিতর্কিত এবং প্রশ্নবিদ্ধ।
আসলে এ রায়ে বাংলাদেশ-মিয়ানমারের দাবিকৃত মূল চিত্রের খানিকটা পরিবর্তন হলেও ঐ বিভাজন রেখাটি মূলত দণি-পশ্চিমে প্রলম্বিত হয়ে বাংলাদেশের মূল দাবিকৃত বিপুল সমুদ্রাঞ্চলকে গ্রাস করে নিয়েছে। ফলে মিয়ানমার তার দাবিকৃত মহিসোপানের হাইড্রোকার্বন সমৃদ্ধ (গ্যাস ও খনিজ তৈল) বেশিরভাগ ব্লকের মালিকানা পেয়েছে। পান্তরে বাংলাদেশ দূরবর্তী গভীর সমুদ্রের তুলনামূলকভাবে কম সম্ভাবনাময় অঞ্চলেই তার একান্ত আর্থনীতিক জোনের মালিকানা পেয়েছে। মিয়ানমারের সন্নিকটস্থ মহিসোপানেই সবচেয়ে সমৃদ্ধ প্রামাণ্য প্রাকৃতিক গ্যাসের মজুদ আবিষ্কৃত হয়েছে। সুতরাং এখানেও আত্মতৃপ্তির কোনো কারণ নেই।
সোনার বাংলা : মিয়ামারের সাথে বিরোধটি আসলে কোথায় ছিল ?
ড. আব্দুর রব : সমুদ্রসীমা নিয়ে মিয়ানমারের সঙ্গে বাংলাদেশের বিরোধের মূল বিষয় ছিল এই যে, মিয়ানমার সমুদ্রতট থেকে সমদূরত্ব নীতির মাধ্যমে ঊঊত(ঊীপষঁংরাব বপড়হড়সরপ তড়হব) এলাকা নির্ধারণের কথা বলে। যাতে বাংলাদেশের আপত্তি ছিল। কারণ, তাতে বাংলাদেশ থেকে আসা পলির স্তরের ওপর মিয়ানমারের অধিকার বর্তায়। ট্রাইব্যুনালের কাছে বাংলাদেশ উভয় দেশের ঊঊত নির্ধারণের জন্য সমদূরত্ব নীতি প্রয়োগের বিরোধিতা করে। কিন্তু মিয়ানমার সমদূরত্ব নীতি অবলম্বনের কথা বলে। ট্রাইব্যুনাল নাফ নদের মুখকে সমদূরত্ব রেখা শুরুর বিন্দু সাব্যস্ত করে। বাংলাদেশ টঘঈখঙঝ ওও-এর ৭৬.১ ধারার পলিপাতন নীতি দাবি করলেও ট্রাইব্যুনাল সমদূরত্বের নীতিই গ্রহণ করেন। বাংলাদেশের বঙ্গীয় সমুদ্রে পলিপাতনের বিবরণের আপত্তি জানায় মিয়ানমার। ট্রাইব্যুনাল মিয়ানমারের দেয়া আপত্তি গ্রহণ করে বাংলাদেশের যুক্তি অগ্রাহ্য করে। অথচ এখানে নিয়মানুযায়ী পলিপাতন নীতিই প্রাধান্য পাওয়ার কথা, এটাই ইক্যুইটি। কিন্তু এখানেই বাংলাদেশ হেরে যায়।
ট্রাইব্যুনাল সিএস (কন্টিনেন্টাল শেল্ফ) নির্ধারণের েেত্র উদ্যোগী হলে মিয়ানমার বলে, ২০০ নটিক্যাল মাইল দূরত্বেই উভয় দেশের সমুদ্রসীমা নির্ধারণ হয়ে গেছে। বাংলাদেশ এর প্রতি আপত্তি জানায়। টঘঈখঙঝ ওওও-এর ৭৬ ধারার ৫ উপধারা অনুযায়ী, কোনো দেশের মহীসোপানের সীমা ২৫০০ মিটার গভীরতা থেকে ১০০ নটিক্যাল মাইলের বেশি হতে পারবে না। ৬ উপধারা অনুযায়ী, মহীসোপানের সীমা তটরেখা থেকে ৩৫০ নটিক্যাল মাইল পর্যন্ত হতে পারবে, তবে পাশের দুই দেশের পলিপাতন বিভাজন রেখার খাঁড়ি অতিক্রম করবে না। বাংলাদেশ টঘঈখঙঝ ওওও-এর ৭৬.৫ ধারা অনুযায়ী ঘধঃঁৎধষ চৎড়ষড়হমধঃরড়হ-এর যুক্তি দিলে ট্রাইব্যুনাল তা গ্রহণ করে না। ট্রাইব্যুনাল বলে, বাংলাদেশ ২০০ নটিক্যাল মাইলের বাইরে সিএসের যে দাবি করে তা মিয়ানমারের ২০০ নটিক্যাল মাইল ঊঊত এলাকা। যেহেতু দুই দেশের ঊঊত এলাকা একে অপরের ওপর পড়ছে না, সেহেতু ঊঊত ভাগাভাগির প্রশ্নই ওঠে না। অতঃপর ট্রাইব্যুনাল সমদূরত্ব রেখাটিই ২১৫০ আজিমুথ বরাবর প্রলম্বিত করে উভয় দেশের সিএস চূড়ান্তভাবে ভাগ করে দেয়। তাতে বাংলাদেশের পরাজয় হয়।
সোনার বাংলা : আপনি বাংলাদেশের পরাজয়টি ঠিক কিভাবে দেখছেন?
