somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। জাবি ও জাকসু নিয়ে গোলাম আযমের ছেলের ‘বেদনাবিধুর কাহিনী’

১৭ ই সেপ্টেম্বর, ২০২৫ রাত ৮:৪৭
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :




জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে আমার বেদনাবিধুর কাহিনী ও জাকসু নির্বাচন’ এ শিরোনামে একটি লেখা তার ফেসবুকে পোস্ট করেছেন বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর সাবেক আমির ও ডাকসুর সাবেক জিএস অধ্যাপক গোলাম আযমের ছেলে সালমান আল আযমী।

শনিবার (১৩ সেপ্টেম্বর) রাতে এ পোস্ট করেন তিনি।

--------------------------------------------------------------------------------------------------

পাঠকদের জন্য তার পোস্টটি হুবহু তুলে ধরা হলো-

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে আমার বেদনাবিধুর কাহিনী ও জাকসু নির্বাচন

কদিন আগে ডাকসু নির্বাচন ও ১৯৮২ সালে বোমা হামলায় আহত হওয়া নিয়ে আমার লিখাটি অনেকে শেয়ার করেছেন দেখলাম। আজ যে অভিজ্ঞতা বর্ননা করব তা আমার জীবনের অন্যতম ট্র্যাজেডি ছিল যা আমি কোনদিন ভুলতে পারবোনা, যদিও এর মাধ্যমে আল্লাহ অনেক ভাল কিছু রেখেছিলেন যা আমি পরে বুঝতে পারি।

১৯৮৮ সালের নভেম্বরে আমি জাহাঙ্গীরনগরের ইংরেজী বিভাগে ক্লাস শুরু করি। কিছুদিনের মধ্যেই বুঝতে পারি যে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিটি ছাত্র-ছাত্রী জানত যে আমি অধ্যাপক গোলাম আযমের ছেলে। ইংরেজী বিভাগে একজনেরই দাড়ি ছিল, সে আবার ডিপার্টমেন্টের ক্রিকেট টিমের উইকেটকিপার - সুতরাং আমার চেহারা পরিচিতি পেতে সময় লাগেনি। কয়েকমাসের মধ্যে শুরু হয় বিড়ম্বনা। যেখানেই যেতাম, দেখতাম কেউ না কেউ আমার দিকে তাকিয়ে আছে, অধিকাংশ কৌতুহলী চোখে, কিন্তু কেউ কেউ কট্টর চোখে। ঢাকা যাবার জন্য যখন বসে উঠতাম, তখন প্রায়ই শোনা যেত , ‘গোলাম আযম আব্বাস খান, চলে যাও পাকিস্তান’। কোন কোন বড় ভাই আবার ডেকে নিয়ে কনফার্ম করতেন,

‘এই, এদিকে আস ’

‘জি?’

"তুমি কি গোলাম আযমের ছেলে"

"জি, কিছু বলবেন?"

"না, যাও"...

তবে কেউ গায়ে আঘাত বা সরাসরি অপমান করেনি দূরে থেকে টিটকারী মারা ছাড়া। আমার ক্লাসমেটরা মাঝে মাঝে বলত, "তুই এক কাজ কর, গলায় একটা সাইনবোর্ড লাগা এই বলে যে, 'হ্যা, আমি গোলাম আযমের ছেলে, প্লিজ আমার দিকে এভাবে তাকাবেন না, আমি বিব্রত বোধ করি'"।

তখন শিবির সেখানে প্রকাশ্য রাজনীতি করত। কিন্তু আমি ক্যাম্পাসে থাকতাম না এবং সেখানে কোন রাজনীতির সাথে জড়িত ছিলামনা। শিবিরের সাথে আমার সম্পর্ক ছিল সাংস্কৃতিক কার্যক্রমে। যখন ভর্তি হই তখন আমি সাইমুম শিল্পী গোষ্ঠীর সহকারী পরিচালক ছিলাম এবং ১৯৮৯ সালের মার্চ/এপ্রিলে পরিচালকের দায়িত্ব গ্রহণ করি। তারপরও আমাকে সর্বদা সেই তীর্যকদৃষ্টি সহ্য করতে হত।

একদিন আব্বাকে বললাম যে, মাঝে মাঝে আমি খুব নিরাপত্তাহীনতায় ভুগি। আব্বা দুটি দোয়া পড়তে বললেন, "হাসবুনাল্লাহি নি'মাল ওয়াকিল, নি'মাল মাওলা ওয়া নি'মান নাসির" ও "রাব্বি আউযুবিকা মিন হামদাতিস শায়াতিন" ।

