somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

ছোটগল্পঃ রফিকের ভালবাসা দিবস

১৫ ই ফেব্রুয়ারি, ২০১৫ বিকাল ৪:৫০
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

-খবরদার, আমার মোবাইলে হাত দিবি না।
-বন্ধু এমুন করছ ক্যান? ইকটু খালি ছুইয়া দেখমু।
-না না। মাত্র কিনছি মোবাইলডা। এক্কেরে ধরবি না কইয়া দিলাম।

সাতসকালে রিকশা নিয়ে বের হয়ে প্রথমেই মোড়ের কুতুব মিয়ার চায়ের দোকানে বসে এক কাপ চা খাওয়াটা রফিকের অভ্যাস। আজও তার ব্যতিক্রম হয়নি। রাস্তায় এখনও লোকজন বের হয়নি তেমন একটা, শুধু অফিসযাত্রী কিছু ব্যস্ত মানুষ ছাড়া। দোকানের পাশে দাঁড়িয়ে থাকা রফিকের রিকশাটা দেখে কয়েকজন জিজ্ঞেস করে গেছে, সে যাবে কি না। কিন্তু চা শেষ করার আগে রফিক উঠতে চাইছে না।
আজ কুতুব মিয়ার দোকানে বসেই প্রথম যে জিনিসটা রফিকের চোখে পড়ল সেটা হচ্ছে চকচকে একটা নতুন মোবাইল ফোন। তারস্বরে বাংলা সিনেমার গান বাজছে সেখানে। এক হাতে আলতো করে মোবাইলটা ধরে রেখেছে কুতুব মিয়া, আরেক হাতে চা বানাচ্ছে। ব্যস্ততা বেড়ে গেলে মোবাইলটা পাশে রেখে দিল। রফিক মোবাইলটা একটু ধরে দেখতে যেতেই ঝাড়ি দিয়ে উঠল কুতুব মিয়া।
-হুমুন্দির পো, হাত সরা।

কুতুব মিয়াকে নিজের বন্ধু বলেই ভাবত রফিক। আজ সেই কুতুবের মুখে সামান্য একটা মোবাইলের জন্য গালি শুনতে হল তাকে! অভিমান করে চা পুরোটা শেষ না করেই উঠে দাঁড়াল সে। রিকশায় উঠে জোরে জোরে প্যাডেল মারতে মারতে কুতুব মিয়ার দোকানের সামনে থেকে সরে এল।

একটা মোবাইলের শখ রফিকের অনেক দিন ধরে। কিন্তু তার সীমিত উপার্জনে পেটের ভাত যোগানোই কঠিন হয়ে যায়, তার উপর দেশের বাড়িতেও মাসের শেষে কিছু টাকা পাঠানোই লাগে। মোবাইলের শখটা তাই আর বাস্তবে পরিণত হয়নি।

আজ খুব সম্ভব বিশেষ কোন দিন। রিকশা নিয়ে রাজপথে উঠে এসেছে রফিক। দেখল, রাস্তায় কমবয়েসী ছেলেমেয়েরা লাল হলুদ রঙের শাড়ি আর পাঞ্জাবী পরে ঘুরে বেড়াচ্ছে। সবার মুখে হাসি। মেয়েরা সুন্দর করে সেজেছে, কারও কারও মাথায় ফুল দিয়ে তৈরি মালার মত একটা জিনিস। মোড়ের মাথায় রিকশা থামাতে না থামাতেই এক জোড়া ছেলেমেয়ে এগিয়ে এল তার দিকে। নিজেদের ভেতর হাসতে হাসতে কি যেন বলাবলি করছে। রফিক যে ভাড়া বলল তাতেই রাজি হয়ে রিকশায় উঠে বসল দুজন।