ড. আব্দুর রব : ট্রাইব্যুনালের ৫০৬টি অনুচ্ছেদ সংবলিত রায়ে সালিশি আদালত গঠন বিষয়ে বিবরণ দেয়ার পরই রয়েছে উভয় দেশের দাবিনামার বিবরণ। সমুদ্রতটবর্তী দুটি পাশাপাশি দেশের রাষ্ট্রীয় সমুদ্র (ঞবৎৎরঃড়ৎরধষ ঝবধ) বিষয়ে বাংলাদেশ দাবি করেছিল, সেন্ট মার্টিন দ্বীপের দেিণ সাগরসীমা নিয়ে ১৯৭৪ ও ২০০৮ সালে মিয়ানমারের সঙ্গে বাংলাদেশের সমঝোতা চুক্তি আছে। মিয়ানমার এতে আপত্তি করে বলে, ওই সমঝোতাগুলো ছিল জাহাজ চলাচলবিষয়ক, সীমানা নির্ধারণের চুক্তি নয়, বা ওই কাজ যথাযথ কর্তৃপ দ্বারা হয়নি। ট্রাইব্যুনাল মিয়ানমারের যুক্তির প্রতি সমর্থন জানায়। বাংলাদেশ ঐ চুক্তির প্রয়োগ সম্পর্কে নানা প্রমাণ দেখালেও মিয়ানমার তার বিরোধিতা করে। ট্রাইব্যুনালও বাংলাদেশের দাবি গ্রহণযোগ্য মনে করেননি। মিয়ানমার বলে, সেন্ট মার্টিন দ্বীপ তার স্থলসীমানার (নাফ নদ) ভেতরে পড়ে, তাই একে পৃথকভাবে দেখা হোক। ট্রাইব্যুনাল মিয়ানমারের যুক্তিকে মেনে নিয়ে সেন্ট মার্টিন দ্বীপকে মূল ভূখণ্ড থেকে বিচ্ছিন্ন ধরে বাংলাদেশকে সর্বাধিক ১২ নটিক্যাল মাইল (উল্লেখ্য, ১ নটিক্যাল মাইল = ১.৮৫২ কিলোমিটার) রাষ্ট্রীয় সমুদ্রের অধিকারই প্রদান করেন । ফলে বাংলাদেশ সমুদ্রতটের দণি সীমানা সেন্ট মার্টিন দ্বীপের দণি থেকে মূল ভূখণ্ডে টেকনাফের কাছে সরে আসে। এখানেই বাংলাদেশ হেরে যায়। প্রশ্ন উঠে যেহেতু সেন্ট মার্টিন আমাদের ভূ-খণ্ড তাহলে একে বেইস লাইন ধরা হল না কেন? এখানে গভীর ষড়যন্ত্র রয়েছে। যারা মামলা পরিচালনা করেছেন তারা কম অভিজ্ঞতার কারণে বিষয়টি ধরতে পারেননি। ভবিষ্যতে এ দ্বীপ নিয়ে আন্তর্জাতিক মহল ষড়যন্ত্র করতে পারে।
টঘঈখঙঝ ওওও-এর ৭৬.১ ধারা অনুযায়ী, একটি দেশের সমুদ্রতীরবর্তী এক্সকুসিভ ইকোনোমিক জোন (ইইজেড) বলতে তার তটরেখা থেকে ওই এলাকা বোঝায়, যা ওই দেশের পলি-পাতনের মাধ্যমে প্রাকৃতিকভাবে প্রাগ্রসরমান হয়েছে। রাষ্ট্রীয় সমুদ্র ও সন্নিহিত এলাকাসহ এই এলাকা মহিসোপানের ২০০ নটিক্যাল মাইল পর্যন্ত বিস্তৃত। বাংলাদেশের েেত্র গঙ্গা ও ব্রহ্মপুত্র নদীর পলির মাধ্যমে এর সাগরতল গঠিত হয়েছে, যা দণিমুখী রাখাইন সমুদ্রের দিকে প্রাগ্রসরমান।
এত বড় একটি ইস্যুতে পররাষ্ট্রমন্ত্রী দীপু মনি ও এক্সপার্ট হিসেবে একজন এয়ার কমোডর আদালতকে কনভিনস করতে যথেষ্ট ছিলেন না বলেই আমরা হেরে এসেছি।
সোনার বাংলা : বাংলাদেশ কি হারিয়েছে?
