স্বপ্নের জিলা স্কুল । খাঁকি প্যান্টের উপর সাদা শার্ট । কুষ্টিয়াতে পারিবারিক মান সম্মানের ইস্যু ছিলো জিলা স্কুলের ছাত্র হওয়া । আপনার ছেলেতো ব্রিলিয়ান্ট ছাত্র! জিলা স্কুলে পড়ে। আমি কিভাবে এস এস সি পাশ করলাম জানিনা; তবে আমার প্রতিভার স্বাক্ষর বোধহয় এখনও জিলা স্কুলের বাথরুমে, দেয়ালে, বোর্ডে আছে । আছে কলকাকলী, জিলা স্কুল আর সার্কিট হাউজের সেই সরু দেয়ালেও । সেই দেয়াল শুভ্রে্র ভারি শরীর সইতে পারবেনা এখন; কিংবা আমিও দৌড়ে শুভ্রকে ধরতে পারবোনা । এবারে দেখলাম কলকাকলী স্কুলের ডাটবাট বেড়েছে । দেয়ালে নতুন চুনের প্রলেপ । দুই স্কুল কে আলাদা করে রাখা দেয়ালও বেরসিকের মত বেড়ে আকাশ ছুঁতে চাইছে । প্রায়ই কলকাকলীর সেই দেয়ালের পাশে টিফিন পিরিয়ডে চলে যেতাম । নীল ফ্রক আর সাদা জামা পরা দুই বেণীর মেয়েদের মধ্যে কাউকে কাউকে মনে মনে দুই একটা লভ লেটারও দিয়ে ফেলতাম। তখনতো ‘আই লাভ ইউ’ বাক্য জানাই মহাপাপ; মনেমনে উচ্চারন করলেও লজ্জায় লাল হয়ে যেতাম।
‘আলী ভাই, একটা চটপটি দাও’, টিফিন পিরিয়ডে বের হয়েই আমার অর্ডার। আলী ভাই খুক খুক করে কাশি দিলেন । এরপরে ডান হাত দিয়ে মুখ মুছে সেই হাতকে বেশি পরিস্কার করতে তার নিতম্ব ঢেকে রাখা তেল চিটচিটে কাপড়ে মুছে ফেললেন । আমাদের তখন এত জ্ঞান ছিলোনা। নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারের ছেলে হিসেবে আলী ভাইয়ের এক টাকার চটপটি ছিলো আমার স্বপ্নের খাদ্য । তো আলী ভাই সেই ডান হাত দিয়ে আলু মাখানো, বুটের ডাল আর তেতুলের পানির সাথে পরিমাণমত বিট লবণ দিয়ে চটপটি বানিয়ে দিলেন । আলী ভাইয়ের মত মানুষেরা পেটের দায়ে চটপটি বেচতেন তবুও আমাদের সাথে ব্যবসায়িক বুদ্ধি খুব খাটাতেন না। এক টাকা প্লেটের চটপটিতে আমরা তেতুলের পানি নিতাম তিনবার সাথে দুইবার কখনও আলী ভাইয়ের মন ভাল থাকলে তিনবার আলু সেদ্ধ্য ফ্রি । আলী ভাই সবাইকে তুই তুকারী করতেন । জীর্ণশীর্ণ শরীরে সারাদিন বিড়ি টানতেন । মাঝেমাঝে ছাত্রদের ঝাড়িও দিতেন। তবুও আলী ভাই আমাদের আপণজনই ছিলেন । হঠাৎ করেই আলী ভাই আসা বাদ দিয়ে দিলেন । আমাদের ছোট মাথায় তখন অত কিছু ছিলোনা; সামান্য চটপটি বেচা আলী ভাই শুনেছি হাঁপানিতে ভুগে একদিন মারা গেছেন ।
বিষু দাঁ ছিলেন অলসের অলস । সারাদিন নিজের দোকানের মুড়ি মাখানো নিজেকেই বেশি খেতে দেখতে পেতাম । সেই ভারি শরীর একদিন ভার সইতে না পারলে শেষমেষ ঠাই হলো তারই চারচাকার দোকানের উপরে । আলী ভাইয়ের ব্যবসায়ীক প্রতিদ্বন্দ্বী হলেও ঝগড়া ছিলোনা কোনদিন ।
