somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

গ্রেট ওয়াল

১৭ ই সেপ্টেম্বর, ২০২০ সন্ধ্যা ৭:৪৯
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :




৮২ সালের অকটোবর মাস । হাল্কা শীত ভাব চলে এসেছে । বেইজিং ল্যাঙ্গুয়েজ ইন্সটিটিউট যা এখন বেইজিং ল্যাঙ্গুয়েজ অ্যান্ড কালচারাল ইউনিভারসিটি থেকে ভোরের নাস্তা খেয়েই অনেকের সাথে ১৫ টি বাসের একটিতে চড়ে বসলাম । সেপ্টেম্বর , অক্টোবর মাসে প্রতি রবিবারেই নতুন আসা ছাত্রদের জন্য এই প্লেজার ট্রিপ থাকতো। পৃথিবীর বিবিধ দেশের ছাত্রছাত্রী আসে এখানে ভাষা শিখতে । তারপর তারা মুল বিষয় শিখতে বিবিধ বিশ্ববিদ্যালয়ে যায় । পিকিং শহর ছেড়ে আমরা পাহাড়ি পথ ধরলাম । চিকন রাস্তা পাশে খাঁদ , অন্যদিকে উচু পাহাড় । একসময় আমরা গ্রেটওয়ালে চলে এলাম । বাসগুলো সারি বেধে দাঁড়ালো আর আমরা বহুজাতিক বাহিনী গ্রেটওয়ালের সিঁড়িতে পা রাখলাম । বেশ টুরিস্ট এসেছে । আমরা একটা চৌকি মত জায়গায় দাড়িয়ে ছবি তোলা শুরু করলাম । পুরো পাথরের তৈরি রাস্তা ক্রমশ উপরে উঠেছে । কিছুদুর বাদে চৌকি যেখানে রাস্তা সরু । আমাদের শিক্ষক লেকচার ঝাড়ছিলেন আমরাও শুনছি । ১৬ ফিট চওড়া রাস্তা যার দুদিক ৬ ফিট দেয়াল মাঝে ফোকর কাটা । এই ফোকর দিয়ে আগুনের কুণ্ডলী ঠেলে দিত সৈন্যরা মঙ্গল দস্যুদের ঠেকাতে । চৌকির ওপরে নজরদারি করার বা তীরন্দাজ দাঁড়ানোর ব্যাবস্থা ছিল । এই রাস্তা দিয়ে ঘোড়া ছুটত রাজাদের চিঠি নিয়ে । ছয়টি ঘোড়া পাশাপাশি ছুটতে পারত এই দেওয়ালে। প্রায় ছয় হাজার কিলোমিটার দেওয়াল বানিয়েছে তিনটি সাম্রাজ্য হাজার বছর ধরে । এবার খাড়া পথ , সবাই উঠতে থাকলাম , এবার সিঁড়ি বেশ ছোট , রেলিং ধরে একদম উচু মাথায় উঠে হাপাতে লাগলাম । পাহাড় এখানে উচু বলে ঠাণ্ডা হাওয়ায় ভাল লাগছিল আবার চোখ বন্ধ হয়ে যাচ্ছিল । ফটো সেশন । এখানে দীর্ঘ সময় দাঁড়ানো যায়না কারন নিচ থেকে আরও দর্শনার্থী উঠছে । চারিদিকে চোখ বুলিয়ে নিলাম । ওয়াল বানানোর কায়দা কানুন খুবই উন্নত এবং কঠিন শ্রমের ব্যাপার । পর্বতের উচু জায়গা বেছে নেওয়া হয়েছে কৌশল হিসাবে যাতে শত্রু বেয়ে উঠে সুবিধা করতে পারেনা আগুনের কুণ্ডলী বা বড় পাথরের টুকরার আঘাতে । সেনাবাহিনী দ্রুত মোতায়েনে এরচে চমৎকার ব্যাবস্থা আর নেই । খুব উচু জায়গায় ঘোড়া থেমে যেত । আরোহীরা পায়ে হেটে চৌকি পার হয়ে অন্য দিকের ঘোড়ায় সওয়ার হত । এভাবে পায়ে হেটে হাজার সৈন্য শত মাইল পাড়ি দিত । শুনেছি দেওয়ালের পাথর কাটার জন্য , বয়ে নিয়ে বসানোর জন্য দাস ধরে আনা হত । তাদের পায়ে শেকল বেড়ি দিয়ে রাখা হত যাতে পালাতে না পারে । মিশরেও একই কায়দায় জোরপূর্বক শ্রম নেওয়া হত । সারা পৃথিবীর অনন্য সৃষ্টির পিছনে লক্ষ দুর্ভাগা শ্রমিকের রক্ত , ঘাম আর জীবন জড়িয়ে আছে । শ্রমিকরা মারা গেলে পাশেই লাশ ঠেলে ফেলা হত । সেখানে দেহ পচত বা পশুতে খেত । প্রতিটি সৃষ্টির পিছনে করুন বেদনাময় কাহিনী জড়িয়ে আছে । যাদের অপহরন করে আনা হত তাদের স্বজনরা আর কখনই তাদের দেখা পেত না । ওয়ালে দাড়িয়ে বেশ ভাবাতুর হয়ে গেলাম ।
দুঘণ্টা কাটিয়ে নেমে এলাম নিচে । রেস্টুরেন্ট নেই বা যা আছে আমাদের খাবার উপযোগী নয় । এরপর মিং সম্রাটদের কবর প্রায় দশতলা মাটির নিচে দেখে বাগান ঘুরে ফেরত এলাম ।

