(পূর্ব প্রকাশের পর)
১৯৫৩ সালের ৪ ডিসেম্বর আওয়ামী লীগ ,কৃষক শ্রমিক পার্টি, নেজাম -এ-ইসলাম ,বামপন'ী গণতন্ত্রী দল এ চারটি বিরোধী রাজনৈতিক দলের সমন্বয়ে গঠিত হয় ’যুক্তফ্রন্ট’। যুক্তফ্রন্টের নির্বাচনী প্রচারণা ২১ দফা কর্মসুচির ভিত্তিতে পরিচালিত হয়। ২১ দফার প্রধান দফা ছিল পূর্ণ আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসন। এতে নেতৃত্বে ছিলেন এ কে ফজলুল হক, মাওলানা আঃ হামিদ খান ভাসানী, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, মাওলানা আতাহার আলী ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। সর্বজনীন ভোটাধিকার এবং স্বতন্ত্র নির্বাচকমন্ডলীর সিদ্ধানে-র ভিত্তিতে ১৯৫৪ সালে প্রাদেশিক নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। এ নির্বাচনে যুক্তফ্রন্ট অভূতপূর্ব সাফল্য অর্জন করে। যুক্তফ্রন্ট প্রাদেশিক আইন পরিষদের মোট ৩০৯ টি আসনের মধ্যে এককভাবে ২২৩ টি আসন লাভ করে। অন্যান্য আসনগুলোর মধ্যে মুসলীম লীগ ৯ টি আসন, নির্দলীয় সদস্যগণ ৪ টি এবং খেলাফত রব্বানী ১ টি আসন লাভ করে। এ নির্বাচনে ৭২ টি আসন অমুসলিম সমপ্রদায়ের জন্য সংরক্ষিত ছিল। সাধারণ জনগণ ও ছাত্রজনতার আন্দোলন ধীরে ধীরে তীব্র আকার ধারণ করলে তৎকালীন পাকিস-ান সরকার সকল রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধ ঘোষণা করে সমগ্র পাকিস-ানে সামরিক শাসন জারি করে। এ সময় ১৯৪৭-৫৮ সাল পর্যন- ৪ জন রাষ্ট্রপ্রধানের মধ্যে মাত্র ১ জন ছিলেন পূর্ব পাকিস-ানের এবং তিনিও ছিলেন উর্দুভাষী। এসব বৈষম্য কোনভাবে বাঙালীরা আর সহ্য করতে পারছিল না। ফলে শিক্ষানীতি ও সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে ছাত্রদের দেশব্যাপী আন্দোলন শুরু হয়। পূর্ব বাংলার মানুষের নির্যাতন, শোষণ ও জীবন রক্ষার তাগিদে ২৩ মার্চ লাহোরে সাংবাদিক সম্মেলনে শেখ মুজিব বিরোধী দলসমুহের সম্মেলনে ছয়দফার কথা ব্যক্ত করেন। ছয়দফা ছিল বাঙালীদের মুক্তির সনদ। বস'তপক্ষে ছয়দফা পরিণত হয়েছিল বাংলার জনগনের আশা আকাঙ্ক্ষার প্রতীকে এবং এর প্রতি জনসমর্থন ছিল স্বতঃস্ফ'র্ত ।পূর্ব পাকিস-ানের জনগণের মধ্যে বাঙালী জাতীয়তাবাদের ধারণার বিকাশ ঘটাতে ছয়দফার গুরত্ব ছিল অপরিসীম। ছয়দফার মধ্যে বাংলাদেশের স্বাধীনতার বীজ নিহিত ছিল। ব্রিটিশ গণতন্ত্রেও ইতিহাসে যেমন ম্যাগনা কার্টা অধিকার বিল, ঠিক তেমনি বাঙালীদের স্বাধীনতা আন্দোলনের ভিত্তি ছিল ছয়দফা কর্মসূচি। তাই এর গুরত্ব ছিল অনস্বীকার্য। ছয়দফার কর্মসূচি বাঙালীদের মধ্যে দ্রুত জনপ্রিয়তা লাভ করে এবং এর পক্ষে অভূতপূর্ব সাড়া পাওয়া যায়। কিন' পাকিস-ানী শাসকগোষ্ঠী ছয়দফাকে পাকিস-ানের অসি-ত্বের প্রতি হুমকিস্বরুপ মনে করে। তারা একে রাষ্ট্রবিরোধী ও বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলনরুপে অভিহিত করে। সরকার