আর বছর বন্যার কথা মনে আছে তর? ঐযে একদিন রাইতের বেলা তুই আইসা কইলি, তর নাকি খুব মন খারাপ। আমারে বিলে ঘুরাইতে নিয়া যাইতে কইলি। ঐদিন তর মুখের দিকে চাইয়া আমার বুকটাও কেমন জানি মোচড় দিয়া উঠছিল। মুখে কিছু কইতে পারি নাই। তয় খুব ইচ্ছা করছিল হাতদুইটা দিয়া তর পুতুলের মতন মুখখান ধরতে। কিন্তু সাহস পাইনাই।
আমার নাওডা বেশি বড় না। তার উপরে আবার পুরান হইয়া গেছে। কোনমতে হালকা-পাতলা দুইজন বসন যাও, তাও ঢুলু ঢুলু করে। গলুইয়ের একমাথায় তরে বসাইয়া আরেক মাথায় আমি বইসা নাও ঠেললাম। বাড়ির ঘাট থিকা বিলের দিকে যাইতে ছোট্ট একটা খাল পড়ে। খালে দুই পাশেরই ছনের জঙ্গল। এরে মইধ্যে আবার রাইতে ঝিঝি ডাকে। রাইত কইরা এর মইধ্যে দিয়া যাইতেই শইল্লের মধ্যে কেমন জানি কাটা দিয়া উঠে।
খাল পাড় হইলেই বিশাল বিল। বন্যার পানি আইলে ভইরা উপচাইয়া উঠে। মইধ্যেখানে গেলে মনেহয় দুইন্নায় পানি ছাড়া আর কিছুই নাই। তয় ঐ রাইতে এমনেও কিছু দেহা যাইতাছিল না। কৃষ্ণপক্ষের রাইত। চাদ উঠে মেলা রাইত কইরা। এর আগে পরাই ঘুটঘুটা অন্ধকার। খুব কাছে না হইলে কোনকিছু ঠাওর করা খুব মুশকিল। তয় নাও বাইতে তেমন কোন ঝামেলা হয়না। বাইতে বাইতে আন্দাজ হইয়া গেছে।
এই আন্ধারে কিছু ঠাওর করা না গেলেও আমি ঠিকই তরে ঠাওর করতে পারি। তর সেই মায়া মায়া চোখ, কপালের উপরের কথা না শুনুইন্না কয়ডা চুল যেইগুলা বার বার তর চোখ্খের সামনে আইসা পড়ে, কচি একখানা নাক- তাতে তারার লাহান একটা নাকফুল, বাশপাতার মত চিকন দুইটা ঠোট সবই আমি দেহি। আন্ধারেও দেহি, চক্ষু বুজলেও দেহি।
হঠাৎ তুই কইলি বিলের মইধ্যেখানে যাবি। লোকে কয় এই বিলের উপরে নাকি আছর আছে। রাইত বিরাইতে নাকি অনেকেই কিসব দেখছে। এগুলান তুই-আমিসহ বেবাকেই জানে। তারপরও তুই যাবি। তর জোড়াজোড়িতে আমিও জোড় দিয়া না করলাম না যহন দেখলাম তর মনডা লাগে ভাল হইতাছে, তর মুখের ভারগুলা সইরা যাইতাছে। তুই পানি নিয়া খেলতাছস আর কিজানি গুনগুন করতাছস। তাই দেইখা আমারো ভাল লাগতাছিল।
ইচ্ছা কইরা তরে রাগাইতে আমার খুব ভাল লাগতো। তারপর আবার যহন নিজেই সেই রাগ ভাঙাইতাম তহন আরো বেশি ভাল লাগতো। কি জন্যে জানস? তুই বাচ্চাগো মত গাল ফুলাইয়া বসার পর আমার কোন রাগ ভাঙানি কথায় ঠিক যখন তর রাগ পইড়া যাইতো তহন তুই বুঝতে দিতে চাইতি না যে তর রাগ পইড়া গেছে। তুই ভিতরে ভিতরে হাইসা দিতি কিন্তু হাসি বাইরে আসতে দিতি না। কিন্তু তুই জানস না, আমি তহন ঠিকই বুঝতাম তর রাগ পইড়া গেছে। ঠিক এই সময়ডাতে যে তরে কত্ত সুন্দর লাগতো তা যদি তুই জানতি…। আমি এহনো চক্ষু বন্ধ করলে তর ঐ চেহারাডা দেখবার পারি।
তয় রাগে রাগে ফারাক আছে। এইগুলান হইলো হেয়ালী রাগ। যহন তুই সত্যি সত্যি রাগ করতি তহন আমি খুব ভয় পাইতাম। কেন ভয় পাইতাম, কিসেরে ভয় পাইতাম তা জানিনা। শুধু জানি ভয় পাইতাম। তর রাগ আসল নাকি হেয়ালী তা বুঝতাম রাগের সময় তর চেহারা দেইখা। কেমনে বুঝতাম তা তরে বুঝাইতে পারুম না, তয় বুঝতাম।
ঐদিনও তর মেজাজ ভাল দেইখা আমি কি কইয়া জানি তরে রাগাইয়া দিছিলাম। তুই রাইগাও গেছিলি। পানির লগে খেলা, গুণগুণানী বাদ দিয়া অনেকক্ষণ থম মাইরা বইসা ছিলি। আন্ধারে তর চেহারা দেহা যায়নাই দেইহা বুঝিও নাই তুই সত্যি সত্যি রাগ করছস। হেয়ালী রাগ ভাইবা মনের মইধ্যে পাকাইতাছিলাম কেমনে তর রাগ ভাঙ্গান যায়। এরমধ্যেই হঠাৎ কিজানি বড় একটা পানিতে পড়ার আওয়াজ পাইলাম। আতকা তাকাইয়া দেহি নাওয়ে তুই নাই। আমি চিৎকুর দিয়া চাইরদিক কাপাইয়া তরে ডাকতে লাগলাম, পানিতে নাইমা ডুবাইয়া ডুবাইয়া তরে খুজতে লাগলাম, কিন্তু তরে আর খুইজা পাইলাম না।
তারপর থিকা আইজো পত্তেক রাইতে আমি বিলের মইধ্যে গিয়া তরে তালাশ করি। এহনো তর আশায় ভাবি, যদি তরে খুইজা পাই। কিন্তু পাইনা। আমি সেই চেহারাডা আর দেহিনা। সেদিনের এক রাইতের আন্ধার আমার সবগুলা রাইতেরেই আন্ধার কইরা দিয়া গেছে।
সর্বশেষ এডিট : ১২ ই মে, ২০১৫ রাত ৯:০৮