এভাবেই ১৯৮৯ সালের আগস্ট মাসের মাঝামাঝি এসে গেল। তারিখটি মনে নেই, তবে আমাদের ফার্স্ট ইয়ার ফাইনাল পরীক্ষার দু সপ্তাহ আগে হবে। যথারীতি শান্তিনগর থেকে বাসে উঠেছি। উঠেই শুনলাম আগের রাতে শিবিরের সাথে ছাত্রদলের গন্ডগোল হয়েছে। আমার ক্লাসমেট, যার সাথে প্রতিদিন যাতায়াত করতাম, আমাকে পরামর্শ দিল ক্যাম্পাসে না যেতে। আমি বললাম যে সবাই তো জানে আমি ক্যাম্পাসে থাকিনা, তাই কোন সমস্যা হওয়ার কারণ আমি দেখছিনা। কিন্তু আমার সে বন্ধুটি সে সময় বেশ বিচক্ষণতার পরিচয় দিল এবং এক প্রকার জোর করে মগবাজারে নামিয়ে দিল। পরে বিকেলে সে আমাকে বলল যে সেদিন বিশ্ববিদ্যালয়ে বাস প্রবেশের সময় প্রতিটি বাসে তারা আমাকে খুঁজেছে।

এর পর আর কোনদিন ক্যাম্পাসে যেতে পারিনি। তথাকথিত সব প্রগতিশীল ছাত্র সংগঠন মিলে ক্যাম্পাসে শিবিরকে নিষিদ্ধ করল এবং ১৮ জনের লিস্ট করল যাদের আর ক্যাম্পাসে ঢুকতে দেয়া হবেনা। ক্যাম্পাসে থাকতামনা বলে আমার নাম সেই লিস্টে ছিল না, কিন্তু তাই বলে সেখানে প্রবেশ করার কোন উপায় আমার ছিলনা। অনেকদিন পর একজনকে দিয়ে আমাকে জানানো হল যে, আমি যদি প্রকাশ্যে ঘোষণা করি যে শিবিরের সাথে আমার কোন সম্পর্ক নেই, তবে আমি আমার পড়াশুনা চালিয়ে নিতে পারব। কিন্তু আমি সে ফাঁদে পা দেইনি।

এভাবেই আমার জীবন থেকে দুটি বছর চলে যায়। বেশ কিছুদিন চলে যায় আশায় আশায় যে আমি আবার পড়াশুনায় ফিরতে পারব। তা যখন হলনা, তখন ভীষণ হতাশ হয়ে পড়লাম। কি করব বুঝে উঠতে পারছিলামনা। উপায় না দেখে বিদেশে চেষ্টা করতে লাগলাম কারণ বুঝতে পারলাম যে দেশের কোন বিশ্ববিদ্যালয়ে এই পিতৃপরিচয়ে পড়তে পারব না। কিন্তু প্রথমেই ধাক্কা খেলাম। ইংল্যান্ডে চেষ্টা করলাম, কিন্তু ভিসা পেলাম না। এরপর পাকিস্তানের আন্তর্জাতিক ইসলামী বিশবিদ্যালয় ও আলীগড় মুসলীম বিশ্ববিদ্যালয়ে আবেদন করলাম, এবং দুটি থেকেই অফার পেলাম। অনেকে পরামর্শ দিলেন পাকিস্তানে যেতে, কিন্তু পাকিস্তানী গালি আমরা এত খেতাম যে আবার সেই পাকিস্তানে গিয়ে এই গালিকে পাকাপোক্ত করার চেয়ে আলীগড়ে যাবার সিদ্ধান্তই নিলাম। এর আরেকটি কারন ছিল যে আমার পাড়ার এক বন্ধু তখন সেখানে পড়ত, এবং একবার আমি আলীগড় ঘুরে এসে তা এত ভাল লাগল যে সেখানেই পড়ার সিদ্ধান্ত নিলাম।

আল্লাহ যা করেন অবশ্যই ভালর জন্য করেন। জাহাঙ্গীরনগরের ইংরেজী বিভাগের বেশিরভাগ শিক্ষক ছিলেন কড়া বামপন্থী। ভাল রেজাল্ট করতে পারতাম কিনা জানিনা। তাছাড়া যে আগ্রহ নিয়ে ইংরেজী সাহিত্য নিয়েছিলাম, তা এতটা enjoy করছিলামনা। আলীগড়ে Linguistics এ ভর্তি হলাম এবং তৎক্ষণাৎ এ সাবজেক্টের প্রেমে পড়ে গেলাম। বাকীটা ইতিহাস। যারা জানেননা, অন্য কোনদিন বলা যাবে।

আজ ৩৬ বছর পর সেই জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র সংসদ নির্বাচনের ২৫ পদের মধ্যে ২০টি পদ এখন ছাত্রশিবিরের প্যানেল সদস্যদের হাতে। এটা কি ভাবা যায়? কোনদিন কি কল্পনাও করতে পেরেছি ? বামপন্থীদের স্বর্গরাজ্য হিসেবে পরিচিত এই ক্যাম্পাসের সিনেট ভবনে আজ ফলাফল ঘোষণার সময় যখন 'আল্লাহু আকবর' ধ্বনী উচ্চারিত হচ্ছিল, আমার লোম তখন দাঁড়িয়ে গিয়েছিল। খুবই আবেগপ্রবন হয়ে গিয়েছিলাম। একেই বলে poetic justice! আল্লাহ কি না পারেন। জুলাই বিপ্লবের সেই শহীদ ও আহতদের আত্মত্যাগের মাধ্যমে নতুন বাংলাদেশের ছাত্র রাজনীতিতে আল্লাহ এক নতুন দিগন্ত উন্মোচন করেছেন। এই অগ্রযাত্রা ইনশা আল্লাহ থামবেনা। সামনেই আসছে রাকসু ও চকসু। আল্লাহ যেন এ সাফল্য অব্যাহত রাখেন।

