(পূর্ব প্রকাশের পর )
আধুনিক অস্ত্রসস্ত্রে সজ্জিত পাকিস্তানী সেনাবাহিনী গণবিধ্বংসী ট্যাংক, বোমা, ডিনামাইট দ্বারা সারা দেশে ধ্বংসলীলা শুরু করলে বাংলার সাধারণ জনগণ নিজেদের জীবন রক্ষার তাগিদে নিজ বসতভিটা ছেড়ে কেউ গ্রামের বাড়িতে, কেউ আত্মীয় স্বজনের বাড়িতে, কেউ গহীন জঙ্গলে আশ্রয় নেয়। কিন্তু যখন এতেও জীবনের নিরাপত্তার অভাব দেখা দিলে তখন প্রায় ১ কোটি মানুষ ভারতে আশ্রয় নেয়। এ সময় ভারত ও সোভিয়েত ইউনিয়ন বাংলাদেশের মানুষকে আশ্রয়, খাদ্য ও অনেক অস্ত্রসস্ত্র দিয়ে সাহায্য ও সহযোগিতা করে। শেষপর্যন্ত তারা নিজেরাও অংশগ্রহণ করে দেশের স্বাধীনতায় বিরাট অবদান রাখে।১৯৭১ এর যুদ্ধেও সময় মূলত ভারত,সোভিয়েত ইউনিয়ন,ইসরাইল,বেলজিয়াম,চেকোশ্লেভিয়া,হংকং প্রভৃতি দেশ বাংলাদেশের স্বাধীনতার সমর্থনে ছিল। এ সময় বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের প্রধান সেনাপতি আতাউল গনি ওসমানী সমগ্র বাঙলাদেশকে মোট ১১ টি সেক্টরে ভাগ করে প্রত্যেক সেক্টরের দায়িত্বে একজন সেক্টর কমান্ডার নিয়োগ করেন। এছাড়াও এয়ার কমান্ডার এ কে খন্দকার বিমান বাহিনী পরিচালনার দায়িত্বে নিযুক্ত হন। তার নেতৃত্বে গেরিলা ও নিয়মিত বাহিনীর সমর্থনে বিমান বাহিনী কয়েকটি সাফল্যজনক অভিযান চালায়। এ সময় প্রায় ২৫ হাজার মুক্তিযোদ্ধা যুদ্ধে অংশগ্রহণ করে। কিন্তু লে.জে. এ .এ .কে নিয়াজীর মতে ঐ সময় ২ লক্ষ ৮৭ হাজার ৫ শ মুক্তিযোদ্ধা, ৫০ হাজার ভারতীয় সৈন্য ,৫০ হাজার রাজাকার ও ৩ ডিভিশন পাকিস্তানী সৈন্য ( দেড় লক্ষ) যুদ্ধে অংশগ্রহন করেছিল ।
যুদ্ধের সময় যুবক বয়সের লোক দেখলেই তারা মুক্তিবাহিনী সন্দেহ করে বাড়ি থেকে ধরে নিয়ে যেত। এরপর তাদেরকে এক লাইনে দাঁড় করিয়ে ব্রাশ ফায়ার করে মেরে গণকবর দিত। যুদ্ধের সময় মুসলিম লীগই দেশে নানা রকম অশান্তি সৃষ্টি করে, যা আজ জামায়াতে ইসলামী দল নামে দেশে ব্যপক ভাবে পরিচিত। এছাড়াও কিছু লোক পাকিস্তানী সেনাবাহিনীদের মুক্তিযোদ্ধাদের অবস্থান ও তাদের ঘরবাড়ি দেখিয়ে দিয়ে মালামাল লুটপাট, ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে দেওয়া ও মা-বোনদের ইজ্জত কেড়ে নেওয়ায় সহায়তা করে। এই দলটি বর্তমানে রাজাকার নামে পরিচিত। এছাড়া রাজাকারদের ও পাকিস্তান প্রেমিকদের “শান্তি কমিটি” নামক সংগঠন গঠন করা হয়। যাদের একমাত্র কাজই ছিল অশান্তি সৃষ্টি করা। তারা ঐ সময়টা খুব আনন্দে ও সুখে কাটায়। এদের পাশাপাশি মুক্তিযোদ্ধারা অনেক কষ্ট করে। এ সময় ৩১৫ জন মুক্তিযোদ্ধা ৪ দিন আটকা পড়ে শুধু পানি খেয়ে বেঁচে থাকে। সবাই ধারণা করেছিল তারা সবাই মারা যাবে , কিন্তু অনেক কষ্টে প্রাণে বেঁচে যায়।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর ১৮ এপ্রিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন উপাচার্য বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী ছাত্র শিক্ষকদের গণহত্যার একটি বিবরণ বিশ্ববাসীর কাছে তুলে ধরেন। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে বিশ্ব জনমত গড়ে তোলা ও আর্ন্তজাতিক সমপ্রদায়ের সমর্থন আদায়ের লক্ষ্যে তিনি মুজিব নগর সরকারের স্থায়ী প্রতিনিধি হিসেবে লন্ডনে অফিস নিয়ে যুদ্ধের বাকি সময় জোর তৎপরতা চালান।
