somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। অচেনা স্বজন

২৫ শে সেপ্টেম্বর, ২০২৫ সকাল ১১:২৮
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :



আমি পুরো বাজারটি ঝাড়া দু ঘণ্টা ঘুরলাম উদ্দেশ্যবিহীন ভাবে। বাজারটির গা ঘেসে পুরাতন দুতাবাস এলাকার শুরু। দিল্লিতে ফলের রস সস্তা । বেশ ঠাণ্ডা ফ্রেশ রস খেলাম । কাপড় , খাবার , নকশি করা নানা জিনিস পত্র দেখলাম খুঁটিয়ে । ঘড়ি দেখলাম , নাহ মনে হয় এত তাড়াতাড়ি শমশের তার বাসায় ফিরেছে। আরও একটু সময় কাটাই , এছাড়া আর কিছুই করার নেই এই ছোট খোলা বাজারে। চারিদিকে সুস্বাদু খাবারের ছড়াছড়ি কিন্তু শমশেরের বাসায় আমার রাতের দাওয়াত । ঠাণ্ডা বিয়ার খেতে চাইলেও খাওয়া হচ্ছেনা শমশেরের ধার্মিক স্বভাবের কারনে । ও জানে সেই পিকিং জীবন থেকে যে আমি তরলে অভ্যস্ত । বরং হোটেলে রাখা বোতল খাব ফিরে গিয়ে। একদিকে দাড়িয়ে সিগারেট খেলাম আর তাকিয়ে তাকিয়ে নানা কিসিমের ভারতীয় মানুষের মুখ মুখস্থ করলাম। সবই প্রায় আর্য এবং তারা ফর্সা চামড়ার । খুব মোটা সোটা রমণীরা টাইট জামা পরে যেহারে ভাজাপোড়া খাচ্ছে , আমার মনটা বেশ তাজা হয়ে উঠল সুন্দরীদের লিপস্টিক বাচিয়ে কি কৌশলে লুচি গুজে দিচ্ছে সুন্দর মুখের অভ্যন্তরে। আমার চাহনিতে নৈরাজ্য বা নির্লজ্জতা বলে কিছু নেই ।
একটা সিগারেট ধরালাম । পুরাতন দিল্লী থেকে স্কুটারে আসতে আসতে খেয়াল করলাম নতুন দিল্লীর এদিকটা অনুচ্চ ভবন ঘেরা আবাসিক এলাকা। গাছপালা এত যে ভাল লেগে যাবে যখন তখন । মোহাজির কলোনি খুব প্লান করে বানিয়েছে ওরা। মোহাজির তারা যারা ৪৭ সালে পাকিস্তান ছেড়ে ভারত এসেছিল , এরা সবাই হিন্দু । ভেতরের বাগান আর পার্ক দেখে মুগ্ধ আমি। প্রত্যেকেরই তিন তালা বাড়ি , ইচ্ছা খুশি মত বাড়ানোর উপায় নেই। কাছেই মেইন রোডের পাশেই বাংলাদেশ দুতাবাস । শমশেরের একটি সান্ধ্যকালীন দাওয়াত থাকায় সে আমায় টিভির সামনে বসিয়ে দিয়ে যেতে চাইল, বলল রাত আটটার মধ্যেই তারা ফিরছে। আমি বললাম আমি টিভিতে খুব আসক্ত নই । মার্কেট আছে কোথাও কাছে পিঠে ? অতঃপর আমি এই একদম অপরিচিত একখানে সময় কাটাচ্ছি।
হুম এবার কথা মত রিকশা নিতে হয়। এই অজানা বিশাল এলাকায় রিকশা চলে তবে মেইন রোডে নয়। শমশের আমায় বলেছে এলাকাটি নির্জন এবং ছিনতাইয়ের প্রকোপ আছে বিশেষ করে বিদেশী পেলে।
সারি দিয়ে কিছু রিকশা দাড়িয়ে। দিল্লিওয়ালারা দরদাম করেনা । কিন্তু আমায় তো করতে হবে ।
আমি চেহারা দেখে পরখ করে ভাবছি কোনটা ভাল আর কোনটা ডাকু !
হটাত চিকন গলায় ডাক “ আইয়ে সাব, কাহা চলেঙ্গে আপ?”
আমি ওকে একনজরে বিশ্বাস করে ফেললাম । ৬ রুপিতে সাব্যস্ত হল । মানিব্যাগ মোজার মধ্যে চালান করে দিলাম।
