somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

অমিতেন্দ্রনাথ ঠাকুর

১০ ই ফেব্রুয়ারি, ২০২১ সন্ধ্যা ৭:৩৮
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

অমিতেন্দ্রনাথ ঠাকুর

ঠাকুর পরিবারের দুই বাড়ি অর্থাৎ জোড়াসাঁকো আর বোলপুর শান্তিনিকেতন গেছি একাধিকবার । ৮২ সালে আনন্দ বাবু সকাল বেলা আমাদের শান্তিনিকেতন ঘুরে বয়ান করে দেখালেন । তিনি রবীন্দ্র গবেষক এবং আনন্দ বাজার পত্রিকার গবেষক সম্পাদক । জোড়াসাকো দেখতে গিয়ে চালাকি করে আরেক দলের ভাষ্যকারের পিছু নিলাম । দক্ষিনের বারান্দা আমারও প্রিয় খুব । খুব জানতে ইচ্ছে করত ঠাকুরবাড়ির পরবর্তী বংশ কোথায় কিভাবে থাকে । জেনে কষ্ট লাগলো রবি ঠাকুর বেচে থাকতেই জোড়াসাঁকো হাতবদল হয়েছিল , সেই অজানা কাহিনী দেখে কপি করে ছেপে দিলাম পাঠকদের জন্য ।

