ইমিগ্রেশনে রাত বারটা থেকে দাঁড়িয়ে আছি। বাংলাদেশে সমস্যা হলো এই একটা জায়গাতে সবাই ভাব মারতে চায়। পুলিশ এসে বারবার সন্দেহজনক দৃষ্টিতে তাকাচ্ছে। তাদের ভাবটা এমন যে আমি হয়ত সোনা পাচার করছি অথবা ভুয়া পাস্পোর্টে বিদেশ যাচ্ছি। যাইহোক দীর্ঘ চার ঘন্টা পড়ে ছাড়া পেলাম। চেয়ারে বসতেই একজন ইশারায় জানালো বিমান ছেড়ে যাবে একটু পড়েই। দিলাম দৌড়। জীবনের প্রথম এই দামী বাহনে আসা। সিট বেল্ট লাগানো থেকে শুরু করে সবকিছুতেই আনন্দ। বিমানবালা আসছে আর মনেহচ্ছে সবকিছুই নিয়ে নিই; ফ্রি তো! কি বিশ্রি কান্ড। জানালা দিয়ে বাইরে তাকালাম; প্রাণের ঢাকা শহর সামান্য দূরেই। একটু পরে পেছনের দিকে বিমান হাটা শুরু করলো। অনুভুতিটা তখনও সজীব। হঠাৎ থেমে যেয়ে এবারে ঘোষণা এলো আমরা অল্প কিছুক্ষণের মধ্যেই উড়ব! মোবাইলে বড় আপা। ভেতরে কথা বলা নিষেধ। কে শোনে কার কথা। আপার কন্ঠ এক সময় নেটওয়ার্ক থেকে হারিয়ে গেলো। ঢাকার আকাশ আস্তে আস্তে ছোট হয়ে এলো আর আমার একাকিত্ব বড় হতে শুরু করলো। আমরা যারা মধ্যবিত্ত পরিবার থেকে আসি তাদের জন্যে এই যাত্রাটা অনেক কষ্টের। হঠাৎ মনেহলো, সারাদিন আম্মার সাথে ঝগড়া করা এই আমি চাইলেও আর দেখতে পারবনা। এই যাত্রায় পেছনে ফেরার আর পথ নেই। খুব কান্না পেলেও করার আর কিছুই নেই।
এখানে চাইলেই অনেক কিছু করা যায়। সমস্যা হলো যার অনেক কিছুই অভিনয় দিয়ে মেশানো। ভাষা না জেনে হো হো করে হাসির দলে মিশে যাওয়া যায় কিন্তু একটু পরেই নিজের কাছে নিজেকে ছাগল মনেহয়। তবুও নিজেকে বাঁচিয়ে রাখার তাগিদে হাসতে হবে বা মজা করতেই হবে। চাইলেই বিকেলে এখানে ঘুম থেকে উঠে বাসার সামনে জম্পেশ চায়ের আড্ডায় নিজের বিষণ্ণতাকে মিশিয়ে দেয়া যায়না। আমি আসলে যতনা বেশি হোমসিক তার থেকে মাদার সিক বেশি। দেশে থাকতেও খুব বেশি আম্মাকে মিস করতে চাইতাম না। এখানে একদিন বিকেলে ঘুম থেকে উঠে ভিষণ মন খারাপ। একেবারে যাচ্ছেতাই অবস্থা। দরজার খিল এটে জানালার উপরে বসে কাঁদছি! মুখ চেপে বুক হালকা করার মত ব্যাপার। পুরুষ মানুষ ‘ভ্যা’ ‘ভ্যা’ করে কাঁদলেতো হয়না। হঠাৎ করে ডানিয়েল নীচ থেকে ডাক দিলো, ‘হেই শাহ্ বীচ, হোয়াটস দ্যা ফাক ইউ আর ডুয়িং? উই হ্যাভ এ পার্টি। গেট রেডি সুন’। আমি ‘ওকে’ বলে নেমে আসলাম। ক্যারিবিও রক্তের ডানিয়েল যদি কান্না দেখে তাহলে সারা পারা এক করে ছাড়বে। এখানকার পার্টি মানেই ভাষা না জানলে আপনাকে একটু পরে বেকুবের মত একাএকা থাকা লাগবে। আর আমার মত ইংরেজি জানলেতো কথাই নেই। মাঝেমাঝে