পাকিস্তানী শাসনামল থেকে শুরু করে ৭১ এর যুদ্ধের সময় পর্যন্ত বিভিন্ন জায়গায় বাঙালীরা পাকিস্তানী পতাকা নামিয়ে সবুজ, লাল ও সোনালী রং এর পতাকা উড়ায়। বাংলাদেশের পতাকা তখন থেকেই বাঙালীরা ভালবেসে বুকে ধারণ করেছিল, যার জন্য আধুনিক অস্ত্রের শক্তি দ্বারাও সে পতাকা হৃদয় থেকে ছিনিয়ে নিতে পারে নি। ঐ সময় যে সমস্ত বাঙালীরা পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে চাকুরি করার জন্য যোগ দিয়েছিল ঠিক যুদ্ধেও আগে আগে ও যুদ্ধের শুরুতে তাদের পাকিস্তানী বাহিনীর হাতে নির্মম ভাবে প্রাণ দিতে হয়েছে। অল্প কিছু লোক বুদ্ধির জোরে আগেই পালিয়ে বেচে গিয়েছিল।
শেষপর্যন্ত মুক্তিযোদ্ধা ও যৌথবাহিনীর উদ্যোগে চাপে পড়ে পাকিস্তান সেনাবাহিনীরা প্রাণ রক্ষার তাগিদে জেনারেল নিয়াজীর মাধ্যমে ঢাকার সোহরাওয়ার্দী উদ্দ্যানে ৯৩ হাজার সৈন্য নিয়ে আত্মসর্মপণ করে। যা পৃথিবীর ইতিহাসে এক বিরল ঘটনা। এত বিশাল সেনাবাহিনী নিয়ে আত্মসর্মপণ করার ইতিহাস এর আগে ছিল না। অবশেষে ১৬ ডিসেম্বর মাত্র ৯ মাসের মধ্যে বাংলাদেশ স্বাধীন হয়, যা আরও একটি ইতিহাস। এত অল্প সময়ের মধ্যে এর আগে কোন দেশ যুদ্ধে জয়ী হয় নি। শেষ পর্যন্ত ১০৮ টি দেশ বাঙলাদেশকে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দেয়। এ যদ্ধে যারা সবকিছু বিসর্জন দিয়ে দেশটাকে শএুমুক্ত করেছে,এদেশবাসী তাদেরকে বীরশ্রেষ্ঠ (৭),বীরউত্তম(৬৮),বীরবিক্রম(১৭৫),বীরপ্রতিক(৪২৬) মর্যাদায় তাদের স্মরনীয় করে রেখেছে।
আমাদের বাঙলাদেশ সবুজাভ সৌন্দর্যের এক প্রানবন্ত প্রকাশ। সুদীর্ঘ সংগ্রামের বনার্ঢ্য ঐতিহ্য নিয়ে সগর্বে মাথা উচু করে দাড়িয়ে আছে দক্ষিণপূর্ব এশিয়ার মানচিত্রে ৩০ লক্ষ শহীদের রক্তে আর ২ লক্ষ মা বোনের সতীত্ব আমাদের পতাকার দৃপ্ত অহংকার। যে সব মৃত্যুঞ্জয়ী বীরের সুমহান আত্মত্যাগের বিনিময়ে আমরা পেয়েছি আমাদের কাঙ্ক্ষিত স্বাধীনতা আর সে জন্যই তাদেরকে জানাই শ্রদ্ধা ও হৃদয়ের ভিতরে লুকিয়ে থাকা সবটুকু ভালবাসা।
বীর মুক্তিযোদ্ধারা আমাদের অহংকার। যুগ যুগ ধরে আমরা তাদের গৌরব গাথা স্মরণ করে তাদের নামে গাইব। আর বাংলার সবুজ জারজ, কুলাঙ্গার, আল শামসের সদস্যদের নামে থুথু ছিটাব। পাকবাহিনীর দোসররা বাংলা মায়ের কলঙ্ক, যুগ যুগ ধরে বাঙালী জাতি তাদের নামের ওপর ঘৃণার বারুদ ছড়াবে, এটাই হোক বর্তমান ও আগামী প্রজন্মের অভিপ্রকাশ।
আজ আমরা ৩৭ এ পা দিয়েছি তবু স্বাধীনতা অর্জনের পুরো তৃপ্তিটুকু আমরা আজও ঠিকমত ভোগ করতে পারি নি , তা কিছু যুদ্ধপরাধীদের করনে ।৭১ এর যুদ্ধের সময় তারা দেশ ও দেশের মানুষের বিরুদ্ধে যে কর্মতৎপরতা চালিয়েছে তা জাতি আজও ভুলে যায় নি । একমাত্র এই বাঙলাদেশেই যুদ্ধপরাধীরা এখনও বুক ফুলিয়ে চলাফেরা করছে । তারা সুযোগ পেলে এখনও মুক্তিযোদ্ধাদের মারার চেষ্টা করছে । তারা দেশের
বড় বড় অবস্থানে রয়েছে । বিশ্বের অনেক দেশেই যুদ্ধপরাধীদের বিচার কাজ সম্পন্ন হয়েছে ।মূলত জাপান,জার্মানী,রুয়ান্ডা ,বসনিয়া,হারজেগোভিনা ও কম্বোডিয়া প্রভৃতি দেশ ।দেশের লোকজনের সমর্থনে আমাদের দেশেও যুদ্ধপরাধীদের বিচার সম্পন্ন করার জন্র খুব তাড়াতাড়ি আনত্মর্জাতিক আদালতে কেচ করার মাধ্যমে এই কাজ শুরু করা খুব কঠিন কিছু না , তবে বেশি দেরি করলে হয়ত আর কিছুদিন পর কোন যুদ্ধপরাধীকে জীবনত্ম অবস্থায় পাওয়া যাবে না । যুদ্ধপরাধীদের বিচার হোক খুব কঠিন ভাবে এটাই হোক আমাদের প্রত্যাশা ।
----------------------------------
(চলবে)
সর্বশেষ এডিট : ২৮ শে জুলাই, ২০০৮ রাত ৮:৫৪