#############
ঠাকুরবাড়ির দীর্ঘজীবী পুরুষ!!
তাঁর ছোটবেলা কেটেছে জোড়াসাঁকোতেই।দ্বারকানাথের শখের পাঁচ নাম্বার বাড়ির বিশাল বিশাল ঘর, হলরুম,বিলিয়ার্ড ঘর, গুনেন্দ্রনাথের বাগান সব মিলিয়ে বিশাল বাড়িতেই জন্ম তাঁর এবং কেটেছে শৈশব। দেখেছেন রবীন্দ্রনাথ,গগনেন্দ্রনাথ,অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরবাড়ির তিন নক্ষত্রকে। সেই সাথে চোখের সামনে তাসের ঘরের মতো ভেঙে যেতে বাংলার রেঁনেসার অগ্রদূত ঠাকুরবাড়িকে।ছিঁড়ে যেতে দেখেছেন সব বাঁধনকে।
আমি যার কথা বলছি তিনি হলেন অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জ্যেষ্ঠ নাতি অলোকেন্দ্রনাথের পুত্র অমিতেন্দ্রনাথ ঠাকুর। অবনীন্দ্রনাথের কোলে-পিঠে বড়ো হওয়া অমিতেন্দ্রনাথের জন্ম ১৯২২ সালে।
কৈশোরে ঠাকুরবাড়িতে তাঁর ও অন্যান্য কচিকাঁচাদের যাত্রাপালা উপভোগ করেছিলেন স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ। দিনেন্দ্রনাথ ঠাকুরের কাছে শিখেছেন গানও। এমনকি, স্মৃতিচারণে জোড়াসাঁকোর ‘দক্ষিণের বারান্দা’র কথাও ফিরে এসেছে বারবার। জোড়াসাঁকোয় অবনীন্দ্রনাথের চানঘর-লাগোয়া একটি বিশাল চৌবাচ্চা ছিল। শৈশবে একদিন সকলের চোখ এড়িয়ে সেই চৌবাচ্চার পাড়ে উঠলেন অমিতেন্দ্রনাথ। ধরা পড়লেন ‘দাদামশায়’ অবন ঠাকুরের কাছেই। শাস্তিস্বরূপ কুকুর বাঁধার চেন দিয়ে বাঁধলেন অমিতেন্দ্রনাথকে। তারপর, পায়ের জুতো দিয়ে পিঠে আঘাত। ব্যথা হয়তো লাগেনি, কিন্তু সবার সামনে অবনীন্দ্রনাথের সেই মার প্রৌঢ় বয়সেও ভুলতে পারেননি অমিতেন্দ্রনাথ।
ঠাকুরবাড়ির শেষ দিনগুলো নিয়ে তিনি লিখেছেন-
"রবি অস্তমিত হলে জোড়াসাঁকো বাড়িতে অন্ধকার নেমে এল। বিশেষ করে পাঁচ নম্বর বাড়ির আর্থিক অবস্থা তাসের ঘরের মতো ভেঙে পড়ছে, জমিদারির আয় থেকে বিশাল পরিবারের খরচ অসম্ভব হল। গগনেন্দ্রনাথ এবং অবনীন্দ্রনাথের সঙ্গে লর্ড রোনাল্ডশে-র অন্তরঙ্গ পরিচয় ছিল, চেষ্টা করা হয়েছিল যাতে জমিদারিটি কোর্ট অফ ওয়ার্ডসে নিয়ে নেওয়া হয়, তারা মাসোহারা দেবে এবং ক্রমে ক্রমে ধার শোধ করবে। ‘‘কোর্ট অফ ওয়ার্ডস থেকে বলা হয় যে কলকাতার সম্পত্তি পুরোটা বিক্রি না করলে সম্পূর্ণ ধার শোধ করা যাবে না। তাই ১৯৪১ সালে আমরা জোড়াসাঁকো পাঁচ নম্বর বাড়ির বসবাস ছেড়ে উঠে আসতে বাধ্য হই।’’
"গগনেন্দ্র-পরিবার চলে গেলেন ল্যান্সডাউন প্লেসে, সমরেন্দ্রনাথ বালিগঞ্জের সুইনহো স্ট্রিটে। অমিতেন্দ্রনাথের স্মৃতি সেই ভাঙনের ছবিটা বাস্তবে ও কান্নায় মিলিয়ে এমনই সুস্পষ্ট করে তোলে, পাঠকের বুকের মধ্যে সে যে কী পাষাণভার জমিয়ে তোলে, ভাষা নেই যে বর্ণনা করি, ‘‘শুধু আমরাই পড়ে রইলুম দোতলার পশ্চিমের অন্দরমহলে। তখন বাড়ির লোকজন কেউ নেই বললেই চলে। বা’র বাড়িতে আর ঝাড় পোঁছ হয় না, বাড়ির গা থেকে চুন বালির বড় বড় চাঙড় ভেঙে পড়ছে প্রায়ই। ছুটি হয়ে গেছে দারোয়ানদের। একতলার ধুলোয় ভরা বারান্দা সব যেন গিলতে আসছে। বাগানের পাশে দফতর খানা, তোশা খানা সব বন্ধ, অপরিষ্কার। ম্যানেজার, সরকারদের ছুটি হয়ে গেছে, তারা চলে গেছে বাড়ি ছেড়ে। বাগানের গাছঘরের একপাশ ভেঙে পড়েছে রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে। বাগানে লতার ঝাড়-ছাওয়া পারগোলার লোহার ফ্রেম চুরি হয়ে গেছে।’’