ড. আব্দুর রব : সমুদ্রসীমা বিষয়ক আন্তর্জাতিক ট্রাইব্যুনালের রায়ে বাংলাদেশ সেন্ট মার্টিন দ্বীপের দণি-পশ্চিম বরাবর তার এক্সকুসিভ ইকোনোমিক জোন (ইইজেড) হারিয়েছে। সমুদ্রসীমা নির্ধারণে ঘধঃঁৎধষ চৎড়ষড়হমধঃরড়হ নীতির বদলে সমদূরত্ব নীতি প্রয়োগ হওয়ায় বাংলাদেশ ২০০ নটিক্যাল মাইল দেিণ ১৫০ নটিক্যাল মাইল কন্টিনেন্টাল শেলফ (সিএসে)’র বিস্তীর্ণ এলাকা হারিয়েছে। এই এলাকায় বাংলাদেশের তেল-গ্যাস অনুসন্ধানের ২০টি গভীর সমুদ্র ব্লকের উঝ-০৮-১৮, উঝ-০৮-২২, উঝ-০৮-২৩, উঝ-০৮-২৬, উঝ-০৮-২৭, উঝ-০৮-২৮ ব্লক পুরোপুরি এবং উঝ-০৮-১৩, উঝ-০৮-১৭, উঝ-০৮-২১, উঝ-০৮-২৫ ব্লক আংশিক হাতছাড়া হয়েছে। তা ছাড়া সেন্ট মার্টিনসংলগ্ন অগভীর ১৮ নম্বর ব্লকটির কিছু এলাকাও হাতছাড়া হচ্ছে। অফসোর এলাকায় হাইড্রো-কার্বন পাওয়া যায়। ডিপ সি-তে পাওয়া যায় না। বাংলাদেশের উপকূল অফসোর এবং ভারত ও মিয়ানমারের উপকূলীয় এলাকা ডিপ-সী। বাংলাদেশের এই এলাকা হাতছাড়া হওয়ায় খনিজসম্পদ থেকে বঞ্চিত হল। সমুদ্রে যাওয়ার পথ কমে গেল।
সোনার বাংলা : ভারতের সাথে বিরোধ নিষ্পত্তিতে এই রায় কি প্রভাব ফেলবে ?
ড. আব্দুর রব : জাতিসংঘের সমুদ্র আইন সংক্রান্ত ১৯৬০ (’৬৭) সালের (টঘঈখঙঝ-ওও)-এ মাত্র ৬৬টি রাষ্ট্র ১২ নটিক্যাল মাইল আঞ্চলিক সমুদ্রাঞ্চল মেনে তাতে স্বার করে। ৮টি দেশে ২০০ ন. মা. দাবি করে। আমেরকিাসহ বড় বড় নৌ-শক্তিগুলো এতে মোটেই স্বার করতে রাজি হয়নি। এই আইন বিতর্কিত। যে ৬৬টি দেশ ১২ ন. মা.-এ রাজি হয়েছে দেশগুলোর বেশিরভাগের উপকূলই খুবই গভীর এবং ভূ-বৃদ্ধির কোনো সম্ভাবনা বা সমুদ্র সম্পদ আহরণের সম্ভাবনাও সেগুলোর বিশেষ নেই। পান্তরে বাংলাদেশের উপকূলীয় এলাকার গঠন এমন যে দেিণ একশত মাইল চলে গেলেও সেখানে সমুদ্রের অগভীরতা মাত্র কয়েক ফ্যাদম। ইটলসের রায়ের ফলে ভারত-বাংলাদেশের মধ্যকার ২০১৪ সালে নিষ্পত্তিতব্য মামলার ইন্টারন্যাশনাল পারমানেন্ট কোর্ট অব আরবিট্রেশনের রায়ের ফলাফল যে একইভাবে প্রভাবিত হবে তা নিশ্চিত করে বলা যাবে না।
সোনার বাংলা : ভারত ইতোপূর্বে অন্যান্য দেশের সাথে তার সমুদ্রসীমা কিভাবে নির্ধারণ করেছে?
