somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। ‘মুবারকাবাদ বিশ্ববিদ্যালয়’

০২ রা ফেব্রুয়ারি, ২০২৫ রাত ৮:০৯
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :







সাত কলেজ ইস্যুতে রাজধানী উত্তাল সময় পার করছে কদিন। কলেজগুলোর সম্মিলিত শিক্ষার্থীর সংখ্যা প্রায় দুই লাখ। পাশাপাশি শিক্ষক সংখ্যা হবে এক হাজারের বেশি। একটা সময় জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে থাকা এসব কলেজে নিয়মিত ক্লাস হতো না। পরীক্ষা নেওয়ার ক্ষেত্রে বিবিধ জটিলতা আর সময়মতো ফল প্রকাশে গড়িমসি শিক্ষার্থীদের জীবনকে বিপন্ন করেছিল।

তাদের শিক্ষার মান উন্নয়ন আর সেশনজট কমানোর কথা বহু আগে থেকে জোরেসোরে উচ্চারিত হতে থাকে। এমনি পরিস্থিতিতে অগ্রপশ্চাৎ চিন্তা না করে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় আইন লংঘনের মাধ্যমে প্রায় আট বছর আগে এসব কলেজকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীন রাখা হয়। ৮ বছরের পথচলায় তাদের কোনো সমস্যার সমাধান তো হয়নি বরং ভোগান্তি দীর্ঘতর হয়েছে।

জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে থাকা অবস্থায় সাতটি কলেজের যে সমস্যা দৃশ্যমান হয়েছিল সেখানে যুক্ত হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের সীমাহীন 'অবহেলা'। ব্যাপারটা গিয়ে এমন অবস্থানে দাঁড়ায় যে কোনো দম্পতির নিজ সন্তান প্রতিপালনের সক্ষমতা নাই তারা অন্যের সাতটি সন্তানকে অগ্রপশ্চাৎ না ভেবে দত্তক নিয়ে বসে আছে। এর ফলাফল যা হওয়ার তাই হয়েছে।

৫ আগস্ট পরবর্তীকালে নতুন করে উত্তাপ ছড়াতে শুরু করে সাত কলেজ ইস্যু। শিক্ষার্থীরা তাদের নানা দাবি দাওয়া নিয়ে নিয়মিত রাস্তায় নামতে শুরু করে। তারা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ–উপাচার্যের আচরণে আপত্তি জানিয়ে পদত্যাগের দাবিতে বের করে বিক্ষোভ মিছিল। ঢাকা কলেজের মূল ফটকের সামনে তাদের বিরাট বিক্ষোভে টনক নড়ে কর্তৃপক্ষের। তারই পরিপ্রেক্ষিতে রাজধানীর ঐতিহ্যবাহী এই সাতটি সরকারি কলেজের জন্য পৃথক একটি বিশ্ববিদ্যালয় করার পরিকল্পনা হচ্ছে বলে সংবাদ প্রকাশ হয়েছে।

জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় আইন লংঘন করে কোনো সাতটি কলেজকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে নেওয়া হয়েছিল সে প্রশ্নের উত্তর না খুঁজে সম্প্রতি বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন (ইউজিসি) একটি কমিটির মাধ্যমে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে কলেজগুলোকে আলাদা করার কাজ শুরু করছে। ইউজিসি সাত কলেজের শিক্ষার্থীদের সঙ্গে ধারাবাহিকভাবে বৈঠকও চালিয়ে যাচ্ছে। এমনি পরিস্থিতিতে সবথেকে বড় প্রশ্ন হয়ে দেখা দিয়েছে বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে এই সাত কলেজের সম্মিলিত নাম কী হবে?

সাত কলেজের জন্য নতুন বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম হতে পারে 'জুলাই ৩৬ বিশ্ববিদ্যালয়' এই সংবাদ প্রচার হওয়ার পর জনমনে দেখা দেয় মিশ্র প্রতিক্রিয়া। বাস্তবে এই নাম প্রস্তাব করেছে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের (ইউজিসি) চেয়ারম্যান অধ্যাপক এস এম এ ফায়েজের নেতৃত্বাধীন কমিটি। তারা জানিয়েছে শিক্ষার্থীরা চাইলে এই নামটি গ্রহণ করা হতে পারে। আন্দোলনের সঙ্গে মিল রেখে প্রস্তাব করা হলেও এই ঢাকার সাতটি কলেজের জন্য এই নাম কতটা যৌক্তিক না নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে সবার। ঢাকার মধ্যে অবস্থিত সাতটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের নাম কীভাবে 'জুলাই ৩৬ বিশ্ববিদ্যালয়' হবে? এই প্রশ্নের সদুত্তর তারা দিতে পারেন নাই।

