somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

বিপন্ন ড. জি. সি দেবের বিশ্ববীক্ষা: আমাদের রন্দ্রে-রন্দ্রে জিজ্ঞাংসা

০১ লা মার্চ, ২০১৬ দুপুর ১২:৩১
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

গোবিন্দ চন্দ দেব পূর্ব ও পশ্চিমের একজন মানবতাবাদী দার্শনিক এ কথাটি সর্বজন বিদিত। তাঁর সমন্বয়বাদি জীবনদর্শনে অর্থাৎ ভাববাদ বা আধ্যাত্নবাদ ও বস্তুবাদের সংঘাতহীন সম্মিলন দার্শনিক মহলে আজ চর্চিত হচ্ছে। বিশেষভাবে বলতে গেলে ঋষিতুল্য এই পন্ডিত, জ্ঞান তাপস এদেশে দর্শনের এক প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছেন। তাঁর উজ্জল্য ও শ্রদ্ধা আরও বেড়ে যায় যখন দেখা যায় এই মহান ব্যক্তি জাতির স্বাধীনতার সংগ্রামে শহীদ হন। তাঁর মানব জাতির জন্য উৎসর্গকৃত মহাপ্রয়াণে মানবকূল অনেক কিছু হারিয়েছেন। এ রচনা তার দর্শনতত্ত্ব ও সহজ জীবনাচরণ বা জীবনদর্শনের আলোচনা নয়। তাঁর প্রতি শ্রদ্ধাজ্ঞাপন এবং এই সুযোগে কিছুটা আত্মসমালোচনাও। জিসি দেবের প্রতি শ্রদ্ধার সুযোগ বা দুঃসাহস হয়েছে এ জন্য যে তিনি আমাদের লোক। তার জন্ম ও শৈশব-কৈশোর কেটেছে আমাদের এ পঞ্চখন্ডে ( সিলেটের বিয়ানীবাজার)। বর্তমানে পিছিয়ে পড়া (অনেক অর্থে) এ অঞ্চলে তাঁর প্রকাশ অনাকাঙ্কিত কোন ঘটনা নয়;বরং বলা যায় ঐতিহাসিক প্রক্রিয়ার ফসল, কেননা এ অঞ্চলে ভারত-গৌরব রঘুনাথ শিরোমণি, মহেশ্বের ন্যায়লঙ্কার, মুন্সি ইরফান আলীসহ অনেক বিবেকী মানব সত্ত্বার উন্মেষ ঘটে।

ফলত দেশ জাতি ও সমগ্র মানবকূলের জন্য শান্তি-মুক্তির আওয়াজ ও চর্চা গতিশীল হচ্ছে। আমাদের প্রাসঙ্গিক এ মনীষী তার ধী-শক্তি দিয়ে ভোগবাদি, আগ্রাসী এ বিশ্বচরাচরে মানবতা, শান্তি, বলতে গেলে গান্ধীর অহিংস নীতির আদলে জ্ঞানের বুদ্ধিভিত্তিক মানবতাবাদী বিশ্ববীক্ষণের প্রকিয়াকে প্রাচ্যে ব্যবহারিক অর্থাৎ চর্চার ক্ষেত্রে নিয়ে আসেন। তার এ বিশ্ববীক্ষা মানবতাবাদকে আরও শক্তিশালী ও পাকাপোক্ত করে। তিনি মানব কল্যাণের জন্য বৌদ্ধ, সার্ত্র ও মার্কসের কল্যাণকর চিন্তা শক্তিকে প্রয়োগের দিকে নিয়ে আসেন অনেকটা মার্কসের ভাষায় ‘দার্শনিক ব্যাখা কম হয়নি। প্রয়োজন এখন পৃথিবীকে বদরে দেবার, মানুষের সমাজ থেকে অমানবিকতা ও অসংগতি দূর করা’। এই উক্তির মতো বিশ্বের মানব জাতির অহিংস মানবিক বিকাশ কামনা এবং তিনি নিজে চর্চা করে গেছেন আজীবন। তার এই চিন্তা বা ধ্যানের সাথে বর্তমান বিশ্বের মানবসমাজের অবস্থান কি? তার ভবিষ্যত কি?