ড. আব্দুর রব : ভারতের মামলার আরজিতে ‘ল অব ইক্যুটির’ স্থলে তাদের উপস্থাপিত ‘ইক্যুইডিস্টেন্স প্রিন্সিপল’ যা ‘সমদূরবর্তী নীতি’ গ্রহণ করেছে। ভারত এর আগে মালদ্বীপ, শ্রীলঙ্কা, মিয়ানমার, ইন্দোনেশিয়া এবং মালয়েশিয়ার (আন্দামান সাগর) সাথে সমুদ্রসীমা নির্ধারণে ঐ ‘ইক্যুইডিস্টেন্স প্রিন্সিপল’ ভিত্তি করে বিবাদ নিরসন করেছে। এই পদ্ধতিতে বাংলাদেশের বেলায় খাটবে না। তাছাড়া ভারত একটি আঞ্চলিক শক্তি। নৌ-শক্তিতে অগ্রগণ্য। ভারত তার স্বার্থের বিপে যাওয়া রায় কিছুতেই মানবে বলে মনে হয় না।
সোনার বাংলা : ভারতের সাথে বিরোধ মেটাতে কোন পথে যাওয়া উচিত বলে মনে করছেন?
ড. আব্দুর রব : ভারতের সাথে অন্যান্য দেশের সমুদ্র সমস্যা ছিল তাদের মহাদেশীয় দ্বীপাঞ্চল বা উপকূলে। বাংলাদেশের সাথে তা খাটবে না। বাংলাদেশের ব-দ্বীপিয় ভূ-গঠনের কারণে ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের সমুদ্রসীমা নির্ধারণীতে (বাংলাদেশের পশ্চিমাংশের উপকূলে) বাংলাদেশকে একটি ক্রমবর্ধমান ব-দ্বীপিয় রাষ্ট্র হিসেবে উপকূলীয় সীমানা নির্ধারণী হাড়িয়াভাঙ্গা নদীর ‘মূল-মধ্যরেখা নীতি’ ঞযধষবিম উড়পঃৎরহব বা গরফ-পযধহহবষ ঢ়ৎরহপরঢ়ষব- নীতি অনুসরণে ভারতের সঙ্গে নিষ্পত্তিতে অগ্রসর হতে হবে। কিন্তু এখন যদি ঐ একই ‘ইক্যুইটি প্রিন্সিপাল’ বা ন্যায়পরতার নীতির মাধ্যমে আবার ভারত-বাংলাদেশ সমুদ্রসীমা নিষ্পত্তি হয় তবে আবারও বাংলাদেশ ভারতের কাছে তার দাবিকৃত (যৌক্তিক) সমুদ্রাঞ্চলের (ঊঊত এবং ঈঝ) ভূমির অধিকার থেকে বঞ্চিত হবে। আর ভারত তার ঈপ্সিত দাবি প্রতিষ্ঠার জন্য তার শক্তিশালী প্রচার মাধ্যমের সাহায্যে বঙ্গোপসাগরে জেগে ওঠা হাড়িয়াভাঙ্গা নদীর মোহনার নতুন দ্বীপ দণি তালপট্টিকে মানচিত্র থেকে নিশ্চিহ্ন করে দিয়েছে। অনেকে বলে থাকে, বৈজ্ঞানিক নদীশাসন পদ্ধতির মাধ্যমে ভারত ওই দ্বীপটিকে ধ্বংস করে ফেলেছে কিন্তু‘ এখনো ভাটার সময় ভূ-উপগ্রহচিত্রে দণি তালপট্টি অস্তিত্ব পরিদৃষ্ট হয়।
সোনার বাংলা : মহিসোপানের বিষয়টিকে কিভাবে দেখছেন?