ভীত-সন্ত্রস- ও ক্ষিপ্ত হয়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব, অন্যান্য নেতা-কর্মী এবং বিশিষ্ট ব্যক্তিকে গ্রেপ্তার করে। ছয়দফা কর্মসূচিকে অঙ্কুরে বিনষ্ট করার উদ্দেশ্য ১৯৬৮ সালের জানুয়ারী মাসে শেখ মুজিবকে প্রধান আসামী করে ৩৪ জনের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহিতার অভিযোগ এনে “আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা” নামে একটি মিথ্যা মামলা দায়ের করা হয়। তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ ছিল যে, তারা ভারতের সহায়তায় শসস্ত্র বিপ্লবের মাধ্যমে পূর্ব পাকিস-ানকে পাকিস-ান থেকে বিচ্ছিন্ন করার ষড়যন্ত্রে লিপ্ত ছিলেন। এরপরে ১৯৬৯ সালের প্রথমদিকে ছাত্র সমাজের এগার দফা দাবি পেশ পাকিস-ান শাসকগোষ্ঠীর শোষন ও বৈষম্য নীতির প্রতি তীব্র অসনে-াষেরই প্রকাশ। ঐ বছরের প্রথম দিকের ধারাবাহিক ঘটনাবলী ১৯৬৯ সালের আন্দোলনকে একটি গণঅভ্যুত্থানে রূপ দেয়। এ সময় ছাত্রনেতা আসাদ পুলিশের গুলিতে নিহত হন, সার্জেন্ট জহুরুল হক সামরিক হাজতে নিহত হন এবং ডঃ শামসুজ্জোহা রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় চত্বরে সামরিক অফিসার কর্তৃক নিহত হন। এসব ঘটনার ক্রমপুঞ্জিত প্রভাবে চলমান আন্দোলন দুর্বার ও মারমুখী হয়ে ওঠে। সকল সরকারি অফিস ও রাজপথ ছাত্রদের নিযন্ত্রণে চলে যাওয়ায় প্রাদেশিক প্রশাসন কার্যত ভেঙ্গে পড়ে। ২১-২৪ ফেব্রুয়ারী পর্যন- ঢাকায় প্রতিদিন মিছিল হয়েছে, পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষ হয়েছে। এ সময় পুলিশের গুলিতে নিহত হয় ছাত্র মতিউর ও শ্রমিক রুস-ম ।
রাজনৈতিক পরিসি'তি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাচ্ছে দেখে আইয়ুব খান ১৯৬৯ সালের ২২ ফেব্রুয়ারী আগরতলা মামলা প্রত্যাহার করে। ফলে শেখ মুজিবসহ আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার সকল আসামী মুক্তিলাভ করে । অতঃপর আইয়ুব খান এক গোলটেবিল বৈঠক আহ্বান করেন। কিন' এ বৈঠক পূর্ণ স্বায়ত্বশাসনের দাবি না মানায় গোলটেবিল বৈঠক ব্যর্থ হয়। ফলে বেসামরিক সমাজ অসি'র, উত্তেজিত ও বিক্ষুদ্ধ হয়ে ওঠে। ২৫ মার্চে আইয়ুব খানের পদত্যাগ ও ইয়াহিয়া খানের ক্ষমতা গ্রহণ হয়।
১৯৭০ সালের প্রাদেশিক ও জাতীয় পরিষদের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ১৬৭ টি ও পাকিস-ান সরকার ২টি আসন লাভ করে। তাতে আওয়ামী লীগের নিরষ্কুশ বিজয় হয় । কিন' এ নির্বাচন পাকিস-ান মেনে নেয় নি ।২ মার্চে প্রথম বাংলাদেশের পতাকা ওড়ানো হয়।