চারদিকে উৎসব উৎসব আবহাওয়া রফিকের মনেও রঙ লাগিয়েছে। গুন গুন করে একটু আগে শুনে আসা গানের কলি ভাজতে ভাজতে প্যাডেলে চাপ দিল সে। ছেলেমেয়ে দুটোর কথা শুনে বুঝতে পারল আজ পহেলা ফাল্গুন। ফাল্গুন নামে একটা বাংলা মাস আছে এটা সে জানে। তবে সেই মাসের প্রথম দিনটা এইভাবে আনন্দ করার কারণ তার মাথায় ঢুকল না। পহেলা বৈশাখের মত কিছু একটা হবে হয়তো, ভাবল সে।
যাত্রী দুজনের আরও কিছু কথা বার্তা কানে আসল তার। কাল নাকি ভালবাসা দিবস? এর মানে কি সেটা সে অল্প অল্প জানে। কুতুব মিয়া একদিন তাকে কথায় কথায় বলেছিল, ঢাকা শহরে রিকশাওয়ালাদের তিন নম্বর ঈদ হচ্ছে ভালবাসা দিবস। এইদিন সবার মন মেজাজ থাকে ফুরফুরে, ডাবল ভাড়া দিতেও কেউ দ্বিধা বোধ করে না। তবে সেটা অবশ্যই সাথে ভালবাসার মানুষটা থাকলে।

তাহলে কালকেই সেই ভালবাসা দিবস? ভালবাসার মানুষকে পাশে নিয়ে রিকশায় ঘুরে বেড়ানোর দিন? বুকের মধ্যে কেমন জানি করে উঠল রফিকের। তার বুকের ভেতর খুব খুব গভীরে একটা স্বপ্ন লুকিয়ে রেখেছে সে। স্বপ্নটায় সে তার রিকশায় একটা লাজুক বালিকাকে নিয়ে পুরো ঢাকা শহর টহল দিয়ে বেড়ায়। মেয়েটা মাঝে মাঝে তার বেপরোয়া রিকশা চালানো দেখে ভয়ে আঁতকে ওঠে, তখন রফিক হা হা করে হেসে উঠে আরও জোরে প্যাডেল মারে। স্বপ্নটায় নিজের রিকশাকে ছোটবেলায় দাদীর মুখে শোনা গল্পের পঙ্খীরাজ ঘোড়া বলে মনে হয় তখন।

পরদিন সকালবেলায় রফিক একটু সকাল সকাল বের হল। যদিও তার স্বপ্নে দেখা সেই ভালবাসার মানুষটার দেখা এখনও মেলেনি, কিন্তু তবুও একটু একটু উত্তেজনা বোধ করছে সে। মানুষকে ভালবাসতে দেখতেও আসলে ভাল লাগে!

কুতুব মিয়ার চায়ের দোকানের সামনে রিকশা থামাল সে। তারপর কুতুবকে বলল, একটা চা দেও বন্ধু। লগে একটা বাটার বন।
চোখ সরু করে তাকাল কুতুব মিয়া। বলল, তর চায়ের বিল তিনশ টাকা বাকি পইড়া গেছে। আগে টেকা দে, তারপরে বাটার বন খা।
-আরে বন্ধু, টেকা টেকা কর ক্যান এত? বাটার বন তো বাকি খামু না তোমার কাছে, টেকা দিয়াই খামু। দেও দেও।
মুখ বিরস করে পলিথিন থেকে একটা বাটার বন বের করে দেয় কুতুব মিয়া। তারপর বলে, দোকানের সামনে বইয়া থাক। আমি পানি নিয়া আসি। বলে চুলা থেকে কেটলীটা তুলে নিয়ে দোকান থেকে বেরিয়ে যায়।

রফিক বাটার বনে প্রথম কামড় বসাতে না বসাতে একটা জিনিস খেয়াল করে। কুতুব মিয়া তার মোবাইলটাকে দোকানে রেখেই বেরিয়ে গেছে। চার্জারে লাগানো রয়েছে মোবাইলটা, সেজন্যেই রেখে গেছে বোধহয়। হঠাৎ তার মাথায় একটা চিন্তা উঁকি দিল। মোবাইলটা আজ সঙ্গে নিয়ে গেলে কেমন হয়? কুতুব মিয়া ধুমসে গালিগালাজ দেবে, তবে সেটা পরে দেখা যাবে। আজকের দিনে হাতে একটা মোবাইল থাকলে তার ভাবটা কোথায় গিয়ে ঠেকবে সেটা চিন্তা করেই তার মনটা খুশি হয়ে গেল হঠাৎ।