ড. আব্দুর রব : পলিপাতন বিভাজন রেখার যুক্তিতে বাংলাদেশের মহিসোপানের দাবিটিও গ্রহণ করেনি আদালত। সমুদ্রসীমা আইনের ৫ ও ৬ নং উপধারা অনুযায়ী ‘মহিসোপানের সীমা ২৫০০ মিটার গভীরতা থেকে ১০০ নটিক্যাল মাইলের বেশি হতে পারবে না। আবার মহীসোপানের সীমা তটরেখা থেকে ৩৫০ নটিক্যাল মাইল পর্যন্ত হতে পারবে; তবে পার্শ্ববর্তী দু’দেশের পলিপাতন বিভাজন রেখার খাঁড়ি অতিক্রম করবে না। এ যুক্তি তুলে ধরে বাংলাদেশ মহীসোপানের দাবি করলে মিয়ানমারের বিরোধিতায় আদালত তা গ্রহণ করেনি। ইটলসের এ রায়ের ফলে বাংলাদেশ মিয়ানমারের দাবিকৃত উপকূলীয় সমুদ্রে বিপুল ভূমির আশাতিরিক্ত (আমাদের দাবির চেয়েও বেশি) সমুদ্র অঞ্চল লাভ করেছে। আর না বুঝে হৈ চৈ এবং আনন্দ-উল্লাসের মাধ্যমে সরকার জাতিকে ধোঁকা দিয়েছে। এটা ঠিক হয়নি।
সোনার বাংলা : প্রফেসর আনু মুহাম্মাদ বিবিসিকে দেয়া এক সাাৎকারে এটিকে বাংলাদেশের বিজয় হিসেবে দেখেছেন, আপনি কোন দিক দিয়ে ভিন্ন দৃষ্টি রাখছেন ?
ড. আব্দুর রব : বিষয়টি বেশ জটিল, আইনি এবং টেকনিক্যাল হওয়ার ফলে ভিন্ন জ্ঞান শাখার পণ্ডিতবর্গ বেশ বিব্রত এবং ধাঁধায় নিপতিত হয়েছেন। কেউবা সম্পূর্ণ বিভ্রান্ত। মিয়ানমারের সঙ্গে সমুদ্রসীমা মামলার রায়ের বিষয়ে পানি, পরিবেশ ও ভূ-রাজনৈতিক বিশ্লেষক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক ড. মনিরুজ্জামান মিঞা, ড. ফেরদৌস কোরেশী, প্রকৌশলী ম. ইনামুল হকসহ অনেকেই আমার মতের সাথে এক মত। আমদের পড়াশুনা এবং গবেষণার বিষয় এটি। এ বিষয়ে যারা বিশেষজ্ঞ তারাই ভালো করে বলতে পারবে আসল ঘটনা কি। সিঙ্গাপুর প্রবাসী সমুদ্র আইন বিশেষজ্ঞ ক্যাপ্টেন এম. রেজাউল করিম চৌধুরীর গবেষণামূলক প্রতিবেদনেও আমার মতোই ফুটে উঠেছে।
সোনার বাংলা : বর্তমান সরকার বলছে এটি তাদের অর্জন, আপনার দৃষ্টিতে কি ?