১৯৭১ সালের ৬ মার্চ তৎকালীন পূর্ব পাকিস-ানের গভর্নর হিসেবে জেনারেল টিক্কা খানকে নিয়োগ করা হয়।পরের দিন ৭ মার্চ ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে অনুষ্ঠিত এক বিশাল জনসভায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তাঁর ভাষনে পূর্ব পাকিস-ানের বাঙালীদের স্বাধীনতার জন্য প্রস'তি গ্রহনের আহ্বান জানান। উপসি'ত জনতার সম্মূখে দ্ব্যর্থহীন ভাষায় তিনি ঘোষনা করেন, “... ... ঘরে ঘরে দূর্গ গড়ে তোল। তোমাদের যার যা আছে তাই দিয়ে শত্রুর মোকাবেলা করতে হবে। ... ... এবারের সংগ্রাম আমাদের স্বাধীনতার সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম।”
১৬ মার্চে ঢাকায় মুজিব ও ইয়াহিয়া বৈঠক শুরু হয় এবং শেষ পর্যন- এ বৈঠক ব্যর্থ হয়। কিন' ছাত্র জনতা ইয়াহিয়া ও ভুট্টোর আসল উদ্দেশ্য বুঝতে পারে এবং তারা স্বাধীনতার প্রস'তি গ্রহণ করতে শুরু করে। ১৭ মার্চ আবার ঢাকায় পাকিস-ানী জেনারেলদের গোপন বৈঠক অনূষ্ঠিত হয়। এতে বাঙালী হত্যার নীল নকশা “অপারেশন সার্চলাইট” চূড়ান- করা হয়। অপারেশন সার্চলাইট, বাঙালী হত্যার নীল নকশা যে ৬জন ব্যাক্তি চূডানত্ম করেন তারা হলেন প্রেসিডেন্ট জেনারেল ইয়াহিয়া খান,জেনারেল টিক্কা খান, জেনারেল আ: হামিদ খান, জেনারেল পীরজাদা,মেজর জেনারেল রাও ফরমান আলি,মেজর জেনারেল খাদিম হোসেন রাজ।২৩ মার্চ নেতৃবৃন্দের আহ্বানে “পাকিস-ান প্রজাতন্ত্র দিবস” এ বাংলাদেশের মানচিত্র খচিত পতাকা সবর্ত্র ওড়ান হয়। ২৫ মার্চ কোন প্রকার ঘোষণা না দিয়েই ইয়াহিয়া খান ঢাকা ত্যাগ করেন। তিনি যাবার আগে বাঙালীদের উপর ক্ষিপ্ত হয়ে জোর গলায় বলেন “এ দেশের মানুষ চাই না, শুধু মাটি চাই”। তিনি পূর্ব বাংলার শ্যামল ভুমিকে রক্তে লাল করে দেয়ার কথা জানান ।
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের রাজনৈতিক পটভূমি ও ঐতিহাসিক অহিংস অসহযোগ আন্দোলনের বিশ্লেষণে এটা সুস্পষ্ট হয়ে উঠে যে, ৭১-এর স্বাধীনতা যুদ্ধ কোন আকস্মিক ঘটনা বা বিচ্ছিন্নতাবাদী যুদ্ধ ছিল না। একটা আধা ঔপনিবেশিক ব্যবস'া থেকে শোষিত জনপদের সর্বাত্মক সংগ্রাম ইতিহাসের ধারাক্রমে অনিবার্য হয়ে উঠেছিল। ইতিহাসের জঘন্যতম বিশ্বাসঘাতক ইয়াহিয়া খান ২৫ মার্চের কালোরাতে বাঙালী জাতিকে পৃথিবী থেকে নিশ্চিহ্ন করে দেবার জন্য গণহত্যার আদেশ দিয়ে ঢাকা ত্যাগ করেন। আর কুখ্যাত টিক্কা খান বর্বর পাকিস-ান সেনাবাহিনীকে লেলিয়ে দিয়ে বলেন ুকরষষ ঃযব ইবহমধষরং, ৎধঢ়ব ঃযবরৎ ড়িসবহ, ষড়ড়ঃ ঃযবরৎ াধষঁধনষবং ধহফ নঁৎহ ঃযবরৎ ঢ়ৎড়ঢ়বৎঃরবংচ।
ফলে ২৫ মার্চ রাতেই সারা দেশে ৩-৫ লক্ষ মানুষ নিহত হয় ও অসংখ্য মানুষকে বন্দী করা হয় ও অনেকেরই বাড়িঘর জ্বালিযে দেওয়া হয়। ঐ রাতে শেখমুজিবসহ আরো অনেকে পাকিস-ান বাহিনীর দ্বারা খুব খারাপ ব্যবহার ও ধাক্কাধাক্কিসহ করুণ অবস'ায় বন্দী হন। ২৬ মার্চ বেলা ২.৩০ টার দিকে জনাব হান্নান সর্বপ্রথম চট্রগ্রামের কালুরঘাট স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র পাঠ করেন।
----------------------------------------------------------------
(চলবে)
সর্বশেষ এডিট : ২৬ শে জুলাই, ২০০৮ সকাল ১০:৫১