এদিক ওদিক একবার তাকাল রফিক। তারপর আস্তে করে মোবাইলটা খুলে নিয়ে শার্টের পকেটে ভরে ফেলল। দুই কামড়ে বাটার বন শেষ করে রিকশাটা টান দিয়ে নিয়ে বেরিয়ে গেল গলি থেকে।

সারাটা দিন রফিকের দারুণ আনন্দে কাটল। অন্যান্য দিনের চাইতে দ্বিগুন ইনকাম হয়েছে আজ। তাছাড়া যখনই সুযোগ পেয়েছে মোবাইলটা বের করে গান শুনেছে। আশেপাশের রিকশাওয়ালারা যখন তার দিকে তাকাচ্ছিল তখন দারুণ লাগছিল তার। তার উপর যখন একটা মেয়ে তার রিকশায় উঠে হেসে বলল, বাহ মামা, আপনার গানের রুচি তো খুব সুন্দর! তখন তো বলতে গেলে আনন্দে নেচেই উঠেছিল সে!

বিকেলবেলা থেকে একটা মেয়ে উঠল তার রিকশায়। মেয়েটাকে দেখে কিছুক্ষণ হা করে তাকিয়ে ছিল রফিক। মানুষ কোনদিন এত সুন্দর হয়? এতদিন তার স্বপ্নে রিকশায় বসে থাকা মেয়েটার মুখ দেখতে পেত না সে, কেমন জানি ঝাপসা লাগত। কিন্তু এই মেয়েটাকে দেখার পর তার মনে হল, চাইলেও এখন বোধহয় আর কারও মুখ সে কল্পনা করতে পারবে না। মেয়েটা রিকশায় উঠে বসতেই মোবাইলে বাজতে থাকা গানটা বন্ধ করে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল সে, তারপর প্যাডেল মারতে শুরু করল।

মেয়েটা একটু পর পরই কার সাথে যেন ফোনে কথা বলছে। কি বলছে কান পেতে একটু শোনার চেষ্টা করল রফিক। কারও সাথে ঝগড়া করছে বলে মনে হল। নিশ্চয়ই মেয়েটার ভালবাসার মানুষ। আজকের দিনেও কিসের ঝগড়া ওদের? আরেকটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসতে চাইল রফিকের বুক থেকে। তারপর নিজেই লজ্জা পেল সে। কোথায় সে আর কোথায় এই মেয়ে!

হঠাৎ মেয়েটার ডাকে চমক ভাঙল তার। তাকে থামতে বলছে মেয়েটা। জায়গাটা একটা গলির সামনে, রিকশা ঢুকবে না ভেতরে। রফিক রিকশা দাঁড় করাতেই মেয়েটা নেমে দাঁড়িয়ে আবার ফোন বের করল। কাকে যেন ফোন করবে, কিন্তু কানে ঠেকিয়েই বলে উঠল, ধুর! ব্যালেন্স শেষ হওয়ার আর সময় পেল না!

এদিক ওদিক তাকাল মেয়েটা, যেন কি করবে বুঝতে পারছে না। তারপর হঠাৎ রফিকের দিকে তাকাল। মামা, মোবাইল আছে না আপনার কাছে? দেখি, দেন তো একটু?

রফিক কিছুটা হকচকিয়ে গেল। মেয়েটা কি তার কাছে সাহায্য চাইছে? আজ সকালে কার মুখ দেখে ঘুম থেকে উঠেছিল সে? তাড়াতাড়ি করে শার্টের পকেট থেকে মোবাইলটা বের করে দিল।

মেয়েটা একটা নাম্বার ডায়াল করে কাকে যেন ফোন করল। তারপর বলল, ইশশ, নেটওয়ার্ক পাচ্ছে না কেন? মোবাইলটা কানে ঠেকিয়ে এদিক ওদিক হেঁটে বেড়াচ্ছে সে। হাঁটতে হাঁটতে গলির ভেতর ঢুকে পড়ল।