ড. আব্দুর রব : ১৯৭৪ সালে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমান বঙ্গোপসাগরের জরিপের কথা প্রথম শুরু করলেও তিনি এর কোনো অগ্রগতি ঘটাতে পারেননি। বাংলাদেশের সমুদ্রাঞ্চলের অধিকারের ব্যাপারে প্রথম যৌক্তিক ও জোরালো উদ্যোগ গ্রহণ করেন শহীদ জিয়াউর রহমান। তাঁর শাসনকালে রিয়ার অ্যাডমিরাল এম এইচ খানের নেতৃত্বে দ. তালপট্টি ও বঙ্গোপসাগরে বাংলাদেশের সার্বভৌমত্ব প্রতিষ্ঠা ও সমুদ্রসম্পদ আহরণের নানা উদ্যোগ নেয়া হয়।
১৯৭৫ সালের পরে জিয়াউর রহমান আবার শুরু করলে ভারত কানাডিয়ান সার্ভে জাহাজকে নৌবাহিনী দ্বারা তাড়া করে। পরে প্রেসিডেন্ট জিয়া দণি তালপট্টির দিকে বাংলাদেশের নৌবাহিনীকে পাঠানোর উদ্যোগ নেন। ওই সময় ঘঙঅগও নামক গবেষণা প্রতিষ্ঠানের উদ্যোগে বঙ্গোপসাগরের ওপর কয়েকটি গবেষণা কার্য পরিচালনা করা হয়। প্রফেসর ড. মনিরুজ্জামান মিয়া (ঢাবি), ড. এম আই চৌধুরী (জাবি), প্রফেসর ড. হাবিবুর রহমান (রাবি) এবং প্রফেসর ড. আইনুন নিশাত (বুয়েট) এসব গবেষণা কার্যক্রমে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন। শহীদ কমোডর রাব্বানী এবং কমোডর খুরশেদ আলমও (বাংলাদেশ নৌবাহিনী) বঙ্গোপসাগরে বাংলাদেশের আঞ্চলিক সমুদ্রসীমা সংক্রান্ত গবেষণা ও আইনি তৎপরতায় বিশেষ অবদান রাখেন। জিয়ারষ্কৃত্যুর পর বঙ্গোপসাগরে বাংলাদেশের অধিকারের প্রশ্ন চাপা পড়ে যায়।
কিন্তু মিয়ানমার ও ভারতের সঙ্গে নীতি-নির্ধারণীতে সর্বশেষ আলোচনা ও উদ্যোগ নেয়া হয় বিগত ২০০৮ সালের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে। তখন এ বিষয়ে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তৎকালীন উপদেষ্টা ড. ইফতেখার আহমেদ চৌধুরীর উদ্যোগে মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব আবুল কালাম মাহমুদকে (কায়েস) এ বিষয়ের সেলের প্রধান করে কমোডর (অব.) মোহাম্মদ খুরশেদ আলমকে উপদেষ্টা নিয়োগ করা হয়। তখন থেকেই এ েেত্র বিশেষ অগ্রগতি শুরু হয়।
সোনার বাংলা : লকড-জোন এর বিষয়টি পরিষ্কার করে বলবেন কি?
ড. আব্দুর রব : ভারত যদি মিয়ানমারের মতো ‘ল অব ইক্যুইটি’ যা ন্যায়পরতার নীতির ভিত্তিতে বাংলাদেশের সঙ্গে সমুদ্রসীমা নির্ধারণে বাধ্য বা রাজি হয় তবুও ওই রায়ের ফলে দু’দেশের মধ্যে নিষ্পত্তিকৃত রায়ের নির্ধারিত বিভাজন রেখা সরাসরি দেিণ চলতে থাকলে (যা মিয়ানমারের েেত্র সোজা দেিণ না চলে কিছুটা পশ্চিমে বেঁকে গিয়েছে বলে দেখা যায়) ভালো। কিন্তু তা যদি দণি-পূর্বদিকে চলতে থাকে (রায়ের ফলে) তবে বাংলাদেশের পূর্বাঞ্চলীয় সমুদ্রেও আমাদের ঊঊত এবং ঈঝ -এর আয়তন বিপুলভাবে কমে যাবে এবং চূড়ান্ত পর্যায়ে বাংলাদেশের সমুদ্র-দাবি ‘বলয়বদ্ধ’ বা ‘ লক্ড-জোন ’ (খড়পশবফ -তড়হব) হয়ে পড়বে।
ইটলস রায়ের মাধ্যমে আমরা আমাদের ঊঊত -এর পূর্বাঞ্চলে গুরুত্বপূর্ণ বিশাল সম্পদ সম্ভাবনাময় (তেল-গ্যাসসমৃদ্ধ) ব্লকগুলো থেকে বঞ্চিত হতে যাচ্ছি এবং ইটলসের রায়সম্ভূত সীমা নির্ধারণী রেখা পশ্চিম দিকে তির্যকভাবে চলে গিয়ে বাংলাদেশের অংশের ইইজেড এবং এর ধারাবাহিকতায় মহিসোপানকেও কৌণিকভাবে সংকীর্ণ করে দেবে। শুধু তাই নয়, এই রায় ভারতের সঙ্গে আমাদের হেগের মামলার ফলাফলকেও প্রভাবিত করতে পারে। তাহলে আমারা চূড়ান্ত নিষ্পত্তিতে একটি ‘ লক্ড-জোন ’ (খড়পশবফ -তড়হব) কন্টিনেন্টাল শেল্ফ এর দিকে এগোচ্ছি। সমুদ্রে আমরা লকড - জোন বা অবরুদ্ধ হয়ে যাব।
সোনার বাংলা : আমরা জোন-লকড হলে ভারতের লাভ কি?