"লক্ষ্মী তো অনেক আগেই বিদায় নিয়েছেন এ বার পালা সরস্বতীর। অবনীন্দ্র-পরিবারের নবনীড় রচিত হল বরানগরের ভাড়াবাড়িতে, ‘গুপ্তনিবাস’। ‘‘যে শালগ্রাম শিলা একদিন আদি বাড়ি থেকে নীলমণি ঠাকুর নিয়ে এসেছিলেন, তাকে আর একদিন সকালে ঠাকুর মশায় গলায় ঝুলিয়ে বাবা অলোকেন্দ্রনাথের সঙ্গে বরানগরের গুপ্তনিবাসে নিয়ে গিয়ে ঠাকুরঘরে প্রতিষ্ঠা করলেন।’’ বিরহের স্মৃতিতেই আটকে থাকে না জীবন, সে আবার পাখা মেলে, যে যার মতো করে নিজে সাজে, চারপাশকে সাজায়, জানে, দেখে, শোনে, নদীর মতন বয়ে চলে, ‘‘গুপ্তনিবাসে এসে আমরা জোড়াসাঁকো হারানোর শোক অনেকটাই ভুলতে পেরেছিলুম। সুন্দর বড় সাজানো বাগান, তিনখানা বড় বড় পুকুর ছিল— কলকাতার মধ্যে থাকলে তো এসব পাওয়া যেত না।’’ কিছু দিন যেতে না যেতে বড়দা মোহনলালকে ডেকে নিলেন দাদামশায়।"
অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর তখন কলাভবনের দায়িত্বে। দৌহিত্র অমিতেন্দ্রনাথ-সহ গোটা পরিবার গিয়ে হাজির শান্তিনিকেতনে। সেখানেই কিছু ছেলেকে একদিন ক্রিকেট খেলতে দেখলেন তরুণ অমিতেন্দ্রনাথ। কিন্তু চেয়েও খেলতে পারলেন না তাদের সঙ্গে। কেননা, একমাত্র বিশ্বভারতীর ছাত্ররাই খেলতে পারে সেখানে।
খেলার জন্য তখন ছাত্র হতেও রাজি অমিতেন্দ্রনাথ। গিয়ে হাজির সদ্য-প্রতিষ্ঠিত চিনা-ভবনে। চিনা ভাষার ছাত্র হিসেবে বিশ্বভারতীতে নাম উঠল তাঁর। ব্যস, আর কোনো বাধাই রইল না ক্রিকেট খেলার।
শান্তিনিকেতনে পড়াশোনা শেষ করে, অমিতেন্দ্রনাথ সহপাঠীদের সঙ্গে উচ্চশিক্ষার জন্য পাড়ি দেন চিনে। সেখানে একবার চিনা ছেলেরা যাতায়াতের পথে ‘ওয়াই কোরেন, ওয়াই কোরেন’ বলে উত্যক্ত করত তাদের। ‘ওয়াই কোরেন’ মানে ‘বিদেশি’। একদিন ঘুরে দাঁড়িয়ে অমিতেন্দ্রনাথরা কড়া গলায় জবাব দিলেন, ‘চুং কোরেন, চুং করেন’। অর্থাৎ, ‘চুপ করো।’ নাহ, সেই উত্তর শোনার পর আর কোনো চিনা ছেলে জ্বালাতে আসেনি তাঁদের।চিন থেকে ফিরে শান্তিনিকেতনেই শিক্ষকতা শুরু করেন অমিতেন্দ্রনাথ। তারপর দেরাদুন, পুনে হয়ে আমেরিকার ফিলাডেলফিয়া বিশ্ববিদ্যালয়। পরবর্তীকালে ওকল্যান্ড বিশ্ববিদ্যালয়েও চিনা ভাষা পড়িয়েছেন দীর্ঘ দু-দশক। অবসর জীবনে কলকাতায় ফিরে সল্টলেকে বসবাস শুরু করেন। আমৃত্যু কাটিয়েছেন সেখানেই।
ঠাকুরবাড়ি থেকে গুপ্তনিবাস হয়ে সল্টলেক জীবনের রঙ্গমঞ্চে সব দিকটাই দেখেছেন অমিতেন্দ্রনাথ।ঠাকুরবাড়ির সোনালী দিনগুলো,রবীন্দ্রনাথের পর্বততুল্য ব্যক্তিত্ব, ঠাকুরবাড়িতে দেশি বিদেশি আন্তর্জাতিক পর্যায়ের লোকজনের আগমন সেই সাথে রবীন্দ্রনাথের মৃত্যু,রথীন্দ্রনাথের বাড়ি ছেড়ে চলে যাওয়া, জোড়াসাঁকোর ৫ নং বাড়ি বিক্রি করে দেওয়ার সময় অবনীন্দ্রনাথের দীর্ঘশ্বাস, মাড়োয়ারিদের দ্বারা বাড়ি ভাঙন,ছয় নাম্বার বাড়ি সরকার কর্তৃক অধিগ্রহন,পারিবারিক প্রতিষ্ঠান শান্তিনিকেতনকে সরকারিকরন সব মিলিয়ে সবকিছুর জীবন্ত সাক্ষী।
৯৯ বছর বয়সে আজ 'অমিতকথা'র সেই অমিতেন্দ্রনাথ ঠাকুরবাড়ির সকল স্মৃতি বুকে নিয়ে ছুটি নিয়ে চলে গেলেন অমৃতলোকে।
তথ্যসূত্রঃ
১/ অমিতকথা,অমিতেন্দ্রনাথ ঠাকুর,সিগনেট প্রেস,কোলকাতা,২০১৮,(পৃষ্ঠাঃ১১,২৬-২৮)।
২/ আনন্দবাজার পত্রিকা,১৮ নভেম্বর,২০১৮।
সর্বশেষ এডিট : ১০ ই ফেব্রুয়ারি, ২০২১ সন্ধ্যা ৭:৩৯
৯টি মন্তব্য ৮টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