রফিক বসেই থাকল রিকশায়। মেয়েটাকে গলির ভেতর হারিয়ে যেতে দেখে একবার ডাক দিতে চাইল সে, কিন্তু গলা দিয়ে কোন শব্দ বের করতে পারল না। সে কি রিকশা রেখে মেয়েটার পিছন পিছন যাবে? এই রাস্তা তার চেনা নয়, অচেনা রাস্তায় রিকশা রেখে যেতেও ভরসা হচ্ছে না। ওদিকে মেয়েটারও কোন দেখা নেই।

বিকেল গড়িয়ে আস্তে আস্তে সন্ধ্যা নেমে আসল ঢাকার বুকে। চারদিকে জ্বলে উঠল হাজার রঙের আলো। রফিক তার রিকশায় বসেই থাকল...
২টি মন্তব্য ২টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

ছি , অবৈধ দখলদার॥ আজকের প্রতিটি অন‍্যায়ের বিচার হবে একদিন।

লিখেছেন ক্লোন রাফা, ০৪ ঠা ডিসেম্বর, ২০২৫ দুপুর ১২:১০



ধিক ‼️বর্তমান অবৈধভাবে দখলদার বর্তমান নরাধমদের। মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীন বাংলাদেশে । বীর মুক্তিযোদ্ধাদের ক্ষমা চাইতে হলো ! রাজাকার তাজুলের অবৈধ আদালতে। এর চাইতে অবমাননা আর কিছুই হোতে পারেনা।... ...বাকিটুকু পড়ুন

আম্লিগকে স্থায়ীভাবে নিষিদ্ধে আর কোন বাধা নেই

লিখেছেন সৈয়দ মশিউর রহমান, ০৪ ঠা ডিসেম্বর, ২০২৫ দুপুর ১২:২২


মঈন উদ্দিন ফখর উদ্দিনের ওয়ান-ইলেভেনে সরকারের ২০০৮ সালের ডিসেম্বরে ভারতের সহায়তায় পাতানো নির্বাচনে হাসিনা ক্ষমতায় বসে। এরপরই পরিকল্পিত উপায়ে মাত্র দুই মাসের মধ্যে দেশপ্রেমিক সেনা অফিসারদের পর্যায়ক্রমে বিডিআরে পদায়ন... ...বাকিটুকু পড়ুন

মিশন: কাঁসার থালা–বাটি

লিখেছেন কলিমুদ্দি দফাদার, ০৪ ঠা ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ৯:২৭

বড় ভাই–ভাবীর ম্যারেজ ডে। কিছু একটা উপহার দেওয়া দরকার। কিন্তু সমস্যা হলো—ভাই আমার পোশাক–আশাক বা লাইফস্টাইল নিয়ে খুবই উদাসীন। এসব কিনে দেওয়া মানে পুরো টাকা জ্বলে ঠালা! আগের দেওয়া অনেক... ...বাকিটুকু পড়ুন

আওয়ামী লীগের পাশাপাশি জামায়াতে ইসলামীকেও নিষিদ্ধ করা যেতে পারে ।

লিখেছেন সৈয়দ কুতুব, ০৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ১২:৪৫


বাংলাদেশে আসলে দুইটা পক্ষের লোকজনই মূলত রাজনীতিটা নিয়ন্ত্রণ করে। একটা হলো স্বাধীনতার পক্ষের শক্তি এবং অন্যটি হলো স্বাধীনতার বিপক্ষ শক্তি। এর মাঝে আধা পক্ষ-বিপক্ষ শক্তি হিসেবে একটা রাজনৈতিক দল... ...বাকিটুকু পড়ুন

J K and Our liberation war১৯৭১

লিখেছেন ক্লোন রাফা, ০৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ৯:০৯



জ্যাঁ ক্যুয়ে ছিলেন একজন ফরাসি মানবতাবাদী যিনি ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তান ইন্টারন্যাশনাল এয়ারলাইন্সের একটি বিমান হাইজ্যাক করেছিলেন। তিনি ৩ ডিসেম্বর, ১৯৭১ তারিখে প্যারিসের অরলি... ...বাকিটুকু পড়ুন

×