১৯৮৬ সালে দীর্ঘ ৭৬ ঘণ্টার ট্রেন জার্নির সময় কানসু প্রভিন্সের মরুময় এলাকায় নজরে এল গ্রেট ওয়ালের শেষ মাথা । বালু মাটি দিয়ে তৈরি শেষ প্রান্ত প্রকাণ্ড । অনেক সৈন্য থাকত ওখানে ডাকাতদের বাধা দিতে । যতক্ষন নজরে আসে চেয়ে রইলাম শেষ প্রান্তের দিকে । আমরা যাচ্ছি আসলে তুনহুয়াং বৌদ্ধ গুহায় স্টাডি ট্যুরে । প্রতি বছর দুটো ট্যুর থাকে স্কলারশিপ পাওয়া ছাত্র ছাত্রীদের জন্য । আমরা এসময় যে হোটেলে অবস্থান করতাম সেখানে কার্ড দেখিয়ে কম মুল্যে চার কোর্সের খাবার পেতাম । গ্রেট ওয়ালের শুরুটা দেখা হয়নি তবে শেষটা দেখলাম ।

তখন চায়নার একমাত্র টেলিভিশন সি সি টি ভি দুটো চ্যানেল চালাত । আমার টি ভি ছিল নিজের । রাতে এক ভয়াবহ দৃশ্য দেখলাম । ইনার মঙ্গোলিয়ায় গ্রেট ওয়ালের গা ঘেসে মানুষ বসবাস করছে তাও ওয়ালের পাথর খুলে নিয়ে । ঐ এলাকায় আধুনিকতা পৌঁছেনি , মানুষের যারা মুলত কৃষিজীবী কোন ধ্যান ধারনা নেই নির্বিবাদে পাথর খুলে একদম সাফ করে দিয়েছে । ওখানে রাষ্ট্র নেই, পুরাতত্ত্ব বিভাগ নেই, কমিউনিস্ট পার্টি নেই কিছুই নেই । ওদের জিজ্ঞাসা করা হল এই গ্রেট ওয়াল নিয়ে তারা দাত কেলিয়ে বোকা হাসি হেসে জানাল তারা জানেইনা এসব কি , তারা শুধু জানে ঘর তৈরির জন্য এই পাথর বেশ মজবুত , কাউকে টাকা দিতে হয়না । এক ঐতিহাসিক ঘটনা দেখলাম সি সি টি ভির অগ্রগামী দলের । সম্ভবত নেতারা জানার পর ঐ প্রোগ্রাম আর দেখা যায়নি ।

৮৭ সাল থেকে চাকুরী জীবনে ইউরোপ থেকে আসা উচ্চ কর্মকর্তা , বিবিধ রাষ্ট্রীয় ব্যাক্তিবর্গদের নিয়ে আমি গেছি গ্রেট ওয়ালে প্রায় প্রতি রবিবারে । বেশ টুরিস্ট গাইডের মত পোজপাজ মেরে বক্তৃতা ঝাড়তাম । ততদিনে ভাল রেস্টুরেন্ট হয়েছে , ছয় লেনের রাস্তা হয়েছে । মানুষের ভিড় বেড়েছে বহুগুন । সর্ব সাকুল্যে ৫০ বারের অধিক যাওয়া পড়েছে ।