নিজের নাম কি এটা বলাই ভুলে যাই। যাইহোক; পার্টি শুরু হলো। আস্তে আস্তে সভ্য থেকে অসভ্য হলাম। নারীরা তাদের দুরত্ব কমালো। কাপলদের ঠোটের মাঝের দুরত্ব কমতে লাগল আশংকাজনকভাবে। লাল-নীল-বেগুনী আর হরেক রকম বর্ণের আলোয় আমি চুপচাপ একা বসে সিগারেট ফুকতে লাগলাম। কখনও আমার উপরে লাইট পরে বা কখনও তাদের উপরে। তাদের উপরে লাইট পড়লে হাসি-উচ্চলতা আর নির্ভার জীবন আর আমার উপরে পড়লেই একটা বিষণ্ণ তেলাপোকা চুপচাপ সোফাসেটে বসে সিগারেট ফুকছে; অন্যহাতে ড্রিংক্স।
দিনার আপা মানে আমার ছোট আপার অবস্থা খুব খারাপ হয়ে গেলো। বাসায় কল দিলেই আম্মার পাশে আপার গুঙ্গানী শুনতে পাই। এদিকে তার দুঃখে আমি কাতর। জবে মন দিতে পারিনা। চিকিৎসকরা এক প্রকার আশা ছেড়েই দিলেন এমন একটা ভাব। আমি চাইলেও যেতে পারছিনা; সামনেই পরীক্ষা। কোন একদিন সেই অবলা নারীর কথা ভেবে আবেগকে বশ মানাতে পারলাম না। সেদিন সারাদিনই চোখের উপরে দিয়ে বর্ষণ ভারি থেকে ভারিতর হয়েছে। একই অবস্থা হয়েছিলো হুমায়ুন স্যারের মৃত্যুতেও। আমার ফেসবুকের অনেকেই মহাবিরক্ত। তাদের কে বোঝাতে ইচ্ছা করেনাই যে বাংলাদেশের একজন হারিয়ে গেলে আমাদের অন্তত কেমন লাগে। তাও যদি হুমায়ূন স্যারে মত একজন হয়।
ইদানিং আরেকটা সমস্যা হয়েছে যা আগে ছিলোনা। সারাদিন শেষে হাপিয়ে উঠি বাংলায় কথা বলার জন্যে। বাংলাদেশে যারা তারা বাংলাতে হরহামেশা কথা বলে তৃপ্তি পান অথচ আমাদের একটাই উপায় হয় ফোন করতে হবে নাহলে ফেবুতে চ্যাট করো। সময়ের একটা দীর্ঘ পার্থক্যের কারণে কল করাটা অনেক সময়ই অবিবেচকের মত হয়ে যায়।
জীবনে সেলিব্রিটি দেখে হিংসা লাগত যদি আমিও এমন হতাম। কোন একদিন আমার প্রয়াত বাবাকে মনে পড়তে লাগল। সে এক বিশ্রি কান্ড। মনেহয় আব্বা আমার চেয়ারের পাশেই বসে মিটমিট করে হাসছে; পাশে তাকালেই নেই। সেইদিনটা আব্বাকে স্মরণ করে কাটালাম। স্মৃতির তলা থেকে অতি সাধারণ আর সারাজীবন পোড় খাওয়া পিতার সাথে আমার খানিকটা সময়ের সম্পর্ককে মনে আনতে চাইলাম। চোখের পানির আজকাল কোন দাম নাই। সেদিনই একটা লেখা লিখেছিলাম। গতবারে নববর্ষে সেই লেখাটাই দিয়ে দিলাম বর্ষবরণ অনুষ্ঠানে। পুরস্কারের নাম ঘোষনায় আমার নাম আসতেই অবাক হয়ে গেলাম। লালচে-নীল আলো... কয়েকশ মানুষের করতালি; নিজেকে কয়েক মুহুর্তের জন্যে সেলিব্রিটি মনেহলো। সেই পুরস্কারটা দামে মুল্যায়ণ করা যায়না। আমি আবারও এসে কাঁদলাম।