ইতিহাস বিশ্লেষণ করতে গেলে আমরা দেখি ঢাকার আদি নামগুলোর একটি ছিল ইকলিম মুবারকাবাদ অন্যটি ছিল জাহাঙ্গীরনগর। প্রাক-মোগল বাংলায় ঢাকার রাজনৈতিক গুরুত্ব কতটা ছিল তা তৎকালীন শিলালিপি থেকে বিশ্লেষণ করা যেতে পারে। ঢাকা নগরীতে প্রাপ্ত দুটি গুরুত্বপূর্ণ শিলালিপির একটি সুলতান নাসিরউদ্দিন মাহমুদ শাহের (১৪৩৬-৫৬ খ্রি.) সময় খোদাই করা। এই শিলালিপির ভাষ্য থেকে অনুমান করা হয় তখনকার ঢাকা ছিল ইকলিম মুবারকাবাদের অন্তর্গত। খুব সম্ভবত স্বাধীন সুলতানি বাংলার সূচনাকারী সুলতান ফখরুদ্দিন মুবারক শাহের নাম সামনে রেখেই পত্তন হয়েছিল এই 'ইকলিম মুবারকাবাদ' নামটি।

যাই হোক ঢাকার ইতিহাসের গুরুত্বপূর্ণ সেই দুটি শিলালিপির প্রথমটি পাওয়া গিয়েছিল নারিন্দা থেকে। সেখানে একটি মসজিদের গায়ে সাঁটানো অবস্থায় লিপিটি পাওয়া গিয়েছিল। দ্বিতীয়টি পাওয়া গিয়েছিল পরিত্যক্ত কেন্দ্রীয় কারাগারের কিছুটা পশ্চিম থেকে। সেখানে গিরিদিকিল্লা নামের মহল্লায় নাসওয়ালাগলি মসজিদ অবস্থিত। এই মসজিদের একটু সামনের একটি তোরণের গায়ে সাঁটানো ছিল লিপিটি। বর্তমানে সেই পুরাতন মসজিদ বা তোরণের কোনো খোঁজখবর নেই। শুরুতে ঢাকা কালেক্টরেটে থাকা সেই লিপিটি বর্তমানে জাতীয় জাদুঘরে সংরক্ষিত।

নারিন্দার থেকে প্রাপ্ত শিলালিপির সূত্রেই জানা গিয়েছে মসজিদটির নির্মাণকাল ৮৬১ হিজরি অর্থাৎ ১৪৫৬-৫৭ সাল। অন্যদিকে নাসওয়ালাগলি থেকে প্রাপ্ত শিলালিপির খোদাইকাল জুন ১৪৫৯ সাল। সময়কাল বিচারে দুটি শিলালিপির খোদাইকারী সুলতান নাসিরউদ্দিন মাহমুদ শাহের সঙ্গে সম্পর্কিত।প্রথম শিলালিপির বক্তব্য অনুযায়ী ব্যক্তিগত উদ্যোগে মসজিদটির নির্মাণ করা হয়েছিল। অন্যদিকে দ্বিতীয় শিলালিপি অনুযায়ী মসজিদের সামনের তোরণ নির্মাণের কথা জানা যায়। সরকারি উদ্যোগে সমকালীন সুলতান নাসিরউদ্দিন মাহমুদ শাহের নাম উত্কীর্ণ করা হয়েছিল সেখানে। সেখানে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা হিসেবে খাজা জাহানের নাম যেমন লেখা হয়েছে। তেমনি মসজিদের নির্মাণ অঞ্চল হিসেবে পাওয়া গিয়েছে 'ইকলিম মুবারকাবাদ' নামটি। বিষয়গুলোর বিস্তারিত আলোচনা পাওয়া যায় গবেষক শামসুদ্দিন আহমদের 'Inscriptions of Bengal' (Vol-IV) গ্রন্থে।

নাসওয়ালাগলি থেকে প্রাপ্ত শিলালিপিটি সরাসরি সরকারি পৃষ্ঠপোষকতার স্বাক্ষী দিচ্ছে।সেখানে সুলতানের নামের সঙ্গে নির্মাতা হিসেবে খাজা জাহানের নাম পাওয়া যায়। যতদূর জানা যায় তুঘলক যুগে দিল্লি থেকে নিয়োগপ্রাপ্ত প্রধান কর্মকর্তা তথা উজিরকে খাজা জাহান উপাধি দেওয়া হতো। অন্যদিকে সুলতানি যুগের প্রাদেশিক শাসনকর্তাদের উপাধিও ছিল এই খাজা জাহান। সে হিসেবে ধরে নেওয়া যেতে পারে বর্তমান ঢাকা তথা তৎকালীন 'ইকলিম মুবারকাবাদের' শাসনকর্তা ছিলেন খাজা জাহান। পাশাপাশি পনেরো শতকে 'ইকলিম মুবারকাবাদের' অংশ হিসেবে বর্তমান ঢাকার একাংশে বিস্তৃত নগরের অস্তিত্ব ছিল এটা ধরে নেওয়া যেতেই পারে।

