|(পূর্ব প্রকাশের পর)
পাকিস-ানীরা পূর্ব পাকিস-ানের সম্পদ লুন্ঠন করার লোভে কেন্দ্রীয় সচিবালয়ে ১৯ জন এবং গণপরিষদের ৭৯ জন সদস্য তাদের নিজেদের মধ্য থেকে নিযুক্ত করেছিল। পাকিস-ানের ১৯৪৭-৭১ সালের আর্থিক ইতিহাসের দিকে দৃষ্টিপাত করলে নানা চিত্র ফুটে ওঠে। তার মধ্যে বৈদেশিক সাহায্য ও ঋণের শতকরা ১০ ভাগ থেকে ১৫ ভাগ মাত্র খরচ করা হত পূর্ব পাকিস-ানের জন্য। পাকিস-ানের রাষ্ট্রীয় যন্ত্র পশ্চিম পাকিস-ানে থাকায় অল্প সময়ের মধ্যে পশ্চিম পাকিস-ানের অনেক উন্নতি হয়। পূর্ব পাকিস-ানের পাট থেকে যে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জিত হত তা দিয়ে পশ্চিম পাকিস-ানে শিল্পায়ন হত। সে অনুপাতে পূর্ব পাকিস-ানে শিল্প প্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠে নি। নদীতে বাঁধ দিয়ে পশ্চিম পাকিস-ানে বিদ্যুৎ উৎপাদিত হত, কিন' পূর্ব পাকিস-ানে কোনো নদীতে বাঁধ দিয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদিত হয় নি। সিন্ধুর মরু অঞ্চলে পানিসেচের ব্যবস'া করে শস্য উৎপাদন করা হত কিন' পূর্ব পাকিস-ানে বন্যা নিয়ন্ত্রণে কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয়নি।
১৯৪৯-৫০ সালে পাকিস-ানের মাথাপিছু আয় ছিল ৫১ ডলার আর পূর্ব পাকিস-ানের মাথাপিছু আয় ছিল ৪৬ ডলার। পাকিস-ানের শাসকগোষ্ঠী ১৯৫০-৫৪-৫৫ সালে মোট উন্নয়ন বরাদ্ধের শতকরা আশি ভাগই ব্যয় করেছিল পশ্চিম পাকিস-ানে আর মাত্র ২০ ভাগ ব্যয় করেছিল পূর্ব পাকিস-ানে। পাকিস-ানীরা নিজেদের দেশের উন্নয়ন করতে খুব দ্রুত এই পূর্ব পাকিস-ানের লোকজনকে আধুনিক অস্ত্রের ভয় দেখিয়ে সব সম্পদ লুন্ঠন করতে শুরু করেছিল। এ সময় পূর্ব পাকিস-ানের লোকসংখ্যা ছিল সাড়ে ৬ কোটি এবং পশ্চিম পাকিস-ানের ছিল ৩ কোটি ৬৪ লক্ষ। জনসংখ্যায় অর্ধেক হওয়া সত্ত্বেও তারা সবকিছুতেই বৈষম্য সৃষ্টি করেছিল। ১৯৪৭-৪৮ সাল থেকে ১৯৬৮-৬৯ সাল পর্যন- বেসামরিক খাতে পাকিস-ানে মোট ব্যয় হয়েছিল ৭১৮ কোটি টাকা এবং পূর্ব পাকিস-ানের জন্য ব্যয় হয়েছিল ১৮৪ কোটি টাকা। এমনকি সেনাবাহিনীতে পূর্ব পাকিস-ানের মাত্র ৫% লোক নিয়োগ দেওয়া হত। এই সমস- ঘটনায় পূর্ব পাকিস-ানের লোকজন ধীরে ধীরে প্রতিবাদমুখর হয়ে ওঠে।
সরকার পাকিস-ান সৃষ্টির পর থেকে পূর্ব পাকিস-ানের স্বতন্ত্র সাংস্কৃতিক সত্ত্বাকে ধ্বংস করার প্রচেষ্টা চালায় যার প্রেক্ষিতে সূচিত হয় ভাষা আন্দোলন। ভাষা আন্দোলন শুধু বাংলাদেশে নয়, সারাবিশ্বের ইতিহাসে এক নজির সৃষ্টি করেছে। ভাষা আন্দোলনের সূত্রপাত হয় ১৯৪৭ সালের সেপ্টেম্বর মাসে। তার কয়েক মাস আগেই ১৭ মে পাকিস-ানের হায়দ্রাবাদে এক ঊর্দু সম্মেলনে মুসলিম লীগ নেতা চৌধুরী খালিকুজ্জামান ঘোষণা দেন “ঊর্দুই হবে সমগ্র পাকিস-ানের জাতীয় ভাষা”। এর সঙ্গে গলা মেলান আলীগড় মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ডঃ জিয়াউদ্দিন। সেই ভাষণের প্রতিবাদে ২৯ জুলাই ডঃ মুহম্মদ শহীদুল্লাহ আজাদ পত্রিকায় বলেন “বাংলাই হওয়া উচিত পাকিস-ানের রাষ্ট্রভাষা, তবে দুটি রাষ্ট্রভাষা করা গেলে ঊর্দুর কথা বিবেচনা করা যায়”। এভাবে আন্দোলন ধীরে ধীরে তীব্র হয়ে উঠতে থাকে। তৎকালীন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছিল পূর্ব বাংলার রাজনীতির কেন্দ্রবিন্দু। সবকিছুর সূচনা এই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও ছাত্রদের মাধ্যমেই হত। ফলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মওলানা ভাসানী ও গোলাম মাহবুবের নেতৃত্বে “সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা কর্মপরিষদ ” গঠিত হয় । এই কমিটি তাদের প্রথম বৈঠকেই ২১ ফেব্রুয়ারীকে ‘ভাষা দিবস ’ হিসেবে ঘোষনা করে সমগ্র পূর্ব বাংলাব্যাপী সর্বাত্মক দর্মঘট , শোভাযাত্রা ,ও জনসভার আহ্ববান জানায় । যুবলীগ,ছাত্রলীগ আর সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের শত শত কর্মী ‘ভাষা দিবস ’ কে সফল করার জন্য অক্লানত্ম পরিশ্রম করে । তবে তমুদ্দিন মজলিশ , খেলাফত রব্বানী ও ইসলামী ছাত্রসংঘ প্রভৃতি ইসলামী আদর্শের গোষ্ঠীগুলোর তেমন কোন ভূমিকা ভাষা আন্দোলনে ছিল না । ১৯৪৮ সালের ২ মার্চ গঠিত হয় ‘সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ’ এবং ১১ মার্চ এই সংগ্রাম পরিষদ সারা পূর্ববঙ্গে ধর্মঘট আহ্বান করে। ১৯ মার্চ পাকিস-ানের প্রথম গভর্নর মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ ঢাকায় আসেন এবং ২১ মার্চ তিনি রেসকোর্স ময়দানে দেওয়া বক্তৃতায় বলেন “আমি স্পষ্টভাবে বলে দিতে চাই ঊর্দুই হবে সমগ্র পাকিস-নের রাষ্ট্রভাষা, অন্য কোন ভাষা নয়”।
১৯৪৮ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারী গণপরিষদের অধিবেশনে পরিষদের ভাষা হিসেবে ঊর্দু ও ইংরেজী গৃহীত হয় এবং বলা হয়, “এই দুই ভাষা ছাড়া আর কোনো ভাষা ব্যবহার করা যাবে না”। এরপর অধিবেশনে সংশোধন প্রস-াব আনলেন গণপরিষদের সদস্য কুমিল্লার ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত। তিনি বলেন, “২৯ সংখ্যক ধারার (১) উপধারায় ইংরেজী শব্দটির পর ‘অথবা বাংলা’ শব্দ দুটো যোগ করা হোক”। ধীরেন্দ্রনাথ দত্তের রাষ্ট্রভাষা দাবির কথাটি পাকিস-ানী শাসকদের উত্তেজিত করে তোলে। তখন পাকিস-ানের প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী বলেন, “মাননীয় সদস্য আপনি পাকিস-ানের বিভিন্ন অংশের মধ্যে ভুল বুঝাবুঝির অবকাশ সৃষ্টি করেছেন”। এ সময় পূর্ববঙ্গের প্রধানমন্ত্রী খাজা নাজিমুদ্দিন বলে বসেন, “আমার উচিত পরিষদকে জানানো যে, পূর্ব পাকিস-ানের সিংহভাগ মানুষ ঊর্দুকে একমাত্র রাষ্ট্রভাষা হিসেবে দেখতে চায়; বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার কোন ভিত্তি নেই”।
১৯৫১ সালের আদমশুমারীতে দেখা গেছে, পাকিস-ানে বিভিন্ন ভাষাভাষী মানবগোষ্ঠীর মধ্যে
বাঙালী ৫৪.৬%
পাঞ্জাবী ২৮.৪%
ঊর্দুভাষী ৭.২%
এত অল্প সংখ্যক ঊর্দুভাষীর লোকজন শুধুমাত্র ক্ষমতা ও অস্ত্রের ভয় দেখিয়ে তাদের নিজেদের উর্দু ভাষাকে রাষ্ট্রভাষা করতে চেয়েছিল।
এরপরে ১৯৫২ সালে পাকিস-ানের মুসলিম লীগের কাউন্সিল অধিবেশনে যোগ দেওয়ার উদ্দেশ্যে ঢাকায় আসেন খাজা নাজিমুদ্দিন। ২৭ জানুয়ারী পল্টন ময়দানে তার বক্তৃতার পরিপ্রেক্ষিতে এই পূর্ববাংলার বাঙালীরা ফুঁসে উঠে।