১। বর্তমান বিশ্বের পোষাকীরূপ উজ্জ্বল,স্বাভাবিক মনে হলেও আসলে তার প্রকৃত বিকার চোখে পড়ে মানবিক দৃষ্টি দিয়ে থাকালে। পৃথিবীর কথিত সভ্যতার বিকাশের পাশাপাশি শুরু হয় আত্মাতায়ী সভ্যতার বিকাশ। এখনও ধর্মের নামে মানুষ হত্যা হয় দেশে-দেশে সামরিক বাহিনী গঠন করা হয় সার্বভৌমত্ব রক্ষার নামে নিরীহ সাধারণ মানুষ হত্যার জন্য। একটি মত (সাম্যবাদ) দমন করার জন্য দেশে-দেশে মুক্তিকামী সাম্যবাদী মানুষের নেতাদের হত্যার জন্য রাষ্ট্রযন্ত্র গোপণ মিশন চালায়। পৃথিবীর কিছু সংখ্যক মানুষের অর্থনৈতিক সচ্ছলতার জন্য অন্যদেশের, তেল গ্যাস প্রাকৃতিক সম্পদ লুট করার জন্য হাজার হাজার শিশু ও মানুষকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। এ সবের বিপরীতে যাদের অবস্থান স্পষ্ট হয় তাদের পরিণতি হয় আরো নির্মম, নিষ্টুর, পাশবিক।

২। বাংলাদেশ। এদেশের মানুষের মানবিক মূল্যবোধ পৃথিবীর আর-আর দেশ থেকে বহুমাত্রিক। তবে তা অমানবিক। এখানকার রাজনীতিবিদ সুস্পষ্ট রূপে দুর্নীতিপরায়ন (ব্যতিক্রম অল্প)। শিক্ষক-বুদ্ধিজীবী অধিকাংশই বন্ধ্যা, ভন্ড। ওরা জ্ঞান দানের চেয়ে দলা দলিতে ব্যস্ত থাকে। লাল-নীল, সাদা-কালো দল গঠন করে। সামান্য পদন্নোতির ও প্রাপ্তিযোগের জন্য ক্ষমতাবানদের পাঁ চাটে। জ্ঞান বুদ্ধি শিক্ষাকে তারা ভোগের হাতিয়ার করে জাতিকে অন্ধকারের দিকে ঠেলে দিচ্ছে। সর্বোপরি দেশের সিংহভাগ সরল মানুষকে জটিলতার আবর্তে ঘুরপাক খাওয়াচ্ছে। সামান্য সংখ্যক মানুষ আজ আমাদের সামনে দানবসম। তাদের মধ্যে অধিকাংশই কুশিক্ষায় শিক্ষিত। তাদের অনেকেরই জীবনদর্শন ভোগের, ত্যাগের নয়। মানব কল্যাণের জন্য নয়, এমন কি মুক্তির জন্যও নয়। এখানে রাষ্ট্রও জনগণের প্রতিপক্ষ হয়ে ওঠে।

৩। ছাপ্পান্ন বর্গ মাইলের এ পঞ্চখন্ড অনেক ঐতিহ্যের, গর্বের, অহংকারের। এখানে অনেক ঋষিতুল্য পণ্ডিতদের আবাসস্থল ছিল। যারা এ উপমহাদেশের কল্যাণ ও জ্ঞানচর্চার ক্ষেত্রে অবদান রেখেছেন। অজয় ভট্টাচার্যের (নানকার বিদ্রোহের নেতা) মতো জন্ম হয়েছে। ড. গোবিন্দচন্দ্র দেবের মতো বিশ্ব বিবেকের শৈশব, কৈশোর কেটেছে এরই আলো বাতাসে। এখানকার প্রকৃতি মাটি তাদের অস্তিত্বের, বিকাশের প্রয়োগের স্মৃতি বা স্বাক্ষর হয়ে আছে। যদিও ওদের সমস্ত ভাবনা চিন্তা এ অঞ্চলের মানব সন্তানরা বহন, লালন, চর্চা করে আসার কথা ছিল, কিন্তু বাস্তব প্রেক্ষাপট তার উল্টো। জিসি দেব কে? এ উত্তর অধিকাংশজনের অজানা। এ অঞ্চলের অধিকাংশ শিক্ষার্থীরা তার নাম পর্যন্ত জানে না। ভন্ড সমাজপতিদের অনেক সময় জানার কথা নয়, তাই তাদের দায় দায়িত্ব অনেকটা নেই বললেই চলে। যাদের জানার ও জানানোর কথা আঞ্চলিক বুদ্ধিজীবী! এলাকার বিবেকখ্যাত শিক্ষক, সমাজের কর্তা রাজনীতিবিদ, সাংবাদিকসহ যারা মানুষের কল্যাণ ও বুদ্ধিভিত্তিক চর্চা করে বলে দাবিদার তারা ব্যর্থতার পরিচয় দিচ্ছেন। সাধারণেরা এ পবিত্র জ্ঞান বিজ্ঞানের উর্বর মাটির সন্তান হয়েও মূর্খ অর্থাৎ গাড়ল প্রকৃতির হয়ে বেড়ে উঠছি।