২০০৫ সালে গেলাম আমার ঢাকার অফিসের বসদের নিয়ে । ড্রাইভার আমাদের ঘুমিয়ে পড়ার সুযোগে বা তা লিং সেকশনে না নিয়ে অন্য কোন সেকশনে নিয়ে গেল । পছন্দ হলনা । আগের সেকশনে নাকি এতই ভিড় যে গাড়ি পারকিং পাওয়া একটা ঝামেলা। গ্রেট ওয়ালের অব্যবহৃত অংশে আমেরিকান গরীব টুরিস্টরা স্লিপিং ব্যাগ নিয়ে ঘাটি গেড়েছে । দেয়ালের পাশেই নিচে নেমে বানিয়েছে টয়লেট । আশপাশের গ্রামের লোক লাঞ্চ বক্স নিয়ে এদের কাছে বিক্রি করে।বেইজিঙের আশেপাশের অঞ্চলের কর্মহীন পরিবারগুলো ঘাটি গেড়েছে ওইসব টুরিস্ট স্পটের আশেপাশে । স্থানীয়ভাবে লোকবল দরকার এই বিশাল টুরিস্ট ভেনুতে । অ্যামেরিকানদের জন্য নিখরচায় গ্রেট ওয়ালে দু তিন দিন থাকা , মন্দ নয় । পাশেই পাচতারা হোটেল হয়েছে । সেখানে পাচতারা মার্কা লোকজন আসে । চাঁদনী রাত ওয়ালে বসে উপভোগ আবার ওয়ালে বসে সূর্যোদয় দেখা । গ্রেট ওয়ালের আশপাশ দিয়ে রেস্টুরেন্ট আর গ্রামের লোকদের কাজ হচ্ছে লাঞ্চ বক্স বিক্রি কারন রেস্টুরেন্টে বসে খেতে অনেক খরচ । দু’লক্ষের মত লাঞ্চবক্স তৈরি হয় প্রতিদিন।
গতবছর চৈনিক পত্রিকায় পড়ছি যে ইনার মঙ্গোলিয়ার ঐ অঞ্চলে গ্রেট ওয়ালের পুনঃনির্মাণ , মেরামত শেষ । সরকার আশা করছে এখানে ব্যাপক টুরিস্ট আগমন ঘটবে । কিভাবে চেষ্টা চলছে টুরিস্ট আকর্ষণের । বিবিধ স্পট মেরামত করে নব্য ধনী চীনাদের আগমনে বাকবাকুম করে উঠবে আবার ।





সর্বশেষ এডিট : ১৭ ই সেপ্টেম্বর, ২০২০ সন্ধ্যা ৭:৫০
১০টি মন্তব্য ১০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

খুলনায় বসবাসরত কোন ব্লগার আছেন?

লিখেছেন ইফতেখার ভূইয়া, ১৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ ভোর ৪:৩২

খুলনা প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় তথা কুয়েট-এ অধ্যয়নরত কিংবা ঐ এলাকায় বসবাসরত কোন ব্লগার কি সামুতে আছেন? একটি দরিদ্র পরিবারকে সহযোগীতার জন্য মূলত কিছু তথ্য প্রয়োজন।

পরিবারটির কর্তা ব্যক্তি পেশায় একজন ভ্যান চালক... ...বাকিটুকু পড়ুন

একমাত্র আল্লাহর ইবাদত হবে আল্লাহ, রাসূল (সা.) ও আমিরের ইতায়াতে ওলামা তরিকায়

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ১৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ ভোর ৬:১০



সূরাঃ ১ ফাতিহা, ৪ নং আয়াতের অনুবাদ-
৪। আমরা আপনার ইবাদত করি এবং আপনার কাছে সাহায্য চাই।

সূরাঃ ৪ নিসার ৫৯ নং আয়াতের অনুবাদ-
৫৯। হে মুমিনগণ! যদি... ...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। মুক্তিযোদ্ধা

লিখেছেন শাহ আজিজ, ১৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:২১



মুক্তিযুদ্ধের সঠিক তালিকা প্রণয়ন ও ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা প্রসঙ্গে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক বলেছেন, ‘দেশের প্রতিটি উপজেলা পর্যায়ে মুক্তিযোদ্ধা যাচাই বাছাই কমিটি রয়েছে। তারা স্থানীয়ভাবে যাচাই... ...বাকিটুকু পড়ুন

ভারতীয় রাজাকাররা বাংলাদেশর উৎসব গুলোকে সনাতানাইজেশনের চেষ্টা করছে কেন?

লিখেছেন প্রকৌশলী মোঃ সাদ্দাম হোসেন, ১৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ২:৪৯



সম্প্রতি প্রতিবছর ঈদ, ১লা বৈশাখ, স্বাধীনতা দিবস, বিজয় দিবস, শহীদ দিবস এলে জঙ্গি রাজাকাররা হাউকাউ করে কেন? শিরোনামে মোহাম্মদ গোফরানের একটি লেখা চোখে পড়েছে, যে পোস্টে তিনি... ...বাকিটুকু পড়ুন

ঘুষের ধর্ম নাই

লিখেছেন প্রামানিক, ১৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ সন্ধ্যা ৭:৫৫


শহীদুল ইসলাম প্রামানিক

মুসলমানে শুকর খায় না
হিন্দু খায় না গাই
সবাই মিলেই সুদ, ঘুষ খায়
সেথায় বিভেদ নাই।

হিন্দু বলে জয় শ্র্রীরাম
মুসলিম আল্লাহ রসুল
হারাম খেয়েই ধর্ম করে
অন্যের ধরে ভুল।

পানি বললে জাত থাকে না
ঘুষ... ...বাকিটুকু পড়ুন

×