বিজয়ীদের অভিনন্দন! তোমরা মনে রাখবে সেই গুরুত্বপূর্ণ প্রবাদবাক্য - "স্বাধীনতা অর্জনের চেয়ে স্বাধীনতা রক্ষা করে কঠিন" । তোমাদের উপর যে আমানত অর্পিত হয়েছে, তা রক্ষা করা এখন তোমাদের ঈমানী দায়িত্ব। তোমরা এখন আর ছাত্রশিবিরের প্রতিনিধি নও, প্রায় ১২ হাজার ছাত্র-ছাত্রীদের প্রতিনিধিত্বকারী। আল্লাহ তোমাদের সেই দায়িত্ব পালনে তৌফিক দান করেন এই দোয়া করি।

সালমান আল আযমী

সর্বশেষ এডিট : ১৮ ই সেপ্টেম্বর, ২০২৫ সকাল ৯:৪৪
৪টি মন্তব্য ৩টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

আওয়ামী লীগের পাশাপাশি জামায়াতে ইসলামীকেও নিষিদ্ধ করা যেতে পারে ।

লিখেছেন সৈয়দ কুতুব, ০৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ১২:৪৫


বাংলাদেশে আসলে দুইটা পক্ষের লোকজনই মূলত রাজনীতিটা নিয়ন্ত্রণ করে। একটা হলো স্বাধীনতার পক্ষের শক্তি এবং অন্যটি হলো স্বাধীনতার বিপক্ষ শক্তি। এর মাঝে আধা পক্ষ-বিপক্ষ শক্তি হিসেবে একটা রাজনৈতিক দল... ...বাকিটুকু পড়ুন

J K and Our liberation war১৯৭১

লিখেছেন ক্লোন রাফা, ০৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ৯:০৯



জ্যাঁ ক্যুয়ে ছিলেন একজন ফরাসি মানবতাবাদী যিনি ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তান ইন্টারন্যাশনাল এয়ারলাইন্সের একটি বিমান হাইজ্যাক করেছিলেন। তিনি ৩ ডিসেম্বর, ১৯৭১ তারিখে প্যারিসের অরলি... ...বাকিটুকু পড়ুন

এবার ইউনুসের ২১শে অগাষ্ঠ ২০০৪ এর গ্রেনেড হামলার তদন্ত করা উচিৎ

লিখেছেন এ আর ১৫, ০৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ৯:৪০



এবার ইউনুসের ২১শে অগাষ্ঠ ২০০৪ এর গ্রেনেড হামলার তদন্ত করা উচিৎ


২০০৪ সালের ২১ শে অগাষ্ঠে গ্রেনেড হামলার কারন হিসাবে বলা হয়েছিল , হাসিনা নাকি ভ্যানেটি ব্যাগে... ...বাকিটুকু পড়ুন

বাংলাদেশের রাজনীতিতে নতুন ছায়াযুদ্ধ: R থেকে MIT—কুয়াশার ভেতর নতুন ক্ষমতার সমীকরণ

লিখেছেন এস.এম. আজাদ রহমান, ০৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ দুপুর ১২:৪৪



বাংলাদেশের রাজনীতিতে নতুন ছায়াযুদ্ধ: R থেকে MIT—কুয়াশার ভেতর নতুন ক্ষমতার সমীকরণ

কেন বিএনপি–জামায়াত–তুরস্ক প্রসঙ্গ এখন এত তপ্ত?
বাংলাদেশের রাজনীতিতে দীর্ঘদিন ধরে একটি পরিচিত ভয়–সংস্কৃতি কাজ করেছে—
“র”—ভারতের গোয়েন্দা সংস্থা নিয়ে রাজনীতিতে গুজব,... ...বাকিটুকু পড়ুন

নিশ্চিত থাকেন জামায়েত ইসলাম এবার সরকার গঠন করবে

লিখেছেন সূচরিতা সেন, ০৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ৯:৪২


আমাদের বুঝ হওয়ার পর থেকেই শুনে এসেছি জামায়েত ইসলাম,রাজাকার আলবদর ছিল,এবং সেই সূত্র ধরে বিগত সরকারদের আমলে
জামায়েত ইসলামের উপরে নানান ধরনের বিচার কার্য এমন কি জামায়েতের অনেক নেতা... ...বাকিটুকু পড়ুন

×