দায়িত্ববানদের দায়িত্বহীনতার জন্য প্রজন্ম থেকে প্রজন্ম সংস্কৃতিহীন, জ্ঞানহীন এমনকি মানুষের সবচাইতে প্রধান বোধ মানবিক মূল্যবোধ হারিয়ে যাচ্ছে। পৃথিবীর আলোকিত কয়েকজন সমন্বয়বাদী দার্শনিকের একজনের আলোর নিচে হয়েও অন্ধ বধির হয়ে কুসংস্কারাচ্ছন্ন মানবগোষ্টির অভিধায় অভিধিত হচ্ছি। আমরা আজকাল অনেক সময় জাতির কাছে আদিম বর্বর সংস্কৃতির লালনকারী বলেও পরিচিত হচ্ছি। আমাদের ইন্দ্রেয়ের প্রধান চাওয়া হচ্ছে টাকা ও পেশি শক্তি। তাই এ অঞ্চলের অনেক সম্ভাবনার ক্ষেত্র থাকা সত্ত্বেও আমরা সংস্কৃতিহীন অঞ্চলের উদাহরণের দিকে চলে যাচ্ছি। আমাদের রন্দ্রে-রন্দ্রে এখন জিজ্ঞাংসা, অমানবিকতার চর্চা দেখা যাচ্ছে। আমরা আমাদের অবচেতনমনে ধর্মের নামে কুসংস্কার লালন করে যাচ্ছি। অধিকাংশ সমাজপতি ও অভিভাবকদের দায়িত্বহীনতা বা জ্ঞানহীনতার জন্য সমাজের কিশোর-তরুণীরা বিজাতীয় কুসংস্কৃতি লালন করতে শুরু করেছে। ফলে তারা বিকারগ্রস্ত হচ্ছে। বেপরোয়া হয়ে উঠছে। নেশার জগতে মেতে থাকছে। পাড়ায় পাড়ায় অশ্লীল সিডি ভিসিডির লাইব্রেরী গড়ে ওঠাতে বিপথগামী হচ্ছে স্কুলগামী ছাত্রছাত্রী। এখন যোগ হয়েছে ইন্টারনেট এর অনৈতিক ব্যবহার, তাই তারা জ্ঞান দর্শনের প্রতি আগ্রহী না হয়ে গোপনে আড়ালে-আবডালে শ্লীলতাহানির চেষ্টা চালাচ্ছে, নিজেরাও অনেক সময় শিকার হচ্ছে। যদিও এরজন্য দায়ী সমাজের অভিভাবক। কিন্তু শিকার হচ্ছে সহজ সরল দেশ, জাতির আগামীর সমাজ রাষ্ট্রের কান্ডারীরা।