গরমে আমাদের সবার ঠোট কখন সবুজ, কখনও গোলাপী হত । এর কারন তৃষ্ণা মেটানো ‘সেভেন আপ’ আইস্ক্রীম। কত যে খেয়েছি তার ইয়ত্তা নেই ।
আলী ভাই নেই, বিষু দাও কোথাও হারিয়ে গেছেন । এক সময়ের বিশাল জিলা স্কুলকে এখন রোগাগ্রস্ত লাগে। চারিপাশে নতুনের ছোঁয়া লাগলেও; আমার প্রিয় জিলা স্কুল এখনও তেমনি আছে। বড় হয়ে গেলে কেউই সব কিছুকে দোষের চোখে দেখেনা; তবুও লুকিয়ে সার্কিট হাউজের দেয়াল পার হয়ে জনি, আদনান, শুভ্র কিংবা নাদিমের সাথে সিগারেট টানতে ইচ্ছা করে। সেই আমগাছের নীচের দাঁড়িয়ে কল্পনায় ‘আমি শপথ করিতেছি যে’ বলে সমস্বরে কন্ঠ মেলাতে ইচ্ছে করে। লাল সবুজ পতাকার দিকে তাকিয়ে অবুঝের মত স্যালুট দিতে ইচ্ছে করে । এক লাইনে সবার সাথে ক্লাসে যেতে ইচ্ছে করে । প্রচন্ড রাগি রহমত উল্লাহ্ স্যারকে ঈমানে মুজমাল আর ঈমানে মুফাসসাল মিশিয়ে বলে সেই যাত্রায় পার পেয়ে যেতে ইচ্ছে করে । টিং টিং শব্দে হই হই করতে করতে ক্লাস থেকে বের হতে ইচ্ছে করে । টিফিনের এক্সট্রায় এক কে কায়দা করে দুই বানিয়ে টিফিন মেরে দিতে ইচ্ছে করে । লোটাস স্যার, জলিল স্যার, শাহ্জাহান কবির স্যার , আনিস স্যার, হুমায়ুন কবির স্যার, লিলি আপা, শ্রীনিবাস স্যার, ফজলুল করিম স্যার, ফরিদ স্যারদের সাথে চরম দুষ্টুমিতে মেতে উঠতে ইচ্ছে করে।
আর স্কুল ছুটি হলেই ডানপিটে ছেলেদের মত মারামারি করতে করতে বাড়ি ফিরতে ইচ্ছে করে। স্কুলের দেয়ালের পাশে রাস্তায় রাখা সারি সারি ট্রাকের ফাকে তাকালে বিশালদেহী সাব্বির কে স্কেল হাতে ছুটে আসতে দেখা যাবেনা কিংবা সুমনের পিঠে দুমদাম দুই চারটা কিল বসিয়েই বাসায় পালানো যাবেনা; তবুও স্মৃতির মণিকোঠায় প্রানের জিলা স্কুল এখনও জ্বলজ্বলে।
একটা সময় জিলা স্কুল ছিলো আমাদের জীবন চক্রের মত । মিশন স্কুল থেকে পাশ করে ছেলেরা জিলা স্কুল আর মেয়েরা গার্লস স্কুলে এস এস সি; তারপরে সরকারী কলেজ থেকে এইচ এস সি সম্পন্ন করতো। ছেলেমেয়েদের এই জীবন চক্রের একটা ধাপ সম্পন্ন করা ছিলো পারিবারিক ঐতিহ্যের মত। গার্লস স্কুল যখন এসেই গেল তখন সেই বিষয়ে কথা বলতেই হয় । নীল সাদা পোষাকে দুই বেণী করে যাওয়া আমাদের স্বপ্নের রাণীদের কথা না বললে জীবন চক্রের একটা ধাপকে অস্বীকার করা হবে। সেই স্মৃতির কথা হবে আগামি পর্বে; আপাততো সোহেলী, লাজিনা, অরণী, মহুয়া, ঝুমুর, সিমি, সুতপা, সোনিয়া, আর কালিপদ স্যারের অপুর্ব সুন্দরী মেয়ে মিশু কিংবা সিথিরা স্মৃতির অপর পৃষ্ঠাতেই থাক!
**চলবে**