১৬১০ সালে সুবেদার ইসলাম খান চিশতি ঢাকায় বাংলার রাজধানী স্থানান্তর করেছিলেন্। তিনি মোগল সম্রাট জাহাঙ্গীরের নামানুসারে ঢাকার নামকরণ করেছিলেন জাহাঙ্গীরনগর। ঢাকার অদূরে সাভারে অবস্থিত 'জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়' এখন শিক্ষা-দীক্ষা ও সংস্কৃতি চর্চার কেন্দ্র হিসেবে দেশের মধ্যে সুপরিচিত। সে হিসেবে 'জাহাঙ্গীরনগর' এর বহু আগে 'ইকলিম মুবারকাবাদ' নামে পরিচিত ঢাকায় মুবারকাবাদ বিশ্ববিদ্যালয় নামে আরেকটি বিশ্ববিদ্যালয় থাকা উচিৎ ছিল আরও আগে থেকেই। সম্প্রতি সাত কলেজের নাম নিয়ে যে তর্ক উঠেছে তা সমাধানের সুযোগ রয়েছে এখানেই।

জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়ম মেনে এই সাত কলেজ পূর্বের মতো সেখানে ফিরিয়ে নিয়ে গেলে সব সমস্যার সহজ সমাধান হতে পারে। আর যদি এদেরকে নতুন কোনো বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে গড়ে তোলার চেষ্টা করা হয় সেখানে ঢাকার আদি নাম 'ইকলিম মুবারকাবাদ' থেকেই নামকরণ করা যেতে পারে। আর তখন অবশ্যই সাত কলেজের সম্মিলনে সৃস্ট নতুন বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম হওয়া উচিৎ 'মুবারকাবদ বিশ্ববিদ্যালয়'।


স্টার থেকে
সর্বশেষ এডিট : ০২ রা ফেব্রুয়ারি, ২০২৫ রাত ৮:০৯
৪টি মন্তব্য ৪টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

=আমারও লিখতে ইচ্ছে করে=

লিখেছেন কাজী ফাতেমা ছবি, ১২ ই ফেব্রুয়ারি, ২০২৫ বিকাল ৫:১৩



বইয়ের ঘ্রাণে মাতাল হাওয়া
আমার মনেও দোলা দিয়ে যায়, আমি অবসর খুঁজি
এক ফালি অবসর আমারও চাই,
তোমরা কতটা স্বাধীনতায় গা ভাসিয়ে বই বুকে আঁকড়ে
সুর উঠাও সুখের আর আমি
তোমাদের সুর কলরব... ...বাকিটুকু পড়ুন

জাপানি জীবনদর্শন: ৮টি কার্যকরী টেকনিক

লিখেছেন মাহদী হাসান শিহাব, ১২ ই ফেব্রুয়ারি, ২০২৫ রাত ৮:০৭

এই টেকনিকগুলো প্রতিদিনের জীবনে অনুসরণ করলে জীবনযাপন আরও সহজ হবে।



নিচের এই জাপানি টেকনিকগুলো আমি প্রতিনিয়ত মনে রাখার চেষ্টা করি। সবগুলো একসাথে গুছিয়ে রাখলাম। আশা করি, আপনাদের কাজে লাগবে।

১.... ...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। আ. লীগ নিষিদ্ধে বৈষম্যবিরোধী ছাত্রদের নতুন কর্মসূচি ঘোষণা

লিখেছেন শাহ আজিজ, ১২ ই ফেব্রুয়ারি, ২০২৫ রাত ৮:৫২




আওয়ামী লীগের বিচার ও নিষিদ্ধের দাবিতে সারাদেশে নতুন কর্মসূচি ঘোষণা করেছে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন। আজ বুধবার বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ফেসবুক পেজে এক পোস্টে এই কর্মসূচি ঘোষণা করা... ...বাকিটুকু পড়ুন

সব কিছুরই একটা সাইড ইফেক্ট থাকে...

লিখেছেন অপলক , ১২ ই ফেব্রুয়ারি, ২০২৫ রাত ১০:০৫

অভিনেত্রীদের শরীরের খোলা শহর সকল দর্শকদের জন্যে, আর ঢাকা শহর 'উনাদের' জন্যে। তেনাদের সাথে উনাদের বনিবনা না হলে, তখন সেটা কাস্টিং কাউচ। অত:পর কেউ অন্তরালে চলে যায়, কেউ সময়ের সমান্তরালে... ...বাকিটুকু পড়ুন

ব্লগকতৃপক্ষের দৃষ্টি আকর্ষন করছি।

লিখেছেন সৈয়দ মশিউর রহমান, ১৩ ই ফেব্রুয়ারি, ২০২৫ বিকাল ৩:৫২



আম্লিগের ১৬ বছরের খুন, গুম, হত্যা, ধর্ষণ, চাঁদাবাজী, জমিদখল, নদী দখল, আয়নাঘর, ব্যাংকলুট এবং বিদেশে দেশের টাকা পাচার এমন হেন অপকর্ম নেই যে আম্লিগ করেনি। মানুষের পিঠ যখন দেয়ালে... ...বাকিটুকু পড়ুন

×