এ ধারাবাহিকতা অব্যাহত থাকলে বিপন্ন হবে সমাজ। বিনষ্ট হবে সামাজিক ভারসাম্য। বিভ্রান্ত ও মেধাহীন হবে জাতি। দেশের মানবগোষ্টির ক্রান্তিলগ্নে অর্থাৎ বিপন্ন সময়ে ব্যতিক্রমী ব্যক্তিত্ব আমাদের গোবিন্দচন্দ্র দেব। তার মতো মহা মনীষীদের এক সময় রাষ্ট্রীয় সম্মাননায় অভিষিক্ত হওয়া এটাই প্রমাণ করে জ্ঞান-ঐশ্বর্যই চিরন্তন এবং চিরস্থায়ী। অর্থ প্রাচুর্য ক্ষণস্থায়ী আস্ফালন, সাময়িক উন্মাচনা। সময়ের বিপরীতে স্রোতে হলেও আলোর অভিযাত্রার শামিল হওয়ার বিকল্প নেই।
দেশের এই নীরব দুর্ভিক্ষেরকালে কান্ডারীহীন ভাসমান ডিঙ্গায় বসে মানবতার পথিকৃত প্রাসঙ্গিক দার্শনিকের দর্শনে আলোকিত হওয়াটাই কাম্য।

সর্বশেষ এডিট : ০১ লা মার্চ, ২০১৬ দুপুর ১২:৩৩
৩টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

যে ভ্রমণটি ইতিহাস হয়ে আছে

লিখেছেন কাছের-মানুষ, ১৮ ই মে, ২০২৪ রাত ১:০৮

ঘটনাটি বেশ পুরনো। কোরিয়া থেকে পড়াশুনা শেষ করে দেশে ফিরেছি খুব বেশী দিন হয়নি! আমি অবিবাহিত থেকে উজ্জীবিত (বিবাহিত) হয়েছি সবে, দেশে থিতু হবার চেষ্টা করছি। হঠাৎ মুঠোফোনটা বেশ কিছুক্ষণ... ...বাকিটুকু পড়ুন

আবারও রাফসান দা ছোট ভাই প্রসঙ্গ।

লিখেছেন মঞ্জুর চৌধুরী, ১৮ ই মে, ২০২৪ ভোর ৬:২৬

আবারও রাফসান দা ছোট ভাই প্রসঙ্গ।
প্রথমত বলে দেই, না আমি তার ভক্ত, না ফলোয়ার, না মুরিদ, না হেটার। দেশি ফুড রিভিউয়ারদের ঘোড়ার আন্ডা রিভিউ দেখতে ভাল লাগেনা। তারপরে যখন... ...বাকিটুকু পড়ুন

মসজিদ না কী মার্কেট!

লিখেছেন সায়েমুজজ্জামান, ১৮ ই মে, ২০২৪ সকাল ১০:৩৯

চলুন প্রথমেই মেশকাত শরীফের একটা হাদীস শুনি৷

আবু উমামাহ্ (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, ইহুদীদের একজন বুদ্ধিজীবী রাসুল দ. -কে জিজ্ঞেস করলেন, কোন জায়গা সবচেয়ে উত্তম? রাসুল দ. নীরব রইলেন। বললেন,... ...বাকিটুকু পড়ুন

আকুতি

লিখেছেন অধীতি, ১৮ ই মে, ২০২৪ বিকাল ৪:৩০

দেবোলীনা!
হাত রাখো হাতে।
আঙ্গুলে আঙ্গুল ছুঁয়ে বিষাদ নেমে আসুক।
ঝড়াপাতার গন্ধে বসন্ত পাখি ডেকে উঠুক।
বিকেলের কমলা রঙের রোদ তুলে নাও আঁচল জুড়ে।
সন্ধেবেলা শুকতারার সাথে কথা বলো,
অকৃত্রিম আলোয় মেশাও দেহ,
উষ্ণতা ছড়াও কোমল শরীরে,
বহুদিন... ...বাকিটুকু পড়ুন

স্প্রিং মোল্লার কোরআন পাঠ : সূরা নং - ২ : আল-বাকারা : আয়াত নং - ১

লিখেছেন মরুভূমির জলদস্যু, ১৮ ই মে, ২০২৪ রাত ১০:১৬

বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম
আল্লাহর নামের সাথে যিনি একমাত্র দাতা একমাত্র দয়ালু

২-১ : আলিফ-লাম-মীম


আল-বাকারা (গাভী) সূরাটি কোরআনের দ্বিতীয় এবং বৃহত্তম সূরা। সূরাটি শুরু হয়েছে আলিফ, লাম, মীম হরফ তিনটি দিয়ে।
... ...বাকিটুকু পড়ুন

×