সিগারেট ধরালাম একটা। ডানদিকে একটা মরা খাল আর বা দিকে ব্রিটিশ আমলে তৈরি দুতাবাসের সারি । রাস্তাটি বেদম অন্ধকার এবং কোন মানুষকে দেখা গেলনা মায় কি দুতাবাসের গেটে পর্যন্ত । দুতাবাসগুলির ভেতরের আলো কিছুটা আলো দিচ্ছে মাঝে মধ্যে । ভৌতিক অবস্থা একেবারে । মরা খালে নোংরা কালচে পানি এবং গাছপালা দিয়ে ঘেরা।
ছেলেটির সাইজ রিকশার জন্য অনুপযুক্ত । ও একবার ডানে একবার বায়ে নেমে প্যাডেল মারছে।
হটাত নীরবতা ভেঙ্গে ছেলেটি শুরু করল “স্যার , আপ টুরিস্ট হ্যায়”?
সতর্ক হলাম , এতো দুর্বল লাইনে এগুচ্ছে । হ্যা , জবাব দিলাম।
“এক বাত পুছুঙ্গা স্যার, আগার আপ নারাজি না হো ?”
‘নেহি , পুঁছো ‘ ।
“আপ কাইকা হ্যায়?”
এবার আমি চুপ , প্রমাদ গুনছি, পেছনে তাকালাম , সামনেও , কেউ কোথাও নেই ।
আমি একটু গম্ভীর গলায় জিজ্ঞাসা করলাম ‘ কিউ পুছ রাহি হো ‘?
“অ্যায়সাই স্যার”।
“বাংলাদেশ , পেহচান্তে হো ” ।
সে বরিশালের স্থানীয় ভাষায় হইচই লাগিয়ে দিল । পেছন ফিরে সে খুশি প্রকাশ করছে। আমি তাকে ধরে মুখ সামনে ঘুরিয়ে দিলাম যদি খালে নেমে যায় !!
বললাম ধীরে ধীরে চালাও এবং কথা বলো ।
“আপনারে বাজারে ঘোরতে দেইখা আমার শন্দ হইছে এই মানুষ এদ্যাশের না , বাঙ্গালিই হইবে”।
‘তা তোমার বাড়ি মানে দেশের বাড়ি কোথায়?’
“খুলনায়।“
প্রচণ্ড ধাক্কা খেলাম ।
“৭ নং ঘাটে, এরশাদ শিকদারের নাম হোনছেন”।
আমি ওই আলাপে না গিয়ে শুধোলাম ‘দিল্লী কবে এলে ?’
“ যখন ছয়মাস বয়স তহন মা বাপে লইয়া আইছে। “
‘দেশে গেছো কখনো ? ‘
“একবারও না , যাইতে ইচ্ছে করলেই তো যাওন যাইবেনা , পাসপোর্ট , ভিসা এইসব ভ্যাজাল কইরা আর সয়না, তয় আমাগো দেশি লোক এইহানে অনেক, রিকশা চালায় ,ইটা বাঙ্গে ,সাইটের কামে খাডে। সব্জির যতো দোকান দ্যাখবেন ব্যাবাক বাঙ্গালী কিন্তু আপনার লগে প্রকাশ হইবে না“।
‘তা তোমার বাবা কি করেন?’
“সবজি ব্যাচা কেনা করত, মা মাইনসের বাসায় কামে খাডে, বাপেরে ব্যামোয় ধরলে পর পুজি দিয়া রিকশা কিন্যা দিল বাকি লোকেরা । যা আয় অয় তা দিয়া বস্তি ভাড়া , খাওন দাওন অইয়া যায় । স্যার দোয়া করেন আরেকটু ডাঙ্গর হইয়া বেবী টেক্সি কিনমু , বাপের ঔষধ খরচা উইডা যাইবে “।
আমি স্তব্ধ এবং বাকহীন । একটা অপরাধবোধ কাজ করছে মাথার মধ্যে ।
আমরা বাংলাদেশ মিশনের কাছে রাস্তা সংলগ্ন খালি জায়গায় গল্প করছি । ও নিচে বসে আর আমি রিকশায় হেলান দিয়ে। আমার পানির বোতল থেকে দুহাত পেতে পানি খেলো, দরদর করে ঘামছে জুনের প্রচণ্ড গরমে ।
ওকে দশ রুপির যতো নোট আছে দিয়ে দিলাম আর বললাম মাত্র ১২ বছর বয়সে তুমি মা বাপকে কামাই করে খাওয়াচ্ছ ,তুমি একদিন বড় হবে এবং তোমার অনেক টাকা হবে কারন তুমি পরিশ্রমী ।
“স্যার , আবার দিল্লী আইলে এইখানে আইসেন, আমারে পাইবেন, জিগাইবেন বিল্লালের রিকশা কোনহানে?’
বিল্লাল কে দুটো ফল আর পানির বোতলটা দিয়ে দিলাম , বললাম , যাও এখনও হয়ত দু একজনকে বাজারে পাবে।
আমি ব্যাথিত, বিস্ময় ভরা এক অপরিচিত পৃথিবীর পথে পা বাড়ালাম।।
*********