আমি হাসান মাহবুবের তাতিন নই।

লিখেছেন ৎৎৎঘূৎৎ, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ দুপুর ১:৩৩



ছোটবেলা পদার্থবিজ্ঞান বইয়ের ভেতরে করে রাত জেগে তিন গোয়েন্দা পড়তাম। মামনি ভাবতেন ছেলেটা আড়াইটা পর্যন্ত পড়ছে ইদানীং। এতো দিনে পড়ায় মনযোগ এসেছে তাহলে। যেদিন আমি তার থেকে টাকা নিয়ে একটা... ...বাকিটুকু পড়ুন

ভারতীয় পণ্য বয়কটের কেন এই ডাক। একটি সমীক্ষা-অভিমত।।

লিখেছেন সাইয়িদ রফিকুল হক, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ বিকাল ৩:১৫



ভারতীয় পণ্য বয়কটের কেন এই ডাক। একটি সমীক্ষা-অভিমত।।
সাইয়িদ রফিকুল হক

বিএনপি ২০২৪ খ্রিস্টাব্দে দেশে অনুষ্ঠিত “দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে”-এ অংশগ্রহণ করেনি। তারা এই নির্বাচনের বহু আগে থেকেই নির্বাচনে অংশগ্রহণ... ...বাকিটুকু পড়ুন

মুক্তিযোদ্ধাদের বিবিধ গ্রুপে বিভক্ত করার বেকুবী প্রয়াস ( মুমিন, কমিন, জমিন )

লিখেছেন সোনাগাজী, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ বিকাল ৫:৩০



যাঁরা মুক্তিযদ্ধ করেননি, মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে লেখা তাঁদের পক্ষে মোটামুটি অসম্ভব কাজ। ১৯৭১ সালের মার্চে, কৃষকের যেই ছেলেটি কলেজ, ইউনিভার্সিতে পড়ছিলো, কিংবা চাষ নিয়ে ব্যস্ত ছিলো, সেই ছেলেটি... ...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। সাংঘাতিক উস্কানি মুলক আচরন

লিখেছেন শাহ আজিজ, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ সন্ধ্যা ৭:০৪



কি সাঙ্ঘাতিক উস্কানিমুলক আচরন আমাদের রাষ্ট্রের প্রধানমন্ত্রীর । নাহ আমি তার এই আচরনে ক্ষুব্ধ । ...বাকিটুকু পড়ুন

একটি ছবি ব্লগ ও ছবির মতো সুন্দর চট্টগ্রাম।

লিখেছেন মোহাম্মদ গোফরান, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ রাত ৮:৩৮


এটি উন্নত বিশ্বের কোন দেশ বা কোন বিদেশী মেয়ের ছবি নয় - ছবিতে চট্টগ্রামের কাপ্তাই সংলগ্ন রাঙামাটির পাহাড়ি প্রকৃতির একটি ছবি।

ব্লগার চাঁদগাজী আমাকে মাঝে মাঝে বলেন চট্টগ্রাম ও... ...বাকিটুকু পড়ুন

×