জীবন প্রণালীতে খুব বেশি ভ্যারিয়েশন নেই। প্রতিদিন সকালে উঠেই মন খারাপ থাকবেই। বিশাল জানালা দিয়ে বাইরে তাকালে ঠিক ঐপাশেই আম্মার জানালা দেখা যায়না। সেই জানালা যেটা দিয়ে তাকালেই দেখা আম্মা তার ছোট ছেলের জন্যে দুঃশ্চিন্তা নিয়ে তাকিয়ে আছেন; অপেক্ষা করছেন কখন আমি দরজা খুলবো। সাধারণ শেকলটা ঘটাং করে নীচে পড়লেই আম্মার হাসিমুখ দেখা যেত। আমাদের মধ্যে বিশ্রি ধরণের ভাল একটা সম্পর্ক ছিলো। আম্মার রুটি আর আলু ভাজি ছাড়া কিছুই ভাল লাগত না আর আমার হাতের চা ভাল লাগত মায়ের কাছে। আমরা দু’জনে নাস্তা করে চুক চুক চা খেতাম। অতি সাধারণ অথচ কি অসাধারণ একটা জীবন।
গতদিন তিনদন আগের কথা। খুব মন খারাপ লাগছে। কেন যে এটা হচ্ছে জানিনা। এপার্ট্মেন্টে কেউই নেই। কারও সাথে যে কথা বলব সেই উপায়ও নেই। অবস্থা যখন চুড়ান্ত খারাপ ঠিক তখন ইনা আর ক্যারোলিন আসলো। ওদের তীব্র চিৎকারে আমি যেন আরও একা হয়ে গেলাম। মনে হচ্ছিলো ছুটে বাড়ি চলে যাই। একবার দরজা খুলে ওদের দিকে তাকিয়ে থাকলাম। আবার দরজা বন্ধ করে ফিরে আসলাম। আবার দরজা খুলে কিচেনে যেয়ে দেখি ওরা পরম আয়েশে সিগারেট টানছে। ওরা নিরাবেগী মানূষ। শুধু এতটুকুই বোঝাতে পারলাম যে আমি ভাল নেই। ছুট দিলাম মিঠুনের রুমে। আমি বরাবরই মিঠুনের আনেক্সেপেক্টেড গেষ্ট। একরাত থাকার কথা বলে তিনদিন থেকে আসলাম। এটাহলো সেলফ ট্রীট্মেন্ট। বাঁচতে হলে জানতে হবে।
কান্নার কোন ঠিক ঠিকানা নেই। কোন স্থান কাল পাত্রও নেই। গান ছেড়ে কাঁদো, শুয়ে কাঁদো, বসে কাঁদো যেভাবে হোক কাঁদো। ইদানিং একটা নতুন ষ্টাইন আবিস্কার করেছি যার নাম দিয়েছি সিনেম্যাটিক কান্না। সিনেমার নায়ক-নায়িকাদের মত বাথরুমের শাওয়ার ছেড়ে কান্না। জীবনের আবেগ অনুভুতি সব গরম পানির সাথে মিলেমিশে একাকার। মাঝেমাঝে ভাবতে ভালই লাগে; আমার চোখের পানি রি-সাইকেল্ড হয়ে হয়ত কোন এক দারুণ সুন্দরী রমনীর হাতে ধরা গ্লাসের মধ্যে। দারূন কামার্ত সেই ঠোটে রমনী পানি খাচ্ছে আর হি হি করে হেসেই খুন হচ্ছে। নিজের উপরে ঘেন্না হলে শাওয়ারের মধ্যে প্রশাবও করে দেয়া যায়। চোখের পানি, প্রশাবের পানি আর বিশুধ্য পানি মিলেমিশে একাকার। শিট!
জীবনটা তেলাপোকার জীবন চক্রের মতই। তেলাপোকা মাঝেমাঝে ঘরের দেয়ালে এসে বসে। তাকে ধরতে চাইলে আস্তে আস্তে করে উপরের দিকে উঠে যায়; হয়তবা মাঝেমাঝে উড়েও যায়। আমার জীবনটাও তেলাপোকার মতই। কেউ আমাকে আষ্টেপিষ্ঠে বাধতে চেয়েছে আর আমি সরেসরে গিয়েছি। এখন অনেকটা জীবন সায়াহ্নে পৌছে যাবার মত অবস্থা; কেউ ধরতে চাইলে আমি ধীরে ধীরে সরে যাচ্ছি। হুমায়ুন স্যারের ভাষায় গর্তজীবি হয়ে যাচ্ছি।