১৯৯৬ সালে দিল্লিতে ।।


সর্বসত্ত্ব সংরক্ষিত ।। শাহ আজিজ
সর্বশেষ এডিট : ২৫ শে সেপ্টেম্বর, ২০২৫ সকাল ১১:৩২
৪টি মন্তব্য ৪টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

আওয়ামী লীগের পাশাপাশি জামায়াতে ইসলামীকেও নিষিদ্ধ করা যেতে পারে ।

লিখেছেন সৈয়দ কুতুব, ০৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ১২:৪৫


বাংলাদেশে আসলে দুইটা পক্ষের লোকজনই মূলত রাজনীতিটা নিয়ন্ত্রণ করে। একটা হলো স্বাধীনতার পক্ষের শক্তি এবং অন্যটি হলো স্বাধীনতার বিপক্ষ শক্তি। এর মাঝে আধা পক্ষ-বিপক্ষ শক্তি হিসেবে একটা রাজনৈতিক দল... ...বাকিটুকু পড়ুন

J K and Our liberation war১৯৭১

লিখেছেন ক্লোন রাফা, ০৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ৯:০৯



জ্যাঁ ক্যুয়ে ছিলেন একজন ফরাসি মানবতাবাদী যিনি ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তান ইন্টারন্যাশনাল এয়ারলাইন্সের একটি বিমান হাইজ্যাক করেছিলেন। তিনি ৩ ডিসেম্বর, ১৯৭১ তারিখে প্যারিসের অরলি... ...বাকিটুকু পড়ুন

এবার ইউনুসের ২১শে অগাষ্ঠ ২০০৪ এর গ্রেনেড হামলার তদন্ত করা উচিৎ

লিখেছেন এ আর ১৫, ০৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ৯:৪০



এবার ইউনুসের ২১শে অগাষ্ঠ ২০০৪ এর গ্রেনেড হামলার তদন্ত করা উচিৎ


২০০৪ সালের ২১ শে অগাষ্ঠে গ্রেনেড হামলার কারন হিসাবে বলা হয়েছিল , হাসিনা নাকি ভ্যানেটি ব্যাগে... ...বাকিটুকু পড়ুন

বাংলাদেশের রাজনীতিতে নতুন ছায়াযুদ্ধ: R থেকে MIT—কুয়াশার ভেতর নতুন ক্ষমতার সমীকরণ

লিখেছেন এস.এম. আজাদ রহমান, ০৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ দুপুর ১২:৪৪



বাংলাদেশের রাজনীতিতে নতুন ছায়াযুদ্ধ: R থেকে MIT—কুয়াশার ভেতর নতুন ক্ষমতার সমীকরণ

কেন বিএনপি–জামায়াত–তুরস্ক প্রসঙ্গ এখন এত তপ্ত?
বাংলাদেশের রাজনীতিতে দীর্ঘদিন ধরে একটি পরিচিত ভয়–সংস্কৃতি কাজ করেছে—
“র”—ভারতের গোয়েন্দা সংস্থা নিয়ে রাজনীতিতে গুজব,... ...বাকিটুকু পড়ুন

নিশ্চিত থাকেন জামায়েত ইসলাম এবার সরকার গঠন করবে

লিখেছেন সূচরিতা সেন, ০৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ৯:৪২


আমাদের বুঝ হওয়ার পর থেকেই শুনে এসেছি জামায়েত ইসলাম,রাজাকার আলবদর ছিল,এবং সেই সূত্র ধরে বিগত সরকারদের আমলে
জামায়েত ইসলামের উপরে নানান ধরনের বিচার কার্য এমন কি জামায়েতের অনেক নেতা... ...বাকিটুকু পড়ুন

×