ড. আব্দুর রব : ২০০৯ সালে ভারত মিয়ানমারের জন্য মহিসোপানের কিছু অংশ রাখে, বাংলাদেশের জন্য কোন অংশ না রেখেই পুরো মহিসোপানের দাবি উপস্থাপন করে ট্রাইব্যুনালে। বঙ্গোপসাগরে এবং সংলগ্ন অঞ্চলে আমেরিকার বিশেষ আগ্রহ রয়েছে। এ অঞ্চলে ঘাঁটি গড়া তাদের দীর্ঘদিনের ইচ্ছা। এজন্যই মিয়ানমারের উপকূলীয় অঞ্চলের দাবি-দাওয়া নিয়ে মামলা আন্তর্জাতিক ফোরামে বিশেষ গুরুত্ব পেতে থাকে। আমেরিকাকে ঠেকাতে ভারত চায় আমাদেরকে সমুদ্রে লকড -জোন করতে। সমুদ্রে আমরা জোন-লকড বা অবরুদ্ধ হয়ে গেলে বিদেশি জাহাজ চলাচলে ও বণিজ্যে মিয়ানমার এবং ভারতের কাছ থেকে আমাদের ট্রানজিট নিতে হবে। ভারত চায় আমরা নৌ-শক্তিতে তাদের উপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ি। আর সমুদ্রে ট্রানজিট দিয়ে বাংলাদেশের স্থল ট্রানজিট স্থায়ীভাবে পাকাপোক্ত করতে চাইছে ভারত। একান্ত আর্থনীতিক জোন এবং একইভাবে মহিসোপান অঞ্চলের সমুদ্রের দাবিকৃত এলাকাকে সংকীর্ণ করে বহুগুণ কমিয়ে দিবে।
সোনার বাংলা : ভারতের সাথে সমুদ্র বিরোধ নিষ্পত্তিতে দেশীয় বিশেষজ্ঞদের কি ভূমিকা রাখা উচিত?
ড. আব্দুর রব : সরকারকে সহযোগিতা করার জন্য বেসরকারিভাবে একটি জাতীয় কমিটি করলে ভালো হয়। এখানে সব রাজনৈতিক দলের প্রতিনিধি, শিক, সমুদ্র আইনবিদ, ওসেনোগ্রাফার, সাংবাদিক, নেভীর কর্মকর্তা, বুয়েটের গবেষক এবং কূটনীতিক, নিরাপত্তা বিশ্লেষক, অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মকর্তারা থাকবেন। তারা দেশের জনগণকে সব বিষয়ে অবহিত করবেন। এবং মায়ানমারের সাথে নিষ্পত্তির রায়টি জন সম্মুখে প্রকাশ করার ব্যবস্থা করবেন।
সোনার বাংলা : সমুদ্র সংক্রান্ত সার্বিক বিষয়ে সরকার, সংশ্লিষ্ট কর্তৃপ ও বিশেষজ্ঞদের প্রতি আপনার পরামর্শ কি?
ড. আব্দুর রব : সমুদ্র আইন এবং ভারতের সাথের বিষয়টি বার বার রিভিউ করতে হবে। সমুদ্র আইনবিদ, ওসেনোগ্রাফার, সাংবাদিক, নেভীর কর্মকর্তা, বুয়েটের গবেষক, এবং কূটনীতিকদের সমন্বয়ের একটি দলকে প্রয়োজনীয় প্রশিণ, ওয়ার্কশপ, আস্থা ভাজন বিদেশি এক্সপার্টদের নিয়ে সমুদ্র এলাকা পরিদর্শন করানো দরকার। এটি রাষ্ট্রের দায়িত্ব। এখানে দেশের স্বার্থে সবাইকে এক যোগে কাজ করতে হবে। এটা ভুললে হবে না যে আমরা ১৯৭১ সালে সবাই মিলে যুদ্ধ করেছি বলেই দেশটি আজ স্বাধীন।