আবার ৩ ফেব্রুয়ারী খাজা নাজিমুদ্দিন ঢাকার গভঃ হাউসে এক সংসদ সম্মেলনে বাংলাকে পাকিস-ানের রাষ্ট্রভাষা করার দাবি নাকচ করে দেন। তিনি বলেন, “আমি স্পষ্টভাবে বলে দিতে চাই যে, পাকিস-ানের রাষ্ট্রভাষা ঊর্দু হতে চলেছে, অন্য কোনো ভাষা নয়। তবে এটা যথাসময়ে হবে। এ ব্যাপারে যিনি আপনাদের বিব্রত করতে চান তিনি পাকিস-ানের দুশমন।”
এরপরে বাংলা ভাষার প্রতিষ্ঠার দাবি পূর্ববঙ্গে তীব্র আকার ধারণ করে। এ কথা অনুধাবন করে ঢাকা জেলা ম্যাজিস্ট্রেট ২০ ফেব্রুয়ারী থেকে ৩০ দিনের জন্য ১৪৪ ধারা জারি করে মিছিল ও গণজমায়েত নিষিদ্ধ ঘোষণা করেন। এতে উত্তেজনা আরো তীব্র হয়। সর্বদলীয় সংগ্রাম পরিষদের অধিকাংশ সদস্যের মতে ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করার সিদ্ধান- গৃহীত হয়।
২১ ফেব্রুয়ারী সকাল ১০ টায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে প্রায় ১০ হাজার ছাত্র-ছাত্রী সমবেত হয়। অধিকাংশের সম্মতিতে ১৪৪ ধারা ভঙ্গের সিদ্ধান- গৃহীত হওয়ার সাথে সাথে ছাত্র-ছাত্রীরা উত্তেজিত হয়ে ‘১৪৪ ধারা ভাঙতে হবে’, ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই’ ইত্যাদি শ্লোগান দিতে থাকে। ১৪৪ ধারা ভঙ্গের প্রথম দলটি গেট থেকে রাস-ায় বের হয়।
ছাত্ররা ১০ জন করে একের পর এক মিছিল বের করে ।
এরপর ছাত্ররা ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করলে ছাত্র ও পুলিশের মধ্যে ইটপাটকেল বিনিময় হতে থাকে। পুলিশ কাঁদুনে গ্যাস নিক্ষেপ করে এবং ছাত্রদের গ্রেপ্তার করে। বেলা ১২ টার দিকে পুলিশের মোটা রশির বাঁধা পেরিয়ে উত্তেজিত ছাত্ররা দলে দলে মেডিকেল কলেজ ও হোস্টেলের দিকে যেতে থাকলে ছাত্র ও পুলিশের মধ্যে পুনরায় ইটপাটকেল বিনিময় শুরু হয় এবং এক পর্যায়ে পুলিশ ছাত্রদের উপর কাঁদুনে গ্যাস নিক্ষেপ করে।
এভাবে ছাত্র-পুলিশ সংঘর্ষ চলাকালে বেলা ৩ টার দিকে পরিসি'তির অবনতি ঘটে। এ সময় উচ্চপদস' পুলিশ ও সরকারি আমলারাও উপসি'ত ছিলেন। তারা ছাত্রদের প্রাদেশিক আইন পরিষদের দিকে যেতে নিষেধ করলে ছাত্ররা উত্তেজিত হয়ে ওঠে। পুলিশ প্রথমে কয়েক রাউন্ড গুলি ছোঁড়ে এবং সে গুলিতে বরকত, রফিক, ছালাম, জব্বার, শফিউর এবং আরও অনেকে শহীদ হন এবং অনেকে হন আহত। এতে সারা পূর্ব বাংলায় আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে।২৩ ফেব্রুয়ারী রাত থেকে ২৪ ফেব্রুয়ারী সকাল পর্যনত্ম ছাত্ররা অনেক অমানষিক পরিশ্রম করে বদরুল আলমের নকশায় প্রথম শহীদ মিনার তৈরি করে ।
ছাত্র জনতা শহীদদের স্মৃতি রক্ষার জন্য ঢাকা মেডিকেল কলেজের সামনে একটি শহীদ মিনার নির্মাণ করে। এ মিনারটি উন্মোচন করা হয় ভাষা শহীদ শফিউর রহমানের পিতাকে দিয়ে। কিন' দুঃখজনক,২৬ ফেব্রুয়ারীতে পুলিশ ও সেনাবাহিনীরা বুলডেজার দিয়ে এ শহীদ মিনারটি ভেঙ্গে দিয়েছিল। আজও সারা বিশ্বে এমন কোন দেশ নেই যেখানে বাংলাদেশের মানুষের মত ভাষার জন্য জীবন দিতে হয়েছিল। ভাষা হচ্ছে মানুষের একটি মৌলিক অধিকার। কত বড় নরপশু বা ঘাতক পিশাচ হলেই কেবল এভাবে মানুষের মুখের ভাষা কেড়ে নেওয়ার চেষ্টা করা হয়? যার কারণে আজ ২১ ফেব্রুয়ারীকে সারা বিশ্বে আন-র্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে পালন করা হয়।
--------------------------------------
(চলবে)
সর্বশেষ এডিট : ২৫ শে জুলাই, ২০০৮ বিকাল ৪:৩২